skip to Main Content

ছুটির ঘণ্টা I বারবারদের বারান্দায়

মারাক্কেশের মরুভূমি, স্ট্রিট ফুড, কাফেলা- সবই উপভোগ্য। তবে বেশি আকর্ষণীয় পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা বারবারদের গ্রাম। ঘুরে এসে সেই বৃত্তান্ত শোনাচ্ছেন তানভীর অপু

ফিনল্যান্ডে সেই সময় তাপমাত্রা ছিল শূন্য ডিগ্রির কাছাকাছি; আর আমার গন্তব্যে রোদের রাজত্ব। তাপমাত্রার তারতম্য তাই কিছুটা ভাবিয়ে তুলেছিল বৈকি। অবশ্য অদেখাকে দেখার নেশায় সব বাধাই ম্লান হয়েছে। সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে গত বছরের নভেম্বর মাসের কনকনে ঠান্ডার এক সকালে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি থেকে উড়াল দিই সাহারা মরুভূমির দেশ মরক্কোর উদ্দেশে। এবারের যাত্রা মরক্কোর দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মারাক্কেশ।
আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে আফ্রিকার পশ্চিম সীমান্তের দেশ মরক্কো। উত্তর দিকে মাত্র কয়েক কিলোমিটারের জিব্রাল্টার প্রণালি পেরোলেই ইউরোপ। দেশটির রাজধানী রাবাত; কিন্তু সবচেয়ে বড় শহর আর বন্দরনগরী কাসাব্লাঙ্কা। যা হোক, মারাক্কেশ শহরকে অনেকে ‘রেড সিটি’ বা ‘রাঙা শহর’ বলে। হাজার বছরের পুরোনো এই শহর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বলা হয়, সত্যিকারের ঐতিহ্যবাহী মরক্কো দেখতে হলে মারাক্কেশে যেতেই হবে। শহরটির অবস্থান এটলাস পর্বতমালার কোল ঘেঁষে। এখানকার উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে জিমা আল-ফানা, সুক, শহরের দেয়াল এবং ফটক, বাদি প্যালেস, রাজকীয় প্যালেস, বাহিয়া প্যালেস, কুতুবিয়া মসজিদ, বেন ইউসুফ মসজিদ, মোয়াসিন মসজিদ, সাদিয়ান মাজার শরিফ, সাত পীরের মাজার শরিফ, মারাক্কেশ জাদুঘর, মিউজিয়াম অব ইসলামিক আর্ট, বারবারদের ঐতিহ্য ও জীবনধারা। প্রাচীন সময় থেকে এখানকার হস্তশিল্প বিশ্বখ্যাত। যারা বিভিন্ন সংস্কৃতির জীবনযাত্রার অভিজ্ঞতা নিতে পছন্দ করেন, এই শহর তাদের ভ্রমণের জন্য উপয্ক্তু।

এ ছাড়া মারাক্কেশে পর্যটকদের জন্য রয়েছে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও। দর্শনীয় সমুদ্রসৈকত, সুইমিংপুলসহ বহু বিলাসবহুল হোটেলও রয়েছে পর্যটকদের জন্য। তবে যারা এখানকার স্থানীয় খাবারের সঙ্গে পরিচিত হতে চান এবং কেনাকাটা করতে ভালোবাসেন, সম্ভবত তারাই এই গন্তব্যস্থলকে সবচেয়ে বেশি উপভোগ করবেন।
আমরা চার-পাঁচজনের একটি দল ২০১৭ সালের ১৮ নভেম্বর পৌঁছাই মারাক্কেশ। প্লেন থেকে নেমেই মনটা ভালো হয়ে যায়। মারাক্কেশের ঝলমলে রোদে যেন নিজেকে ফিরে পাই। প্রথম দিন আমরা শহর ঘুরে দেখি। হোটেলের আশপাশের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো আমাদের মুগ্ধ করে। সঙ্গে মারাক্কেশের স্ট্রিট ফুড। অনেকের কাছেই শুনেছি এখানকার রাস্তার খাবার খুবই সুস্বাদু। স্বাদ নিয়ে আমারও তাই মনে হলো। বিশেষ করে আনারের যে শরবত, তা দারুণ সুস্বাদু। যা হোক, পরের দিন আমরা রওনা দিই মূল গন্তব্যে। মারাক্কেশ শহর থেকে এক শ কিলোমিটারের বেশি দূরে অবস্থিত বারবারদের গ্রামে। আমাদের এবার মরক্কো আসার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বারবারদের যাপন, ঐতিহ্য, খাবার, পোশাক অর্থাৎ এককথায় তাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা। রাস্তায় নেমে শুরুতেই চোখে পড়ে জলপাই বাগান, মরুভূমির একাংশ আর ছোট-বড় বেশ কয়েকটি উটের কাফেলা। এই কাফেলা পর্যটক আর ট্যুরিস্ট গাইডদের। পর্যটকদের উটের পিঠে মরুভূমি দেখানো এই অঞ্চলের অনেকেরই পেশা। মরুভূমির মাঝে পিচঢালা রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলে। একসময় দূর থেকে পাহাড়ের গায়ে পাথরের তৈরি বারবারদের গ্রাম দেখতে পাই। আমরা পাহাড়ের যত কাছাকাছি যেতে থাকি, তত স্পষ্ট হতে থাকে বাড়িগুলো। ড্রাইভার বলেন, পাহাড়ে ওঠার আগে বারবারদের একটা হাট আছে। বহু বছরের পুরোনো। সপ্তাহে দুই দিন বসে- রবি ও মঙ্গলবার। আজ রবিবার। আপনাদের ভাগ্য ভালো, হাটের দিন চলে এসেছেন, দেখে যান আদি জনপদের হাট।
কথামতো হাজির হয়ে যাই হাটে। আমাদের গ্রামগঞ্জে যে হাট দেখে অভ্যস্ত, অনেকটা সে রকমই। চাল-ডাল, শাক-সবজি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল- সবই বেচাকেনা চলছে। সঙ্গে ফলমূলও। মজার বিষয় হচ্ছে, হাটে খরগোশ ও ময়ূর বিক্রি হচ্ছে। জানা গেল, বারবাররা প্রাচীন সময় থেকে ময়ূর ও খরগোশ রাখে তাদের খাদ্যতালিকায়। তারা পাহাড়ের ঢালে ও পাদদেশে বসবাস করে। প্রতিটি পাহাড়ে গড়ে ওঠে ছোট ছোট গ্রাম। সেই গ্রামগুলো থেকে পসরা নিয়ে গ্রামবাসী সপ্তাহে দুই দিন হাজির হয় এই হাটে। আর আসা-যাওয়া কিংবা পণ্য পরিবহনের জন্য তাদের প্রধান বাহন হচ্ছে গাধা।
হাট থেকে বেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে আমরা পৌঁছে যাই বারবারদের একটি গ্রামে। পাথরের তৈরি ঘরগুলো বাইরে থেকে দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের মাটির বাড়ির মতো। একটি বাড়িতে ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে তাদের চাষাবাদের নানা সরঞ্জাম। পাশাপাশি পুরোনো হারিকেনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। তবে ঘরের অভ্যন্তর কিছুটা আলাদা। তাদের আসবাব ভিন্ন। ঘরের সঙ্গেই রান্নাঘর, মাটির চুলা। আমরা যে বাড়িতে গিয়েছি, তারা আপ্যায়ন করে চা দিয়ে। তুলসীপাতার চা। এটা তাদের ঐতিহ্যবাহী পানীয়। বারবাররা কাঁসা, মাটি ও পিতলের তৈরি তৈজস বেশি ব্যবহার করে। আমাদের চা খেতে দেয়া হয় পিতলের কাপে। পরিবারটির সঙ্গে আমরা কিছু সময় গল্প করলাম।

বারবারদের জীবন ও ঐতিহ্য নিয়ে নানা কথা হয়। জানতে পারি একসময় তারা যাযাবর থাকলেও এখন মূলত কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের সব থেকে পুরোনো কৃষিপণ্য হচ্ছে বাদাম। মারাক্কেশের পাহাড়ের ঢালে বিশেষ একধরনের বাদামের চাষ হয়। এই বাদাম থেকে তারা তেল উৎপাদন করে। রান্না এবং ত্বকের যত্নে তা ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আগে তারা জাঁতায় পিষে তৈরি করতো; এখন সেখানে মেশিন চলে এসেছে। এখন পৃথিবীর নানা দেশেই তাদের বাদামজাত এই তেল রপ্তানি হচ্ছে। আমরা আরও কয়েকটি বারবার পরিবারের সঙ্গে কথা বললাম। এরপর পাহাড়ের ঝরনার ধারে একটি রেস্টুরেন্টে খেতে যাই। রেস্টুরেন্টটি অদ্ভুত সুন্দর। সেখানে কুসকুস নামে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারের স্বাদ নিই। কুসকুস মূলত ভাত ও সবজির তৈরি একটি খাবার। ঝরনার ধারে বসে খাবারের এমন আয়োজন এর আগে কখনো দেখিনি।

ছবি : লেখক

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top