skip to Main Content

আলাপন I নগরসভ্যতা ও অরণ্যের মেলবন্ধনই আমার স্বপ্ন – মারজিয়া হোসেন

একবার ভাবুন তো, আপনার ঘরের দেয়ালটি সবুজ বাগানে রূপ নিয়েছে। সেই বাগানে কোনো মাটি নেই। আলাদা করে পরিচর্যাও নিষ্প্রয়োজন। বাগানই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সার-পানি সব নিচ্ছে। সরাসরি সূর্যের আলোর দাবি নেই সেই বাগানের। এক সপ্তাহের জন্য কোথাও বেড়িয়ে এলেও দেখা যাবে দেয়ালবাগান আগের মতোই সুস্থ-সুন্দর আছে। কৃত্রিম আলোতেই ঝলমল করছে বাগান। ঠিক এ রকম একটি দেয়ালবাগানের সৃজনকর্ম হয়ে থাকে জংলা স্টুডিওতে। স্থপতি মারজিয়া হোসেন গড়ে তুলেছেন এই জংলা স্টুডিও। ক্যানভাসের হয়ে তাঁর সঙ্গে আলাপ করেছেন স্থপতি সুপ্রভা জুঁই

ক্যানভাস: মারজিয়া, আপনি ২০১১ সালে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন স্থাপত্যবিদ্যায়। ‘স্থাপত্য’ থেকে ‘জংলা’- এই রূপান্তরের গল্পটা কেমন?
মারজিয়া: স্থাপত্যবিদ্যায় পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ছয়-সাত মাস এই বিষয়েই চাকরি করেছি। অথচ সত্যি বলতে স্থাপত্যবিদ্যায় পড়তে যত ভালো লেগেছিল, চাকরি করতে এসে সেই ভালো লাগাটা একেবারেই যেন হারিয়ে গেল। এই হতাশায় চাকরিটা ছেড়ে দিই। আমাদের বাড়িতে বাগান আছে, সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি। শুধু আমি না, বাসার সবারই ভীষণ বাগানপ্রীতি। চাকরি ছাড়ার পর থেকে আমার বাগানে সময় কাটানো আগের চেয়ে আরও বেড়ে গেল। এই বাগানবিলাস দেখে সেই সময়ে আমার হবু বর (তিনিও স্থপতি) আমাকে বললো যে বিদেশে গ্রিন ওয়াল মানে সবুজ দেয়াল বা ভার্টিক্যাল গার্ডেন নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশে এই চিন্তাটা একেবারেই নতুন। আমিও ভাবলাম, যেহেতু গাছপালা নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে, তাই এই সবুজ দেয়াল নিয়েই কাজ করতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট ঘেঁটে অনেক গবেষণা শুরু করি এবং সেখান থেকেই কাজ করতে করতে আজ জংলা স্টুডিওতে এসে পৌঁছানো।
ক্যানভাস: জংলা স্টুডিও নিয়ে আপনার কাজের শুরুর দিকের অভিজ্ঞতাটা…
মারজিয়া: শুরুটা অনেক কঠিনই ছিল। বিদেশে এই চর্চা এতটাই এগিয়ে গেছে যে বহু বিশেষজ্ঞ রয়েছেন এ জন্য। এখন গ্রিন ওয়াল কিট পাওয়া যায়। যা কিনে এনে দেয়ালে লাগালেই কাজ শেষ। সেখানে গাছ আপনাতেই বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশে এসব কিছুই পাওয়া যায় না, তবে হ্যাঁ, আমাদের আছে ইচ্ছা ও মনোবল। যেহেতু কোনো রেফারেন্স এখানে নেই, তাই আমায় অনেক পড়াশোনা করতে হয়েছে। এখানে কোনো ম্যাটেরিয়ালও পাওয়া যায় না আর বিদেশ থেকে সেসব এনে শুরু করা খুব ব্যয়বহুল, তাই ঠিক করলাম লোকাল ম্যাটেরিয়াল যা জুতসই হবে, তাই-ই ব্যবহার করব। শুরু হলো খোঁজ– নবাবপুর, সদরঘাট, হাটখোলা, তেজগাঁও, বনানী, গাজীপুর, স্টেডিয়াম– কোথায় যাইনি আমি! প্রথম যে সবুজ দেয়াল বানিয়েছিলাম, সেটা ছিল খুব ছোট। পরেরটা করি বাসার ড্রয়িংরুমে ২০ বর্গফুটের দেয়াল। মূলধনটা দিয়েছিলেন মা, সঙ্গে অনুপ্রেরণাও। বাবারও সমর্থন ছিল। যা হোক কাজের শুরুটা মোটেও মসৃণ ছিল না। গবেষণার পরে হাতেকলমে কাজ করতে গেলে দেখা গেল, সূত্রগুলো মিলছে না। পর্যায়ক্রমে গাছ এবং যন্ত্রের ভাষা বুঝতে শুরু করলাম। প্রাণ ও অপ্রাণ মিলে এক প্রাণে সৃষ্টির খেলায় আমি তখন মগ্ন। এদের সবার সুর এক করা তখন আমার ধ্যান। ধীরে ধীরে তাদের দখলে আনতে পারলাম এবং সব সহজ হয়ে গেল। এভাবেই একসময় আত্মবিশ্বাসী হলাম এবং বাণিজ্যিকভাবে সবুজ দেয়াল করার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখন জংলা স্টুডিও তার আকার পেল। এখন আমরা ল্যান্ডস্কেপিং নিয়েও কাজ করতে যাচ্ছি।
ক্যানভাস: স্থাপত্যবিদ্যার সঙ্গে জংলা স্টুডিওর কাজের বৈশিষ্ট্যগত কোনো সংযোগ আছে কি?
মারজিয়া: স্থাপত্যবিদ্যা হলো পরিবেশবিজ্ঞানের একটি বিভাগ। সেখানে ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন হলো স্থাপত্যবিদ্যার একটি অংশ। আর সেই ল্যান্ডস্কেপিং এর একটা ক্ষুদ্র অংশ হলো সবুজ দেয়াল। সে অর্থে স্থাপত্যবিদ্যার পরিসর কিন্তু অনেক বড়। শুধু আমরা যে বাড়িটুকু দেখি তার মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। আবার একজন স্থপতিমাত্রই সবুজ দেয়াল বিশেষজ্ঞ হবেন, সেটাও ঠিক নয়।
ক্যানভাস: গতানুগতিক ধারার বাইরে এ রকম একটি চিন্তা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আপনি কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন?
মারজিয়া: আপনি যখন প্রচলিত ধ্যানধারণার বাইরে কাজ করবেন, তখন সবার আগে কাজটি সম্পর্কে মানুষজনকে স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে এবং তাদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এই কাজ কিন্তু মোটেও সহজ নয়। শুরুর দিকে আমি পরিচিতজনদের বাড়িতে কিছু প্রজেক্ট করলাম। এরপর নানা এক্সপোতে যাওয়া শুরু করি। অভাবনীয় সাড়া পাই। সবাই ছুঁয়ে দেখত, গাছগুলো আসল নাকি প্লাস্টিকের। ছবি তোলার জন্য রীতিমতো লাইন পড়ে যেত। কিছুটা ব্যয়বহুল বলে সবাই কিনতে পারেননি কিন্তু কাজটির প্রশংসা হয়েছিল বেশ, যা ভীষণ উৎসাহ জুগিয়েছিল। এভাবেই আমি আস্তে আস্তে কাজ পেতে শুরু করলাম।
ক্যানভাস: একটি প্রজেক্টের উদাহরণ দিয়ে বলবেন যে ঠিক কীভাবে কাজের প্রক্রিয়াটি ঘটে থাকে?
মারজিয়া: যখন কেউ সবুজ দেয়াল করতে আগ্রহী হয়, তখন পুরো প্রক্রিয়াটি তিনটি ধাপে সমাধা হয়। ১. প্রজেক্ট ডিজাইন, ২. ইনস্টলমেন্ট এবং ৩. মেইনটেন্যান্স। প্রজেক্ট ডিজাইনের মাঝে পড়ে মূলত জায়গা নির্বাচন করা। সেখানে প্রাকৃতিক আলোর উপস্থিতি পরিমাপ করা হয় এবং সেসব বিচার করে কৃত্রিম আলোর প্রয়োজনীয়তা ও পরিমাণ ঠিক করা হয়। সেই আলোতে কোন গাছ ভালো হয়, তাদের ইরিগেশন কীভাবে হবে– এসব মিলিয়ে একটা বাজেট ও চুক্তি নির্ধারণ করা হয়।
ডিজাইনের ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তুত করে নানা মডিউল ঠিক করে বানিয়ে দেয়ালে আটকে দেওয়ার প্রক্রিয়াটাই হলো ইনস্টলমেন্ট, যার সর্বশেষ ধাপ হলো গাছ লাগানো।
মেইনটেন্যান্স বা রক্ষণাবেক্ষণের এই ধাপে জংলা স্টুডিও নিজেই প্রথম তিন মাস নতুন প্রজেক্টের দায়িত্ব নিয়ে থাকে। কারণ, মাটি থেকে ভিন্ন মাধ্যমে গাছগুলো নেওয়ার ফলে নতুন পরিবেশ এবং আলোর সঙ্গে মানিয়ে চলার জন্য যত্নের দরকার পড়ে।
ক্যানভাস: এই উদ্যোগ যেহেতু বাংলাদেশে একেবারেই নতুন, তাই অবকাঠামোগত বা নীতিগত কোনো প্রত্যাশা আছে কি? মানে, কী করলে এ রকম অনেক উদ্যোক্তার জন্য আগামীর পথটা সহজ হতে পারে?
মারজিয়া: এই জিনিসটা আমাকে আসলে ভাবায়নি কখনো। সেটা হতে পারে নিজে নিজে খেটে কোনো প্রত্যাশা না রেখে নিজের বুদ্ধির ধারেই সব গুছিয়ে এনেছি বলে। আবার অন্যদিক থেকে দেখলে এই পুরো প্রক্রিয়াটা ভীষণ ব্যয়বহুল। অনেক কিছুর প্রয়োজন হয় এর জন্য। একটা প্ল্যান্ট প্যানেল, স্ট্রাকচার প্যানেল, এরপরে ইরিগেশন কীভাবে হবে, সেন্সর কীভাবে দেওয়া যেতে পারে, তারপরে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা– এই সবকিছু মিলিয়ে প্রজেক্টটা নিজে থেকেই অনেক খরচের পর্যায়ে চলে যায়। তাই সবার বেশ পছন্দ হলেও সাধ্যে কুলিয়ে উঠতে পারেন না। এই প্রতিবন্ধকতাও হয়তো কাটিয়ে ওঠা যাবে আরও চর্চা আর প্রযুক্তিগত প্রগতির মাধ্যমে।
ক্যানভাস: ব্যয়বহুল হলেও বিশ্বজুড়ে সবুজ দেয়াল ব্যবহারের জনপ্রিয়তা কম নয়, এটা কেন?
মারজিয়া: কারণটা খুব সহজ। বিপণনের দিক থেকে অনেক পরিসংখ্যান গবেষণা আছে সবুজ দেয়াল ব্যবহারের, যা আমি বলছি না। সেটা একেবারেই বাণিজ্যিক চিন্তা। কিন্তু আরও সংবেদনশীল কতগুলো জায়গা আছে, সেগুলোকেই প্রাধান্য দিয়ে বুঝিয়ে বলি।
প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে আমাদের ঘর এবং কমার্শিয়াল ভবনগুলো কিন্তু বাইরের চেয়ে অভ্যন্তরীণ দিক থেকে বেশি দূষিত। একে ‘সিক বিল্ডিং সিনড্রোম’ বলে। নাসার গবেষণায় দেখা গেছে, সবুজ দেয়াল ব্যবহারের ফলে এসব দূষণ কমে যায়। অর্থাৎ ফরমালডিহাইড, কার্বন মনোক্সাইড, ভিওসি, টলুইন ইত্যাদি শোষণ করে দূষণ কমায়।
দিন দিন আমরা দেখতে পাচ্ছি গ্রামের চেয়ে শহরের তাপমাত্রা বাড়ছে। সবুজ দেয়ালের প্রয়োগ এই তাপমাত্রা কমিয়ে জীববৈচিত্র্য বাড়াতে সহায়তা করে এবং কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে আনে। ২০ বর্গমিটারের সবুজ দেয়াল যে পরিমাণে কার্বন শোষণ করে, তা একটি মাঝারি আকারের গাছের সমান।
সবুজ দেয়ালের পুরুত্ব শব্দ, তাপ, কম্পন শোষণ করে যা মানুষ ও পরিবেশের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। ৬-৮ ইঞ্চি স্তরের সবুজ দেয়াল ১০ ডেসিবেল পর্যন্ত শব্দ দূষণ কমাতে সক্ষম। আর এই তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে এনার্জি কম খরচ হয়, তাই বাসার বিদ্যুৎ বিলও কমে আসে।
দেখা গেছে, স্কুলে ছেলেমেয়েরা মনোযোগী হয়ে ওঠে, কমার্শিয়াল ভবনের কর্মীরা চাপ অনুভব করেন না, হাসপাতালে রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন, ঘর গৃহস্থালির মানুষজনের স্নায়ু শীতল থাকে।
ক্যানভাস: এই গাছগুলো জোগাড় করেন কী করে?
মারজিয়া: আপাতত নার্সারি থেকেই করি। আলোর ওপর সম্পূর্ণটা নির্ভর করছে যে কী গাছ সেখানে ব্যবহার করা যাবে। তবে নিজের একটা নার্সারি করার চিন্তা আছে। আশা করি এ বছরের শেষের দিকেই সেটা হয়ে যাবে।
ক্যানভাস: আপনার ক্লায়েন্টদের নিয়ে একটু বলবেন, মানে ঠিক কারা এই সুবিধা নিচ্ছেন?
মারজিয়া: সাধারণত বহুজাতিক কোম্পানির হেডকোয়ার্টার, ব্যাংক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভবন, আবাসিক ভবন, সীমানাপ্রাচীর কিংবা বাসার ভেতরে নানা জায়গায় সবুজ দেয়াল ব্যবহার করতে চান, এ রকম ক্লায়েন্ট বেশি পেয়ে থাকি।
ক্যানভাস: অনেক ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।
মারজিয়া: ধন্যবাদ জুঁই। এবং ক্যানভাসকে অনেক ধন্যবাদ এ রকম একটি উদ্যোগকে সবার সামনে আনার জন্য।
https://web.facebook.com/jonglastudio
www.jonglawall.com
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top