skip to Main Content

আলাপন I বলিউডকে বেছে নিলে নিজের মতো বাঁচতে পারতাম না -সব্যসাচী চক্রবর্তী

 

ফেলুদা চরিত্রটিকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের পর তিনিই জনপ্রিয় করেছেন। চলচ্চিত্র ও মঞ্চের প্রখ্যাত অভিনেতা। ফটোগ্রাফারও। ছবি তোলার জন্য ছুটে যান অরণ্যে। সম্প্রতি এসেছিলেন ঢাকায়। ছবির শুটিংয়ে। এই শিল্পীর সঙ্গে আলাপচারিতায় অতনু সিংহ

ক্যানভাস: আপনি বাংলাদেশের পরিচালক ফখরুল আরেফিন খানের ছবি ‘গন্ডি’তে অভিনয় করছেন। এ বিষয়ে জানতে চাই।
সব্যসাচী: পরিচালক প্রথমে ফোনালাপে এই ছবির বিষয়ে বলেছিলেন। তারপর উনি কলকাতায় গিয়ে গল্পটা শোনান। জানতে পারি যে ছবির আখ্যান প্রকাশিত একটি গল্প থেকে নেওয়া হয়েছে। গল্পটা শুনেই ভালো লেগে যায়। তা ছাড়া কোনো ছবিতে অভিনয় করার ক্ষেত্রে আমি দেখি পরিচালক মানুষ হিসেবে কেমন। ফখরুল আরেফিন খানকে সেই জায়গা থেকেও আমার পছন্দ হয়। গন্ডি ছবির গল্পটা হচ্ছে বন্ধুত্বের সম্পর্কবিষয়ক। বন্ধুত্ব কোনো বয়সের শর্ত মানে না। মানে না কোনো সামাজিক বেড়া। এই ছবিতে এমন একজন প্রবীণ ব্যক্তির চরিত্রে আমি অভিনয় করেছি, যিনি স্মৃতিভ্রমের রোগে ভুগছেন। এই অবস্থায় একজন প্রবীণার সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়, যার স্বামী নেই। দুজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তারা বাইরে বেড়াতে যায়। ফিরে এসে ওই ব্যক্তি আবার স্মৃতি হারিয়ে ফেলে। অন্যদিকে এই দুজন মানুষের বন্ধুত্বকে তাদের সন্তানেরা ভালোভাবে নিতে পারে না। নিছক বন্ধুত্বের ভিন্ন অর্থ তৈরি করে, বন্ধুত্বের সম্পর্কের ভিন্ন নাম দিতে চায়। এই আরকি! ছবিতে বলা হচ্ছে, ফ্রেন্ডশিপ হ্যাজ নো বাউন্ডারি।
ক্যানভাস: বাংলাদেশে কোন কোন অভিনয়শিল্পী ও পরিচালককে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?
সব্যসাচী: সত্যি কথা বলতে বাংলাদেশে এ মুহূর্তে যারা অভিনয় করছেন, বা পরিচালনা করছেন কিংবা প্রযোজনা করছেন, সবাইকে চিনি না। তবে এটুকুই বলতে পারি, এখানে গুণী মানুষের অভাব নেই। রিসোর্সের অভাব হয়তো রয়েছে। যেখানে মার্কেট বেশি, সেখানে বেশি টাকা ঢালা হয়। তাই এখানের কলকাতার সিনেমায় বেশি বিনিয়োগ হয়। আবার কলকাতার চেয়েও মুম্বাইতে আরও বেশি, আবার মুম্বাই থেকে ক্যালিফোর্নিয়ায় অনেক বেশি। বলা যেতে পারে, এখানে যদি আরেকটু বেশি ফান্ডিং হয়, তাহলে এখানে যারা ভালো কাজ করছেন, তারা আরেকটু সুযোগ পাবেন। কলকাতাতেও এমন অনেকে রয়েছেন যারা ভালো ছবি করতে পারেন কিন্তু প্রডিউসার পান না। এখানকার অনেকেই আমার ভালো বন্ধু। এই ছবির সুবাদে সুবর্ণা ম্যামের সঙ্গে পরিচয় হলো। বন্ধুত্ব হলো। সুবর্ণা মুস্তাফার কাজ দেখে আসছি অনেক আগে থেকেই, কিন্তু পরিচয় ছিল না। এ ছাড়া এখানকার জাকির আমার খুব কাছের মানুষ, সে আমার ছেলের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। ফেরদৌস আমার ভালো বন্ধু, জয়া আমাদের ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। এখানকার অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে এমন অনেকেই আছেন। তারা শুধু প্রপার সুযোগটা পেলেই হয়। যেমন জয়া অনেক ভালো ভালো কাজের সুযোগ পেয়েছেন। এ ছাড়া এখানে ভালো পরিচালক ও টেকনিশিয়ানরাও রয়েছেন। তাদের ক্ষেত্রেও আরেকটু সুযোগ দরকার।
ক্যানভাস: তার মানে, আপনি বলছেন, বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সম্ভাবনা রয়েছে?
সব্যসাচী: হ্যাঁ, আমি সেটাই বললাম যে বাংলাদেশের ইন্ডাস্ট্রির প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। এই সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হলে কিছু মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। একটা কথা তো ঠিক, বাংলাদেশের জিডিপি গ্রোথ প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর সুবাদে বাংলাদেশের পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রচুর বিনিয়োগ হচ্ছে, ফান্ড আসছে। এ কারণে আমরা এটা আশা করতেই পারি যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূত্রে বাংলাদেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতেও আগামী দিনে বিনিয়োগ বাড়বে। সেই দিক থেকে কলকাতার তুলনায় ঢাকার ইন্ডাস্ট্রির আগামীর সম্ভাবনা বেশি বলেই মনে করি।
ক্যানভাস: ফেলুদা চরিত্রে সৌমিত্র এবং আপনি অভিনয় করেছেন। পরের প্রজন্মও সেটি করেছে। বাংলাদেশেরও একজন তাতে আছেন। পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের কেমন লেগেছে?
সব্যসাচী: দেখুন, অভিনয় চাইলে সবাই করতে পারে। ফেলুদা চরিত্রেও যে কেউ তা পারবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, মানুষ কাকে পছন্দ করছেন সেই ব্যাপারটা। আমায় যে ফেলুদা চরিত্রে মানাবে, সেটাই বিশ্বাস করিনি। মনে হয়েছিল, মানুষ বলবে, একে মানাচ্ছে না, কিন্তু হলো তো উল্টো। মানুষ ভালোভাবেই গ্রহণ করল। ঠিক তেমনই আমার পরবর্তী প্রজন্মের যেসব শিল্পী ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করছেন, তাদেরকেও তো মানুষ গ্রহণ করেছে। এখন আপনি যদি রেটিং করতে বলেন, কে কত ভালো, সেটা আমি পারব না। এটা পরিচালক আর দর্শকদের ওপরেই ছেড়ে দেব। কলকাতার আবীর চট্টোপাধ্যায় ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় আমার পরে ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আমার মনে হয়, শুধু তারাই নয়, ফেলুদা চরিত্রে আরও অনেকেই ভালো কাজ করতে পারেন। যেমন ধরুন, টোটা রায়চৌধুরী কিংবা ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। মোটকথা, ফেলুদা চরিত্রটির যে ব্যক্তিত্ব, যে গাম্ভীর্য রয়েছে, সেটা থাকতে হবে। তাহলেই চরিত্রে কাজ করা সম্ভব। মনে রাখতে হবে, চরিত্রটি শিক্ষিত, মার্জিত এবং যথেষ্ট জ্ঞানী-গুণী। সেই অনুযায়ী অভিনয়টা করতে হবে।
ক্যানভাস: সত্যজিতের ফেলুদা এবং সুনীলের কাকাবাবু—এই দুটি চরিত্রেই আপনি অভিনয় করেছেন। তুলনামূলকভাবে কোন চরিত্রটি বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছে?
সব্যসাচী: অবশ্যই ফেলুদা। কারণ, কাকাবাবু তো গোয়েন্দা নয়; বরং অ্যাডভেঞ্চারিস্ট। চরিত্রটি নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে অ্যাডভেঞ্চার করে বেড়ায়, তার মধ্যে হয়তো ছোটখাটো তদন্তটদন্তও করতে হতে পারে।
ক্যানভাস: কাকাবাবু চরিত্রটি সঙ্গে আপনার ব্যক্তিজীবনের বেশ কিছু মিলও তো রয়েছে!
সব্যসাচী: হ্যাঁ, দেশ-বিদেশে নানা জায়গায় ঘুরতে আমারও ভালো লাগে। অচেনা জায়গা খুঁজে বের করা, সেখানে যাওয়া—এগুলো আমার রয়েছে। কিন্তু আমার সঙ্গে ফেলুদার বেশি মিল।
ক্যানভাস: কলকাতা দূরদর্শনের শুরু থেকেই আপনি টেলিভিশন ফিকশনে অভিনয় করেছেন। যেগুলোকে আমরা স্পনসরড প্রোগ্রাম বলতাম। আগেকার টেলিভিশন নাটক আর আজকের মেগাসিরিয়ালের মধ্যে বিরাট কিছু মৌলিক ফারাক তৈরি হয়েছে। আজকের মেগাসিরিয়ালের প্যাটার্নের নিরিখে ফারাকটা আপনি কীভাবে দেখেন?
সব্যসাচী: আগের দিনে যখন স্পনসর প্রোগ্রাম হতো, তখন প্রডিউসারের তরফে দূরদর্শন বা সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের কাছে প্রোপোজাল দেওয়া হতো। চ্যানেল কর্তৃপক্ষ সেটা বিবেচনা করে অ্যাপ্রুভ করত। তারপর সেটা পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার, ক্যামেরাম্যান, এডিটর প্রমুখের সৃষ্টি হিসেবে তৈরি হতো। এখন আর সেটা হয় না। এখন চ্যানেল প্রোপোজাল দেবে, চ্যানেল গল্পটল্প সব ঠিক করে দেবে। পরিচালক কেবল ক্যামেরা পজিশন ঠিক করার মতো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। শিল্পকে করপোরেটাইজ করাটাই এখনকার কাজের বৈশিষ্ট্য। আমি বলব, আর্ট যদি করপোরেটাইজ হয়ে যায়, তাহলে আর্ট থাকে না, অন্য কিছু হয়ে যায়। এখন যদি কোনো মেগাসিরিয়ালের স্পনসর শ্যাম্পু হয়, তাহলে দেখবেন সব কটা নারী-চরিত্রের চুল খোলা, আবার স্পনসর কোনো জুয়েলারি কোম্পানি হলে, দেখবেন সব নারী চরিত্র গয়না পরে আছে! জামাকাপড়ের ব্র্যান্ড যদি স্পনসর হয়, তাহলে দেখবেন চরিত্রের পোশাক বদলে যাচ্ছে দ্রুত। সিরিয়ালে যারা পয়সা দিচ্ছে, তাদের হয়ে ব্র্যান্ডের প্রমোশন করে যেতে হবে! কাজেই আর্ট যখন একটা পণ্যের জায়গায় চলে যায়, তখন শিল্পটা মার খায়। আগেকার টেলিভিশন নাটকের থেকে আজকের টিভি সিরিয়ালে আর্ট কম, পণ্য বেশি। এখন কলকাতার সিরিয়ালে দেখবেন, বাড়ির মহিলারা বেনারসি শাড়ি আর গয়না পরে ঘুমাচ্ছেন। আবার তাদের মুখে চড়া মেকআপ! আমাদের বাস্তব জীবনে তো এমন হয় না। টেলিভিশনে হয়। এমনকি কিছু সিনেমাতেও। তাই এগুলো আর শিল্প নেই। লোকে হয়তো আজকাল এমনটাই চাইছেন। কাজেই এসবের বিচার করার আমি কেউ নই। দর্শক যা চাইবে, তা-ই হবে। যেমন হঠাৎ দেখা যাচ্ছে, পৌরাণিক কাহিনির ওপর টেলিভিশনের অডিও-ভিজ্যুয়াল খুব জোর দিচ্ছে। প্রাইভেট টিভি চ্যানেল দর্শকের রুচি অনুযায়ী চলবে, সেটা স্বাভাবিক। আবার এটাও ঠিক যে পণ্যের নিরিখে তারাও দর্শকের রুচি তৈরি করে দেয়।
ক্যানভাস: শিল্পের পণ্যায়নের প্রসঙ্গে কথা উঠল। পণ্য, বাজার, ক্রেতা-ভোক্তা, পুঁজি—এই বিষয়গুলো শিল্পের নান্দনিক বিবেচনার ক্ষেত্রে যুক্তও করলেন। আমরা জানি, আপনি রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি এবং শিল্পী। তো নিজেকে একজন মার্ক্সিস্ট মনে করেন কি?
সব্যসাচী: মার্ক্সিস্ট হিসেবে নিজেকে যে মনে করব, অত পড়াশোনা আমার নেই। আমি রাজনৈতিক আবহে বেড়ে ওঠা একজন মানুষ। কারণ, আমার বাবা-মা, পিসেমশাই—এঁদের কাছ থেকে আমি নাটকের কাজকর্ম শিখেছি। তাঁরা সবাই মঞ্চনাটক বা গ্রুপ থিয়েটার করতেন। প্রত্যেকেই বামপন্থায় বিশ্বাসী ছিলেন। আমি তাঁদের সঙ্গে মঞ্চে কাজ করার সুবাদে মানুষ চেনা শিখেছিলাম। একসময় আমার এমন মনে হতে লাগল যে যারা ভালো মানুষ, তারা বামপন্থায় বিশ্বাস করেন।
ক্যানভাস: আপনি একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাস করেন, তার নিরিখে আপনার শিল্পবোধ তৈরি হয়েছে। এই মতাদর্শের দিক থেকে আপনাকে কাজের জায়গায় কতটা কম্প্রোমাইজ করতে হয়?
সব্যসাচী: যেহেতু একটা সিস্টেমের মধ্যে অবস্থান করে আমার পেশাজীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাই, সেহেতু কম্প্রোমাইজ করতেই হয়। এটা না করলে তো এই সিস্টেম আমায় খাওয়া-পরার জোগানটুকুও দেবে না। তবে নিজের রুচি, পরিবারের সম্ভ্রম—এগুলো যতটা সম্ভব বজায় রেখে যতটুকু আপোস করতে হয়, সেটা করি।
ক্যানভাস: মঞ্চ, টেলিভিশন ও সিনেমা—তিনটি মাধ্যমেই আপনি অভিনয় করেছেন। কোনটিতে বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন?
সব্যসাচী: দেখুন, টেলিভিশন আর সিনেমা হচ্ছে আমার পেশা, জীবিকা; থিয়েটার হচ্ছে নেশা। টেলিভিশন ও সিনেমা থেকে আমি টাকাপয়সা উপার্জন করি। আর থিয়েটারে পয়সা ঢালি। থিয়েটার হচ্ছে আমার স্কুল, আমার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখান থেকে অভিনয় শিখেছি। সিনেমা এবং টেলিভিশনে সেটা কাজে লাগিয়েছি। থিয়েটার এখনো ছাড়িনি।
ক্যানভাস: থিয়েটারের সঙ্গে আপনার যুক্ত হওয়াটা পারিবারিক সূত্রে, তাই তো?
সব্যসাচী: একেবারেই। আমার পুরো পরিবার নাটকের সঙ্গে যুক্ত। খুব ছোটবেলা থেকেই বাড়িতে নাটকের কাজকর্ম চলতে দেখেছি। বাবা জগদীশ চক্রবর্তী, মা মনিকা চক্রবর্তীসহ আমাদের নিকটাত্মীয়দের অনেকেই গ্রুপ থিয়েটারের লোক। আমি এবং আমার বোন নাটকের সেট-প্রপসের ট্রাঙ্কের ওপর বসে শৈশব কাটিয়েছি। তাই নাটকের লোকেদের আশৈশব খুব কাছ থেকে দেখেছি। তাদের অধ্যবসায়, তাদের চিন্তা-চেতনা, রাজনীতি-সচেতনতা ভালো লেগেছে। তাদের প্রতি মুগ্ধতা বোধ কাজ করেছে। কিন্তু আমি যে অভিনেতা হবো, কখনো সেটা ভাবিনি। এমনকি অভিনেতা হওয়ার ইচ্ছাটাও ছিল না। ইচ্ছা ছিল টেকনিক্যাল কাজ করার, যেমন সেট, লাইট, সাউন্ড, কস্টিউম—এসব নিয়ে কাজ করতে চাইতাম। এগুলো আগেও করেছি, এখনো করি। আমায় জোর করে অভিনয় করানো হয়েছিল। আমায় বাড়ি থেকে বলা হলো, মঞ্চের পেছনে টেকনিক্যাল কাজ করার মতো অনেক ভালো ভালো লোক আছে, কিন্তু অভিনয়ের মানুষ কম। তাই অভিনয় করতে বলা হলো। আমি মনে করি, অভিনয় করার জন্য যেসব গুণ দরকার, সেগুলো আমার মধ্যে কমই রয়েছে। তবু যে লোকে কেন আমায় পছন্দ করে, সেটাই বুঝি না।
ক্যানভাস: বলিউডের বেশ কিছু ছবির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে আপনাকে দেখা গেছে। তারপরেও আপনি বলিউডকেন্দ্রিক হয়ে যাননি। আপনার কি বলিউডের ব্যাপারে কোনো অনীহা রয়েছে?
সব্যসাচী: আমি একজন বাঙালি। আমার মাতৃভাষা বাংলা। আমি আমার মাতৃভাষায় কাজ করাটাকেই বেশি প্রাধান্য দিই। মনে রাখতে হবে, আমার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। শহর কলকাতা। কাজের ক্ষেত্রে আমার ভাষা, সংস্কৃতিকেই বেশি গুরুত্ব দেবো, এটাই স্বাভাবিক। কলকাতা ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না। পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে মাটির ভাঁড়ে চা না খেলে আমার হজম হবে না। বন্ধুদের সঙ্গে আমি জঙ্গলে বেড়াতে না গেলে আমি বাঁচবই না। কাজেই এগুলো মুম্বাইতে গেলে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তাই মুম্বাইয়ের লোক হয়ে যাইনি। আমি যেখানকার মানুষ, যে ভাষার মানুষ; সেখানেই কাজ করছি। বোম্বে গেলে এমন হবে যে হাতে প্রচুর কাজ কিন্তু আমার ছেলের সঙ্গে লাস্ট কবে দেখা হয়েছে, সেটাই বলতে পারব না। এটা কখনোই চাই না। সুস্থ ও সাধারণ মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই। আমার সবচেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে, অভিনেতা হওয়ার জন্য কোনো বইমেলায় যেতে পারি না, চিড়িয়াখানায় যেতে পারি না। তবে এর পরেও নিজের কাজের বাইরে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সুখ-দুঃখ মিলিয়ে বাঁচতে পারি। মুম্বাই গেলে এটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না। একেই পণ্য হয়ে গেছি, মুম্বাই গেলে নিজের আর কিছুই থাকবে না।
ক্যানভাস: পণ্য কেন হবেন! আপনি তো শিল্পী!
সব্যসাচী: শিল্পী আর হতে পারছি কই! কোন জিনিসটা করলে বেশি বিক্রি হবে, সেই দিকেই তো আমায় ফেলে দেওয়া হচ্ছে। এই যে অভিনয়শিল্পীদের একজনের সঙ্গে অন্যের রেষারেষি, কে কত ভালো তা নিয়ে—এসব আমার মোটেও ভালো লাগে না। কার ছবি কত জনপ্রিয় হচ্ছে, সিনেমা হলে কার ছবি দেখতে লোকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সেই হিসাবে তার মূল্যায়ন—এসবের মধ্যে আমি থাকতে চাই না। এসব ভাবার জন্য বা এসবের পার্ট হওয়ার জন্য অভিনয়ে আসিনি।
ক্যানভাস: অভিনয়শিল্পী ছাড়াও আপনার আরেকটি পরিচয় হলো, আপনি ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার। তো আজকের এই বিশ্ব উষ্ণায়নের যুগে ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফিতে পরিবেশ-সচেতনতার দিকটি কতটা প্রাসঙ্গিক?
সব্যসাচী: অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। পরিবেশ-সচেতনতার জায়গা থেকেই আমি ফটোগ্রাফি করতাম। এখনো তাই করি। আমি হচ্ছি সেই লাখ লাখ মানুষের মধ্যে একজন, যারা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, প্রগতি মানে গাছ কেটে রাস্তা তৈরি করা নয়। কারণ, গাছ না থাকলে আমাদের অক্সিজেন কে দেবে? আমরা কি কাঁধে করে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে ঘুরব? গাছপালা না থাকলে মানুষ কি টাকা খেয়ে-পরে বাঁচবে? অতএব এটা খুব সহজ বিষয় যে পরিবেশ বিপন্ন হলে আমরা বাঁচতে পারব না। যেভাবে ইভল্যুশন হয়েছে, তাকে যদি আমরা উল্টো দিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি, তাহলে পৃথিবীই আর থাকবে না। এগুলোই মানুষকে বোঝাতে চেষ্টা করি। তবে একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার বলতে যা বোঝায়, আমি তা নই। কারণ, তার জন্য যেসব এক্সপার্টিজ প্রয়োজন, আমার তা নেই। আমি একজন ট্যুরিস্ট উইদ ক্যামেরা। খুব দামি দামি ক্যামেরা ব্যবহার করেছি, এখনো করছি। কিন্তু সেগুলো তো ধার করা। নিজের নয়। ওসব কেনার ক্ষমতা নেই। নিকন কোম্পানি থেকে আমায় ক্যামেরা ধার দেওয়া হয়। ছবি তুলে ক্যামেরা ফেরত দিই। ছবিগুলো অবশ্য মাঝেমধ্যে কোথাও না কোথাও প্রকাশিত হয়।

ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top