skip to Main Content

ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাশন I মাল্টিলিঙ্গুয়াল মুভমেন্ট

‘দ্য মোর দ্য মেরিয়ার’—ভাষাগত দক্ষতার এই জাদুমন্ত্রেই জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো জয় করে নিচ্ছে ফ্যাশন বিশ্ব। কিন্তু কীভাবে? জানাচ্ছেন আল মারুফ রাসেল

চলতি শতকের শুরুতে বাংলাদেশের ফিচার জার্নালিজমের পুরোধা সঞ্জীব চৌধুরী এক আড্ডায় বলেছিলেন, বাংলা ও ইংরেজির বাইরে তৃতীয় একটা ভাষা জানা থাকলে না খেয়ে থাকতে হবে না। বিশ্বায়নের এ যুগে বাস্তব পরিস্থিতি ব্যাপারটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। আর এটা যদি হয় ফ্যাশনের ব্যাপার, তাহলে তো কথাই নেই। আন্তর্জাতিক ক্রেতা, বিক্রেতা, গার্মেন্টস, মধ্যস্থতাকারী মিলিয়ে তিন-চার দেশের কারবার। শুধু তা-ই নয়, আন্তর্জাতিক ফ্যাশন উইক বা এক্সপোতেও কাজের সুবিধা হবে বিস্তর। এ ছাড়া জনসংযোগ, নেটওয়ার্ক তৈরি করা, ভ্রমণ, মডেলিং বা নিজের ব্র্যান্ড তৈরিতেও একাধিক ভাষায় দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ।
অ্যালডো লিগোরি তার কাজ করতে পারতেন না, যদি কয়েকটা ভাষা জানা না থাকত। লিগোরি গ্লোবাল হেড হিসেবে কাজ করছেন জাপানি প্রতিষ্ঠান ফাস্ট রিটেইলিংয়ে, যারা আন্তর্জাতিক ক্লদিং জায়ান্ট ইউনিক্লো আর ফরাসি ব্র্যান্ড কোমটোয়া দে কোটোনিয়াসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জাপানিসহ আরও চারটি ভাষায় গড়গড় করে কথা বলতে পারেন। তার ভাষ্যমতে, এটা ‘পুরোপুরি সুবিধা’ করে দিয়েছে মিডিয়া ও বিশ্বজুড়ে তার সিনিয়র সহকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে। তার ধারণা, বিশ্বায়নের বাজারে আর কার্যক্রমে একাধিক ভাষা জনসংযোগে সবচেয়ে ধারালো ও কার্যকর অস্ত্র। এমনকি ‘লস্ট ইন ট্রান্সলেশন’-এর ঝামেলায় পড়তে হয় না বিজ্ঞপ্তির সময়েও।
ইউনিক্লোর হেডকোয়ার্টার টোকিওর সবচেয়ে উঁচু বিল্ডিংটা থেকে তাকালে রাস্তার মানুষগুলোকে বর্ণিল টি-শার্ট আর পাফার জ্যাকেট পরে চলাফেরা করতে দেখা যায়। সেখানে বসেই অ্যালডো লিখেছেন, ভাষাগত দক্ষতাই তার ক্যারিয়ারকে নিয়ে এসেছে এত দূর। তাকে নমনীয় আর অভিযোজিত হওয়ার দিয়েছে দক্ষতা। সুযোগ করে দিয়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার। তিনি বিভিন্ন দেশের কোম্পানি, পণ্য আর মিডিয়া সম্পর্কে নিজের জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়েছেন তাদের ভাষায় কথা বলে। আর এটা ধরে নিয়ে যে, সবাই তার ভাষায় কথা বলবে না।
যদিও ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির অনেক জায়গাতেই ইংরেজি প্রচলিত, তারপরও বিদেশি ভাষায় দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় ও তৃতীয় জনপ্রিয় হাই স্ট্রিট শপ জারা ও এইচঅ্যান্ডএমের ভিত্তিই বিদেশি আরএমজির ওপর। অন্যদিকে প্রথম স্থানে থাকা নিউ লুক সম্প্রতি জানিয়েছে, প্রথমবারের মতো তারা ইউরোপের অন্যান্য বাজারে ও চীনা বাজারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
ইউনিক্লোর মতো আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড নিয়োগের সময় ভাষাগত দক্ষতার ওপর জোর দেয়। পুরোপুরি সড়গড় হতে হবে এমন নয়: কোম্পানিই বিভিন্ন ভাষাগত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকে। যাদের উন্নতির প্রয়োজন, তাদের জন্য অ্যালডোর পরামর্শ—সব জান্তার ভান না করার। তিনি বলেন, ‘যদি পুরোপুরি বুঝতে না পারেন, কেউ আপনাকে কী জিজ্ঞাসা করছে, সে ক্ষেত্রে আপনি পিছিয়ে গিয়ে নির্দ্বিধায় আবার তাকে বলতে বলুন। আমি অনেক বছর আগে শুরু করেছি, তবে এটাই ছিল আমার সাফল্যের মূলমন্ত্র।’
ভাষা নিয়ে পড়াশোনা হয়তো আ লা মোদ নয়, কিন্তু ব্রিটিশ ফ্যাশন কাউন্সিল ভাষার ক্ষমতার ওপর জোর দিচ্ছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ডিজাইনার ও ব্র্যান্ডগুলোকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। তাদের সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে তারা ভাষার ওপর জোর দিয়ে ব্রিটিশ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বৈশ্বিক অবস্থান উন্নত করার ইচ্ছে প্রকাশ করেছে।
ক্যাট শ্যালক্রস মনে করেন, ফরাসি ও স্পেনীয় ভাষার ডিগ্রি তাকে সাহায্য করেছে নিউ লুকের মার্কেটিং অ্যাডমিনিস্ট্রেটর পদে বসতে, তাদের ইউরোপীয় দোকানগুলোয় মজুতের পরিমাণ নিরীক্ষা করতে। তার ভাষ্য, ‘আমার ভাষাগত জ্ঞান ছাড়া এই কাজ করা খুবই কঠিন হতো। ইংরেজির বদলে ফরাসি বলাটা অনেক ক্ষেত্রেই আমার কাজের কার্যকারিতা বাড়িয়েছে।’
বিভিন্ন ভাষায় তার দক্ষতা যে প্রয়োজনীয় তা প্রমাণিত হয়েছে, যখন তিনি সফল প্রেজেন্টেশন দেন ইউরোপীয় টিম কনফারেন্সে এবং প্যারিস ও বেলজিয়াম ভ্রমণে, যেখানে স্টোর ম্যানেজাররা সবকিছু ইংরেজিতে বোঝাতে না পারলে ফরাসি ভাষায় ব্যাখ্যা করে।
বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারটা ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে বাইরের লোকদের কাছে অনেক গ্ল্যামারাস করে দেখায়। যদিও এই ভ্রমণগুলোয় কেবল ইংরেজি বলে পার পাওয়া যাবে না, বলেছেন প্যাট্রিক ক্লার্ক। তিনি ভাষা বিষয়ে ডিগ্রিধারী ও ঝাঁ-চকচকে ম্যাগাজিন শোনের অনলাইন সম্পাদক। নিয়মিত মিলানের ফ্যাশন উইক ও অন্যান্য অ্যাসাইনমেন্টে যেতে হয় তাকে। সেখানে শোর বাইরে যোগাযোগ আর সম্পর্ক তৈরি করাটাও কাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্যাট্রিকের ভাষ্য, ‘ফ্যাশন উইকে বা ফ্যাশন স্টোরের কর্মকর্তা—যার সঙ্গেই দেখা করেন না কেন, তিনি আপনার সম্ভাব্য সহকর্মী। আমি অনেকের সঙ্গেই ভালো সখ্য গড়ে তুলেছি ইতালীয় ভাষায় কথা বলে। একজন ফটোগ্রাফারের সঙ্গে আমরা এখন কাজ করছি যে কিনা আমার বন্ধুর বন্ধু।’ ইংরেজিতে যে বিজ্ঞপ্তিগুলো আসে, সেগুলোয় প্রচুর ভুল থাকে, তাই তিনি সব সময় ইতালীয় ভাষায় পড়েন, যেন লেবেলের ইমেজ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকে।
জন্মসূত্রে রুশভাষী জানা রেনল্ডস। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন প্যারিসের N010 শোরুমে। তিনি বলেন, ‘আমি রুশভাষী না হলে মোট গ্রাহকদের ৯৮ শতাংশই আমার গ্রাহক হতেন না।’ তিনি আবিষ্কার করেছেন, আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার গড়তে গড়গড় করে ফরাসি ও ইতালীয় বলাটাও ইংরেজির মতো কার্যকর। তার ভাষ্য, ‘যদি ফরাসি বা ইতালীয় ভাষায় কথা বলেন, বা আপনি একজন ডিজাইনার, যিনি ফ্রান্স বা ইতালিতে প্রদর্শনী করছেন, আপনাকে দেখাতে হবে যে আপনি সেখানে থাকার যোগ্য। ফ্যাশন এমনই এক ইন্ডাস্ট্রি, যা প্রচন্ডভাবে সাংকেতিক মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে আছে।’
যত বেশি ভাষা জানা যাবে তত ভালো, কিন্তু কোন কোন ভাষা শিখতে হবে? ‘বেশির ভাগ কেনাবেচা ফ্রান্স আর ইতালিতে হলেও আসল টাকাপয়সা ইউরোপে নেই—খদ্দেররা সব চীন আর জাপানের,’ জানা বলেছেন। প্যাট্রিক একমত পোষণের পাশাপাশি যোগ করেন, মিলানের শোরুমগুলোয় অনেক লোক রয়েছে, যারা রুশ আর চীনা ভাষায় পূর্বের ধনকুবেরদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।
এই ট্রেন্ডটা অ্যাসোস অ্যাডপ করে নিয়েছে বেশ ভালোভাবেই, তারা চীনা ভাষায় ওয়েবসাইট খুলেছে সম্প্রতি। আর টপশপ জলদিই চীনে তাদের প্রথম দোকান খুলতে যাচ্ছে। ‘অনেক সময় এমন ঘটেছে যখন ইংরেজি যথেষ্ট ছিল না কাজের জন্য’, চায়না ফ্যাশন কালেকটিভের প্রতিষ্ঠাতা টিমোথি প্যারেন্ট বলেছেন। ‘অনেক ডিজাইনারই চীনা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা জানেন না। নতুন সব সম্পর্ক তৈরি আর নতুন মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা অত্যন্ত জরুরি, আর চীনা ভাষা না জানলে সেখানে আপনার উপস্থিতি সীমিত হয়ে পড়বে।’
দেশের বাইরে র‌্যাম্পে ক্যাটওয়াকের মোহ থাকলেও ইংল্যান্ডে স্নাতক পর্যায়ে কোনো যৌথ ফ্যাশন ও ভাষার কোর্স নেই। তাই যেসব শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কাজ করতে চান, তাদের নিজেদেরই আলাদা করে মূল ডিগ্রির সঙ্গে ভাষা শিখে নিতে হয়, অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে হলেও। কিছু বিশ্ববিদ্যালয়, যেমন ইউনিভার্সিটি অব দ্য ক্রিয়েটিভ আর্টস কোনো ধরনেরই ভাষার কোর্স পড়ায় না। লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশনের ক্যারিয়ার ও স্টুডেন্ট রিক্রুটমেন্ট প্রধান জ্যাসন ক্ল্যাপারটনের মতে, এটা সম্ভবত ব্যবহারিক ডিগ্রির প্রকৃতিগত চাহিদার কারণেই ঘটে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘প্রতিটি কলেজকেই ইন্ডাস্ট্রির বৈশ্বিক ব্যাপারটা মাথায় রাখা প্রয়োজন।’ আপনি যদি নিজের লেবেল প্রতিষ্ঠা করতে চান, আপনাকে ইন্ডাস্ট্রির লোকদের সঙ্গে কীভাবে মিশতে হয়, সেটা জানতে হবে। তাদের মধ্যে একেকজন একেক দেশেরও হতে পারে।’
লন্ডন কলেজ অব ফ্যাশনের শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা কেন্দ্র আর ইরাসমাস লিংকগুলো ব্যবহারের জন্য। লিয়নে টেক্সটাইল বা ডেনমার্কে ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনার ক্ষেত্রেও আগ্রহী করে তোলা হয়। জ্যাসনের সহকর্মী এমিলি গোটিয়ে বলেন, নতুন ভাষা শেখা আর দেশের বাইরে যাওয়া একধরনের সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক বিনিময়, যা একজন ডিজাইনারের দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া কথা বলা ও যোগাযোগের দক্ষতাও বাড়িয়ে তোলে।
কয়েকটি ভাষা জানা থাকলে প্রতিযোগিতাময় ফ্যাশন জগতে নিজের অবস্থান পোক্ত করা বেশ সুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ইংরেজি ইন্ডাস্ট্রির ‘লিংগুয়া ফ্রাংকা’, তারপরও আরেকটি ভাষা জানা থাকলে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার পথটা বেশ সহজ হয়ে দাঁড়ায়। যেমনটা জানা বলেছেন, ‘আপনি ইংরেজি দিয়ে কাজ করতেই পারেন, তবে যোগাযোগের মান এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাশনের লোকেরা খানিকটা খ্যাপাটে [যুক্তিহীন], অনুভূতিপ্রবণ, পাগলাটে। তাই তারা যদি আপনার সঙ্গ উপভোগ করে, আপনি তাদের আরও কাছে যেতে পারবেন।’

[গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ক্যাটি ফর্স্টারের Languages are in vogue in the fashion industry অবলম্বনে] ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top