skip to Main Content

আলাপন I ব্যাংকিং আমার প্যাশন, সাহিত্য কলিং — মাসরুর আরেফিন

 

সাহিত্যচর্চায় আত্মবিকাশের একপর্যায়ে ব্যাংকিংয়ে প্রবেশ। তবে আলো ছড়াচ্ছেন দুই জগতেই। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে ক্যানভাসের একটি সান্ধ্যআড্ডা। আলাপচারিতায় চঞ্চল আশরাফ ও শিবলী আহমেদ

ক্যানভাস: কবিতার পাশাপাশি প্রবন্ধ লিখেছেন। লাতিন আমেরিকান সাহিত্য বিশ্লেষণ করেছেন। সম্প্রতি ফিকশনের প্রতি আপনার যে আকর্ষণ ও আগ্রহ, সেটি আলোচিত হচ্ছে। বিশেষ করে ‘আগস্ট আবছায়া’। ফিকশনের দিকে আপনার এই ঘুরে দাঁড়ানোয় কী প্রণোদনা কাজ করেছে?
মাসরুর আরেফিন: ১৯৯০ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে ভারত থেকে যখন ঢাকায় আসি, তখন লাতিন আমেরিকান সাহিত্য পড়তাম খুব— গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মারিও বার্গাস ইয়োসা, হোলিও কোর্তাজার, হুয়ান রুলফো। তখনো বোর্হেসে হাত দিইনি। পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা শুরু করি। সংবাদ পত্রিকায় লিখি, বিশ্বসাহিত্যের বিষয়ে। সাহিত্যের গতিমুখ কোন দিকে যাচ্ছে, তা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। লাতিন ফিকশন আমাকে দেখিয়েছে, সাহিত্য কত গূঢ় প্রশ্ন জীবনের সামনে নিয়ে আসতে পারে। আমার ভেতর থেকে সাহিত্যের ডাক এসেছিল। এটাই আমার নেশা হয়ে যায়। বাংলা সাহিত্য পড়তে শুরু করি। কমল কুমার মজুমদার পড়ি। দেবেশ রায় তখনো অত নাম করেনি। ওই যুগের কথা বলছি। কোনটা ভালো লেখা, কোনটা মন্দ, তখনই বুঝতে শুরু করি। বুঝতে পারি, দস্তয়ভস্কির চেয়েও ভালো লেখক আছেন। সাহিত্যের বদলটাও বুঝতে পারি। মানুষের সংবেদনশীলতা, পাঠকের রুচি আর পছন্দ বদলে গেছে। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসায় বুঝতে পেরেছি যে চাকরি করতে হবে। কিন্তু জীবনে লেখক হতেই হবে আমাকে। আমি তখনো জানি যে আমার শক্তি কবিতায়, কথাসাহিত্যেও। যাহোক সাহিত্য পড়তে পড়তেই ব্যাংকের চাকরিতে ঢুকে যাই। ১৯৯৫ সালে। কিন্তু সাহিত্য ছাড়িনি। এরপর দীর্ঘদিন ঢাকা থেকে দূরে ছিলাম। ফিরে আসি ২০০১ সালে। সেই বছরই প্রথম কবিতার বই বের করি। ‘ঈশ্বরদী, মেয়র ও মিউলের গল্প’। একেবারে অন্য ধরনের বাকভঙ্গি নিয়ে। বইটিকে পোস্টমর্ডানিস্ট বলা যেতে পারে। বেসিক স্ট্রাকচারের বাইরে থাকায় পোস্টকালচারালও বলা যেতে পারে। বইটিতে পলিটিকস আছে। পলিটিকস ছাড়া কোনো সাহিত্য হতে পারে বলে আমি মনে করি না। ওই বয়সে বইটি বেশি চলেনি। নাম ছিল না, কেউ চিনত না, জানত না। প্রথম বইটি বের হওয়ার পর হাওয়া হয়ে যাই। ২০১২ পর্যন্ত। ১১ বছর। এরপর আবার ফিরে আসি। আমি জানতাম, বাংলা সাহিত্যে আমার অনেক কিছু দেওয়ার আছে। আমার মেধা এবং দেখার চোখের ওপর আমার বিশাল আস্থা। ২০১২ সালে আমি ফ্রানৎস কাফকা অনুবাদ করে ফেলি। ‘ফ্রানৎস কাফকা গল্পসমগ্র’। বইটা সাড়া ফেলে দেয়। বাংলা একাডেমির একটা প্রাইজ পায়। পরে ব্র্যাক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার পায়। ওটার দুই বছর পরই আমি হোমারের ইলিয়াডটা বাংলায় অনুবাদ করি। গ্রিক ভাষা শিখতে হয়েছিল। অনেক কষ্ট করে এ দুটি অনুবাদের কাজ করেছি। মনের মধ্যে ছিল যে আমি তো আসলে একজন ফিকশন রাইটার হবো। জীবনের এই সময়ে পরিচয় হয় বোর্হেসের সঙ্গে। হোর্হে লুইস বোর্হেস। তখন আমি বুঝতে পারি যে সাহিত্যের শক্তি আসলে কোথায়। কী করে অল্প লেখার মধ্যেও দুর্দান্ত ভালো সাহিত্য হতে পারে। আমার পারসোনাল প্যাশনের জায়গা ছিল বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড। বহু বছরের প্যাশন। আমার মনে হয় আলাদা আলাদাভাবে যদি প্যাশনগুলো নিয়ে বলি, আমার সেরা পাঁচ প্যাশনের মধ্যে একটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড। তাই ইলিয়াড অনুবাদ শেষ করেই আমি নিজেকে নিয়োজিত করলাম বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডটাকে বুঝতে। তা নিয়ে বই বের হলো ২০১৯ সালের বইমেলায়; প্রথমা থেকে। ‘আগস্ট আবছায়া’। প্রথাগত বাংলা উপন্যাসের সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। এরপর বুঝলাম যে কথাসাহিত্য আমাকে দিয়ে হয়। লিখলাম দ্বিতীয় উপন্যাস। ‘আলথুসার’। প্রথমা থেকে পয়লা ফেব্রুয়ারি আসছে আলথুসার। মাঝখানে ২৭টির মতো নতুন কবিতা লিখেছি। সেগুলো নিয়েও বই আসছে।
ক্যানভাস: তাহলে আপনি কবিতা এবং কথাসাহিত্য— দুটিই এখন সমানতালে চালাচ্ছেন। কখনো কখনো দ্বন্দ্বে পড়ে যান কি না যে, একটি ভাবনা বা আইডিয়া নিয়ে ফিকশন লিখবেন নাকি কবিতা লিখবেন?
মাসরুর আরেফিন: সত্যি বলতে, এখন আর কোনো দ্বন্দ্বে পড়ি না। ছোটগল্প নিয়ে এখন কাজ করছি না। ছোটগল্প নিয়ে কাজ করলে এটা হয়তো হতো। তবে আপনার কথাটা একেবারেই ভুল নয়। কারণ, এই দ্বন্দ্বে তো লেখক পড়েই। এমন অনেকবার হয়েছে যে উপন্যাস বন্ধ করে আমি কবিতা লিখেছি। হয়তো ওই কবিতার উপাদান একটি উপন্যাস থেকেই এসেছে।
ক্যানভাস: আপনার করপোরেট লাইফ এবং সাহিত্যিক সত্তার যে কনফ্লিক্ট, বিশেষ করে সময় ব্যবস্থাপনায়, সেটি কীভাবে মেইনটেইন করছেন?
মাসরুর আরেফিন: এই কনফ্লিক্টগুলো মানুষের বানানো মিথ। মানুষ অলস বলে এগুলো বানায়। অনেকেই ভাবে, এতক্ষণ অফিস করে লেখালেখির আর সুযোগ কই! সাধারণত সে রাত নয়টায় বাসায় গিয়ে টিভি দেখে, বসে বসে চ্যানেল বদলায়। এই অভ্যাস যদি বাদ দেওয়া যায়, যদি প্রতিরাত ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত ৪ ঘণ্টা করে পড়াশোনা বা লেখালেখির পেছনে সময় দেওয়া যায়, তাহলে তা যথেষ্ট। তলস্তয় তার সারা জীবনে সাহিত্য করার জন্য যে সময় পেয়েছেন, চাকরি করার পরও একজন ব্যক্তি সাহিত্য করার জন্য তার চেয়ে বেশি সময় পেতে পারেন। প্রতিদিন যদি ৪ ঘণ্টা করে বের করা যায়, ২২ দিনে আসবে ৮৮ ঘণ্টা। বাকি ৮ দিন, অর্থাৎ প্রতি শুক্র ও শনিবার যদি আড্ডা না দিয়ে ১০ ঘণ্টা করে মোট ২০ ঘণ্টা সাহিত্যের পেছনে ব্যয় করা হয়, তাহলে মাসে অনেক সময় বের করা সম্ভব। বছরে হিসাব করলে তা অনেক বেশি। তো কীভাবে মানুষ বলে যে আমার সময় নেই। ‘আমার সময় নেই’— এটা অলসদের কথা। ব্যাংকিং আমার পেশা। এটি আমি প্রচন্ড প্যাশন দিয়ে করি। সিটি ব্যাংক বাংলাদেশের শীর্ষ তিন ব্যাংকের একটি। সেখানে আমার সিরিয়াস প্যাশন আছে। ব্যাংকিং আমার প্যাশন। এই ব্যাংকটিকে আমি বিশাল আকারের একটি ব্যাংক করব— এই স্বপ্ন নিয়েই আমি ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়েছি। সাহিত্য আমার প্যাশনের জায়গা নয়। সেটা আমার কলিং। তা ছাড়া মানুষ একসঙ্গে তিনটি প্যাশন নিয়ে থাকতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, হাতে পর্যাপ্ত সময় আছে। যে সময়টা মানুষ কিছু না করে নষ্ট করে, আমি সেই সময়টা নিজের লাইব্রেরি রুমে ৮ হাজার বইয়ের মধ্যে বসে কাটাই। আমি এ বিষয়ে একদম নির্মম।
ক্যানভাস: সিটি ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পর আপনার পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইছি…
মাসরুর আরেফিন: আমি সিটি ব্যাংকে আসার দেড় বছরের মাথায় আমাদের ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান আজিজ আল কায়সার আমেরিকান এক্সপ্রেস নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। আজ সেটা ৩০ শতাংশ মার্কেট শেয়ারের একটি কার্ড। ব্যাংকের টোটাল প্রফিটের প্রায় ১৫% আমেরিকান এক্সপ্রেস একা দেয়। টোটাল রেভিনিউরও ১৫-১৬% আসে আমেরিকান এক্সপ্রেস থেকে। আট লাখ লোকের পকেটে আমেরিকান এক্সপ্রেস প্লাস্টিক। আমরাই মার্কেটের লার্জেস্ট কার্ড ইস্যুয়ার। আমি বুঝি যে বাংলাদেশের একটা ব্যাংক শহরভিত্তিক থাকতে পারে না। ইকোনমি ৮% রেটে গ্রো করছে। সারা দেশের মানুষকে নিয়ে এই গ্রোথটা হচ্ছে। এটা তো বেসিক্যালি উদ্যোক্তাদের। ব্যবসায়ীদের। একটা মুদিদোকানদারও এর মধ্যে আছে, আবার বড় একটা পাওয়ার কোম্পানিও এর মধ্যে আছে। কিন্তু বাংলাদেশ ছোট একটা দেশ, করপোরেট সেক্টরটা লিমিটেড। ১৮ কোটি লোকের দেশ, প্রত্যেকে কিছু না কিছু দেখছে বা কিনছে। এই জিনিসটা শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটে হচ্ছে না; সব জেলায় হচ্ছে। ৪৯১টি উপজেলায় এটি হচ্ছে। ৬৮ হাজার গ্রামে হচ্ছে। আমরা মাস-সেগমেন্টে যাচ্ছি। এতে সিটি ব্যাংকের ব্যাপ্তি বা স্কেল অনেক গুণে বাড়বে। আমরা চাইছি তিন কোটি ক্রেডিট কার্ড হোক। ম্যাক্রোইকোনমিতে একটা সাড়া আনার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিংয়ে যাব। চেয়ারম্যানের সমর্থনে। সিটি ব্যাংক প্রতিবছর চার বিলিয়ন ডলারের এলসি খোলে। আমরা গ্রাম-বাংলায়ও যাব। আমাদের মেইন অ্যাকটিভিটি হবে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। টোটাল ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের রেভল্যুশনের দিকেও ঢুকছি। মনে হয় না আর কোনো ব্যাংক আমার মতো করে চিন্তা করছে। আমরা ন্যানোলোন দিতে পারি, মাইক্রোলোন দিতে পারি। নরমাল রেটেই। ব্যাংকের কাস্টমার এক কোটি চাচ্ছি। এরপর তিন কোটি। তাই বৃত্তের বাইরে যেতে চাচ্ছি।
ক্যানভাস: অনেকেই বলছেন, ব্যাংকের ভবিষ্যৎ খুব একটা ভালো নয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি আসায় জবলেস গ্রোথ হবে। সেটা মোকাবিলায় সিটি ব্যাংক কতটা প্রস্তুত?
মাসরুর আরেফিন: না, আমরা এমন কিছু করতে চাই না, যে কারণে অনেক মানুষ চাকরিচ্যুত হতে পারেন। আমাদেরকে সামাজিক দায়বদ্ধতা বুঝতে হবে। এ দেশে যদি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে না পারা যায়, তাহলে পৃথিবীর অন্যদের কপি করতে গিয়ে এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে অনেকগুলো মানুষের চাকরি চলে যেতে পারে। আমরা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করি। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে নিয়ে কলসেন্টারে চ্যাটবট আনতে পারি। সেটা অন্য জিনিস। এআইকে ব্যবহার করে সেবার মান বাড়াতে পারি। কিন্তু মানুষের বিকল্প হলে এটি অর্থনীতির প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে।
ক্যানভাস: আমরা আবার সাহিত্যে ফিরে আসি। যেকোনো সাহিত্যিক যখন লেখালেখি শুরু করেন, তার সামনে একজন থাকেন। যেমন মার্কেজের সামনে ছিলেন কাফকা। নিজের সামনে আপনি কাকে রাখেন?
মাসরুর আরেফিন: আমার সবচেয়ে প্রিয় সাহিত্যিক তো চারজন। কথাসাহিত্যের কথা যদি বলেন, তাহলে আমার সামনে আছেন হোর্হে লুইস বোর্হেস, ডব্লিউজি সেবাল্ড। প্রকৃতি বর্ণনার জন্য আমার কাছে মনে হয় ইভান তুর্গেনেভ এবং বিভূতিভূষণ। রাজনীতির বিষয়ে জোসেফ কনরাড। এ ছাড়া আমি খুব পছন্দ করি ব্রুস চ্যাটুইন। দিন শেষে আমার কাছে মডেল লেখক হচ্ছেন ফ্রানৎস কাফকা। যদি কবিতায় আসি— জীবনানন্দ দাশ। আছেন আরও তিনজন— উৎপল কুমার বসু, বিনয় মজুমদার এবং অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত। আমি যদি কারোর মতো লিখতে চাই, তাহলে বলতাম যে যোসেফ ব্রডস্কি। এক টুকরা ব্রডস্কি এবং দুই টুকরা জীবনানন্দ যদি আমার লেখায় আনতে পারতাম, আর ওটার বিষাদটা যদি পড়তে লাগত ওসিপ মান্ডেলস্টামের মতো, তাহলে বোধ হয় সবচেয়ে সেরা কবিতা হতো।
ক্যানভাস: আঙ্গিকের ক্ষেত্রে অনেক সময় লেখক একটা প্রি-অকুপেশনের মধ্যে পড়ে যান। লেখক আগে যে রকম একটি কাঠামো ঠিক করে রাখেন, সেটাই তিনি ওই বিষয়বস্তুর জন্য বরাদ্দ করেন এবং তার মধ্যেই তিনি থেকে যান। আপনি কি মনে করেন, প্রি-অকুপেশনের দরকার আছে?
মাসরুর আরেফিন: হ্যারল্ড ব্লুম বলেছেন, সাহিত্যিক হিসেবে গল্পের বেসিক থ্রেডটাই রাখো। এত প্ল্যানিং কোরো না, লিখতে বসো। লেখাকে ডালপালা ছড়াতে দাও। আমি এটা বিশ্বাস করি। তবে ওই লেভেলে যেতে পারি না। দুয়ের মাঝামাঝি থাকি। আমি বেসিক থ্রেডটা তৈরি করি, তারপর আরেকটু যোগ করি। ছোট ছোট জটিং করে দুই পাতায় পুরো তিন শ পাতার উপন্যাস লিখে ফেলি। বুলেট পয়েন্টে। বুলেটগুলোই আমার লেখার থ্রেড। তার ওপর ডালপালা বিস্তার করে, আমার কল্পনা দিয়ে সাহিত্য এগোতে থাকে। আমি বলতে চাই— প্রি-প্ল্যান করে সাহিত্য করলে সেটা একটা সেট গেম হয়। সেগুলো পড়তে ভালো লাগে না। এত সাজানো অঙ্ক করে সব সুতা এসে মিলে যাবে— সাহিত্য এত গোছানো হলে এখন আমার আর ভালো লাগে না। মনে হয় একটা উপন্যাস আরেকটু এলেবেলে হতে হবে। জীবন তো সাহিত্যের মতো। জীবন তো এত গোছানো নয়। তারপরও অনেক কিছু গোছাতে হয়। আমার একটা বেসিক প্ল্যানিং থাকে। প্ল্যানিং বেসিকের বাইরে গেলে মুশকিল। আখ্যানের ক্ষেত্রে, ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে থার্ড পারসনে এখনো লিখিনি। আমার উপন্যাস, আমার গল্প— সব আমি দিয়ে বলা থাকে।
ক্যানভাস: আপনার লাইফস্টাইল সম্পর্কে বলুন।

মাসরুর আরেফিনের সঙ্গে চঞ্চল আশরাফ (ডানে), শিবলী আহমেদ (বামে)

মাসরুর আরেফিন: বেশি সিম্পল। সকাল ৮টা ৪৫ কিংবা ৯টায় ঘুম থেকে উঠি। ১০টার মধ্যে অফিস। রাত ৮টায় বাসায় ফিরি। রাত সাড়ে ৯টার দিকে আমার নিজের পড়াশোনা। লেখালেখি তো আর পড়াশোনার মতো হয় না। কারণ পড়াশোনা করা কঠিন, লেখালেখিটা পড়াশোনার চেয়ে সহজ। পড়তে-লিখতে রাত সাড়ে ১২টা বাজে। মাঝেমধ্যে ১টাও বাজে। তারপর ঘুমাতে যাই। উইকেন্ডে চেষ্টা করি পুরো সময়টাই লাইব্রেরি রুমে দিতে। এটুকুই লাইফস্টাইল। মাছ-ভাত পছন্দ করি। আমি বেসিক্যালি পাঠক। আমি লেখক কম। সব সময়ই চেষ্টা করি কিছু না কিছু পড়তে। দু-তিনটি শখ আছে— গাছের নাম জানা, সব পাখির নাম জানা। বন্ধুদের সঙ্গে মাঝেমধ্যে বসি। গাছ নিয়ে কথা বলি। অস্ত্রপাতি ও মেডিকেল সায়েন্সে আগ্রহ আছে। আমার লাইফস্টাইলে এক্সাইটিং কিছু বলার নেই। মাঝেমধ্যে জিমে যাই। স্বাস্থ্যের দিকে তো খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, নিজের শরীরের ওপর তো প্রচুর অত্যাচার করছি। আমার বড় মেয়ে কানাডায় পড়াশোনা করে। ছোট মেয়ে ঢাকায় আছে। স্ত্রী আছে। বাবা নেই। মা আছেন। খুলনায় থাকেন। দুই ভাই আছেন, যার যার মতো প্রতিষ্ঠিত। দুই বোন বিদেশে থাকে। তারাও প্রতিষ্ঠিত। ভালো আছে।
ক্যানভাস: চিন্তাশীল মানুষদের বেশির ভাগই নিজের জীবন থেকে একটা শিক্ষা বা সিদ্ধান্তে আসে। সাহিত্য ও করপোরেট লাইফে সফলতা নিয়ে আপনার সিদ্ধান্ত কী?
মাসরুর আরেফিন: ব্যাংকিং সাইটে বলতে পারেন সফল। কিন্তু আসল সফলতা আসবে যদি ব্যাংকটাকে পুরো জনমানুষের ব্যাংক করতে পারি। সাহিত্যে আমাকে নিয়ে অনেক কথাবার্তা আছে, একটা উপন্যাস অনেক নাম করেছে, কবিতার বইটি নিয়ে একটা সন্ধ্যা হলো। সুপারহিট হয়েছে। এগুলো কিছু না। একটা ছোট বাংলাদেশে আমি সফল হতে আসিনি। আমার বই অনুবাদ হবে, আমার বই সারা পৃথিবীতে পড়বে, তখন বলব সফল হয়েছি। সাহিত্যের সফলতার বিন্দুটাও আমি স্পর্শ করিনি। পাঁচটি উপন্যাস লেখার আগে তা স্পর্শ করতেও পারব না। তবে আমার একটা পাঠক দাঁড়াচ্ছে, এটা ভালো লাগে।
ক্যানভাস: জীবনের এ পর্যায়ে আপনি যতটুকু এসেছেন, তার মূল্যায়নটা কীভাবে করছেন?
মাসরুর আরেফিন: একদমই মিডল ক্লাস ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেই আমার সংগ্রাম। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি। মনে হয়েছিল নিজের জন্য কিছু করতে হবে, অর্থনৈতিক সফলতাটা লাগবে। আর কিছু না হলেও বই কেনার টাকা লাগবে। এখন আমার প্রায় ৮ হাজার বই আছে। এটা জীবনের একটা বড় প্রাপ্তি। এটা যেমন সংগ্রামের দেশ, তেমনি আপনি যদি চান, এটা সফল হওয়ারও দেশ। ব্যাংকিংয়ে ২৫ বছর হয়ে গেছে। সিটি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের সাপোর্ট আমি পেয়েছি। এগুলো হয়তো আমার ব্যক্তিত্ব দিয়েই অর্জন করেছি। সাহিত্য বোঝা তো অনেক কষ্ট। একটা গল্পের প্রকরণ বোঝা, একটা কবিতার আর্ট বোঝা, ১৪ বছর ব্যাংকিং করার সমান। সেটা তো খুবই কঠিন কাজ। তাই বলেছি, ব্যাংকিং আমার প্যাশনের জায়গা আর সাহিত্য আমার কলিংয়ের জায়গা।
ক্যানভাস: অবসর কীভাবে কাটান?
মাসরুর আরেফিন: অবসরে বই পড়ি। আমার কোনো আলাদা করে অবসর নেই। আমি খুব বুকিস। একটু নিরানন্দ লোক।

ছবি: সৈয়দ অয়ন

This Post Has 3 Comments
  1. এই কনফ্লিক্টগুলো মানুষের বানানো মিথ। মানুষ অলস বলে এগুলো বানায়।

  2. কারণ পড়াশোনা করা কঠিন, লেখালেখিটা পড়াশোনার চেয়ে সহজ।

  3. ‘আসল সফলতা আসবে যদি ব্যাংকটাকে পুরো জনমানুষের ব্যাংক করতে পারি।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top