skip to Main Content

ইভেন্ট I ছবিমেলা ২০১৯

ছবিমেলার দশম আসর এবার জমজমাট ৩৩টি প্রদর্শনী আর আন্তর্জাতিক আলোকচিত্রীদের অংশগ্রহণে। এসেছেন অরুন্ধতী রায়ও। উৎসবটির আদ্যোপান্ত নিয়ে লিখেছেন তাওসিফ আহমেদ

সম্প্রতি রাজধানী ঢাকায় দশমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এশিয়ার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আলোকচিত্র প্রদর্শনী উৎসব ‘ছবিমেলা’। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘স্থান’। দৃক-পাঠশালার আয়োজনে ৯ দিনের এই উৎসবে মোট ৭টি ভেন্যু ছিল সরগরম। মূল প্রদর্শনীস্থল ছিল পান্থপথে নির্মাণাধীন দৃক-পাঠশালা ভবন। অন্যান্য ভেন্যু ছিল ধানমন্ডিতে অবস্থিত দৃক গ্যালারি, পান্থপথ দৃক গ্যালারি, গ্যেটে ইনস্টিটিউট, জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ, বৃত্ত আর্ট ট্রাস্ট এবং আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকা। উৎসবকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। গ্যেটে ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত হয় আর্টিস্ট টক, প্যানেল আলোচনা এবং কিউরেটেড স্লাইড শো। আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ দো ঢাকাতে প্রদর্শিত হয় নির্বাচিত কিছু চলচ্চিত্র। আর শিক্ষাবিষয়ক ভেন্যু হিসেবে ছিল পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউট। এখানে কর্মশালা এবং পোর্টফোলিও রিভিউর আয়োজন করা হয়। এ বছর ‘ছবিমেলা আজীবন সম্মাননা পুরস্কার ২০১৯’ এ ভূষিত হয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী, কৃষিবিজ্ঞানী ও লেখক প্রয়াত ড. নওয়াজেশ আহমদ।
উৎসবে গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনীগুলোর মধ্যে ছিল বাংলাদেশের কিংবদন্তি আলোকচিত্রী প্রয়াত রশীদ তালুকদারের কাজ নিয়ে ‘রশীদ তালুকদার (১৯৩৯-২০১১): আ লাইফ’স ওয়ার্ক’। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় এবং বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ছবির অসাধারণ সংগ্রহ নিয়ে ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে এই প্রদর্শনী চলে।
মূল উৎসবস্থল রাজধানীর পান্থপথে নির্মাণাধীন দৃক-পাঠশালা ভবনে প্রদর্শনী ছিল পাঠশালা ফেলোদের কাজ নিয়ে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করেছেন মুশফিক মাহবুব তূর্য। তার এই প্রজেক্টের শিরোনাম ‘আইডেনটিটি’। ফাহিম হাসিন সহন মেন্টাল ডিজঅর্ডার নিয়ে ‘হ্যাপি ট্রি’ শিরোনামে একটি কাজ করেছেন। আশফিকা রহমান তুলে ধরেছেন পুলিশের নির্যাতনের শিকার হয়ে ফিরে আসা নিরীহ মানুষের গল্প। এ ছাড়া ছিল ‘ক্রসফায়ার’ নিয়ে একটি ডকুমেন্টেশন। ভিডিওতে কিছু জায়গা দেখানো হয়, যেখানে খুঁজে পাওয়া যায় ক্রসফায়ারে নিহত মানুষের ছবি। এ রকম আরও বেশ কিছু কাজ ছিল এই ভেন্যুতে।
ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবর-সংলগ্ন জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠে প্রদর্শিত হয় দায়ানিতা সিং, নাঈম মোহাইমিনের আলোকচিত্র। এই গ্যালারির প্রধান আকর্ষণ ছিল মৌসুমি ভৌমিক ও সুকান্ত মজুমদারের তৈরি ডকুমেন্টারি ভিডিও। ‘সীমান্ত ও স্বাধীনতা/স্বাধীনতার সীমান্তরেখা’ শিরোনামে এই প্রামাণ্যচিত্রের দৈর্ঘ্য ৪১ মিনিট ২০ সেকেন্ড। শব্দ গ্রহণ করেছেন সুকান্ত মজুমদার। বিষয়বস্তু ছিল বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা। এখানে ব্যবহৃত হয়েছে বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও খাসি ভাষা। মৌসুমি ভৌমিক এই গ্যালারিতে এসে এ নিয়ে কথা বলেন। কোনো দেশের মানচিত্রে স্থায়ী ঠিকানা না থাকার যে কষ্ট, নিজের জন্মস্থান ছেড়ে অন্যত্র স্থায়ী ঠিকানা তৈরি হওয়ার যে হাহাকার, নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তা বর্ণনা করেন মৌসুমি ভৌমিক। দেশ বিভাগের ফলে হিন্দু-মুসলমান তথা ধর্মীয় সম্প্রদায়গত একটি বিভেদরেখা টেনে দেওয়া হয়। ফলে বাঙালির সংস্কৃতিগত একটা টানাপোড়েন চলে আসে। দেশভাগের সময় নিজ বাড়িঘর তথা নিজ পরিচয় ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয় অন্য ঠিকানায়। এক ভাষা, এক সংস্কৃতি, এক মনোভাব হওয়া সত্ত্বেও সীমান্তরেখা মানুষকে খন্ডিত করে ফেলে। মৌসুমি ভৌমিক ও সুকান্ত মজুমদাররা ঘুরে বেড়িয়েছেন এই অঞ্চলগুলোতে, যেখানে সীমান্তের চোখরাঙানি দেখেছে মানুষ। দ্য ট্রাভেলিং আর্কাইভে ধরা পড়েছে সে মানুষগুলোর অভিজ্ঞতার চিত্র। এই ডকুমেন্টারিতে রয়েছে ‘এইট চ্যানেল’ সাউন্ড আউটপুট। ফলে প্রতিটি শব্দকণাও ফুটে উঠেছে নিখুঁতভাবে।
পান্থপথে অবস্থিত দৃক গ্যালারিতে প্রদর্শিত হয় ডাচ ফটোগ্রাফার ইয়ান বেনিংয়ের ‘রেড ইউটোপিয়া’। বার্লিন দেয়ালের ধ্বংস এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে সমাজতন্ত্র একটি অতীতের বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে মনে করা হয়। আলোকচিত্রী ইয়ান বেনিংয়ের রেড ইউটোপিয়া বিশ্বের নানা কোণের ছবি তুলে ধরেছে। তিনি ভারত, ইতালি, নেপাল, পর্তুগাল ও রাশিয়া— মোট পাঁচটি দেশে এমন জায়গার খোঁজ করেছেন, যেখানে সামজতন্ত্র এখনো সক্রিয়। নগর-বন্দরসহ গ্রামেগঞ্জে ঘুরে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির অফিস, লাল পতাকা, প্রতীকী সাজসজ্জা, ব্যানার এবং মার্ক্স, অ্যাঙ্গেলস, লেনিন, স্টালিন ও মাও সে তুংয়ের পোর্ট্রেট, নেতা, তাত্ত্বিকদের ছবি তার ক্যামেরায় বন্দি করেছেন। কখনো কখনো তিনি স্থানীয় পার্টি কর্মীদের ছবিও তুলেছেন।
গ্রিন রোডের ‘বৃত্ত আর্টস ট্রাস্ট’ ভেন্যুতে পোলিশ আলোকচিত্রী রাফাল মিলাচ-এর ধারণ করা ছবি নিয়ে ‘রিফিউজাল’ শিরোনামে একটি প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তিনি একজন ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট, ছবির বইয়ের লেখকও বটে। ‘রিফিউজাল’ বা ‘প্রত্যাখ্যান’ হলো বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ ও চাপ প্রয়োগব্যবস্থার দৃশ্যায়নের চেষ্টা। মূলত সামাজিক আচরণের ওপর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ এতে দেখানো হয়েছে। ১৯৭১ সালে সোভিয়েত টেলিভিশনে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়, যা ওই সময়ের সম্যক অবস্থা বেশ খোলামেলাভাবেই তুলে ধরছিল। তারই পথ ধরে রাফাল মিলাচের এই সংগ্রহ।
এবারের ছবিমেলার প্রধান একটি আকর্ষণ ছিল বিশিষ্ট লেখক অরুন্ধতী রায়ের বক্তব্য নিয়ে একট সেশন ‘আটমোস্ট এভরিথিং’। ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে এটি অনুষ্ঠিত হয়। এখানে মূলত তাঁর সঙ্গে দৃক গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা এবং ছবিমেলার পরিচালক শহিদুল আলমের মধ্যে কথোপকথন হয়।
এবারের ছবিমেলা আয়োজিত হয় ২১টি দেশের ৪৪ জন শিল্পীর কাজ নিয়ে মোট ৩৩টি প্রদর্শনী। শুরু হয় ২৮ ফেব্রুয়ারি। পর্দা নামে ৯ মার্চ।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top