skip to Main Content

আলাপন I ‘বাংলাদেশের মানুষের আত্মীয়তা আমায় মুগ্ধ করে’ – মীর আফসার আলি

 

কলকাতার বাংলা এফএম রেডিও চ্যানেলের টক শো থেকে পশ্চিমবঙ্গে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন মীর। পুরো নাম মীর আফসার আলি। মীরাক্কেলের মতো টেলিভিশন শো থেকে শুরু করে টেলিভিশনে ও চলচ্চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ একজন সঞ্চালক আর অভিনেতা হিসেবে দুই বাংলার দর্শক-শ্রোতার কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। হিউমার, কমেডি, পলিটিক্যাল স্যাটায়ার এবং অভিনয়ে পটু মীর আজ খ্যাতির চূড়ায়। তাঁর পেশা, শিল্প আর ব্যক্তিজীবন- সব বিষয়ে আলাপ করেছেন অতনু সিংহ

ক্যানভাস: আকাশবাণী ভবন ও বাংলাদেশ রেডিওর পুরোনো বেতার উপস্থাপনার যুগের বাঁকবদল ঘটেছে এফএমের হাত ধরে। এই বাঁকবদলকে কীভাবে দেখেন?
মীর: আমার মনে হয়, একেকটা সময়ে তো একেকটা ধারা আসে এবং মানুষ যেভাবে একে অপরের সঙ্গে কমিউনিকেট করেন, কথা বলেন, সেই বিষয়গুলো মাথায় রেখে আমরা বেতার উপস্থাপনা বা আরজেয়িংয়ের স্টাইলে রূপান্তর ঘটিয়েছি। আমার মনে হয় গণমাধ্যমে, বিশেষ করে বেতার বা রেডিওতে উপস্থাপনার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে খুব স্বাভাবিক পদ্ধতিতে শ্রোতার সঙ্গে কমিউনিকেশন, অর্থাৎ আমরা দৈনন্দিন জীবনে যেভাবে কথাবার্তা বলি, বাক্যালাপ করি, ঠিক সেভাবেই শ্রোতার সঙ্গে কমিউনিকেট করা আর সেই কমিউনিকেশনের মধ্যে পারিপার্শ্বিক প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো নিয়ে আসা, অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে তার মতো করে গণসংযোগটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রকাশভঙ্গি খুব ভাবগম্ভীর হয়ে গেলে তা সাধারণ মানুষকে স্পর্শ করবে না, তার থেকে বরং মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে স্পর্শ করতে পারে এমন ভাবনাকে রেডিও উপস্থাপনায় নিয়ে আসাটা জরুরি। বিষয়টা এখন মাথায় রাখতে হচ্ছে। আগে রেডিওতে ফরমাল উপস্থাপনায় খুব চোখা চোখা তৎসম শব্দে কথাবার্তা বলা হতো, শ্রোতারাও সেভাবে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, কিন্তু সেই সব শব্দ আমরা রোজনামচার জীবনে প্রয়োগ করি না। সেগুলো হয়তো পড়তে খুব ভালো লাগতে পারে, কিন্তু ওইভাবে আমরা ভাবি না বা কথাও বলি না, বরং ওইভাবে কথা বলতে স্বাভাবিক জীবনে মানুষের বেশ খটোমটো লাগে। ওইগুলো আমরা সাধারণত এড়িয়ে যাই। ব্যক্তিগতভাবে আমিও সেটা পছন্দ করি, যে রোজকার জীবনে আর পাঁচটা মানুষের সঙ্গে যেভাবে কথা বলি, সেভাবেই রেডিওতে কথা বলে যাওয়া আর সেই জিনিসটাকেই আমার একটা স্টাইল বানানো। এটা যেকোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব, যদি তিনি নিজস্বতা বজায় রাখেন। কাউকে অনুসরণ কেউ করতে পারেন কিন্তু অনুকরণ করতে গেলে বিষয়টা কিন্তু ঘেঁটে যাবে। যেমন ধরুন, যখন কেউ রান্না করেন তখন তার রান্নায় নিজস্বতাই তো লোকে খোঁজে, রান্নায় কেউ একটু বেশি ঝাল দিলো কি না, কারও রান্নায় সরষে বেশি পড়লো কি না, জিরা কেমন দেওয়া হলো…কিন্তু রেসিপি পড়ে হুবহু সেটা টুকে দিলে সব রান্নাই একরকম। তো রান্নায় আলাদা কী স্বাদ হতে পারে, নিজস্বতা কী থাকতে পারে, সেটার মতোই আমাদের রেডিও উপস্থাপনার স্টাইল। এই স্টাইলটায় এখন একটু বদল এসেছে, কিন্তু মানুষের সেটা ভালো লেগেছে। আলাদা হাতি-ঘোড়া-পালকি আমরা কিছুই করছি না, খুব স্বাভাবিক-সাবলীলভাবেই আমরা কথা বলার চেষ্টা করছি।
ক্যানভাস: এ মুহূর্তে দুই বাংলার মেট্রোসিটিগুলো যেভাবে কসমোপলিটান হয়ে উঠেছে, সেই প্রেক্ষাপট রেডিও উপস্থাপনায় প্রভাব ফেলেছে, তাই কি?
মীর: হ্যাঁ, এটার একটা বড় প্রভাব এফএম চ্যানেলগুলোতে পড়েছে।
ক্যানভাস: কিন্তু এফএম চ্যানেলগুলোর আবির্ভাবের প্রথম দিকে আপনারা যারা সেখানে উপস্থাপনা বা রেডিও জকির (আরজে) কাজ শুরু করেছিলেন, তখন খুব সাবলীল ও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, এমন স্টাইলে কথাবার্তা বলা শুরু করলেও, আজকের প্রজন্মের আরজেরা বাংলা কথার ভেতরে ইংরেজি ও হিন্দি ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। ঢাকার এফএম চ্যানেলগুলোয় উপস্থাপক বা আরজেদের উপস্থাপনায় দেখা যাচ্ছে বাংলার ভেতরে অজস্র ইংরেজি আর কলকাতার বাংলা এফএম চ্যানেলে আরজেদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাংলার থেকে তারা হিন্দি ও ইংরেজিতে কথা বলতে বেশি সাবলীল। এই বিষয়ে কী বলবেন?
মীর: ঠিকই বলছেন। বিষয়টা আমাদের কাছে পীড়াদায়ক তো বটেই, বেদনা হয় এটা দেখে। বাংলা একটা সমৃদ্ধিশালী ভাষা, জনপ্রিয় ভাষা। বাংলা ভাষা নিয়ে দুই বাংলার মানুষেরই অনেক গর্ব। বাংলা ভাষার জন্য বাংলাদেশে মানুষ শহীদ হয়েছেন। ঢাকায় শহীদ মিনার রয়েছে। আমার একটা জিনিস মনে হয়, আমাদের আজকের প্রজন্মের যুব সমাজ হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুক-ইউটিউব জেনারেশন হয়ে গেছে। আমরা এখন লিখি না, সব সময় টাইপ করি, ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে টাইপ করি, একটা ভাষা হাতে-কলমে লেখার মধ্যে মজা আছে, আমরা ছাত্রাবস্থায় শুনতাম যে যা আমরা পড়ছি তা যদি লিখে লিখে পড়ি, তাহলে সেই পড়াটাকে খুব সহজেই স্মৃতি ধারণ করতে পারবে, ঠিক তেমনই হাতে-কলমে লেখার মধ্যে একটা আলাদা জাদু আছে, সেই লেখার অভ্যাস চলে গেছে বলে আমরা যেভাবে চারপাশের কথা শুনছি সেভাবেই টাইপ করছি! তাই বক্তব্যের মধ্যে, কথার মধ্যে এমন অনেক অবাঞ্ছিত শব্দ ঢুকে পড়ছে, যেগুলো আমাদের পরিচিতি বা আইডেন্টিটিকে ধারণ করে না। তবে এটাও ঠিক, ভাষার এগিয়ে যাওয়াটাও রাস্তার মতোই। ভিড় রাস্তায় বাসও চলছে, ট্যাক্সি চলছে, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলছে, রিকশা চলছে, যখন যেটায় চড়তে আপনি আরাম বোধ করবেন তখন সেটায় চড়বেন। কিন্তু একটা কথা মাথায় রাখা জরুরি, রাস্তায় অতিরিক্ত যানবাহনের অপশন যেমন যানজট তৈরি করে, তেমনই ভাষার ক্ষেত্রে নিজের মূল জায়গাটা থেকে সরে গিয়ে নিজের ভাষার মধ্যে ঢুকে পড়া বাইরের ভাষার উপাদানকেই যদি আমি মূলত ফোকাস করে ফেলি, তাহলে সেটা হয় জগাখিচুড়ি ভাষা, নিজের ভাষাও এ ক্ষেত্রে থাকছে না আর অন্যের ভাষাকেও সেই ভাষার মতো করে জানা হচ্ছে না। সবকিছু মিশিয়ে খিচুড়ি তৈরি হচ্ছে- এমন বিষয় অবশ্যই বেদনার। আমরা তো এমনও দেখেছি, বাংলা মিডিয়ামের স্কুল থেকে পড়াশোনা করে জেলা থেকে বা গ্রামবাংলা থেকে শহরের এলিট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এলে, তাদের অনেককেই হেয় করা হয়েছে, ‘গেঁয়ো ভূত’ বলা হয়েছে। এটা যেমন কুৎসিত বিষয়, তেমনই যিনি বাংলা মিডিয়ামে পড়েছেন তাকেও এসব ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী হতে হবে, তিনি যে ভাষায় পড়াশোনা করেছেন, সেই ভাষাতেই যে বহু কিছুই করতে পারেন, এটা তাকেই বুঝিয়ে দিতে হবে। তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে তার শিক্ষা হয়েছে বিশ্বের একটি শ্রেষ্ঠ ভাষায়, যে ভাষাটার নাম ‘বাংলা’। আমাদের এফএম চ্যানেলে আরজে হওয়ার জন্য যারা অডিশন দেন, তাদের আমরা নানাভাবে টেস্ট করি। তারা ইংরেজিতে কত ভালো, বাংলায় কত ভালো, হিন্দিতে কত ভালো ইত্যাদি পরীক্ষা করি। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বেতারের একজন বাচিক শিল্পী অন্য কোনো ভাষায় বলতে পারলো কি পারলো না, তার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ নিজের ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারা, ভাব প্রকাশ করতে পারা। বাংলা এফএমের আরজে বা উপস্থাপকেরা মাতৃভাষায় নিজের চিন্তাচেতনার প্রকাশে সাবলীল হলে অন্য ভাষায় তাদের দক্ষ না হলেও চলে। তবে সৌভাগ্যবশত, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতা কিংবা বিভিন্ন ট্যালেন্ট শোতে আমি অনেক ক্ষেত্রে এটাও দেখেছি, বিচারকদের বেশির ভাগই ইংরেজিতে প্রশ্ন করলেও কোনো কোনো প্রতিযোগী এই ছক থেকে বেরিয়ে এসে বলছেন, আমি কিন্তু বাংলাতেই কথা বলবো, বাংলাতেই উত্তর দেবো। এসব ক্ষেত্রে সঞ্চালক বা বিচারক হিসেবে আমি ওই অনুষ্ঠানকে দারুণভাবে উপভোগ করেছি।
ক্যানভাস: একটা বিষয় লক্ষ করা যাচ্ছে যে সব ভাষা, সব ধর্ম, সব সংস্কৃতির সমানাধিকারের চেতনা ধারণ করে থাকা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে একটি ধর্মীয় পরিচিতিকে রাজনৈতিক মতাদর্শ বানিয়ে তা দিয়ে যেমন আধিপত্যবাদ নামিয়ে আনা হচ্ছে অপরের ধর্মের প্রতি, তেমনই হিন্দি ভাষার আধিপত্য কায়েম করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু ভারতের সংবিধানে কোনো রাষ্ট্রভাষার উল্লেখ নেই, সব ভাষার সমানাধিকারের কথা রয়েছে, এরপরেও অহিন্দি রাজ্যগুলোতে হিন্দি বলয় ও হিন্দি ভাষার যে আধিপত্য নেমে আসছে বলে নানা মহলে অভিযোগ উঠেছে, বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
মীর: হ্যাঁ, ভাষা নিয়ে যেটা হচ্ছে সেটা যে অবশ্যই একটা রাজনীতি, অনুভব করি। এ ব্যাপারে আমি একটা অন্য কথা বলবো, সোশিও-পলিটিক্যাল- এই শব্দটিকে যদি আমরা লক্ষ করি, তাহলে দেখি, সামাজিক ও রাজনৈতিক সেই বিষয়, যেখানে সমাজগঠনের লক্ষ্যে রাজনীতি পরিচালিত হয়। কিন্তু এখানে সমাজ ও রাজনীতি এই দুটি শব্দের মধ্যে সামঞ্জস্য ও ভারসাম্য বজায় রাখার বদলে রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডার মাধ্যমে আধিপত্যের জায়গা তৈরি হয়। ভাষার আধিপত্যের রাজনীতিটাকেও আমি এভাবেই দেখি। তবে এটাও বলবো, কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়া হলে সেটা কতটা মেনে নেওয়া হবে, তা জনগণের ওপরেই তো নির্ভর করে। এটাও খুব ইম্পর্টেন্ট।
ক্যানভাস: কলকাতার এফএম চ্যানেলের প্রথম দিকের বাচিক শিল্পী হিসেবে অথবা পরবর্তীকালে টেলিভিশন উপস্থাপক হিসেবে আপনার মধ্যে নানা সময় রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা লক্ষ করা গেছে, সেটা অবশ্যই হিউমার আকারে, স্যাটায়ারের আদলে। আপনার পরবর্তী প্রজন্মের অনেকে আরজে কিংবা কমেডি আর্টিস্টদের মধ্যেও এই সচেতনতা ছিল। কিন্তু ঠিক এই সময়ে এমন কিছু চোখে পড়ছে না। আচ্ছা, আজকের তরুণ প্রজন্ম কি সমাজ-রাজনীতিবিমুখ?
মীর: না, আমি তা মনে করি না। বরং আমার মনে হয়, আজকের তরুণ প্রজন্ম কথা বলার জন্য অন্য মাধ্যম খুঁজছে। আগে রেডিও, টেলিভিশনে অকপটে কথা বলা যেত। রাজনৈতিক মতাদর্শ যা-ই হোক না কেন, অন্তত নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকেও কিছু যে বলা যায়, এই ব্যাপারটায় ‘সেফ’ভাবে খেলতে গিয়ে কোথাও একটা কথা বলার বিষয়টার মধ্যেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ধরুন, একজন আরজে, তিনি তো দিনের শেষে একটি কোম্পানিরই প্রতিনিধিত্ব করছেন, তো সেই কোম্পানি যদি না চান যে তাদের আরজে জনসমক্ষে কোনো একটি বিষয়ে কথা না বলুক, তাহলে তো তাকে সেই কথা ভেতরে চেপে রাখতেই হবে। তাই আজকের তরুণ প্রজন্ম সোশ্যাল মিডিয়াকে বেছে নিয়েছে। কারণ, একভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় সেন্সরশিপ নেই, তাই নিজের মতামত বা চিন্তা সেখানে পেশ করা যায়। তাই আজকের ক্রিয়েটিভ জেনারেশন মুখ বন্ধ করে আছে তা নয়, বরং বিশেষ বিশেষ প্ল্যাটফর্মে মুখ খুলছেন।
ক্যানভাস: রেডিও, টিভি ও ফিল্ম- তিনটি মাধ্যমেই আপনি জনপ্রিয়, রেডিও থেকে ফিল্মের এই জার্নিতে আপনি নিজেকে কীভাবে পরিবর্তন করেছেন? কীভাবে তিনটি মিডিয়ামের মধ্যে ব্যালান্স করেন?
মীর: আমি আমার ক্রিয়েটিভ ট্যালেন্টকে চ্যানেলাইজ করি। যেমন আমাদের দৈনন্দিন খিদে আছে, কিন্তু সব খাবার আমি ব্রেকফাস্টেই খেয়ে নিই না। কেউই সেটা করে না। খাবার কিছুটা ব্রেকফাস্টের জন্য বাঁচিয়ে রাখি, কিছুটা লাঞ্চের জন্য, আবার কিছুটা ডিনারের জন্য। এভাবেই আমি পিসমিল ডিস্ট্রিবিউশনের মতো করে নিজের ক্যারিয়ারটাকে গড়ার চেষ্টা করেছি। সবটাই যে খুব সচেতনভাবে করেছি, তা নয়। কিছু জিনিস হয়েছে খুব স্বাভাবিকভাবে। আবার কিছু পরিকল্পনামাফিক হয়েছে। আমি আমার জীবনটাকে সেইভাবে কম্পার্টমেন্টালাইজ করেছি। কিন্তু একটার সঙ্গে অন্যটার লিঙ্ক রয়েছে। রেডিওতে কাজ না করলে আমি কোনো দিন টেলিভিশনে ঢুকতে পারতাম না, আর টেলিভিশনও অন্য মাধ্যমে আমায় এক্সপোজার দিয়েছে। আমি মানুষ একটাই, কাজগুলো খালি আলাদাভাবে করছি, যখন যেখানে থাকি তখন সেখানকার মতো করে নিজেকে বদলে নেওয়ার চেষ্টা করি, আদারওয়াইজ মূল কনটেন্ট, মূল বিষয়, মাথা- এটা কিন্তু একই থেকে যাবে।
ক্যানভাস: স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় বা তারপরে কখনো থিয়েটারে অভিনয় করেছেন?
মীর: একেবারেই নয়। বরং আমার মঞ্চভীতি ছিল। স্টেজে উঠে কিছু করার কথা আমায় যদি কেউ বলতো, ভয় লাগতো। ক্লাস ইলেভেন-টুয়েলভে এসে সেই ভয় অবশ্য কিছুটা ভেঙেছিল। কিন্তু তার আগ পর্যন্ত আমি প্রচন্ড নার্ভাস থাকতাম। বরং আমার অনেক বন্ধুকে দেখেই অনেকে বলতেন, এ তো বড় হয়ে নিশ্চয়ই থিয়েটার করবে বা টিভিতে কিছু করবে, সিনেমায় অভিনয় করবে, কিন্তু তারা এখন কোনো না কোনো সংস্থার ইঞ্জিনিয়ার, কেউ ম্যানেজিং ডিরেক্টর, কেউ অ্যাকাউন্টস দেখছে, কেউ ব্যবসা করছে… তাদের সঙ্গে ক্রিয়েটিভ ফিল্ডের সেভাবে আর কোনো সংযোগ নেই। আর আমার সঙ্গে এসবের কোনো সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু কাকতালীয়ভাবে নানা ধরনের মিডিয়ার সঙ্গে আমি যুক্ত এবং নানা রকম ক্রিয়েটিভ কাজে জড়িয়ে রয়েছি। এটা খুবই অদ্ভুত ব্যাপার, কিন্তু এসবে সত্যিই আমার তেমন আগ্রহ ছিল না এবং কোনো কনফিডেন্সও ছিল না।
ক্যানভাস: টেলিভিশন ও রেডিওতে আপনাকে প্রচুর কথা বলতে হয়। অনর্গল কথা বলে যেতে পারেন যেকোনো বিষয়ে। ছোটবেলায় কেমন ছিলেন? টকেটিভ নাকি লাজুক?
মীর: পরিবারের মধ্যে নিজেকে এক্সপ্রেস করতে পারতাম। কিন্তু বাইরে বা বন্ধুবান্ধবের মধ্যে সেটা অত বেশি নয়। সেদিক থেকে একটু লাজুক প্রকৃতির ছিলাম, স্কুলে আমি ব্যাকবেঞ্চার ছিলাম, আমি এগিয়ে এসে নিজে থেকে কোনো কিছু করতে যাইনি। বরং আমি সবকিছু লক্ষ করতাম। ছোটবেলা থেকেই আমি সবকিছু ভালোভাবে অবজার্ভ করতে পারতাম। কোন বিষয়কে কে কীভাবে নিচ্ছেন, কীভাবে রিঅ্যাক্ট করছেন, কথা বলছেন, একটা জায়গাতেই পাঁচটা আলাদা বন্ধু পাঁচভাবে কী রকম কথা বলছে- এসব খেয়াল করতাম। এই বিষয়টা পরবর্তী জীবনে অনেক হেল্প করেছে, আজকেও টেলিভিশন কিংবা রেডিওতে যেভাবে কনটেন্ট সাজাই, সেটা কিন্তু লোকজনকে অবজার্ভ করেই। মীরাক্কেলে আমার ছাত্রদেরও আমি এই কথাটাই বলি যে আলাদা করে জোকস ডাউনলোড করার কোনো দরকার নেই, বরং তুমি যদি তোমার চারপাশটা দেখো সেখানে এত ন্যাচারাল কমেডি পাবে যে সেটা নিয়ে বলতে বলতেই তোমার দিন ফুরিয়ে যাবে।
ক্যানভাস: আপনি তো কলকাতায় থাকেন বহুদিন ধরে। কিন্তু আপনার মূল বাড়ি কোথায়?
মীর: আজিমগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ জেলা।
ক্যানভাস: বাংলাদেশে ছবি করার কোনো অফার পেয়েছেন?
মীর: না, এখনো অবধি পাইনি। তবে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটা ইভেন্ট করেছি। অনেক দিন, অনেক বছর যাওয়াও হয়নি। যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে খুব শিগগির। তবে আমার একটা আক্ষেপের বিষয় আছে, সেটা হলো বাংলাদেশের ভিসা পাওয়ার চেয়ে ইউএসএর ভিসা পাওয়া সহজ হয়ে গেছে। আমি বারবারই দেখেছি, কোনো না কোনো কারণে আর্টিস্টদের ক্ষেত্রে আটকে যায়। আমার মনে হয় সুস্থভাবে, সুষ্ঠুভাবে, সহজভাবে যাতে আমাদের ট্যালেন্ট এক্সচেঞ্জ হতে পারে সেটা দেখা দরকার, যাতে এপার বাংলার লোক ওপারে গিয়ে কিছু করলো আর ওপার বাংলার লোকও এপারে এসে নানা ক্রিয়েটিভ কাজে যুক্ত হতে পারে, এটার জন্য নিয়মগুলো একটু শিথিল হওয়া দরকার। খেয়াল করে দেখেছি, মিডিয়ার ট্যাগ থাকলেই ভিসা পেতে অসুবিধা হয়। এই ব্যাপারটা শিথিল করা খুবই দরকার বলে মনে করি।
ক্যানভাস: বাংলাদেশে তো আপনি আগে বহুবার গেছেন। বাংলাদেশকে কেমনভাবে দেখেন?
মীর: বাংলাদেশের সিনেমা, সাহিত্য, সংগীত- এসবই আমার কাছে খুবই ভালো লাগার জিনিস। কিন্তু বাংলাদেশের প্রধান যে জিনিসটা, সেটা হচ্ছে মানুষের হৃদয়, তাদের আত্মীয়তা। এখান থেকে কোনো মানুষ বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে এক সপ্তাহ থেকে যদি ফেরেন, তাহলে আরামসে তিনি তার ওজন অন্তত পাঁচ কিলোগ্রাম তো বাড়িয়ে ফিরবেনই, যেভাবে ওখানে খাওয়ানো হয়, খাতিরদারি করা হয়…এর মানে এই নয় যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ খাওয়াতে পছন্দ করেন না, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা এতটাই উষ্ণ যে মনে হবে ওখানকার খাবারে এক্সট্রা কার্বোহাইড্রেট, এক্সট্রা মিনারেল, এক্সট্রা প্রোটিন রয়েছে। এটা ঠিক বলে বোঝানো সম্ভব নয়, আত্মীয়তার পাশাপাশি অদ্ভুত হৃদ্যতা রয়েছে ওখানকার মানুষের, সেটা ম্যাজিকের মতো কাজ করে, বাংলাদেশে গেলে অটোমেটিক্যালি মন ভালো হয়ে যায়। আমি ঢাকার ট্রাফিক জ্যামে বেশ কয়েকবার ফেঁসেছি। কিন্তু জ্যাম কাটিয়ে শেষমেশ যখন গন্তব্যে পৌঁছে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খেতে বসেছি, ইনস্ট্যান্টলি মুড চেঞ্জ হয়ে গেছে। আমি বিরাটভাবে খাদ্যরসিক, খাওয়াদাওয়ার প্রতি আমার বিশেষ একটা দুর্বলতা রয়েছে, আর বাংলাদেশের খাবারের প্রতি তো সেটা রয়েছেই।
ক্যানভাস: বাংলাদেশের কোন ধরনের খাবার বেশি পছন্দ করেন?
মীর: বিরিয়ানি খুবই ফেভারিট। মোরগ পোলাও ভালো লাগে, নানা রকমের যেসব ভর্তা পাওয়া যায় বাংলাদেশে, সেগুলো খুব ভালো লাগে। টমেটো পুড়িয়ে কাঁচা লঙ্কা আর তেল দিয়ে মেখে যে ভর্তা কিংবা বেগুন ভর্তা…মাছেরও ভর্তা খেয়েছি, মাংসের ভর্তা খেয়েছি, ওগুলোর স্বাদ আমার জিভে লেগে রয়েছে। ওখানকার বিরিয়ানির বিভিন্ন দোকানে আলাদা আলাদা স্বাদ, ভুনা খিচুড়ি, ভুনা কিংবা কষা মাংস…কাচ্চি বিরিয়ানির কথা তো আলাদা করে বলতেই হবে…আমি এসব যতই বলছি আমার জিভে জল চলে আসছে। আমার মনে আছে, আমি একবার একটা ইভেন্টের জন্য বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। একটা বড় ডাব্বায় করে কাচ্চি বিরিয়ানি নিয়ে ফিরেছিলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top