skip to Main Content

আলাপগুচ্ছ I বিজয়লক্ষ্মী নারী

নারী আজ কেবল গৃহকর্মে আবদ্ধ নয়, নানা দিকে বিস্তৃত তার কাজের পরিধি। বহুমুখী তার কর্মকেন্দ্র। সবখানেই নারী আজ সফল। কিন্তু হঠাৎ করে কিংবা কোনো জাদুবলে এমনটি ঘটেনি। এটা হলো মেধা, শ্রম আর উদ্ভাবনী শক্তির মিলিত লড়াই। সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য। এই সংগ্রামে যারা সফলতার দীপ্তি ছড়িয়ে চলেছেন, তাদের মধ্য থেকে ১৪ জন বিশিষ্ট নারীকে সাক্ষাৎকারের জন্য নির্বাচন করেছে ক্যানভাস। সিটি আলোর সৌজন্যে তা পত্রস্থ হলো। আলাপে অংশ নিয়েছেন জাহিদুল হক পাভেল

গ্রন্থনা: সামিউর রহমান ও আহমাদ শামীম
ছবি: মাল্টিপ্লাই ডিজিটাল, সৈয়দ অয়ন ও সংগ্রহ

বিটপী দাশ চৌধুরী

কান্ট্রি হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, ব্র্যান্ড অ্যান্ড মার্কেটিং
স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক
ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
বিটপী দাশ চৌধুরী: আমরা দেখছি, বাংলাদেশের অনেক মহিলা এখন শিল্পকারখানায় কাজ করছেন। এটি সত্যিই খুব উৎসাহজনক। এর ফলে তারা স্বাবলম্বী হচ্ছেন এবং আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করছেন। এ কারণেই হয়তো দিন দিন তাদের মধ্যে ক্যারিয়ার গড়ার বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। অন্যদিকে, প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানের মালিক বৈচিত্র্যপূর্ণ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। ফলে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই নতুন নতুন কাজের সুযোগ তৈরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যে কারখানায় নারী-পুরুষ উভয়ই কাজ করে, সেখানে উৎপাদন এবং সামগ্রিক পরিচালনা ভালো হয়। এ জন্যই হয়তো অনেক কারখানার মালিককে দেখা যায়, নারীবান্ধব পরিবেশ তৈরিতে তারা বেশি গুরুত্ব আরোপ করছেন। যেমন কারখানার ভেতরেই ডে কেয়ার সেন্টার তৈরি, যাতায়াতের ব্যবস্থা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকেন। ফলে বলা যেতেই পারে, নারীর কর্মক্ষেত্র বেড়েছে, সুযোগ বেড়েছে।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
বিটপী দাশ চৌধুরী: পৃথিবীর সব অফিসেই একটি বিষয় হয়তো খুব সাধারণ, তা হচ্ছে পুরুষের চেয়ে নারী কর্মীর সংখ্যা নগণ্য। সিনিয়র পজিশনে তো আরও কম। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, নতুন কিংবা মাঝারি পর্যায়ে যেসব মেয়ে কাজ করে, তাদের পেশাগত অগ্রগতি অসম। যদিও তারা যথেষ্ট মেধাবী ও কর্মঠ। এ ধরনের বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। আমি মনে করি, একটি মেয়েকে তার যোগ্যতা ও মেধা প্রমাণের জন্য যে পরিমাণ শ্রম দিতে হয়, একটি ছেলেকে সে তুলনায় কিছুই করতে হয় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি মেয়ে আরও পিছিয়ে যায় তার ব্যক্তিগত কারণে। তাকে অফিসের কাজের বাইরেও সন্তান, পরিবার এবং সংসারের দেখাশোনা করতে হবে। আরও একটি বড় সমস্যা হচ্ছে যাতায়াত। আমাদের দেশে অনেকেই চাকরি ছেড়ে দেয় শুধু পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিরাপদ নয় বলে।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল?
বিটপী দাশ চৌধুরী: আগেই বলেছি, বাংলাদেশে কাজের ক্ষেত্রে মেয়েদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হয় অনেক বেশি। আমার পেশাজীবনের শুরুতে আমাকে এমনই একটি বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আমাকে প্রমোশন দেওয়া হয়নি। এমন ঘটনা এ দেশের প্রত্যেক মেয়ের সঙ্গে ঘটে, যারা আমার মতো চাকরিজীবী। এর একটি ইতিবাচক দিকও রয়েছে। বৈষমের শিকার হয়ে তারা নতুন পথ খুঁজে নেয়। যা তাদের সফলতার দিকে আরও একধাপ এগিয়ে দেয়। আমার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। অবশেষে আমি এমন একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, যেখানে কোড অব কন্ডাক্ট অনেক বেশি। মেয়েদের প্রতি আমার পরামর্শ হচ্ছে, মাথানত করে সহ্য করে যাওয়ার কিছু নেই। প্রতিবাদ করতে হবে। মনোবল দৃঢ় রাখতে হবে।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী?
বিটপী দাশ চৌধুরী: আমার অনুপ্রেরণা অনেকেই। তবে আমার প্রাইমারি স্কুলের প্রিন্সিপালের কথা আমি বিশেষভাবে বলতে চাই। যিনি আমার স্ক্র্যাপবুকের ওপর লিখে দিয়েছিলেন, ‘By thine own self be true; then only you can be true to others’। আমি বিশ্বাস করি, আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমি নিজেই। প্রতিদিন কাজের মাধ্যমে আমি নিজেকেই অতিক্রম করতে চাই।
ক্যানভাস: নারীর কর্মসংস্থান বা ক্ষমতায়নে কোন বিষয়গুলোর সংযোজন বা বিয়োজন জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
বিটপী দাশ চৌধুরী: সবক্ষেত্রে সমতা নিয়ে আসতে হবে। নারীদের জন্য উচ্চতর শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। উদ্যোক্তা তৈরিতে উৎসাহ দিতে হবে। কেননা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে এটি জরুরি। মানসিকতার পরিবর্তন আনতে হবে।
ক্যানভাস: কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে নারীদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
বিটপী দাশ চৌধুরী: নিজের কাজ সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে। শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগে সেই প্রতিষ্ঠান এবং তাদের কর্মকা- সম্পর্কে জানতে হবে। পেশাদারত্ব অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে। নিজেকে সময় উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে।

ফারজানা চৌধুরী

ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
গ্রিন ডেল্টা ইনস্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড

ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
ফারজানা চৌধুরী: সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে কর্মক্ষেত্রে নারীর সম্পৃক্ততা বেড়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে এখনো নারীরা অনেকাংশে পিছিয়ে। কারণ, মহিলারা লিডারশিপ পজিশনে অনেক কম আসছেন। আপনারা দেখেন, আমাদের রেমিট্যান্সের যে টাকাটা আসছে, এটা ওয়ার্কাররা পাঠান। এখন মহিলা ওয়ার্কারদের দেশের বাইরে পাঠানো হচ্ছে। কিন্তু সেখানে অনেকগুলো ইস্যু রয়ে গেছে। নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, কিন্তু হেলথ অ্যান্ড সিকিউরিটিজ ইস্যু, ওয়েলবিয়িং রয়ে গেছে। বিভিন্ন ফেজে মেয়েদের যে ট্রান্সফরমেশন হয়, যেমন বিয়ে, তারপর যখন সে মা হচ্ছে, তখন কিন্তু সে বায়োলজিক্যাল একটা ট্রান্সফরমেশনের মধ্য দিয়ে যায়। সেই সময় তার অনেক ধরনের সাপোর্ট দরকার। তাই মনে হয়, সেসব জায়গায় ক্ষমতায়ন বলতে গেলে তাদের জন্য সেখানে কাজের পরিবেশ, প্রোপার ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে আমাদের।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
ফারজানা চৌধুরী: নারীর সফলতায় বাধা তৈরি করে এমন অনেক ইস্যু আমাদের চারপাশেই রয়েছে। যেগুলোর উৎপত্তি পরিবার, সমাজ, নিজের গন্ডি এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায়। নারীর ক্ষমতায়ন না হবার আরেকটি কারণ হলো আমাদের মাইন্ড সেট। তারপরও বলব, অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেকটাই এগিয়েছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী এবং আমি বলতে চাই, তিনি বিশ্বের অন্যতম সফল নেতা। এটাও আমাদের জন্য একটি বড় অর্জন। অনেক মহিলা লিডারশিপ পজিশনে গিয়েছেন, তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। কেন? পারিবারিক কারণে, কিছু আছে সোশ্যাল প্রেশার। কিছু আছে এডুকেশন, বাচ্চাদের জন্য সেক্রিফাইজ। এর জন্য বলব, আমাদের মানসিকতাই দায়ী।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল?
ফারজানা চৌধুরী: ছোটবেলা থেকেই চ্যালেঞ্জ নিতে খুব পছন্দ করি। চ্যালেঞ্জ এবং ক্রিটিসিজম না নিলে আমি আমার সক্ষমতাকে এতটা প্রকাশ করতে পারতাম না। আমার কাজের সমালোচনা হলেই আরও ভালো কাজ করতে পারি। ছোটবেলায় আমার বিজনেসে আসার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। অভিনেত্রী হতে চেয়েছিলাম। থিয়েটারে কাজ করাটা আমাকে অনেক অনুপ্রাণিত করত। স্কুলে, কলেজে আমি গান গেয়েছি, আবৃত্তি করেছি, অভিনয় করেছি। তারপর আমার বাবা যিনি আমলা ছিলেন, পরে বিজনেসে এলেন। তখন আমার মনে হলো, যেহেতু সৃজনশীল সেহেতু আমাকে দেশের মানুষের জন্য কিছু করতে হবে, আর তা করতে হলে আমাকে বিজনেসে আসতে হবে। শিক্ষকতা করেছি, এনজিওতে কাজ করেছি, তখন আমার মনে হলো, যদি ব্যক্তিগতভাবে কিছু করতে পারি, তাহলে তাদের জীবিকার সংস্থান করতে পারব। যদি উদ্যোগ নিতে পারি, তাহলে তা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে আমার পরিবার কখনো মেয়ে বলে আলাদা করে দেখেনি, আমার শিক্ষা বা সুযোগ ভাইয়ের চেয়ে কম হতে পারে, এটা তারা কখনো ভাবেননি। আমি যখন পড়ালেখায় ভালো করছিলাম, তখন আমাকে বলা হয়েছে আমার যা ইচ্ছা তা করতে পারি, তাতে আমি পজিটিভ এনার্জি পেয়েছি। মা-বাবার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি। তাই আমার মা-বাবা আমার আদর্শ, তারা নৈতিক মূল্যবোধগুলো শিখিয়েছেন। সহজে পেয়ে গেলে সেই জিনিসটি দীর্ঘস্থায়ী হয় না, কিন্তু কষ্ট করে কিছু পেলে তা হয়। আমি যেহেতু সৃজনশীল মানুষ, তাই আমি মানুষের জন্য কিছু করতে চেয়েছি, যাতে মানুষ উপকৃত হয়। আমি ব্যাংকে অনেক বছর কাজ করেছি। এসএমই ব্যাংকিংয়ে আমিই পাইওনিয়ার। সেখানে প্রথম মহিলা উদ্যোক্তা, প্রথম প্রোডাক্ট আমার করা। আমি গর্ব বোধ করি যে ব্র্যাক ব্যাংকে কাজ করেছি। এরপর চলে আসি ইনস্যুরেন্সে। আমি অনুভব করি যে এখানেও মহিলাদের জন্য কিছু করতে হবে। সাউথ এশিয়ায় আমরাই প্রথম উইম্যান কমপ্রিহেন্সিভ ইনস্যুরেন্স প্যাকেজ নিয়ে এসেছি। অনেক বাধা এসেছে, কিন্তু ধৈর্যহারা হইনি। আমার পেশাগত সেই জার্নিটা খুব সুন্দর ছিল না। কিন্তু এখানে অনেক কিছু শিখতে পেরেছি। নারী হিসেবে নিজের দক্ষতাকে অনেকবার প্রমাণ করতে হয়েছে। এই ইন্ডাস্ট্রি আমাকে রিজেক্ট করেছিল। বলেছিল, আমি ব্যাংকার, ইনস্যুরেন্সে কী করব। তাই এই সেক্টরের ওপর আমাকে একটি উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করতে হয়েছে।
ক্যানভাস: নবীনদের উদ্দেশে কিছু বলুন।
ফারজানা চৌধুরী: তাদের জন্য আমার সাজেশন হলো, প্লিজ বি ফোকাসড। বর্তমান সময়ের ইন্টারনেটের কল্যাণে নবীনদের কাছে অনেক তথ্য সহজলভ্য বলে তারা খুব অস্থির। নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়নে ভালো কিছু অর্জন করতে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হবে। অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। অন্যের কথা শোনার অভ্যাস করতে হবে। টিমওয়ার্কের প্রয়োজন; কারণ, কোনো কাজ একা আমরা করতে পারব না। কখনোই বলতে পারব না যে আমরা যা কিছু অর্জন করেছি, সব একাই করেছি, এই অর্জনের পেছনে অবশ্যই পুরুষদের অবদান আছে এবং উল্টো ক্ষেত্রেও ঠিক তা-ই হয়। বর্তমান সময়ে কাজের সুযোগ, পরিধি অনেক বেড়েছে। তাই সব তথ্য থেকে কিছু শিখতে হবে এবং ধৈর্য ধরে নিজের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে হবে। এই প্রজন্মের মধ্যে যে ইতিবাচক এনার্জি আছে, তা তাদের বড় কিছু অর্জনে, নিজেদের স্বপ্নগুলো পূরণে সহায়তা করবে। নবীনদের নতুন নতুন আইডিয়া এবং প্রবীণদের অভিজ্ঞতা মিলিয়ে আমরা সফলতার পথে এগিয়ে যেতে চাই।

ফারজানা খান

মহাব্যবস্থাপক, মহিলা উদ্যোক্তা উন্নয়ন, গুচ্ছ উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও প্রযুক্তি উন্নয়ন শাখা, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প ফাউন্ডেশন

ক্যানভাস: নারীর ক্ষমতায়ন কিংবা নারীর কর্মসংস্থান—যেটাই বলি বা যেভাবেই বলি, ২০২০ সালে এসে সার্বিক পরিস্থিতি কী দেখছেন?
ফারজানা খান: ২০২০ সালে আমরা অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছি। মেয়েদের কাজের পরিবেশ অনেক ভালো, একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একটা সময় কোনো মেয়ের রোজ কাজে বের হওয়াকে প্রতিবেশীরা ভালো চোখে দেখত না। এখন এটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। সবাই জানে, নারী হোক বা পুরুষ—সবাই কাজের সন্ধানে সকালবেলা বের হবে। এবং নারীরা রাত করে ফিরলেও ব্যাপারটা আলাদা চোখে দেখা হয় না। সার্বিকভাবে আমি এটাই মনে করছি। ঢাকার বাইরে প্রত্যন্ত এলাকাতে গিয়েও দেখেছি, এখন আর সামাজিক ও পারিবারিকভাবে তেমন একটা বাধা আসে না। তবে কিছু ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।
ক্যানভাস: এখনো কি মেয়েরা কাজের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জায়গায় বাধার সম্মুখীন হচ্ছে?
ফারজানা খান: অবশ্যই হচ্ছে। ব্যাপারটা পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে, এক জায়গায় বলছি এগিয়ে যাচ্ছে, আবার বলছি বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। একটু ভেঙে বলি, সামগ্রিকভাবে চিন্তা করলে বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাবে, মেয়েরা অনেক এগিয়ে আসছে। এবং বর্তমান সরকার, আমাদের প্রধানমন্ত্রী তিনি মেয়েদের এগিয়ে নেওয়ার জন্য যে শুধু মুখে উৎসাহ দিচ্ছেন তা নয়, বিভিন্নভাবে মেয়েদের সহায়ক পরিবেশ তৈরির ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করছেন। সব জায়গায় ডে-কেয়ার সেন্টার করা হচ্ছে, চলাচলের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, বিভিন্ন আইন রয়েছে, হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে যে প্রতিটি সংস্থায় যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল থাকতে হবে। বাধা আসছে বলব মানসিকতায়। যতক্ষণ পর্যন্ত মানসিকতায় পরিবর্তন না আসবে, ততক্ষণ পর্যন্ত নারীর জন্য পরিবেশটা অনুকূল হবে না।
ক্যানভাস: আপনার পেশাগত জীবনের শুরুর দিকের কথাগুলো জানতে চাই, তখন তো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ অনেক কম ছিল?
ফারজানা খান: আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিংয়ে মাস্টার্স করেছি। আমাদের সময়ে মেয়ে শিক্ষার্থী কম ছিল, তবে আমরা যারা ছিলাম তারা কিন্তু কখনোই এটা চিন্তা করতাম না যে কিছু করব না। যেকোনো মেয়ের এগিয়ে আসার পেছনে তার পরিবারের বিশাল একটা ভূমিকা থাকে। আমার মা-বাবাকে দেখেছি, ছোটবেলা থেকেই মেয়ে হিসেবে আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি বা মেয়েলি কাজ—একেবারেই এসব বিভাজন করতেন না। ওই সময় থেকে বলা হতো পড়াশোনা করার কথা। বাবা বলতেন, ‘তুমি পড়ছ না। বড় হয়ে কী খাবে? কী করবে?’ তবে আমি এখনো দেখি, শিক্ষিত অনেক পরিবারে মেয়ে-ছেলের ব্যাপক একটা ভেদাভেদ থাকে। বাবা বড় বোনকে বলতেন ডক্টরেট করতে, এখন এই সময়ের অনেক মানুষের মধ্যেও সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা দেখি না। পড়ালেখা শেষে আমি মাইডাস ফাইন্যান্সিংয়ে যোগ দিই। ওখানে আমি এসএমই লোন দেখতাম, নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে কাজ করতাম। এখনো এসএমই ফাউন্ডেশনে নারী উদ্যোক্তাসহ অনেককে নিয়ে কাজ করছি।
ক্যানভাস: পেশাগত জীবনে আসতে বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে কি কোনো বাধার সম্মুখীন হয়েছেন?
ফারজানা খান: আমি এ ক্ষেত্রে সৌভাগ্যবান। আমাকে খুব একটা বাধার মুখে পড়তে হয়নি। অন্য অনেকেরই অনেক বাধা পেরিয়ে কাজ করতে হয়। মা-বাবার দিক থেকে তো কোনো বাধাই পাইনি, আমার স্বামী, শাশুড়ি সবাই অনেক সহযোগিতার মনোভাব দেখিয়েছেন। পরিবারের মানুষেরা যদি হাসিমুখে নারীর কাজটা মেনে না নেয়, তাহলে কিন্তু তারা এগিয়ে যেতে পারবে না।
ক্যানভাস: তাহলে কি পরিবারই আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা?
ফারজানা খান: হ্যাঁ, তা তো অবশ্যই। তবে এটা যে খুব ভিন্ন কিছু, সেটা কখনো মনে হয়নি। সব সময়ই মেয়ে হিসেবে আলাদা চোখে নয়, বরং মানুষ হিসেবে দেখা হতো। আমাদেরকে পড়ালেখা করে একটা পর্যায়ে যেতে হবে, এটা মা-বাবা সব সময়ই চাইতেন। আমার বাবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন, বেড়ে উঠেছেন গ্রামে। তারপরও মানসিকতায় তিনি অন্য রকম ছিলেন, দৃষ্টিভঙ্গিটা উদার ছিল। এটা খুব জরুরি।
ক্যানভাস: নারীর ক্ষমতায়ন বা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য আপনার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া দরকার কোন বিষয়টিতে?
ফারজানা খান: একজন নারী ঘরটা গুছিয়েই তো অফিসে আসে। এসে সারাক্ষণ চিন্তা করতে থাকে বাচ্চাটা কী খাবে, বাসায় গিয়ে এটা রান্না করতে হবে, একটু দেরি হয়ে গেলে…সমগ্র পদ্ধতিটাই নারীকেন্দ্রিক। তাই অযথা নারীকে চাপ প্রয়োগ করা যাবে না। নারীদের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব রাখতে হবে। বাসার লোকজনকেও তার প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। চলাফেরার সমস্যা, ইভ টিজিং—এসব সমস্যা দূর করতে হবে। পুরুষেরা যারা রাস্তায় বের হয়, সবাই তো আর খারাপ নয়। এ জন্য কাউন্সেলিং দরকার। খারাপ মানুষের সংখ্যা কম, তাদের সংশোধনের পথ দেখাতে হবে।
ক্যানভাস: তরুণদের জন্য কী পরামর্শ আপনার?
ফারজানা খান: ছেলে-মেয়ে সবাইকে বলি, হতাশ হওয়া যাবে না। সব সময় মনোযোগ দিয়ে কাজ করলে সাফল্য আসবে। একবারে সব পাওয়া থেকে, বেশি পাওয়া থেকে উচ্ছৃঙ্খলতা তৈরি হয়। অনেকে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের মধ্যে অস্থিরতা নেই। আবার দেখা যায় তরুণ, ভালো পরিবারের সন্তান, কোনো অভাব নেই, তারা কেউ কেউ আত্মহত্যাও করছে। এ জন্য মা-বাবা সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে। হতাশা দূর করতে হবে আর অল্পে খুশি হতে হবে।

গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী

চেয়ারম্যান, অ্যাডকম
ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী: এ বিষয়ে আমি অবশ্যই ইতিবাচকভাবে ভাবতে চাই। আমরা অনেক দূর এসেছি। কিন্তু আমাদের আরও বহুদূর যেতে হবে। প্রাপ্তির তো কোনো শেষ নেই যে আমি এ পর্যন্ত গেলাম তারপর শেষ হয়ে গেল, এটা এমন নয়। মেয়েরা অনেক কিছু করেছে। সর্বোচ্চ পাহাড়ও জয় করছে, ক্রিকেটে ভালো করছে, কী করছে না! সব দিক থেকেই মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় এবং সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী বলে মনে করেন?
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী : বাধা কিন্তু সবার জন্য আছে। মেয়েদের জন্য যে বাধা আছে শুধু তা নয়, ছেলেদের জন্যও আছে। কিন্তু মেয়েদের জন্য হয়তো একটু বেশি। সেই বাধাগুলো পেরোতে গেলে আমাদের অনেক কিছু দরকার। প্রথমেই চাই সমাজের একটা মানসিক পরিবর্তন। তা না এলে হবে না। আমরা প্রথমেই চিন্তা করি, মেয়ে মানুষ পারবে নাকি পারবে না। এই কথাটা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি আমি। এখনো এই চিন্তাটা মানুষের মাথা থেকে যায়নি। এটা পরিবর্তন করতে হবে। তারপরে অনেক ক্ষেত্রে নারীদের প্রশিক্ষণের অভাব আছে। নানা ক্ষেত্রে ট্রেনিংয়ের দরকার আছে। শিক্ষাগত পরিবর্তনও দরকার বিভিন্ন পর্যায়ে। এগুলো হয়নি এখনো। একেবারে যে হয়নি তা কিন্তু নয়, তবে আরও দরকার আছে বলে মনে করি।
ক্যানভাস: পরিবর্তনের কথা যে বলছেন, এই পরিবর্তনটা আসলে কোথা থেকে শুরু করতে হবে?
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী: পরিবর্তনের শুরুটা করতে হবে ঘর থেকে। এ কথা আমি সব সময় বলে এসেছি, সমাজের পরিবর্তনের শুরুটা হতে হয় নিজ ঘর থেকে, ফ্রম দ্য হোম। মা হিসেবে আমার দায়িত্ব আমি ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে কোনো তফাত করব না। যেভাবে মেয়েকে মানুষ করব, সেভাবে ছেলেকেও মানুষ করব। আমি আমার ছেলেকে শেখাব যে, মেয়েকে সম্মান করতে হবে। একটা মেয়েকে কীভাবে তার মর্যাদা দিতে হয়, সেটা আমি শেখাব। পাশাপাশি মেয়েকেও শেখাতে হবে ছেলেকে সম্মান করার বিষয়টি। কিন্তু আমরা এগুলো শেখাই না, অনেক সময় ভুলে যাই। মা হিসেবে এটা আমার দায়িত্ব। সব ঘরে ঘরে যদি আমরা এই দায়িত্ব নিই, তাহলেই কিন্তু সমাজে পরিবর্তন আসবে। আমি বলছি না পরিবর্তন হচ্ছে না, হচ্ছে। তবে আরও বেশি মাত্রায় দরকার।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল?
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী: নিজেকে আমি ভাগ্যবানই বলব। আমি ছিলাম পরিবারের বড় মেয়ে। আমরা ছয় ভাই-বোন। সবার মধ্যে আমিই সবার বড়। আমি মেয়ে ছিলাম কিন্তু পরিবার থেকে আমাকে মেয়ে হিসেবে মানুষ করা হয়নি। অ্যাজ আ হিউম্যান বিইং আমাকে দেখা হয়েছে কিংবা বলা চলে আমাকে ছেলে হিসেবেই মানুষ করা হয়েছে। আমাকে ভাই-বোনেরা সবাই দাদা বলে ডাকে। আমি কখনো আস্তে কথা বলতে বা আস্তে হাঁটতে শিখি নাই। আব্বা-আম্মা দুজনই বলতেন, মিন মিন করে কথা বলবে না, জোরে কথা বলো। আমি বলব, টিপিক্যাল মেয়েলি জিনিসগুলো আমি শিখি নাই বা শেখানো হয় নাই। বাবার বাড়িতে আদর পেয়ে বড় হয়েছি, আমার লেখাপড়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর আমি ভাগ্যবান যে, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসেও আমার শ্বশুর-শাশুড়ি আমাকে অনেক উৎসাহ জুগিয়েছেন। আমি কাজ শুরু করেছি কিন্তু বিয়ের আগে থেকেই। আমি ক্যারিয়ার শুরু করেছি একজন সাংবাদিক হিসেবে। বেতন পেতাম না কিন্তু লিখতাম। আমি যখন কেজি টুতে পড়ি তখন থেকে আমি লেখা শুরু করি। আমার লেখালেখির বিষয়ে উৎসাহ দিতেন আব্বা-আম্মা। তো সাংবাদিকতা শুরুর সময়ে আমি বৈষম্যের শিকার হয়েছিলাম। আমি নিউজ ডেস্কে কাজ করতে চাইলাম, আমি মেয়ে বলে সেখানে কাজ করতে দেওয়া হলো না। বলা হলো, তুমি ম্যাগাজিন সেকশনে কাজ করো। তারপর অনার্স-মাস্টার্স পাস করলাম, বিয়ে হলো, চলে গেলাম করাচিতে। সেখানে গিয়ে একটা মেয়েদের ম্যাগাজিনে কাজ শুরু করলাম। সেটা কিন্তু মেয়েদের টিপিক্যাল ম্যাগাজিনের মতো ছিল না। সেখানে কাজ করতে গিয়ে আমি আমাদের এখানকার পুরুষ আর ওইখানকার মানে তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের পুরুষদের মধ্যে অনেক তফাত দেখতে পেলাম। আমাদের এখানকার পুরুষেরা মেয়েদের সম্মান করে, উৎসাহ দেয় কাজে, খারাপও যে নেই তা কিন্তু নয়, কিন্তু পাকিস্তানি পুরুষদের তুলনায় আমি বলব বেশ ভালো। বলা যায়, নারীর প্রতি বৈষম্য, অসম্মান ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে আমার গভীরভাবে পরিচয় ঘটে করাচিতে থাকা এবং কাজ করার সুবাদে। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগেই দেশে ফিরে এসেছিলাম। তারপর আমি বিজ্ঞাপনী সংস্থায় কাজ শুরু করি। এখানেও আমাকে অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বিজ্ঞাপনী সংস্থার প্রথম কথা ছিল, মেয়েমানুষের এখানে কী! তখন তো এখনকার মতো এত প্রোডাক্টও ছিল না। রাত জেগে প্রেসে কাজ করতে হতো, মেলায় অংশ নিতে হতো। এই কাজগুলোর অভিজ্ঞতা যেমন কষ্টের ছিল আবার তেমনই মজার ছিল।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী ছিল?
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী: আমার কাজের ক্ষেত্রে অনেকেই অনুপ্রেরণা দিয়েছে। শুরুর সময় অনেক ক্লায়েন্ট ছিল, তারা সাহস দেয়নি ঠিক, তবে এক অর্থে তারা আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। তখন তো অ্যাড ফার্মগুলোর মালিকানা ছিল বিদেশিদের। আমাকে রাগ ধরিয়ে দিত তারা, বলত, তুমি এটা পারবে না। আমাকে আমার সন্তানের কথা বলত, শ্বশুরবাড়ির কথা বলত, কিন্তু আমি তখন চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিতাম কাজগুলো এবং কাজ শেষ করে তাদের প্রমাণ দিতাম, আমি পেরেছি। তারা আবার খোঁজ রাখত আমার। কাজ শেষ করে আসার পর পরের দিন কেক কেটে সেলিব্রেট করত, বলত, খুব ভালো হয়েছে, এভাবে কাজ করে যাও। এগুলো তখন অনুপ্রেরণা জোগাত, ভালো লাগত। সফল হতে হলে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ নিতে হয়। আমি চ্যালেঞ্জ নিতাম এবং সেগুলো পুরোপুরিভাবে শেষ করতাম। কারণ, আমার তো হারাবার কিছু নেই।
ক্যানভাস: তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলুন…
গীতিআরা সাফিয়া চৌধুরী: যে কথা বলতে চাই, আপনাকে আসলে সৎ হতে হবে। আপনার কাজ এবং প্রতিষ্ঠানকে সন্তানের মতো ভালোবাসতে হবে, তাহলেই সাফল্য আসবে।

কানিজ আলমাস খান

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পারসোনা হেয়ার অ্যান্ড বিউটি লিমিটেড

ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্র এবং এর পরিবেশ কেমন দেখছেন?
কানিজ আলমাস খান: নারীর কর্মস্থানের পরিধি যেমন বেড়েছে, তেমনই কর্মজীবী নারীর সংখ্যাও অনেক বেড়েছে। এর একটি বড় কারণ হচ্ছে শিক্ষা ক্ষেত্রে মেয়েরা এখন অনেক অগ্রসর। প্রতিবছরই নারী গ্র্যাজুয়েটের সংখ্যা বাড়ছে। তারা বিভিন্ন পেশায় যোগ দিচ্ছেন। বর্তমানে মেয়েদের মধ্যে আমি একটি বিষয় লক্ষ করলাম, তারা উদ্যোক্তা হতে চান। স্বাবলম্বী হবেন, পাশাপাশি অন্যকে স্বাবলম্বী হতে সাহায্য করবেন। কিছুদিন আগে নারী উদ্যোক্তাদের নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে যশোরে গিয়েছিলাম। সেখানে দেখলাম, নারীরা গাড়ির যন্ত্রাংশ-টায়ার ইত্যাদি বিক্রি করছেন। আবার একজনকে দেখলাম, যিনি কেঁচো সার নিয়ে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। এসব দিক দিয়ে বলা যায়, নারীর কর্মক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত হয়েছে। তবে ক্ষমতায়ন বা এমপাওয়ারমেন্টে তারা কতটা এগিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে এখনো ভাবতে হবে।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
কানিজ আলমাস খান: এই সময়ে এসে মেয়েদের সাফল্য অর্জনের জায়গাটা যেমন হওয়া উচিত ছিল, তেমন হয়নি। কেননা কাজের পরিবেশ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীবান্ধব নয়। এখনো নারীরা কাজে আসতে যেমন ভয় পান, তেমনি রাস্তায় বেরোতে নিরাপদ বোধ করেন না। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ থাকবে আরও উন্মুক্ত, যেকোনো সময় তারা চলাফেরা করতে পারবে। যেকোনো ধরনের কাজের ক্ষেত্রে প্রথম বাধা হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। এখানেই তারা অনেকটা পিছিয়ে পড়ছেন। আবার আমাদের সমাজ নারীদের প্রতি খুব বেশি উদার নয়। অনেকে মনে করে, তাদের কাজ করার প্রয়োজন কী। অনেক পরিবার এখনো ভাবে, ঘরের মেয়েরা কেন কাজ করবে। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রয়োজন নীতিমালার। আরও বেশি নারীবান্ধব হওয়া প্রয়োজন।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে? সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল?
কানিজ আলমাস খান: আমি শুরু করেছি তিরিশ বছর আগে। তখন মোটামুটি একাই কাজ করেছি। কিন্তু আমার পরিবার বরাবরই আমাকে সাহায্য করেছে। যদিও আশপাশের থেকে অনেক ধরনের বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। যেমন আমার ব্যবসা বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত জায়গা পাইনি, দক্ষ কর্মীর অভাব ছিল, ভালো মানের পণ্য পাওয়া যেত না। সবকিছু নিজেকেই করে নিতে হয়েছে। কিন্তু এখন এই প্রতিবন্ধকতাগুলো নেই বললেই চলে।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী ছিল?
কানিজ আলমাস খান: আমার অনুপ্রেরণা নারীরাই। তাদের কাজ করতে দেখলে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হই। আর আমার পরিবার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। যে জন্য আমি খুব স্বাধীনভাবে কাজ করতে পেরেছি।
ক্যানভাস: কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে নবীনদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
কানিজ আলমাস খান: এখন যারা কাজে আসছেন, তাদের জন্য প্রথমেই বলতে চাই, নিজের কাজকে ভালোবাসতে হবে। যেসব বিষয়ে কাজ করার ইচ্ছা সেগুলো সম্পর্কে জানতে হবে, পড়তে হবে এবং দক্ষতা অর্জন করতে হবে। কাজটি করার জন্য নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে। নিজের কাজটা যদি ভালোবেসে করা যায়, তাহলে সাফল্য আসবেই বলে আমি বিশ্বাস করি। পাশাপাশি পরিশ্রম আর পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই।

রাশেদা কে. চৌধূরী

নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান
ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা

ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
রাশেদা কে চৌধূরী: সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশে নারীদের কর্মক্ষেত্র বর্তমানে সর্বত্র বিরাজিত। সবখানে এখন নারীর পদচারণ। সেখান থেকে কর্মক্ষেত্রের বিষয়টি নানাভাবে দেখা যায়। আমি তিনটি আঙ্গিক থেকে বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে চাই। প্রথমত, নারীরা স্বীকৃতি পায় না যেসব কাজ, যেমন—ঘরের কাজ সংসারের কাজ। এসব কাজকে আমাদের দেশে অর্থনীতির মানদ-ে দেখা হয় না। আরেকটা আঙ্গিক হলো অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মক্ষেত্র বা ইনফরমাল সেক্টর, ঘরের বাইরের কাজ যেমন কৃষিকাজ। এসব ইনফরমাল সেক্টর হিসেবে পরিচিত। গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ধান বপন থেকে শুরু করে চাল হওয়া পর্যন্ত ২১টি কাজের মধ্যে ১৭টি সম্পাদন করে নারী। অথচ এটার কোনো স্বীকৃতি সেভাবে নেই। তারপরে তৃতীয় যেটি ফরমাল সেক্টর। বিভিন্ন উৎপাদনমুখী কাজে নারী অংশ নিচ্ছে। আমাদের দেশের পোশাকশিল্পে ৮০ শতাংশের বেশি নারী কর্মী। এ ছাড়া ওষুধশিল্প, চা-শিল্প, পাদুকাশিল্পসহ সব ধরনের কাজে নারীরা আছে। সুতরাং বলা যায় উৎপাদনমুখী সব কাজেই রয়েছে নারীরা উপস্থিতি। কিন্তু সেটা সর্বত্র আয়মূলক কাজ হিসেবে স্বীকৃত নয়। পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে, ৩৯ শতাংশ নারী আয়মূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত। ২০২০ সালে এসে দেখি, নারীর কর্মক্ষেত্র অবারিত কিন্তু তা সর্বত্র স্বীকৃত নয়। কিন্তু নারী তার কাজ করে চলেছে।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
রাশেদা কে চৌধূরী: স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের যে উত্তরণ, সেখান দেখি, নারীরা নানাভাবে নানান পেশায় চলে এসেছে। এসব ক্ষেত্রে সরকারের কিছু ইতিবাচক নীতিমালা কাজ করে। বিভিন্ন পেশায় কোটার ব্যবস্থা আছে। শিক্ষকতা পেশায় যেমন ৭ শতাংশ নারী কোটা আছে। যেসব ক্ষেত্রকে সাধারণত সমানভাবে বিবেচনা করা হয় না, পরিবারের মধ্যেও কিছু বিধিনিষেধ আছে। আরও একটি বিষয় হলো, আমাদের সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো বদলায়নি। অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের মনমানসিকতা পুরুষতান্ত্রিক। আমি বলব না এর জন্য পুরুষেরা দায়ী। মনমানসিকতাই দায়ী। অনেক ঘরের বয়স্ক নারীরা এখনো বলে থাকেন, ঘরের মেয়ে বা বউ লেখাপড়া শিখেছে তো কী হয়েছে, বাইরে কাজ করতে হবে কেন, ঘরের কাজ করলেই হলো। নারীদের কর্মক্ষেত্রে আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো তার নিরাপত্তাহীনতা। আমাদের দুর্ভাগ্য, সমাজে এখন এ ধরনের ব্যাধি ছড়িয়ে গেছে। নারী রাস্তাঘাটে নিরাপদ নয়, বাসে বা গণপরিবহনে নয়, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরও নিরাপদ নয়। এটা রাষ্ট্রেরও যেমন দায়িত্ব, তেমন সমাজেরও।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে? সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল এবং কাজের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী?
রাশেদা কে চৌধূরী: আমার জন্য পথটা সহজ ছিল না। কিন্তু খুব কঠিনও ছিল না। কারণ, আমি এমন এক পরিবারের সন্তান, যেখানে লেখাপড়াকে খুব গুরুত্ব দেওয়া হতো। আমার নানার বাবাও গ্র্যাজুয়েট ছিলেন। চতুর্থ প্রজন্মের গ্র্যাজুয়েট আমি। দ্বিতীয় হলো আমার মা, চার সন্তানের জননী হয়ে তিনি ডাক্তারি পড়েছিলেন। রোকেয়া সাখাওয়াতের সরাসরি ছাত্রী ছিলেন। ফলে ওই অনুপ্রেরণা তো ঘর থেকেই এসেছে। আমাদের মা-বাবা আমাদের প্রচ- উৎসাহ দিতেন। আমরা ভাই-বোনেরা কখনোই বৈষম্যের শিকার হইনি। আমরা তো মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। ক্লাস বয়কট করেছি, নানাভাবে সহায়তা করেছি মুক্তিযোদ্ধাদের। ৭ মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এই মুজিব বর্ষে বঙ্গবন্ধুর কথা খুব বেশি মনে পড়ে, কীভাবে আমাদের প্রজন্ম তার কথায় অনুপ্রাণিত, উজ্জীবিত হয়েছিলাম। আমার বিয়ে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যলয়ে, পড়ার আগেই। তো বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ফেলার পর চুয়াত্তর সালের দিকে ভাবলাম, এবার একটু ঘুরে বেড়াই, কিছুদিন কাজকর্ম না করি, ঘরে একটু বসে থাকি। আমার বাবা অধ্যাপনা করতেন, তিনি ছিলেন ইংরেজির অধ্যাপক। আমার এই অবস্থা দেখে বাবা বললেন, পাস করে বসে আছ, আসলে তুমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা সিট নষ্ট করেছ। কোনো ছেলে হলে এভাবে বসে থাকত না। তার এই কথা আমার খুব আত্মসম্মানে লাগল। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটে একটা রিসার্চ ফাউন্ডেশন ছিল ‘ফ্র্যপ’ নাম, সেখানে যোগ দিলাম অধ্যাপক শামসুল হকের সহকারী হিসেবে। সেখানে গবেষণা করতে এসেছিলেন একজন নারী গবেষক, তিনি আমেরিকার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করতেন। নাম সুলতানা ক্রিপেন্ডফ। তার সঙ্গে সহকারী গবেষক হিসেবে অধ্যাপক শামসুল হক আমাকে যুক্ত করে দিলেন। বললেন, তুমি ওর সঙ্গে কাজ করো। তুমি তো নতুন, মাত্র পাস করে বেরিয়েছ। তো ওই ভদ্রমহিলা এসেছেন বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তকে নারী চিত্রায়ণ কেমন হয়েছে সেটা দেখতে, পর্যালোচনা করতে। তার সঙ্গে থেকে ওই যে আমি শিখলাম—একটা হলো শিক্ষা, আরেকটি হলো নারী। এই দুটিই আমার জন্য একটা স্ফুলিঙ্গের মতো ছিল। তখন আমি দেখেছি নারী-পুরুষের বৈষম্যটা আসলে তৈরি হয় পাঠ্যপুস্তক থেকে। তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে স্কেচ করা আছে, বাবা ক্ষেত থেকে এসেছেন, খেতে বসেছেন, ভাই স্কুল থেকে এসেছে, খেতে বসেছে। মা খাবার বেড়ে দিচ্ছে আর বোন পাখা দিয়ে বাতাস করছে। সেখানেই নারীর ভূমিকা অর্থাৎ বৈষম্যটা আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে গেল। তখন থেকেই আসলে যাত্রা শুরু।
ক্যানভাস: কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে নারীদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
রাশেদা কে চৌধূরী: নতুন প্রজন্মের কাছে অনেক প্রত্যাশা। স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় আমরা যারা সেই সংগ্রামে শরিক ছিলাম। আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি, নানা কারণে তা ভেঙে গেছে। উগ্র মৌলবাদ, তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার ও আমাদের মূল্যবোধের অবক্ষয়—এসব ক্ষেত্রে নারীরাই বেশি শিকার হচ্ছেন। তবে আমি হতাশ হব না এই কারণে যে, এই নতুন প্রজন্মই কিন্তু নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নেমেছে, নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে। কাজেই নতুন প্রজন্মকে যদি সঠিক পথ দেখানো যায়, তবে এরাই একদিন বদলে দেবে। তাদের প্রতি একটাই কথা থাকবে—আমরা মানুষ, আমাদের জীবন একটাই। অপরাধ, মাদক ইত্যাদিতে জড়িয়ে গেলে জীবনটা কিন্তু আর সহজ হবে না। সন্ত্রাসীর মৃত্যু হয় সন্ত্রাসীর হাতে। যেকোনো ধরনের সন্ত্রাসে জড়িয়ে গেলে স্বাভাবিক মৃত্যু হয় না। আমরা উন্নয়নের পথে অনেকখানি এগিয়েছি। সেই উন্নয়ন যেন সমতাভিত্তিক ও ন্যায্য হয়, সেটা দেখার দায়িত্ব কিন্তু নতুন প্রজন্মেরও।

রোকিয়া আফজাল রহমান

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও ব্যবসায়ী
ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
রোকিয়া আফজাল রহমান: নারীরা কাজ করে যাচ্ছে সভ্যতার শুরু থেকেই। কিন্তু তার কাজের পুরোপুরি স্বীকৃতি তখনো ছিল না, আজও নেই। তবে নারীর কর্মক্ষেত্র বেড়েছে বহুগুণ। তারা এখন উপার্জন করছে, সংসার চালাচ্ছে। আমি আমার দেখার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, পুরুষেরা শুধু বাইরে কাজ করে, কিন্তু নারী কাজ করে ঘরে-বাইরে উভয় জায়গায়। সেই হিসেবে বলা যায়, একজন পুরুষের থেকে নারীর অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা বেশি।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
রোকিয়া আফজাল রহমান: ইচ্ছা ও একাগ্রতা থাকলে কোনো বাধাই আর বাধা থাকে না। তারপরও বলব, নারীর বাধা সে নিজেই। কারণ, তাকে মানসিকভাবে বেঁধে রাখা হয়েছে। হাজার বছর ধরে তাকে শেখানো হয়েছে, তুমি পারবে না। বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। কৃষিকাজের কথাই যদি বলি, এর পুরো প্রক্রিয়ার ৭০-৮০ শতাংশ কাজই করে নারীরা। তারপরও বলা হয়, তোমরা পারবে না। তারাও মেনে নেয়, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে না। বলে না আমি পারব। সফলতা অর্জনের জন্য নারী-পুরুষ উভয়েরই সাহস এবং সাহায্য প্রয়োজন। তা হতে পারে আর্থিক, মানসিক এবং শারীরিক। আগে ঘর চালানো, সন্তান লালনপালন শুধু নারীরাই করত কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। পুরুষেরাও ঘরের কাজে সাহায্য করে। যাতে নারীরা বাইরের কাজটি সঠিকভাবে করতে পারে। আরও একটি বড় বাধা হচ্ছে, এখনো বড় বড় দায়িত্বে নারী কর্মীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। কখনো কখনো তাদের বড় দায়িত্ব দেওয়া হয় না, আবার কখনো নিজেরাই নিতে চায় না। এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
বর্তমানে নারীদের এগিয়ে চলায় আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হলো নিরাপত্তাহীনতা। দুর্ভাগ্য, আমাদের সমাজে এখনো এটি বিদ্যমান। রাস্তাঘাট, বাসে, গণ-পরিবহনে, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভেতরও নিরাপদ নয়। নুসরাতের ঘটনা আমাদের তা মনে করিয়ে দেয়। কাজেই নারীর ক্ষেত্রে শুধু নীতিমালা করে, আদালতের নির্দেশনা দিয়ে সুরক্ষা বেষ্টনী তৈরি করা যাবে না। এটা রাষ্ট্রের যেমন দায়িত্ব, তেমনই সমাজেরও। এখনো একজন নারী লাঞ্ছনা বা হেনস্তার শিকার হলে, আইনের আশ্রয় নিতে দ্বিধাবোধ করেন। তার পরিবার এমনকি সমাজও দ্বিধাবোধ করে। আইনের আশ্রয় নিলে না জানি কী হবে। এটাও একটা প্রতিবন্ধকতা। তারপরও কিছু চাঞ্চল্যকর ঘটনা উঠে আসে গণমাধ্যমে। নারী নির্যাতনের শিকার হয়ে যখন বিচার চাইতে যায়, তখন সে পরিবারের কাছে বাধার সম্মুখীন হয়। সেই বাধা পেরিয়ে যখন সে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে যায়, তখন তাকে নিরুৎসাহিত করা হয়, তেমনভাবে ঘটনাটি উপস্থাপন করা হয় না। ফলে যারা অপরাধ করে, তারা পার পেয়ে যায়। অপরাধ করে এই পার পেয়ে যাওয়ার সংস্কৃতিও কিন্তু নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করি। আরও আছে, যেমন বৈশ্বিক প্রতিবন্ধকতা। আমাদের দেশে যেমন আছে, উন্নয়নশীল বিশ্বে আরও বেশি দেখা যায় এটা। পৃথিবীটা তো এখন ডিজিটাল হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। সেখানে নারীর সুযোগও বেশি থাকে না অনেক সময়। নারী প্রতিযোগিতার মধ্যে টিকে থাকতে পারে না। সে ক্ষেত্রে নারী একটু পিছিয়ে যায়।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে? সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল এবং কাজের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী?
রোকিয়া আফজাল রহমান: আমার কর্মজীবন শুরু হয় ব্যাংকে। সে সময় ব্যাংকের কাজ ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। কারণ, তখন কম্পিউটার ছিল না। সব কাজ হাতে করতে হতো। পরিশ্রম আর সহকর্মীদের সাহায্যে ভালোই এগিয়েছিলাম। আমার স্বামীও অনেক সাহায্য করেছেন। এমনকি আমার কাজের সুবিধার্থে নিজের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এটি আমার জন্য একটি বড় পাওয়া। আমার স্বামী আমাকে সব ধরনের সাহায্য করেছেন। সাহস জুগিয়েছেন। তার অনুপ্রেরণায় ব্যবসা শুরু করি। কোল্ডস্টোরেজের। সে জন্য জমি কেনা থেকে শুরু করে ব্যাংকের সব কাজ নিজেই করেছি। ছোট ছোট কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়া সবাই সব সময় সাহায্য করেছে।
ক্যানভাস: নারীর ক্ষমতায়ন বা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের জন্য আপনার দৃষ্টিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া জরুরি কোন বিষয়টিতে?
রোকিয়া আফজাল রহমান: এখানে একটি বড় সমস্যা অসময়ে ঝরে পড়া। অর্থাৎ আমাদের নারীরা হঠাৎ কর্মক্ষেত্র থেকে বিদায় নেয়। এর কারণ যখন মা হচ্ছে তখন ঝরে যাচ্ছে, যখন বিয়ে হচ্ছে তখন ঝরে যাচ্ছে, হাজব্যান্ড বিদেশে যাচ্ছে, তখন সেখানে হাজব্যান্ডের সঙ্গে চলে যাচ্ছে। এই ঝরে পড়া মহিলারা কিন্তু আর উপরে উঠতে পারছে না। যখন এক ধাপ আগাচ্ছে, তখন দশ ধাপ পেছাচ্ছে। সে জন্যই সম্ভবত লিডারশিপ পজিশনে বা যেখানে আমরা তাদেরকে দেখতে চাই, সেখানে আমরা মহিলাদের দেখতে পাচ্ছি না। সে ক্ষেত্রে আমাদেরকে একটা প্রোপার ইকোসিস্টেম তৈরি করতে হবে, মাইন্ড সেট পরিবর্তন করতে হবে। এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রয়োজন। আমরা মুখে মুখে বলে কিন্তু ইকুয়াল অপরচুনিটি আনতে পারব না, জোর করে কারও মাইন্ড সেট পরিবর্তন করতে পারব না। এটা করতে হলে নিজেকে এগিয়ে যেতে হবে। সুতরাং এমনভাবে পলিসিটা করতে হবে যে পুরুষেরাও সেখানে ডিপ্রাইভড হবে না, মহিলারাও সেখানে ডিপ্রাইভড হবে না।
ক্যানভাস: তরুণদের জন্য পরামর্শ…
রোকিয়া আফজাল রহমান: বর্তমানের তরুণেরা অনেক ভাগ্যবান। তাদের হাতের কাছেই সব আছে। এগুলোর সঠিক ব্যবহার করতে হবে। পৃথিবীর যেখান থেকেই পড়ালেখা করুক না কেন, কাজ করতে হবে দেশে। দেশকে ভালোবাসতে হবে। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

রুবি গজনবী

নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ

ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
রুবি গজনবী: আমি মনে করি, বাংলাদেশে গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রির অগ্রগতির সঙ্গে নারীর কর্মক্ষেত্র প্রসারের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এর আগে প্রান্তিক মেয়েদের একটাই লক্ষ্য ছিল, কবে বিয়ে করে সংসারী হবো। এখন এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। স্বাবলম্বী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার জীবনযাত্রার মানে পরিবর্তন এসেছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বেড়েছে। আরও একটি জায়গায় মেয়েরা এগিয়েছে, শিক্ষা ক্ষেত্রে। বাবা-মায়েরা এখন মেয়েদেরও ভালোভাবে পড়ালেখা করাতে আগ্রহী। এর ফলে প্রথমত বাল্যবিবাহ কমে আসছে। এবং মেয়েরা লেখাপড়া করার সুবাদে নিজের ভালোটা বুঝতে শিখেছে। কাজ করার আগ্রহ এবং ইচ্ছা তৈরি হয়েছে। ভালোভাবে বাঁচার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্রের পরিধি বড় হয়েছে। আমাদের সময় দেখেছি নারীর কাজের ক্ষেত্র কম ছিল। হাতে গোনা কয়েকটি পেশা ছাড়া তাদের কাজের আর কোনো জায়গা ছিল না। আমাদের সমাজ পুরোপুরি না হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
রুবি গজনবী: আমাদের দেশে নারীর জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে নির্যাতন। প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি নানাভাবে তারা এর শিকার। শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নির্যাতনও রয়েছে। এর ফলে তাদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার হয়েছে। এই ভয় আরও বেড়ে যাচ্ছে যখন দেখছে, তারা সঠিক বিচার পাচ্ছে না। এভাবে তো খুব বেশি দূর এগোনো যায় না। অনেকে বলবে, এখন নারী নির্যাতন আইন রয়েছে। কিন্তু এই আইন কতটা কার্যকর, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। কেননা এতে কোনোভাবেই নির্যাতনের হার কমানো যাচ্ছে না। সামাজিক বৈষম্যগুলো দূর করতে রাষ্ট্র খুব বেশি কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এ ছাড়া অর্থনৈতিক দিক থেকেও নারীদের জন্য রয়েছে বেশ কিছু বাধা। যেমন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে জামানত দিয়ে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হয়। আমাদের দেশে মেয়েদের সম্পদের পরিমাণ এমনিতেই কম। সুতরাং তার পক্ষে মোটা অঙ্কের জামানত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সে ঋণ নিতে পারছে না, তার ব্যবসা বা উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়ছে। শুধু পারিবারিক দিক থেকে আগের তুলনায় সাহায্য-সহযোগিতা বেড়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বেড়েছে। কিন্তু ঘর থেকে বাইরে এলেই বাধা। তারপরও বলব, মেয়েরা কিন্তু থেমে নেই। তারা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে, পরিশ্রম করছে, নিজের পথ নিজেই তৈরি করছে।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে? সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল? এ ব্যাপারে আপনার অনুপ্রেরণা কী?
রুবি গজনবী: এককথায় বলতে গেলে পারিবারিকভাবে আমাকে কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়নি। বাবা-মা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব সবাই উৎসাহ দিয়েছেন। কিছুটা প্রতিবন্ধকতা এসেছে যখন ব্যবসাটা বড় করতে গিয়েছি। আগেই বলেছি, নারী উদ্যোক্তাদের ঋণ পাওয়া কখনোই খুব একটা সহজ ছিল না। আমিও পাইনি। কিন্তু থেমে থাকিনি। নিজের স্বপ্নপূরণে এগিয়ে গিয়েছি। যখন দেখি একজন কারুশিল্পী নিজের ইচ্ছেমতো কাজের সুযোগ পাচ্ছে, খুবই আনন্দ পাই। অনুপ্রাণিত হই। থেমে থাকলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে।
ক্যানভাস: কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে নারীদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
রুবি গজনবী: স্বপ্ন দেখা থামানো যাবে না। স্বপ্ন দেখতে হবে আর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কেউ না কেউ তো হাত বাড়িয়ে দেবেই। না বাড়ালেও সমস্যা নেই। পরিশ্রম থাকলে সফলতা আসবেই। আমি দেখেছি তরুণেরা অনেক বেশি সম্ভাবনাময়। যেমন কিছুদিন আগে বাংলাদেশে কারুশিল্প পরিষদ একটি জামদানি উৎসব করেছে। সেখানে বহু পুরোনো নকশার শাড়ি নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই কাজগুলো কিন্তু করেছে তরুণ কারুশিল্পীরাই। তাদের কাজ দেখে আমরা মুগ্ধ। সুতরাং সব ক্ষেত্রেই তাদের দক্ষতা রয়েছে, প্রতিভা রয়েছে। শুধু একটু সুযোগ করে দিতে হবে। যাতে তারা তাদের পথটুকু পাড়ি দিতে পারে।

রূপালী চৌধুরী

ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেড
ক্যানভাস: নারীর ক্ষমতায়ন হচ্ছে, মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে আপনার কাছে সত্যিকারের ছবিটা কী মনে হয়?
রূপালী চৌধুরী: অতীতের সঙ্গে তুলনা করলে তো বলতে হয় অনেক এগিয়েছে। মেয়েরা এগিয়েছে নিজেদের সাহসের কারণে। পরিবার ওদেরকে সাহস জুগিয়েছে, সে জন্য এগিয়েছে। সরকারি নিয়োগেও একটা অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। সর্বোপরি, মেয়েদের মধ্যেও একটা চেতনা সৃষ্টি হয়েছে যে তাদেরকেও অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন হতে হবে। বিভিন্ন প্রযুক্তির কারণে আমরা দেখতে পাচ্ছি, অন্যান্য দেশের মেয়েরা কীভাবে কাজ করে। সেটারও একটা প্রভাব আছে। তবে তৈরি পোশাকশিল্পে গ্রামের মেয়েদের নিয়ে এসে তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যেভাবে কর্মশক্তিতে রূপান্তর করা হয়েছে, আমার মনে হয় সেখান থেকেই শক্তিটা সবার মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছে যে ওরা যদি পারে, আমরা কেন পারব না!
ক্যানভাস: কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের এখনো কোন ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়?
রূপালী চৌধুরী: বাধা তো আছেই। করপোরেটে বা কারখানায়, যেটা আউটবাউন্ড জব—সব জায়গাতেই নিরাপত্তা একটা প্রধান ইস্যু। যে কাজে সন্ধ্যার পর থাকতে হবে, কারখানা অনেক দূরে, তাই অনেকটা পথ পাড়ি দিতে রাস্তায় সময় লাগবে অনেক; এ রকম পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠান ঝামেলাটা নিতে চায় না। মনে করে, এ জন্য আমাকে বাড়তি নিরাপত্তার দিকটা দেখতে হবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে আমরা যদি আরও বেশি করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি, তাহলে আমরা কর্মক্ষেত্রে আরও বেশি নারীদের অংশগ্রহণ দেখতে পাব। যেখানেই মেয়েদের নেওয়া হয়েছে, দেখা গেছে তারা কাজ ভালো করে। তারা মনোযোগী, তাদেরকে শিখিয়েও নেওয়া যায়। কোনো জায়গায় মেয়েরা ভয় পেয়ে পিছিয়ে আসছে, এমন রেকর্ড নেই।
ক্যানভাস: আপনি কি কখনো নিরাপত্তাসংক্রান্ত সমস্যায় পড়েছেন?
রূপালী চৌধুরী: চাকরির শুরুর দিনগুলোতে যখন গাড়ি ছিল না, রিকশায় যাতায়াত করতে হতো, সেসব দিনে সন্ধ্যার পর রিকশায় উঠতে ভয় লাগত। তখন একই দিকে যে সহকর্মী যাচ্ছেন তার সঙ্গে যেতাম। বেশি রাত হয়ে গেলে গাড়িতে ড্রপ নেওয়ার চেষ্টা করতাম, অফিসের গাড়ির সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করতাম। সন্ধ্যার পর সব সময়ই একটা ভয় কাজ করত। এ ছাড়া অফিসে অনেক সময়ই অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটতে পারে, যে শব্দটা আমরা এড়িয়ে যাই অর্থাৎ যৌন হয়রানি। এসব ক্ষেত্রে অফিসের মানবসম্পদ বিভাগে অভিযোগ জানানোর ব্যবস্থা আছে। নাম জানিয়ে বা গোপন রেখে অভিযোগ জানানো যায়। যাতায়াতের ব্যাপারটা আমি একটু কম জানি, তবে মেয়েদের আলাদা বাস দেওয়া যেতে পারে। মেট্রোরেল হচ্ছে, তাতে সবারই সুবিধা হবে। তবে একটা ব্যাপার আমি দেখি, অনেকে যাতায়াতের সময় নিরাপত্তার জন্য হিজাব পরে। একটা মেয়েকে কেন হিজাব পরতে হবে? ছেলেদের মনোভাব তারা বদল করবে না, তার জন্য আমাকে কেন দায়ভার নিতে হবে?
ক্যানভাস: আপনি যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন, তখন মেয়েদের কাজে যোগ দেওয়াটা সহজ ছিল না। আপনি পরিবার থেকে কতটা সহযোগিতা পেয়েছিলেন?
রূপালী চৌধুরী: আমার আসলে খুব একটা সমস্যা হয়নি, এটা নির্ভর করে মা-বাবার ওপরে। আমার বাবার কোনো বাধা ছিল না, ছেলে মেয়েতে কোনো তফাত নেই—এটা তিনি জোরালোভাবে বিশ্বাস করতেন। মা চাইতেন, লেখাপড়া শেষ করে বিয়ে থা করে নিই! বড় ভাই অনেক সাহস জুগিয়েছেন। তিনিই আমার অনুপ্রেরণা। এ রকম মানুষ সহজে চোখে পড়ে না।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর ক্ষমতায়ন বা কর্মসংস্থান—যেটাই বলি, নতুন করে কোন জিনিসটার বাস্তবায়ন খুব জরুরি?
রূপালী চৌধুরী: এখন মেয়েদেরকেই এটা অর্জন করতে হবে। আজকাল আমাদের সমাজে মেয়েদের লেখাপড়ায় খুব একটা বাধা নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় মেয়েদের পড়ালেখাকে প্রাধান্যই দেওয়া হয়। বিয়ের একটা ব্যাপার থাকে, সরাসরি বা প্রচ্ছন্নভাবে সেই চাপ তো থাকে। তবে মেয়েদেরকে আমি বলব যে তাদেরকে চিন্তা করতে হবে, আমি জীবনে কী করতে চাই। অর্থনৈতিকভাবে সক্ষমতা অর্জন করাটা হচ্ছে প্রথম। কারণ, আমি যদি তা হই, তাহলে শুধু সমান হওয়াও নয়, আমার একটা অধিকার জন্মায় মানুষ হিসেবে। মেয়েদেরকে বলতে হবে, আমি বিয়ে করি আর যা-ই করি, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব। আমি যেখানেই কাজ করি না কেন, আমার একটা নিজস্ব পরিচয় থাকতে হবে। সেটা নিজেকেই তৈরি করতে হবে।
ক্যানভাস: যারা আপনার পদাঙ্ক অনুসরণ করে এই পর্যায়ে আসতে চায়, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
রূপালী চৌধুরী: তারা ইন্টার্নশিপের কাজটা করতে পারে, বিভিন্ন জায়গায়। অনেকে রিটেইলে কাজ করে। তাতে একটা অভিজ্ঞতা হয়। অনেকে রিসার্চ ইনস্টিটিউটে কাজ করে। আবার কম্পিউটারেও দক্ষতা অর্জন করা, অফিসে যেসব অ্যাপ্লিকেশন সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়, সেসবে ভালো করে প্রশিক্ষণ নিলে বা দক্ষতা থাকলে ভালো। আমাদের মেয়েরা চাকরিটা শুরু করে ভালোভাবেই, কিন্তু বাচ্চা হওয়ার পর আবার ছেড়ে দেয়। ওই জায়গাটায় হাল ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আমি কম বয়সী মেয়েদের বলি, প্রয়োজনে তোমার বেতনের অর্ধেক তুমি সাহায্যকারী বা ডে-কেয়ার সেন্টারের পেছনে খরচ করো। যাতে করে দুজনেই বাচ্চাটাকে একসঙ্গে বড় করতে পারো। তবে ভালো মা হওয়াটাও অনেক কঠিন। কারও জীবনের লক্ষ্য যদি হয় ভালো মা হওয়া, অর্থনৈতিক কাজে জড়িত না থাকা, সেটাও খারাপ কিছু নয়।

সামিয়া রহমান

সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
হেড অব কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, নিউজ ২৪
ক্যানভাস: ২০২০ পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
সামিয়া রহমান: পরিবেশটা এখন অনেক বদলে গেছে। ১৯৯৯ সালে একুশে টেলিভিশনে যখন কাজ শুরু করি, তখন আমাদের চ্যানেলে সব মিলিয়ে মেয়েদের সংখ্যা ছিল তিন থেকে পাঁচজন। সেই সংখ্যাটা এখন অনেক বদলে গেছে, প্রচুর মেয়ে রিপোর্টার আসছে। তবে আমি মনে করি, নারীর ক্ষমতায়নটা তখন সম্ভব হবে যখন নারী পলিসি মেকিং পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবে। যতক্ষণ পর্যন্ত নিজের সিদ্ধান্ত নিজেরা নিতে পারব না, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা আমাদের ভাগ্য বদলাতে পারব না। আমি যখন সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন ছাত্রছাত্রীর অনুপাত প্রায় সমান ছিল। এখন ছাত্রীর সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। সেই মেয়েদের বেশির ভাগই সাংবাদিকতায় আগ্রহী নয়, কারণ ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নারী, স্পিকার নারী, তারপরও ২০ বছরে যতটা অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল ততটা হয়নি।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
সামিয়া রহমান: প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকে। বিয়ের পর অনেকে পরিবার থেকে বাধা না পেলেও জীবনসঙ্গীর কাছ থেকে সহযোগিতা পায় না। তাকে ঘর সামলাতে হয়, বাইরেরটাও সামলাতে হয়। দুটো সামলাতে গিয়ে আমাদের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। বিশেষ করে মাতৃত্ব-পূর্ব ও মাতৃত্ব-পরবর্তী সময়ে উপযুক্ত সমর্থনটাও কর্মক্ষেত্র থেকে সবাই পায় না। সরকারি জায়গাগুলোতে মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস হয়ে গেছে কিন্তু বেসরকারি পর্যায়ে এখনো ছুটিটা ১ মাস, ২ মাস থেকে সর্বোচ্চ ৩ মাস। এ ছাড়া এখন যেসব মেয়ে আসছে, তারা উপস্থাপনায় বেশি আগ্রহী। প্রতিবেদক হয়ে মাঠে-ঘাটে-বাইরে যাবার ঝুঁকি নিতে চায় না। তারপরও মেয়েরা আসছে, তবে আমাদের সমাজ ও পরিবার যদি মানসিকতা না বদলায়, তাহলে পরিবর্তন সম্ভব নয়। এখনো কর্মক্ষেত্রে একজন নারী যখন ভালো একটা পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছায়, তাহলে পুরুষ এমনকি নারী সহকর্মীরাও মনে করেন যে সেই নারীটি অবস্থানে পৌঁছেছেন চেহারা বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের জোরে। অনেক সময় কর্তৃপক্ষও শীর্ষ পদে নারীর উপর ভরসা করতে পারে না। তবে আমি দেখেছি, নারীরা প্রতিষ্ঠানে ‘কোয়ালিটি টাইম’ দেন।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল?
সামিয়া রহমান: গণমাধ্যমে সব সময়ই নারীদের কাজের পরিবেশ ভালো পেয়ে এসেছি। প্রতিবন্ধকতার বেশির ভাগই রাজনৈতিক। একটি চ্যানেলে আমাকে বলা হয়েছিল অসত্য খবর পড়তে। চ্যানেলের মালিকপক্ষ বলেছিলেন উপস্থাপক তোতাপাখির মতো, যা বলব তা-ই শোনাবে। আমি চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি। একটি চ্যানেলে আমাকে মাথায় ঘোমটা দিয়ে খবর পড়তে বলা হয়েছিল, তখন প্রতিবাদ করেছিলাম। আরেকটি চ্যানেলে অপ্রীতিকর অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম, যেটা সব মেয়েকেই পড়তে হয়। তখন চাকরি ছেড়ে দিয়েছি; কারণ, নোংরা মানসিকতার মানুষের সঙ্গে কাজ করা যায় না। আমি নিজের উপর বিশ্বাস রেখেছি। ভেবেছি আমি যদি দক্ষ হই, যোগ্য হই আমার কাজের অভাব হবে না।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী?
সামিয়া রহমান: আমি খুব মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছি। আমার বাবা রেডিওতে ডিরেক্টর ছিলেন, খুব সৎ মানুষ ছিলেন। আমরা চারটা বোন। তিনি সব সময় শিখিয়েছেন কোনো কিছুর জন্য কারও মুখাপেক্ষী না হতে। আমরা সবাই চেষ্টা করেছি নিজের পায়ে দাঁড়াতে।
ক্যানভাস: আপনার মতে নারীর কর্মসংস্থান বা ক্ষমতায়নে কোন বিষয়গুলোর সংযোজন বা বিয়োজন দরকার বলে আপনি মনে করেন?
সামিয়া রহমান: নারীকে শুধু দক্ষ এবং যোগ্য হলেই চলবে না, তাকে তার পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে অধিকতর যোগ্য হয়ে প্রমাণ করতে হবে ‘ভাই, দেখো আমি যোগ্য।’ একই সঙ্গে কর্তৃপক্ষেরও নারীর উপর আস্থা রাখা দরকার যে ‘আমি কাজটা জানি’। কাজের একটা অনুপ্রেরণা থাকতে হবে তো! নারীর কর্মক্ষেত্রে তার নিরাপত্তার ব্যাপারটা চিন্তায় রাখতে হবে। কিছু কিছু সময়ে, বিশেষ করে মা হবার আগে এবং পরের সময়ে তার প্রতি একটু সদয় আচরণ করতে হবে। সেই সময়ে কর্মক্ষেত্রে যদি বিরূপ আচরণের শিকার হতে হয়, সেটা খুব দুঃখজনক।
ক্যানভাস: এই সময়ে এসে কেউ যদি সামিয়া রহমান হতে চায়, তাহলে আপনি তাকে কী পরামর্শ দেবেন?
সামিয়া রহমান: আমি যেহেতু নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে আছি, আমি দেখেছি ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রত্যেকেই খুব ভালো ভালো কথা বলে। তবে ইদানীং বেশ কিছু তিক্ত অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, মেয়েরা টিভিতে যতটা চেহারা দেখাতে আগ্রহী, কাজ শিখতে ততটা আগ্রহী নয়। রিপোর্টিংয়ে যেতে আগ্রহী নয়, নাইট শিফটে কাজ করতে আগ্রহী নয়, প্রত্যেকেরই সংসারে প্রবলেম। নানা রকম অজুহাত দেয়। অজুহাত একবার, দুবার, সর্বোচ্চ পাঁচবার শোনা যায়। এরপর কিন্তু অফিস শুনবে না। তাই আমাকে সেই জায়গাটায় সেই রকমই আচরণ করতে হবে। তবে এই সমস্ত ছাপিয়েও অনেক মেয়ে ভালো করছে।

সোনিয়া বশির কবীর

ফাউন্ডার অ্যান্ড চেয়ারম্যান, এসবিকে টেক ভেনচার
ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
সোনিয়া বশির কবির: আমি ইতিবাচকই বলব। ২০২০ সালে আমি দেখছি, নারীর সংখ্যায় বাড়ছে। তাদের সাহস বাড়ছে। ওরা বেশি বেশি কাজে আসছে, বিশেষত যেটা আমার কাজের মাধ্যম, সেই প্রযুক্তি খাতে নারীর সংখ্যা বাড়ছে। এটা একটা ভালো লক্ষণ। কিন্তু নেতৃত্বের পর্যায়ে যতটা আসার দরকার ছিল ততটা আসেনি। আমি মনে করি, সেটাও চলে আসবে। আগে তো মাঠে নামা দরকার, তারপর না হয় ক্যাপ্টেন হবে।
ক্যানভাস: ওমেন লিডারশিপ বাড়ানোর জন্য গ্রুমিং কেমন হতে পারে বা এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কী?
সোনিয়া বশির কবির: প্রয়োজন আত্মবিশ্বাসের। নারীদের নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসটা ধারণ করতে হবে—আমি পারব। আত্মবিশ্বাসের এই আগুন নিজে থেকে যেদিন আসবে সেদিনই সম্ভব হবে। এই বোধ ভেতর থেকে আসতে হয়, অন্য কেউ এটা দিতে পারে না।
ক্যানভাস: এর পেছনে কোন ধরনের বাধা কাজ করছে? সে বাধাগুলো সামাজিক নাকি রাষ্ট্রীয়?
সোনিয়া বশির কবির: বাধা তো কিছু আছেই। আমাদের মায়েরা তাদের সময়ে তো বাইরে তেমন কাজ করতেন না। আমাদের সমাজে কিছু মাইন্ড সেট আছে। যেমন নারী মানে সে বাসায় থাকবে, সংসার করবে, স্বামী, সন্তান, মা-বাবা, শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাই-বোনদের দেখভাল করবে। এই ট্র্যাডিশনাল মাইন্ডসেট ওভারকাম করে নারীরা যে কিছু করবে, সেটা অনেক সময় হয়ে উঠছে না। এটা একটা বাধা বলে আমি মনে করি। আরেকটা বিষয় হলো, আমি পরিবারের বড় মেয়ে। কিন্তু পরিবারগুলোয় দেখা যায়, কোথাও যেতে হলে ছোট ভাই এগিয়ে দিয়ে আসে বড় বোনকে। এর মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিকভাবেই নারীকে পুরুষের ওপর নির্ভর করে দেওয়া হচ্ছে। আমি বড় বোন কিন্তু আমার ছোট ভাই আমাকে এগিয়ে দিচ্ছে, আমার বিয়ের পরে আমার স্বামী একই কাজ করবেন। আমি মনে করি, নারীদের স্বাধীন হবার পথে বেশ কিছু বাধা আছে। তাদের স্বাধীন হওয়াটা শিখতে হবে।
ক্যানভাস: আপনি যখন কাজ শুরু করেছিলেন, তখন কাজের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কে ছিলেন? কিংবা কোন বিষয়টা আপনাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে?
সোনিয়া বশির কবির: আমার অনুপ্রেরণা আমার বাবা। কারণ, উনি কোনো দিন মনে করাননি যে, আমি মেয়ে। আমি বড় মেয়ে, আমার দুই ভাইয়ের সঙ্গে বড় হয়েছি। আমি আবাহনীর হয়ে ভলিবল খেলেছি। ন্যাশনাল ভলিবল টিমের সদস্য ছিলাম। অমি ফার্স্ট ন্যাশনাল উইমেন্স ক্রিকেট টিমে খেলেছি। তখন আমরা হাফপ্যান্ট পরে স্টেডিয়ামে ভলিবল খেলতাম। আমার বাবা কখনো আমাকে এসবে বাধা দেননি। আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন স্কুল থেকে বলা হলো, একটা ফুটবল টিম হবে, কে কে খেলতে চাও। আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম যে হাত তুলেছি। বাসায় এসে যখন বলেছি, বাবা তখন বলেননি যে মেয়েরা ফুটবল খেলে না। বাবা বলছিলেন, তুমি খেলো। এভাবেই বাবা আমাকে উৎসাহ দিয়েছেন। আমাকে শিখিয়েছেন, কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা। ফলে শৈশব থেকেই আমার মধ্যে অনেক সাহস সঞ্চার হয়েছে। আমি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, চেষ্টা করতে পেরেছি।
ক্যানভাস: যখন কর্মক্ষেত্রে এলেন, সেখানে কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে?
সোনিয়া বশির কবির: বাধা ঠিক ছিল না। এ ক্ষেত্রে বলব আমি কিছুটা ভাগ্যবান। আমার বিয়ের পরেই সিলিকন ভ্যালি চলে যাই। সেখানে আমার বর চাকরি করতেন। আমি পড়াশোনা করতাম। পড়াশোনা শেষ করে সিলিকন ভ্যালিতেই চাকরি করেছি। তো বাংলাদেশে যখন ফিরে এসেছি, তখন এখানে আমি পুরুষদের কাছে অনেক সম্মান, সহযোগিতা পেয়েছি। আমার কাজের ক্ষেত্রে বাধা শব্দটা ওইভাবে নেই। এটা হতে পারে, আমি সব সময় ইতিবাচকভাবে ভাবার চেষ্টা করেছি, তাই হয়তো বাধা দেখতে পাইনি। আর বসে বসে যদি নেগেটিভগুলো খুঁজি, তাহলে হয়তো অনেক পাব কিন্তু আমি সেসব কিছুই ভাবিনি।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর এগিয়ে চলার ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে কোন বিষয়কে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত?
সোনিয়া বশির কবির: আমি বলব যে, নারীদের বাধা নিজেরাই। কারণ, আমি যদি বিশ্বাস না করি যে, আমি এটা পারব, আমি জিতব, আমি অনেক ভালো করব, আমি সফল হব। তাহলে কিন্তু সফল হওয়া সম্ভব নয়। আমি সারাক্ষণ যদি অভিযোগ করতে থাকি, আমার সুযোগ নেই, আমার ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই, তাহলে তো হবে না। আমি অনেক নারীকে চিনি, যারা শুধু নিজেদের ইচ্ছাশক্তিতে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে গেছেন। তাই আমি আবারও বলব, নারীদের বাধা নারীরা নিজেই।
ক্যানভাস: তরুণদের জন্য পরামর্শ…
সোনিয়া বশির কবির: তরুণ যারা বিশেষ করে নারীরা, তাদের আমি বলব, স্বপ্ন অনেক বড় দেখতে হবে। বড় স্বপ্ন দেখতে তো সমস্যা নেই। এটা আপনার মনকে বড় করে তুলবে। স্বপ্ন বড় দেখলে কিছু না কিছু বাস্তব হয়।

সুলতানা কামাল

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী

ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
সুলতানা কামাল: মেয়েদের কিংবা যদি বলি নারীদের কর্মক্ষেত্র অনেক প্রসারিত হয়েছে। তারা বিভিন্ন পেশায় যোগদান করছেন এবং নেতৃত্বের জায়গায় দৃশ্যমান হয়েছেন। তবে একথা ভুলে গেলে চলবে না, আমরা এমন সমাজে বাস করি, যেখানে দারিদ্র্য এবং লিঙ্গভিত্তিক বিভাজন ও বৈষম্য প্রকটভাবে বিদ্যমান। ফলে কোন নারী কোন অবস্থানে আছেন, তার কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের মান অনেকটাই সেটার ওপর নির্ভর করে। একথা অনস্বীকার্য যে সার্বিকভাবে নারীর কর্মক্ষেত্রের উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশেষত নিরাপত্তার বিষয়টি যে উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে, সে বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করার উপায় নেই।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে মনে করেন?
সুলতানা কামাল: নারীর জীবনে নানা সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করা হয়েছে প্রশংসনীয়ভাবেই। কিন্তু নারীর সেসব সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ ও কার্যকরভাবে অনুসরণ করার ক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যে নারীবান্ধব মনোভঙ্গি প্রতিষ্ঠিত করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে বিভিন্ন অঙ্গনে নারীর অবস্থান তৈরি করা এবং সেসব জায়গায় নারীকে নিযুক্ত করাকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু নারীর নিজের জীবনের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ অথবা সর্বক্ষেত্রে সমতার বিষয়টি নিশ্চিত করা যায়নি। তাই নারী এখনো অন্যের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, অন্যের শর্তে জীবন যাপন করতে বাধ্য হয়।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল?
সুলতানা কামাল: নারী হিসেবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে বাধাগুলোর সম্মুখীন হতে হয়, আমারও সেগুলোর অনেকটাই কাটিয়ে এগোতে হয়েছে। তবে আমার পারিবারিক অবস্থান ও প্রেক্ষাপটের কারণে সেখান থেকে উত্তরণ সহজ হয়েছে। লেখাপড়া, যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে প্রথমত পারিবারিক সমর্থন ও সহযোগিতা এবং আত্মবিশ্বাস থাকাটা খুব জরুরি।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনার অনুপ্রেরণা কী ছিল?
সুলতানা কামাল: আমি অত্যন্ত সমাজসচেতন মা-বাবার সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করার ফলে অনুপ্রেরণা মূলত তাদের কাছ থেকে এসেছে যে প্রত্যেক মানুষের অপরের প্রতি, সমাজের প্রতি, দেশের প্রতি কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। সেটা পালন করা সবার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
ক্যানভাস: নারীর কর্মসংস্থান বা ক্ষমতায়নে কোন বিষয়গুলোর সংযোজন বা বিয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
সুলতানা কামাল: সর্বপ্রথমে নারীকে একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিসত্তা হিসেবে দেখার মানসিকতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। তার কর্মের অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। সেই অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক আইনকানুন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে সেটার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে নারীর প্রতি বৈরী ও বিদ্বেষমূলক প্রচারণা ও কর্মকা- দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ক্যানভাস: কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে নারীদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
সুলতানা কামাল: কর্মক্ষেত্রের চাহিদা অনুযায়ী নিজের দক্ষতা, যোগ্যতা ও জ্ঞান অর্জন করা গুরুত্বপূর্ণ, যা তাকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে দায়িত্ব পালনে সাহায্য করবে।

টুটলি রহমান

প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ হেরিটেজ ক্র্যাফট ফাউন্ডেশন
ক্যানভাস: ২০২০ সালের এই পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
টুটলি রহমান: বর্তমান অবস্থা বলতে গেলে, মেয়েরা সব জায়গায়ই আছে। তাদের কর্মক্ষেত্র এখন আর সীমাবদ্ধ নয়। চাকরি, ব্যবসা—সবকিছুতেই তারা দক্ষতা অর্জন করছে। আগে যেমন মেয়েদের কাজের নির্দিষ্ট কিছু জায়গা ছিল। এমনকি হাতে গোনা দু-একজন যারা বাইরে কাজ করতে পেরেছেন বা কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু এখন আমি বলব, সবার জন্যই কাজের সুযোগ রয়েছে। তবে প্রথমেই চাই নিজের ইচ্ছা। অদম্য ইচ্ছাই পারে মানুষকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়?
টুটলি রহমান: যতই সুযোগ তৈরি হোক না কেন, নারীর জন্য কিছু না কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। কেননা আজও সমাজ পুরুষতান্ত্রিক। পুরোপুরি সমতা আসতে কত দিন লাগবে, কেউ জানে না। তবে সমতা আসবে বলে বসে থাকলে চলবে না। কাজ করে যেতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। আগে মেয়েরা পড়ালেখা করবে, এটাই কেউ মেনে নিতে পারত না। এখন কাজ করতেও অনেকে বাধা দেয় না। মা-বাবা তো উৎসাহ দেয়ই। স্বামী শ্বশুরবাড়িও বাদ পড়ে না।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে? সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল এবং আপনার অনুপ্রেরণা কী?
টুটলি রহমান: ব্যবসা করব অথবা চাকরি করব—বিষয়টা এমন ছিল না। আমার ভালো লাগা থেকেই শুরু। যখন যা ভালো লেগেছে করেছি। কখন ব্যবসায় রূপ নিয়েছে, তা-ও বুঝে উঠতে পারিনি। তবে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি, কেননা আমাকে আর দশটা মেয়ের মতো খুব একটা বাধার মুখোমুখি হতে হয়নি। সবার সহযোগিতা পেয়েছি। সবাই সম্মান করেছে। তাই বলে এই নয় যে এমনি এমনি সব হয়ে গেছে। অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমি যেটা করতে চেয়েছি, তা করে দেখিয়েছি। আমার ক্ষেত্রে পরিশ্রমটা ছিল আনন্দের। কেননা যেকোনো কাজই আমি শুরু করেছি শখ থেকে। শখ পূরণ করতে গিয়ে কখন তা চ্যালেঞ্জে রূপ নিয়েছে, বুঝতেও পারিনি। শুধু কাজটাই করে গিয়েছি। আনন্দের জন্য, শখ পূরণের জন্য। এ পর্যন্ত যত কাজ করেছি, এর মধ্যে একটিই সরাসরি ব্যবসা হিসেবে নিয়েছিলাম। সেটি হচ্ছে ওয়েডিং ডেকর এবং ভীষণ সফলভাবে কাজটি আমি করেছি। এখন অবশ্য আর করছি না। অন্যরা করছে। আমার থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে। ভাবতে ভালোই লাগে। আমি সবচেয়ে বেশি অনুপ্রেরণা পেয়েছি মায়ের কাছ থেকে। কাজও শিখেছি তার কাছে। আমার মা ভীষণ গুণী মানুষ ছিলেন। ঘরের বাইরের সব ধরনের কাজই তিনি পারতেন এবং করতেন। আমাকেও উৎসাহ দিতেন নিজের কাজ করার জন্য।
ক্যানভাস: কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের আগে নারীদের কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন?
টুটলি রহমান: একটি কথা সব সময় মনে রাখতে হবে, হঠাৎ করেই কিছু হয় না। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। কাজকে শুধুই কাজ না ভেবে নিজের ইচ্ছাপূরণ বা শখ হিসেবে নেওয়া উচিত। তাহলে কাজ সহজ হবে। তাতে আনন্দ আসবে। চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। কোনো কিছুতে যদি সফলতা চলেও আসে, তবে নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

জারা জেবিন মাহবুব

কান্ট্রি প্রধান ও সিইও
কাজী আইটি সেন্টার লিমিটেড
ক্যানভাস: ২০২০ সালের পরিবর্তিত সময়ে এসে মেয়েদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ কেমন দেখছেন?
জারা জেবিন মাহবুব: ২০২০ সালে এসে বলতে পারি, আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। অনেক কিছু করতে চেষ্টা করছি। নারী-পুরুষ সমানতালেই কাজ করছে। নারীর কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে এখন কর্মস্থলে ডে কেয়ার সেন্টার হচ্ছে, ম্যাটারনিটি লিভের ব্যবস্থা হয়েছে, নানা ধরনের সাপোর্ট সিস্টেম চালু করা হয়েছে। এসবই করা হচ্ছে যাতে তারা কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছাড়া স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে। আমি আরও একটা বিষয় যোগ করতে চাই, এখন মেয়েরা শিফটিং ডিউটিও করছেন। অর্থাৎ আইটি সেক্টরগুলোতে রাত-দিন কাজ করতে হয় বিভিন্ন শিফটে। রাতের শিফটে কাজ করতে মেয়েরা এখন আর আপত্তি জানায় না। এটি দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন। একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে কাজের ক্ষেত্র কতটা বিস্তৃত হয়েছে। বর্তমানে আউটসোর্সিং বেশ জনপ্রিয়। একটু স্কিল ডেভেলপ করলে নারীরা ঘরে বসেই এ কাজ করতে পারে।
ক্যানভাস: সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে এখনো মেয়েদের কী ধরনের বাধার সম্মুখীন হতে হয় বলে আপনি মনে করেন?
জারা জেবিন মাহবুব: কাজ করতে গেলে বাধা থাকবেই। আগেও ছিল, এখনো আছে। শুধু প্রেক্ষাপট পাল্টেছে। আমি মনে করি, বাধা পেরোনোর বিষয়টি নির্ভর করে নিজের ওপর। কেউ যদি মনে করে, প্রতিবন্ধকতা এলেই আর সফল হওয়া যাবে না, সেটা ভুল। এগুলো অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হবে।
ক্যানভাস: কাজের ক্ষেত্রে আপনাকে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং সেখান থেকে উত্তরণের পথ কী ছিল?
জারা জেবিন মাহবুব: আমার কর্মজীবন শুরু হঠাৎ করেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে তৃতীয় বর্ষে পড়ার সময় বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লে একটা বায়িং হাউসে মার্চেন্ডাইজারের কাজ শুরু করি। তখন ফুলটাইম কাজ আর হাফটাইম পড়ালেখা। অনেকেই বলেছে, বাচ্চা একটা মেয়ে, ওকে দিয়ে হবে না। অনেকের ভ্রু কুঁচকানি উপেক্ষা করে আমি আমার কাজটা করে গিয়েছি। সাহায্যও পেয়েছি অনেক। এর চেয়েও বড় শক্তির পরীক্ষা দিয়েছি আমার বয়স যখন পনেরো। মা-বাবার শখ হলো আমাকে দিয়ে মডেলিং করাবেন। কিন্তু কিছুদিন পর নানা ধরনের কটু কথার শিকার হতে থাকলাম। অভিভাবকদের জানালাম, তারা সাহস দিয়ে বলেন, ‘তুমি তো জানো তুমি কেমন। লোকের কথায় কান দিয়ো না।’ সেই থেকে যে আত্মবিশ্বাস তৈরি হলো, তা এখনো আমার পাথেয়।
ক্যানভাস : আপনার অনুপ্রেরণা?
জারা জেবিন মাহবুব: আমার সাহস আমার মা। আমাদের জন্য তার আত্মত্যাগ অসীম। মা খুব ভালো সেতার বাজাতেন, যা তিনি এগিয়ে নিতে পারেননি। এখনো আমি যা-ই করি না কেন, তার সাহায্য পাই। অন্যদিক থেকে আমার অনুপ্রেরণা স্বামী নাভিদ মাহবুব। একজন নারীর এগিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা তার পরিবারের।
ক্যানভাস : তরুণদের জন্য পরামর্শ…
জারা জেবিন মাহবুব: আমার বিশ্বাস, তরুণেরাই পৃথিবী বদলাবে। কারণ, তারা অনেক বেশি সচেতন। প্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী এখন আর গোল নেই, সমান। মুহূর্তেই সব খবর সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। শুধু বলতে চাই, যে কাজটি করবে মন দিয়ে করবে। তাহলেই সফল হতে পারবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top