skip to Main Content

আলাপন I এখানে কেউ প্রশ্ন করতে জানে না —কামালউদ্দীন নীলু

নরওয়েপ্রবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্য নির্দেশক কামালউদ্দীন নীলু সম্প্রতি এসেছিলেন ঢাকায়। তাঁরই নাটক ‘স্তালিন’ মঞ্চায়িত হওয়ার পর দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এ নাটকের ওপর আলো ফেলে বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর সঙ্গে ক্যানভাসের পক্ষ থেকে কথা বলেছেন চঞ্চল আশরাফ

ক্যানভাস: আপনার নতুন নাটক স্তালিন প্রদর্শনের পর যে প্রতিক্রিয়া আমরা দেখলাম, আলাপের শুরুতে সেটি সম্পর্কে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই।
কামালউদ্দীন নীলু: এটা যখন হলো, তখন আমি খুব আনন্দ পেলাম। মনে হচ্ছে, যে কাজটি আমি করেছি, সেটির শক্তি বেশ তীব্র। থিয়েটার যে কত শক্তিশালী একটি মাধ্যম, প্রমাণিত হলো এ প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে। থিয়েটার কী করে একটা ডিবেট তৈরি করতে পারে, কমিউনিকেশনের জায়গা থেকে আমি বলব, শুধু ডাইরেক্ট কমিউনিকেশন না, প্যারাবলিক কমিউনিকেশনটা কী করে তৈরি হয়— এই যে বাংলাদেশের মানুষ একটি নাটক হওয়ার পর একজন আরেকজনের সঙ্গে কথা বলছে, বুদ্ধিজীবীদের কেউ এর পক্ষে বলছে, কেউ বিপক্ষে কথা বলছে, ফেসবুক ভরে যাচ্ছে, অনেকেই আবার নতুন করে স্তালিনকে আবিষ্কারের চেষ্টা করছে— এসব তো দেখা গেল। স্তালিন সম্পর্কে রি-ইনভেস্টিগেশন চাইছে মানুষ, তারা সোভিয়েত হিস্ট্রি পড়ার চেষ্টা করছে, আমি মনে করি এটা এর অত্যন্ত সাকসেসফুল একটা দিক। এটাই যদি না হয়, তাহলে থিয়েটার করে লাভ কী! আমি তো চাই থিয়েটার দেখে মানুষ উত্তেজিত হবে, কথা বলবে। এখন কথা হচ্ছে। ইতিহাস কিংবা সাহিত্য যা-ই বলেন, আপনার রিডিং আর আমার রিডিং কখনোই এক হবে না। রিডিং আর মিসরিডিং বলে কোনো শব্দ এখন আর নেই। আন্ডারস্ট্যান্ডিং আর মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং বলে কোনো কিছু এখন আর নেই। আপনার মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং কিন্তু আমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং হতে পারে। কথা হচ্ছে বিষয়টাকে আমি কীভাবে ব্যাখ্যা এবং পুনর্ব্যাখ্যা করছি, তার ওপর নির্ভর করেছে শিল্পের শক্তি। ঘটনাটা বোধ হয় ওই জায়গা থেকে ঘটেছে।
ক্যানভাস: এক সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছেন, নাটক বা থিয়েটার টেক্সট থেকে নয়, স্পেস থেকে হয়।
কামালউদ্দীন নীলু: এটা আমার কাজের একটি ধারা। আমি যখন টেক্সটটা পাই, তখন সেটাকে আরেকটা ফিজিক্যাল স্পেসের মধ্যে ঢোকাই। কারণ, থিয়েটারে চাই স্পেস এবং ট্রান্সফরমেশন। আপনি কী করে ট্রান্সফর্ম করছেন, সেটা স্পেসের ট্রান্সফর্ম হতে পারে, টেক্সটের হতে পারে, ক্যারেক্টারের হতে পারে— ফুল অব ট্রান্সফরমেশন। আমার কাজ দেখলেই বুঝবেন, স্পেস থেকে আমি যখন কাজটা করছি, হঠাৎ করে আমি শিল্পকলার লবিতে যাচ্ছি। এটা তো ফ্যান্টাস্টিক স্পেস, আমি কেন এ স্পেসটি নিচ্ছি না! আমি ব্যালকনিতে স্তালিনের স্ট্যাচুটা রাখতে পারি। আমি সমস্ত স্পেসটা ভেঙে অন্য একটা স্পেস তৈরি করে ফেললাম। এর কারণ হচ্ছে, আমার নাটকের শুরুটাই হচ্ছে গোটা পৃথিবী নিয়েই। আমি যখন সমস্ত পৃথিবীকে বোঝাচ্ছি, তখন এটি পূর্ণ মাত্রায় একটি পাবলিক স্পেস হয়ে যাচ্ছে। আমরা সবাই কিন্তু এর অভিনেতা-অভিনেত্রী। থিয়েটার মূলত স্পেসের ওপর নির্ভরশীল এবং স্পেস বেস করে যদি আমরা কাজ করতে পারি, একটি অর্থ কিন্তু আমরা প্রকাশ করতে পারি। ড্রামাটিক স্ট্রাকচারের মজা কিন্তু স্পেসেই।
ক্যানভাস: স্পেস সৃষ্টি এবং পুনঃসৃষ্টি ডিরেক্টর টু ডিরেক্টর চেঞ্জ হয়। সেখানে টেক্সট থেকে কি কোনো কল্পনা তৈরি হয় না? নাকি টেক্সট থেকে সেটা বিচ্ছিন্ন?
কামালউদ্দীন নীলু: টেক্সট থাকতে হবে মাথার মধ্যে। সেটা আপনার ইমাজিনেশনের ওপর। ইমাজিনারি লেভেল থেকে আপনাকে দেখতে হবে। সেখানেই হচ্ছে আর্টিস্টিক জায়গাটা। এই ফেসটাকে আমি কীভাবে ঢোকাব, বা এই সিচুয়েশনটাকে কীভাবে ঢোকাব। আপনি দেখবেন, আমি কয়েকটি চেয়ার ব্যবহার করেছি। ১১টি চেয়ার, ২টি টেবিল। সেটা কখনো শেলফ হয়ে যাচ্ছে, কখনো অন্য কিছু হয়ে যাচ্ছে। অবজেক্টগুলোর নানা রূপ আমি তৈরি করছি। এবং আপনাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে এটা পলিটব্যুরো। এটা কনফারেন্স রুম। এটা স্তালিনের বাড়ি। গার্ডেনের যে প্যাসেজটা, ওরা যখন নাচতে নাচতে আসছে তেহরানের মিটিংয়ের পর, এটা তো টেক্সটের সঙ্গেই যুক্ত। কিন্তু স্পেসটা যে রিক্রিয়েট আমি করছি, সে জায়গায় হচ্ছে ডিরেক্টরের কাজ। কীভাবে আমি রিক্রিয়েট করছি, কোন এক্সপ্রেশনে করছি, সেটা মোস্ট ইম্পরট্যান্ট থিং। টেক্সট থাকবে, থাকতেই হবে। কিন্তু আগে স্পেসটাকে কল্পনা করতে হবে। ফর্মটাকে যদি তৈরি করতে না পারেন, তাহলে কনটেন্ট ঢোকাবেন কী করে? কনটেন্টকে ফর্মের সঙ্গে ভাঙতে হবে। সেটাকে মেলাতে হবে। সেটা যদি ভাঙতে না পারেন, তাহলে কিন্তু আর দাঁড়াল না কিছু। তখন ধাক্কা লাগবে। আমি এটা ভাবি, সে জন্য বলি— আগে স্পেসটাকে ক্রিয়েট করতে হবে। স্পেস ইজ ভেরি ইম্পরট্যান্ট।
ক্যানভাস: স্পেসের যে ধারণা প্রথাগত নাটকে আমরা দেখি, সেটিকে আপনি ভাঙেন এবং নতুনভাবে সৃষ্টি করেন। দেখা যায়, পরবর্তী নাটকে স্পেস ভাঙার আইডিয়াটা আর আগের মতো থাকছে না। নিজেকে বদলে ফেলার এই প্রি-অকুপেশনটা কীভাবে ঘটে?
কামালউদ্দীন নীলু: এটি ঘটে টেক্সট থেকে। কনটেন্ট থেকে। কনটেন্টটা কী, তার টেক্সচারটা কী— সেটা কি রাফ নাকি স্মুথ? টেক্সট একটা ম্যাটেরিয়াল কিন্তু। থিয়েটার ডিরেক্টর হিসেবে আমার কাছে সবকিছু হচ্ছে ম্যাটেরিয়াল। আমি যদি গোর্কির লোয়ার ডেপথস করি কখনো, নিশ্চয়ই আমার স্পেস অন্য রকম হতে হবে। এমন হতে পারে, একটি গাছের মধ্যে অনেক পাখির বাসা। কিন্তু সমস্ত মানুষ কোথাও ব্লক হয়ে গেছে এবং সেখান থেকে কথা বলছে। ইটস পসিবল। যেমন আমি রিকোয়েস্ট কনসার্ট বলে একটা নাটক করেছিলাম, সেখানে প্রত্যেক দর্শক জানালার ফ্রেম দিয়ে নাটকটি দেখছে। কারণ হচ্ছে, তাতে এক নিঃসঙ্গ নারী থাকে, সমস্ত কিছু থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, প্রেমিক বিট্রে করেছে ইত্যাদি। অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে কী হয়? একজন নারী যখন একা থাকে, তখন প্রত্যেকের একটা কৌতূহল থাকে যে জানালা দিয়ে দেখে সে কী করছে! এই কৌতূহলকে মাথায় রেখে ওই স্পেসটা তৈরি করা হয়েছিল। সেই পারফরম্যান্সটা ঢাকাতেও হয়েছে। জানালার ফ্রেম দিয়ে প্রত্যেক দর্শক সেই নারীকে দেখছে।
ক্যানভাস: আপনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে নাটক বা থিয়েটারকে দর্শকের কাছে যেতে হবে। প্রফিটেবল হতে হবে। কিন্তু একজন উচ্চাভিলাষী ডিরেক্টর বা অথরের চিন্তা সমকালীন দর্শকের থেকে অনেকখানি অগ্রসর থাকে। সেই জায়গা থেকে কী করে দর্শকদের টানা সম্ভব? সে ক্ষেত্রে আপোসের একটা ঝুঁকি থেকে যায় কি না?
কামালউদ্দীন নীলু: আমার কাছে মনে হয়নি যে আমাকে কখনো আপোস করতে হয়েছে। আমি এমনভাবে কাজটা করি, যাতে সেটা মোটামুটি দর্শকের চিন্তার জায়গাতেই থাকে। প্রতিদিন মানুষকে অবজার্ভ করি। নাটকের মধ্যে এরাও আছে। এদের তো অ্যাকটিভ করতে হবে। দর্শককে প্যাসিভ করে থিয়েটার করা, ওটা ডেড থিয়েটার। ওটাকেই ডেডলি থিয়েটার বলা হয়। কেননা, ওটা উনিশ শতকের বুর্জোয়া থিয়েটার। একটা মঞ্চ থাকবে, সেখানে মানুষ কিছু একটা করবে, দর্শক আসবে, তারা দর্শকের মতো বসে থাকবে, নাটক শেষ। একটু হাততালি দিল, বের হলো, এক কাপ চা খেয়ে চলে গেল। এখানে দর্শক প্যাসিভ। কোনো পার্টিসিপেশন রইল না। দর্শক যদি অ্যাকটিভ না থাকে, তাহলে সেটা কখনো অর্গানিক হতে পারে না। মানুষের টেস্ট বেড়ে গেছে। এখন ভার্চ্যুয়াল জগতের সঙ্গে ফাইট করতে হচ্ছে। সেটাকে মাথায় রাখতে হবে।
ক্যানভাস: পাশ্চাত্য নাটকে বিভিন্ন সংবেদনশীলতার প্রকাশ দেখা যায়। একটা ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে ওখানকার নাটক বিকশিত হয়েছে, বাংলা ভাষায় তেমনটি ঘটেনি। এখানে অ্যাবসার্ড নাটকও সেভাবে বিকশিত হয়নি। এর কারণ কী?
কামালউদ্দীন নীলু: কলোনাইজাররা এমনভাবে আমাদের বডি এবং মাইন্ড সেট করেছে, আমরা যেন তাদের অনুসরণ করি। যাতে কিছু ক্রিয়েট করতে না পারি। আমরা আমাদের নিজস^ সত্তা হারিয়ে ফেলেছি বহু আগে। আমরা জানিই না আমাদের রূপটা কী ছিল। ওরা জানে টেক্সট কোনো ঝামেলা না। এমন একটা স্ট্রাকচার এখানে এনে দিতে হবে, যাতে এর বাইরে আমরা চলে যেতে না পারি। এ জন্যই ওরা ইউরোপ থেকে প্রসেনিয়াম মঞ্চটা এনে ঢেলে দিয়েছে। পাবলিক থিয়েটারে। কারণ ওরা জানে এই স্পেসটা যাদের দেওয়া হচ্ছে, তাদের সেভাবেই নড়তে-চড়তে হবে। সেই স্ট্রাকচারের মধ্যেই থাকতে হয়েছে সব সময়। এর আগে আমাদের কী ছিল, সেটার পরিপূর্ণ রূপ কিন্তু আমরা জানি না। যেমন যাত্রা, যাত্রার যে অরিজিনাল রূপ, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের যে ব্যাপারটা, সংলাপের বিনিময়, মিউজিক… যাত্রা তো এক রকম ছিল না। প্রতিটি যাত্রার সম্পর্ক ছিল একেকটা দেবীকে কেন্দ্র করে। সেখান থেকে নানাভাবে নানা ধরনের দেবীর রিচুয়াল তৈরি হতো। ব্রিটিশরা দেখল, যাত্রার স্পেসটা তো খুব মজার, শেক্সপিয়ারের স্পেসের সঙ্গে এবং গ্লোব থিয়েটারের সঙ্গে এর মিল আছে— ওরা স্পেসটাকে রেখেই তাতে শেক্সপিয়ার ঢেলে দিল। ওরা একটা মিক্সড ফর্ম ঢুকিয়ে দিল। ল্যাঙ্গুয়েজটা শেক্সপিয়ারের, কিন্তু এর সঙ্গে আরেকটা ম্যাটেরিয়াল ঢুকিয়ে দিল। আমাদের কীর্তন যুক্ত করে একধরনের হাইব্রিড ফর্ম তৈরি করল। বাংলা থিয়েটারের ক্ষেত্রে ওরিয়েন্টালিজমের একটা ব্যাপার এসেছে।
ক্যানভাস: সম্প্রতি প্রাচ্যবাদী সংবেদনশীলতার অনুগামী হয়ে বর্ণনাত্মক রীতিতে যে নাট্যচর্চা শুরু হয়েছে বাংলাদেশে, এর জন্য সমালোচনার স্বতন্ত্র পদ্ধতি দরকার। বলতে চাইছি, পাশ্চাত্যের মেথড ও টুলগুলো এতে প্রযোজ্য হতে পারে না। সেই শূন্যতাটা যদি থাকে, তাহলে প্রাচ্যরীতির নাট্যচর্চার বিকাশ কি সম্ভব?
কামালউদ্দীন নীলু: সব কলোনাইজড কান্ট্রির এই অবস্থা। সবাই প্যারাডক্সিক্যাল অবস্থায় আছে। ব্রিটিশদের ধার করা আইন নিয়েই তো আমরা চলছি। কতটা আমরা পরিবর্তন করতে পেরেছি? হঠাৎ করে ম্যাজিক রিয়েলিজম টার্মটা চলে এলো, পোস্টমডার্নিজম, পোস্টস্ট্রাকচারিজম চলে এলো। কিন্তু ব্যাপারটা কী, সেটাই তো আমরা ধরতে পারছি না। আমরা যে একটি থিওরিটিক্যাল ডিসকোর্সের মধ্যে নিয়ে যাব, নাটককে থিওরিটিক্যাল একটি স্পেসের মধ্যে যে নিয়ে যাব, সেই পথগুলো বের করার সময় এসেছে।
ক্যানভাস: সমাজতন্ত্রে কিন্তু ব্যক্তিসত্তার কোনো গুরুত্ব নেই। আপনার ‘স্তালিন’ নাটকে স্তালিন একজন ব্যক্তি এবং তার ইনার এক্সপ্রেশনটা আপনি দেখিয়েছেন। যে মতাদর্শের প্র্যাকটিস করেছে একটা রাষ্ট্র, তাতে একজন ব্যক্তি অবস্থান করছে এবং তারই আধিপত্য চলছে।
কামালউদ্দীন নীলু: সেখানেই সমাজতন্ত্রের সমস্যা। ক্যাস্ট্রো কিন্তু ক্যাস্ট্রো হয়েই ছিলেন। যখন আর পারেননি, তখন ভাইকে ক্ষমতা দিয়েছেন। লেনিনও তাই। যখন পারেননি তখন একটা বাজে লোকের হাতে দিয়েছেন, স্তালিনের হাতে দিয়েছেন। স্তালিন কাকে ক্ষমতা দিলেন? সবচেয়ে খারাপ লোকটা, যিনি ইউক্রেনের আশি লাখ কৃষককে হত্যা করেছেন। কমিউনিজমের কী হয়েছে? মাও মরে গেছেন। এখন যারা আছেন, তারা তো পেছনের সব ভুলে গেছেন।
ক্যানভাস: ব্যক্তির হাতে আদর্শের মৃত্যু দেখাতে চেয়েছেন?
কামালউদ্দীন নীলু: অবশ্যই। এটাই আমি বলতে চেয়েছি। ফিলোসফি, আইডিওলজি হিসেবে সমাজতন্ত্রে তো কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে ব্যক্তিতে।
ক্যানভাস: সমকালীন বাংলা নাটক সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
কামালউদ্দীন নীলু: এখন সো-কলড বাঙালি সংস্কৃতির নামে যে কাজগুলো হচ্ছে, আমার মনে হচ্ছে, এটা পেছনের দিকে টানার একটা প্রচেষ্টা। এতে ডিফর্ম একটা অবস্থা তৈরি হচ্ছে। একটা ডিফর্ম ন্যাশনালিজমের জায়গা তৈরি করা হচ্ছে। যেটি আরও ভয়ংকর। তা ছাড়া দুই নৌকায় পা দিয়ে রাখা হয়েছে। একদিকে বলা হচ্ছে বাঙালি থিয়েটারের ফর্ম তৈরি করতে হবে, অন্যদিকে সিলেবাসের ৮০ শতাংশ পশ্চিমের টেক্সট।
ক্যানভাস: আবার আপনার নাটকে ফিরে আসি। বোঝা যায়, ফিউশন আপনি খুব পছন্দ করেন। তাতে অবজেক্ট কখনো কখনো সাবজেক্ট হয়ে যাচ্ছে।…
কামালউদ্দীন নীলু: আমাদের এশিয়ান থিয়েটারের ফর্মগুলোতে একটা মজার বিষয় হচ্ছে, এগুলো ইনার সাইকোলজিটা ফেসের ভেতর দিয়ে, কালারের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করে। সেটা জাপানিজ থিয়েটার হোক, চায়নিজ থিয়েটার হোক। স্তালিন নাটকের মেকআপ, প্রতিটা কিন্তু খুব স্টাইলাইজড। দেখলেই বোঝা যায় যে কী করে আমি সোশ্যাল রিয়ালিজম ভেঙে আরেকটি জায়গায় যাচ্ছি। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, এশিয়ান থিয়েটারে একটা অবজেক্টের মাল্টিপল অ্যাপ্লিকেশনসের ব্যাপার থাকে। যেমন একটা বালিশ প্রেমিকা হয়ে যাচ্ছে, ঘোড়া হয়ে যাচ্ছে, কখনো বাচ্চা হয়ে যাচ্ছে, যুদ্ধের অস্ত্র হয়ে যাচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে আমি মডার্ন থিয়েটার করছি। আমার কাছে বালিশ তো মুখ্য নয়। আমাকে অলটারনেটিভ একটা অবজেক্ট বের করতে হবে। এই যে চেয়ারগুলো, সেটগুলো একটার থেকে একটা সরে যাচ্ছে, সেটাকে নানাভাবে ব্যবহার করার যে একটা ব্যাপার, এখানে এসে কিন্তু আমি এশিয়ান ও ইউরোপিয়ান ফিউশনটা তৈরি করেছি। মেকআপ ও অবজেক্টের ভেতর দিয়ে। দেখিয়েছি, সাবজেক্ট হয়ে যায় অবজেক্ট, আবার অবজেক্ট পরিণত হয় সাবজেক্টে। তাতে স্পেসগুলো ভেঙে যায়, প্রপসগুলো ভেঙে যায়। হঠাৎ করে টেবিলটা একটা প্ল্যাটফর্ম হয়ে যায়, একটা পলিটিক্যাল মঞ্চ হয়ে যায়। এর অ্যাকটিংয়ের জায়গাটা খুব ইন্টারেস্টিং। কেন স্তালিন বেছে নিলাম? আমার বহুদিনের একটা ইচ্ছা ছিল, রাশিয়ান অ্যাকটিং স্কুলের যেসব বিষয়, এগুলোকে একটা ফর্মের মধ্যে ঢোকাব।
ক্যানভাস: স্তালিনের কন্যা সাভেতলানা কাউন্টার রোল প্লে করেছে। এটা কি আপনার কল্পনা? এর উৎস কী?
কামালউদ্দীন নীলু: সেটিই তো। তার মেয়ে তাকে চ্যালেঞ্জ করছে। যখন অথরিটি একটি ফ্রেমের মধ্যে ঢুকে যায়, তখন কিন্তু ব্যক্তি এবং তার পরিবার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তখন কেবল পরিবারের অধিকার থাকে একিউজ করার। তার কন্যা সারা জীবন তার সঙ্গে লড়াই করেছে। পিতার প্রতি সাভেতলানার আক্রোশ কেন! তার প্রথম প্রেমিককে সে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। ফিল্মমেকারকে। যেহেতু সে ইহুদি ছিল। কন্যা প্রশ্ন উত্থাপন করছে— সে কি মানুষ না? আরও বলছে— ও, তুমি এটা বলছ, যেহেতু সে ইহুদি। তাহলে কার্ল মার্ক্স কী ছিল? সবকিছুর শেষে বলছে, বাবা, তুমি কি জানো আমাদের অবস্থা কী? আমরা ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে আছি। জনগণ বলছে, তোমাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হবে। এটা করা হবে, ওটা করা হবে। সে কিন্তু তার বাবাকে সতর্ক করছে। এ রকম পরিস্থিতিতে পরিবারের কেউ তাই করে। অন্য কেউ করতে পারে না। কারণ, অন্য কাউকে সে বিশ্বাসই করে না। বিষয়গুলো এভাবেই এসেছে। যে কারণে ওই জায়গাগুলো আপনি খেয়াল করে দেখেছেন, সাভেতলানা ও স্টালিনের পোরশনগুলো এক্সট্রিমলি রিয়েলিস্টিক।
ক্যানভাস: স্তালিনকে নিষ্ঠুর ও ভাঁড় হিসেবে দেখানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যখন আপনি এ নাটক নিয়ে কাজ করছেন, তখন কি এই আশঙ্কা বোধ করেননি?
কামালউদ্দীন নীলু: ইচ্ছাকৃতই এটা। আমি জেনে করেছি। কারণ আমার ফর্ম এটা ডিমান্ড করছে। স্তালিনের পোর্ট্রটে করতে চেয়েছি। ক্যারেক্টারটা যা, তা-ই। যেকোনো ডিক্টেটর, যেমন গাদ্দাফি ইজ আ ক্লাউন। সাদ্দাম, হিটলারকে দেখেন। ক্রুয়েল অ্যান্ড ক্লাউন। না হলে চ্যাপলিন কেন ওইভাবে পোর্ট্রটে করল! হিটলারের রিয়েলিটি তো তা-ই। আমি তো ইনার সারফেস নিয়ে কাজ করি। আমি যদি একটা গাছকে গাছের মতো আঁকি, তাহলে ওটা স্টিল ফটোগ্রাফি হয়ে যাবে। পেইন্টিং হবে না। কিন্তু গাছের অনুভূটিতা যদি আমি পোর্ট্রেট করি, সেটা একটা শিল্পের পর্যায়ে যাবে। ভ্যান গঘের সানফ্লাওয়ার পৃথিবীতে এত বিখ্যাত কেন? কেন মানুষ সানফ্লাওয়ার দেখে পাগল হয়ে যায়? কারণ হচ্ছে, সানফ্লাওয়ারের যে ইনার ফিলিংসটা, সেটিকেই তিনি নিয়ে এসেছেন লাইন ও কালারের ভেতর দিয়ে। দ্যাটস দ্য থিং। তারপর পিকাসোর নারী চরিত্রের তিনটি মুখ হয় কী করে? ওরা যে কথাগুলো বলছে, এটা তো শুধু একপ্রেশনিজম না, এটার সঙ্গে কিউবিজমের ব্যাপার আছে, সিম্বলিজমের ব্যাপার আছে। এগুলো যদি না বোঝে, তাহলে তো মুশকিল। আমি পোশাকের নিচের পোরশনে লাল এবং উপরের পোরশনে কস্টিউম দিলাম কেন? স্তালিন যে লাল ট্রাউজার পরে আছে, অন্যরাও সেই ট্রাউজার পরে আছে, এটা কেন করলাম? আমার আর্টিস্টিক পারপাসে আমি করেছি। অনেক সময় এ লোকগুলোকে পাপেটের মতো দেখতে পাচ্ছেন। অর্ধেক দেখতে পাচ্ছেন, অর্ধেক হারিয়ে গেছে। অদ্ভুত এক ইমেজ সৃষ্টি হয়েছে।
ক্যানভাস: থিয়েটারে টেক্সটের স্থানটি আপনার কাছে গৌণ। এই মনোভাব নিয়ে একজন ডিরেক্টর কীভাবে কাজ করবেন?
কামালউদ্দীন নীলু: নাট্যকার জীবিত থাকে পাঠকের কাছে। নাট্যকারের নাটক যখন পারফরম্যান্সে চলে আসে, তখন একজন ডিরেক্টর তাকে নতুন জীবন দিচ্ছে। যেমন চেখভের সব নাটক ব্যর্থ হলো, কোনোটাকে নাটক বলা হলো না। তখন স্তানিস্লাভস্কি তার নাটক নিয়ে কাজ করলো। সারা পৃথিবীতে চেখভকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। একটা নাটকের লাইফ শেষ পর্যন্ত একজন ডিরেক্টরের হাতে। কারণ সে রিইন্টারপ্রেটার। পাঠক হিসেবে আপনার ভালো না-ও লাগতে পারে। আবার দেখা যায়, ওই টেক্সটাই যদি ভালো ডিরেক্টরের হাতে পড়ে, তখন সেটা অন্য রূপ নিয়েছে। শূন্যতা তো আছেই। একটা কবিতা নিয়েও নাটক হতে পারে। একটা উপন্যাস নিয়ে থিয়েটার হতে পারে। গল্প নিয়েও টেক্সটই যে লাগবে, নাটক লাগবে, তা কিন্তু নয়। যেকোনো স্ক্রিপ্ট নিয়েই পারফরম্যান্সে আসা যায়। সোর্স হিসেবে আমাকে বই ব্যবহার করতে হয়েছে। আমি বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন কিছু এনে একটা পারফরম্যান্স স্কোর তৈরি করেছি। সেগুলোর একটা সিরিয়াল করেছি, কোনটা কোন জায়গায় কীভাবে যাবে, কীভাবে এক্সপ্রেস করব— এইসব। যে কারণে আমি এটিকে ড্রামাটোলজিক্যাল ওয়ার্ক বলছি। নিজেকে নাট্যকার বলছি না, বা এটাকে নাটক বলছি না।
ক্যানভাস: নাটকে রূপকটাই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। এখন স্ক্রিপ্টের যে সমস্যা, সেই জায়গায় যেতে চাইছি। বেশির ভাগ সমকালীন নাটকই এলিগোরি হয়ে উঠছে না।
কামালউদ্দীন নীলু: এখন কথা হচ্ছে, তারা তো ওই জায়গাটিই বিশ্বাস করে না। গাছকে গাছের মতোই দেখাতে হবে। একজন পরিপূর্ণ নাট্যকার হতে গেলে কিন্তু প্রথমত তাকে স্কিলড হতে হবে, নানা বিষয়ে তার ধারণা থাকতে হবে, তাত্ত্বিক জায়গাগুলো পরিষ্কার থাকতে হবে। না হলে আপনি আসতে পারবেন না। আমার যদি মিশেল ফুকো পড়া না থাকত বা তার তথ্য আমার জানা না থাকত, তাহলে আমি কী করে একটা স্পেসের মধ্যে আরেকটা স্পেস ঢোকাতাম? কিছু থিওরিটিক্যাল বেস তো লাগবে। কল্পনা করে সব হয় না। থিওরিটা থাকলেই আপনি একটা কিছুর ফর্ম তৈরি করতে পারবেন।

কৃতজ্ঞতা: নাট্যকার সাধনা আহমেদ
শ্রুতলিখন: শিবলী আহমেদ
ছবি: সৈয়দ অয়ন

This Post Has 2 Comments
  1. আমার নির্দেশক আমার গুরু, মিঃ কামালউদ্দিন নিলু।

  2. পড়েছি অনেকগুলো মিস্টেক আছে। শ্রুতি লেখক হয়তো না বুঝে কিছু ভুল করেছেন। শেষের দিকে অনেকগুলো কথা তিনি বলেন নি। যা বলেছেন তা ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। আমি সামনে ছিলাম, আরও কয়েকজন ছিলো। আরেকজন সাংবাদিক ছিলেন। ইন্টারভিউর মাঝে আমাদের নিজেদের কিছু আড্ডা ছিলো, সেখানের কথাগুলোও নীলু স্যারের কণ্ঠে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যা ঠিক হয় নি।এটা ঠিক করে দেবার জন্য অনুরোধ করেছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top