skip to Main Content

ফিচার I লোকাল ইন্টারন্যাশনাল

লোকাল ইন্টারন্যাশনাল। বাংলাদেশ আর জার্মানির ফ্যাশন ডিজাইন শিক্ষার্থীদের জন্য সংস্কৃতি বিনিময় কর্মসূচি। অসাধারণ এই উদ্যোগের দুই নেপথ্য ব্যক্তিত্বের সঙ্গে কথা বলে আদ্যোপান্ত জানাচ্ছেন শেখ সাইফুর রহমান

জার্মানির দুই ফ্যাশন ডিজাইন শিক্ষকের মাথায় এসেছিল ভীষণই সময়োপযোগী একটি ভাবনা। তা-ও আবার কেবল জার্মানি ও বাংলাদেশকে ফ্যাশনের সেতু দিয়ে মিলিয়ে দেওয়ার প্রয়াসে। ভাবনার বীজ থেকেই অঙ্কুরোদ্গম। তা থেকেই আস্তে আস্তে বেড়ে উঠেছে গাছ। তাতে নিয়মিত বসছে নতুন পাখিরা। বাসা বাঁধছে অভিনব সৃজনের আনন্দে।
পুরো বিষয়টা আসলে সংস্কৃতি বিনিময়েরই অংশ। মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্যাশন আর টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিতে টেকসই আর ন্যায্যতার চর্চা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। জার্মানিতে প্রায় সর্বত্রই পাওয়া যায় বাংলাদেশে তৈরি পোশাক। অথচ দেশীয় ডিজাইনারদের ডিজাইন করা পোশাক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় অনুল্লেখ্য। আর বার্লিনের ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাছে এসবই শোনা কথা।
এসব বিবেচনায় গ্যেটে ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ এবং বার্লিনের দুটো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়াইজেনজে কুনথোকশুলা বার্লিন ও ইউনিভার্সিটাট ডার কুনস্টে বার্লিন ২০১৪ সালে দুই শহরের ডিজাইনের ছাত্রছাত্রীদের মেলবন্ধনের সুযোগ করে দেয়; যাতে করে দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবের আনন্দে তাদের ভবিষ্যৎ সৃজন সমৃদ্ধ হয়; এটা ব্যক্তিগত উৎকর্ষের দৃষ্টিকোণ থেকে যতটা, ততটাই যেন অবদান রাখতে পারে দেশের জন্য। দুই শহরের ফ্যাশন ডিজাইন স্টুডেন্টদেরই এই আন্তর্জাতিক ডিজাইন প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য মনোনীত করা হয়। তারা বিভিন্ন কর্মশালা আর লেকচার সেশনে অংশ নেয়। যেখানে মূল বিষয়বস্তুই ছিল টেকসই, ন্যায্যবাণিজ্য, টেকসই নকশা পদ্ধতি—এর মাধ্যমে তারা তাদের সৃজন মনোভাব, ধারণা, পণ্য এবং সংগ্রহ তৈরির প্রয়াস পাবে বিভিন্ন এনজিও ও সহায়ক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এবং সহায়তায়।
এই প্রক্রিয়া পেরিয়ে তাদের সৃষ্টিসম্ভার প্রদর্শিত হয় জার্মানি ও ঢাকায়। লোকাল ইন্টারন্যাশনাল ওয়ান-এর প্রদর্শনী হয় বার্লিনের ডিজাইনট্রান্সফার গ্যালারিতে। ২০১৫ সালের বার্লিন ফ্যাশন উইক চলাকালে। আর পরেরবার ২০১৬ সালের এপ্রিলের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ওয়াইজেনজে কুনথোকশুলা বার্লিনের কুনস্থালে।
এরপর অবশ্য ২০১৬ সালে হয়েছে তৃতীয় পর্ব। আর ২০১৭-১৮ সালে চতুর্থ।
এই প্রকল্পে নেতৃত্ব দেন ওয়াইজেনজে কুনথোকশুলা বার্লিনের ফ্যাশন ডিজাইনের প্রফেসর এবং গ্রিনল্যাব, ল্যাবরেটরি ফর সাসটেইনেবল ডিজাইন স্ট্র্যাটেজিস হেইকে সেলমার ও ইউনিভার্সিটাট ডার কুনস্টে বার্লিনের ফ্যাশন ডিজাইনের প্রফেসর এবং ডিরেক্টর অব দ্য ইনস্টিটিউট অব এক্সপেরিমেন্টাল গার্মেন্ট অ্যান্ড টেক্সটাইল ডিজাইন প্রফেসর ভ্যালেস্কা স্মিডৎ-থমসন। শুরুতেই বলেছিলাম এই উদ্যোগ বস্তুত এই দুই ফ্যাশন ডিজাইন অধ্যাপকের ব্রেনচাইল্ড।
প্রথম পর্বের প্রকল্পের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের নভেম্বরে জার্মানির ৬ জন ছাত্রছাত্রী ঢাকায় আসে আর ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে ফিরতি সফরে ৬ জন বাংলাদেশি জার্মানিতে যায়। পরে জুলাই মাসে বার্লিন ফ্যাশন উইক চলাকালে তাদের প্রদর্শনী হয়।
এরপর দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ২০১৫ সালের অক্টোবর মাসে। ২০১৬-এর এপ্রিল মাসে বার্লিনের হামবার্গার প্লাৎসে অনুষ্ঠিত হয় প্রদর্শনী। এই পর্বে প্রথমবারের মতো দুই দেশের দুই ফ্যাশন ইনস্টিটিউশন ওয়াইজেনজে কুনথোকশুলা বার্লিন ও বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন টেকনোলজির (বিইউএফটি) মধ্যে কোলাবোরেশন হয়। এই পর্বে ছিল ঢাকার ৮ এবং জার্মানির ১৪ জন শিক্ষার্থী।
চতুর্থ পর্বের অংশ হিসেবে এখনো বিনিময় সম্ভব হয়নি পৃষ্ঠপোষকের অভাব। তবে এপ্রিল মাসেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় প্রদর্শনী। ধানমন্ডির জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠে প্রদর্শনীর পাশাপাশি ছিল রাউন্ড টেবিল আলোচনা। এতে দুজন প্রফেসর ছাড়াও অংশ নেন লোকাল ইন্টারন্যাশনালের দুজন অ্যালামনাই বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন টেকনোলজির (বিইউএফটি) ইফতেখার রহমান ও শামশাদ হাসনাইন, লিভিং ব্লুর মিশাল আজিজ আহমাদ এবং অরণ্য ক্র্যাফটসের নওশিন খায়ের।
দুই প্রফেসরের কথা
প্রদর্শনী চলাকালে কথা হয় দুই ফ্যাশন ডিজাইন অধ্যাপক হেইকে এবং ভ্যালেস্কার সঙ্গে। উভয়েই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কেবল প্রতিষ্ঠিতই নন, বিশেষ সম্মানের অধিকারীও। এই প্রকল্পের ইনিশিয়েটরও তাঁরা। কিন্তু কেন? কোন ভাবনা থেকে?
উভয়েই জানালেন, ২০১৪ সালে গ্যেটে ইনস্টিটিউটের প্রধান তাঁদের অনুরোধ করেছিলেন বাংলাদেশের ছেলেমেয়ের জন্য শিক্ষণীয় কোনো কিছু তাঁরা করতে পারেন কি না। কিন্তু কী হতে পারে—সেটা ছিল প্রশ্ন।
—কারণ আমরা যেটা পারি তেমন কিছুই তো করতে হবে, বললেন প্রফেসর হেইকে।
তবে উভয়েই গ্যেটে ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের আমন্ত্রণে এসে এখানকার ফ্যাশন আর টেক্সটাইলে কী কাজ হচ্ছে সেটা দেখেন। প্রকৃতি আর নিসর্গ দেখেন, বিভিন্ন কারখানায় গিয়ে স্বচক্ষে সবকিছু অবলোকনের চেষ্টা করেন, এনজিওগুলোর সঙ্গে কথা বলেন। ১০ দিনের অবস্থানে বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি এবং এর কার্যক্রম ভালোভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ পান।
—এই অভিজ্ঞতা আমাদের দারুণ সহায়ক হয়। তবে আমরা মাথায় রাখি, দীর্ঘমেয়াদি কিছু একটা করার। বিশেষত এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম। কারণ, বাংলাদেশের ফ্যাশন ডিজাইনের শিক্ষার্থীরা পাস করার পর যেসব দেশের জন্য কাজ করে থাকে, সেখানে তারা কখনো যায়নি। অন্যদিকে, জার্মানির ফ্যাশন ডিজাইনাররা জানেন না, তাদের ডিজাইন নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা কারা। কীভাবে কাজ করে থাকেন। কোথায়ই-বা সেসব ডিজাইনের বাস্তবায়ন হয়ে থাকে।
—এ জন্যই আমাদের মনে হয়েছিল, একটা বিনিময় কর্মসূচি বস্তুত উভয় দেশের ফ্যাশন ডিজাইনের শিক্ষার্থীদের নতুন জগতের সন্ধান দেবে; তাদের দৃষ্টি প্রসারিত হবে। এই নতুন অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ভাবনার সংশ্লেষে তারা তাদের সৃষ্টিকে আরও নান্দনিক ও উপযোগী করে তুলতে সক্ষম হবে।
—এভাবেই দানা বাঁধে আমাদের ভাবনা। আর সেটাই আমরা জানাই গ্যেটে ইনস্টিটিউটকে। তারা আমাদের এই প্রকল্প প্রস্তাব অনুমাদন করে। শুরু হয় নতুন স্বপ্ন বোনার কাজ।
এভাবেই অবিরল উচ্ছ্বাসে শুরুর কথা শোনাচ্ছিলেন দুজনে। একজনের উত্তরে আরেকজন খেই ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। কথায় কথায় আরও জানালেন, এই পাঁচ বছরে লোকাল ইন্টারন্যাশনালে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা প্রায় প্রত্যেকেই নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিতে পেরেছেন। বড় ব্র্যান্ডে কাজ করছেন কেউ, কেউবা নিজের লাইন করেছেন। আবার কেউ পড়াচ্ছেন।
প্রফেসর ভ্যালেস্কা যোগ করলেন, ২০১৫ সালের জুলাইতে বার্লিন ফ্যাশন উইক চলাকালে একাধিক ডিজাইনারের ব্যাকস্টেজে গিয়ে কালেকশন দেখার সুযোগ বাংলাদেশে ফ্যাশন ডিজাইনারদের বিশেষভাবে প্রাণিত করেছে। তারা ডিজাইনারদের সঙ্গে মতবিনিময়ের সুযোগও পেয়েছেন। হাইকে বললেন, প্রতিটি সফরে আমি চেষ্টা করেছি এই ইন্ডাস্ট্রিতে আমার পরিচিতদের নিয়ে এসে কথা বলানোর। বিভিন্ন কোম্পানিতে অনেকে আছেন আমার পরিচিত; তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোম্পানিগুলো ঘুরে দেখার, মতবিনিময়ের সুযোগও করে দিয়েছি।

লেখকের সাঙ্গে আলাপচারিতায় প্রফেসর ভ্যালেস্কা (মাঝে) ও প্রফেসর হেইকে (ডানে)

প্রসঙ্গক্রমে প্রফেসর ভ্যালেস্কা যোগ করেন, বস্তুত বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা কোনো অংশেই জার্মানির ছেলেমেয়েদের থেকে আলাদা নয়। তাদের মেধা, জানার ইচ্ছা, সৃজনদক্ষতা—সবই মুগ্ধ করার মতো।
প্রফেসর হেইকে খেই ধরলেন, আসলে ফ্যাশন একটা জটিল বিষয়। ওয়েবসাইটের মাধ্যমে এর শিক্ষা হয় না। তাই তো ওদের নিয়ে আমার বিভিন্ন ফ্যাশন ম্যাগাজিনে গেছি। কথা বলার সুযোগ করে দিয়েছি। রাতের বার্লিন ঘুরে দেখিয়েছি।
তবে জার্মানি তো একটা বাজার। এমন অনেক বাজার আছে। তাই বাংলাদেশি ডিজাইন স্টুডেন্টদের জন্য খুবই ভালো হয় অন্য দেশ যেমন জাপান, আমেরিকা এমনকি ভারত ভ্রমণ করতে পারলে।
একইভাবে জার্মানিতে এখন আর টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি নেই। ফলে বাংলাদেশে এসে তারা স্টেট অব দ্য আর্ট, গ্রিন টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি থেকে মুগ্ধ হয়েছে। উৎপাদনের বিভিন্ন পর্ব চাক্ষুষ করেছে। এই অভিজ্ঞতা তাদের বিশেষ কাজে দিয়েছে।
ভ্যালেস্কা আবার বললেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন কোম্পানি ছোট আকারে ডিজাইন স্টুডিও করছে। সেখানে দায়িত্বে থাকছেন বিদেশিরা। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের নেওয়া উচিত। তাহলে তারা নিজেদের তৈরি করতে পারবে।
দুই অধ্যাপকের সঙ্গে কথা হয় জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠে, প্রদর্শকক্ষের পাশের কক্ষে বসে। জানাচ্ছিলেন এই প্রথম তারা প্রকল্প এগিয়ে নিতে পৃষ্ঠপোষকতার সংকটে পড়েছেন। ফলে নতুন পর্ব শুরু করা যাচ্ছে না। এবার বাংলাদেশে এসে অনেকের সঙ্গে মিটিং করছেন। জিআইজেডের কাছে আবেদনও করেছেন। সাক্ষাতের কথা ছিল বিজিএমইএর প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট রুবানা হকের সঙ্গেও।
(তাদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে, অসাধারণ এই প্রকল্পের বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে বিজিএমইএ। কারণ, বাংলাদেশের ফ্যাশন ডিজাইনের শিক্ষার্থীদের জন্য এটা অনন্য সুযোগ। মূলত বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ ভাবনা থেকেও এটা গুরুত্বপূর্ণ বৈকি।)

ছবি: ক্যানভাস ও গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top