skip to Main Content

ইভেন্ট I ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইক ২০২০

অনুষ্ঠিত হলো বাংলাদেশের ফ্যাশনের সবচেয়ে বড় আয়োজন ট্রেসেমে বাংলাদেশ ফ্যাশন উইকের দ্বিতীয় আসর। ২৩ থেকে ২৫ জানুয়ারি। ঢাকার আইসিসিবিতে। আয়োজক ইউনিলিভারের ব্র্যান্ড ট্রেসেমে এবং সহযোগী ফ্যাশন ডিজাইন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ। এ ছাড়া হসপিটালিটি পার্টনার ছিল পাঁচ তারকা হোটেল লা মেরিডিয়ান। এ উপলক্ষে আইসিসিবি মিলনায়তনে আগমন ঘটে দেশের নামকরা ফ্যাশন ডিজাইনার, ফ্যাশন বোদ্ধা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন ফ্যাশন কৌতূহলীদের। এবারের আয়োজনে দেশীয় ভাবনা, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির মিশেল ঘটেছে স্থানীয় ডিজাইনারদের কালেকশনে। বছরজুড়ে যেসব পোশাক নজর কাড়বে, তার ঝলক দেখা গেছে।
তিন দিন
২১ জন বাংলাদেশি এবং ৯ জন বিদেশি ডিজাইনারের নিজস্ব সংগ্রহ প্রদর্শিত হয় এবারের আসরে। প্রথম সন্ধ্যায় রানওয়েতে ছিল তিনজন বিদেশি এবং ৭ জন তরুণ বাংলাদেশি ডিজাইনারের কালেকশন। তারা হলেন বাংলাদেশের নওশিন খায়ের, রিমা নাজ, তেনজিং চাকমা, রিফাত রহমান, তাসফিয়া আহমেদ, সাদিয়া হোসেন মিশু, আফসানা ফেরদৌসী, ভারতের আনুজ শর্মা, রিধি জৈন এবং নেপালের অজয় গুরুং। দ্বিতীয় সন্ধ্যায় উপস্থাপিত হয় শৈবাল সাহা, ফারাহ আনজুম বারী, মাহিন খান, এমদাদ হক, মারিয়া সুলতানা মুমু, রুপো শামস, শাহরুখ আমিনের মতো দেশের নামকরা ডিজাইনারদের কালেকশন। আরও ছিলেন ভারতের উজ্জ্বল দুবেই (লেবেল অন্তর অগ্নি), সৌমিত্র মন্ডল এবং শ্রীলঙ্কার সোনালি ম্যারি আর ফার্নান্দো। শেষ দিনে ছিলেন বাংলাদেশের লিপি খন্দকার, কুহু প্লামন্দন, চন্দনা দেওয়ান, সারাহ করিম, রিফফাত রেজা রাকা, ফারাহ দিবা, ফায়জা আহমেদ এবং ভারতের অলকা শর্মা, আসিফ শেখ ও ভুটানের চন্দ্রিকা তামাং। ৩০ জন ডিজাইনার ছাড়াও রানওয়েতে দেখানো হয় বাংলাদেশের ৩ জন শীর্ষস্থানীয় মেকওভার আর্টিস্টের বিভিন্ন হেয়ারস্টাইল। তারা হলেন আফরোজা পারভীন, ফারজানা শাকিল ও কানিজ আলমাস খান।
রানওয়ে অব লাইফ
ফ্যাশন উইকের শুরু হয় নারীর স্বকীয়তা উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে। #ডুইটফরইউ বক্তব্যে রানওয়ে অব লাইফে হাঁটেন সংবাদপাঠক তরী, বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দলের অধিনায়ক মৌসুমি, অভিনেত্রী নাবিলা, বৈমানিক মালিহা, সংগীতশিল্পী জেফার, নৃত্যশিল্পী হৃদি শেখ, ডা. তানজিনা ইয়াসমিন, অভিনেত্রী ও মডেল সুনেহরা বিনতে কামাল ও অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সার ইশরাত। এ সময় নিজ নিজ ক্ষেত্রে সফল এই নয়জন নারীকে নিয়ে ছন্দময় পঙ্‌ক্তি পাঠ করেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী আফসানা মিমি। প্রথম দিনের হেয়ারস্টাইলিস্ট ছিলেন মেকওভার আর্টিস্ট আফরোজা পারভিন। দ্বিতীয় দিন একই নারীদের দেখা যায় মেকওভার আর্টিস্ট ফারজানা শাকিলের হেয়ারস্টাইলিংয়ে জমকালো পার্টি লুকে। শেষ দিনটিতে সবার সাজে ছিল ছুটির আমেজ। এদিনের হেয়ারস্টাইলিস্ট মেকওভার এক্সপার্ট কানিজ আলমাস খান।
জমকালো সূচনা
প্রথম সন্ধ্যায় প্রদর্শিত হয় দেশের মেধাবী তরুণ ডিজাইনারদের পোশাক। একেক ডিজাইনারের পোশাকে ছিল একেক রকম থিম। যেমন তাসফিয়া আহমেদ বেঙ্গল টাইগারের স্ট্রাইপ এবং নকশি কাঁথা থিমে ফিউশনধর্মী পোশাক নিয়ে হাজির হয়েছেন। বাঙালি গয়নার নকশা অনুপ্রাণিত প্রিন্টের উপস্থিতি ছিল রিমা নাজের পোশাকে। ডেনিমের ওপর হাতে আঁকা বিভিন্ন প্রাণীর ছবি শোভা পায় সাদিয়া হোসেন মিশুর ডেনিমেল কালেকশনে। ফ্যাশনের মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষার মন্ত্রণা দিয়েছেন আফসানা ফেরদৌসি। সুন্দরবন বাঁচানোর তাগিদে এই থিমে নানা রকম পশুপাখির নকশায় তিনি তৈরি করেছেন ড্রেস, টপ, স্যুট, শার্ট, প্যান্ট। তবে এই সন্ধ্যার সবচেয়ে নজরকাড়া কালেকশনগুলো ছিল নওশিন খায়ের এবং তেনজিং চাকমার। অরণ্যের ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর নওশিন খায়ের ঐতিহ্যবাহী জামদানি ও খাদি কাপড়ের ব্যবহার করে এনেছেন দারুণ সব শাড়ি, জামদানির শার্ট, খাদির স্যুট, প্যান্ট, হুডি, পাঞ্জাবি, সুতির ড্রেস ইত্যাদি। টয় সোলজার মুভি থিমে ও ইউনিফর্ম স্টাইলে ইউনিক সব কোট, প্যান্ট, লং জ্যাকেট, প্লিটেড প্যান্ট, ড্রেস ছিল তেনজিং চাকমার সংগ্রহে। আরও ছিল অনিন্দ্যসুন্দর কাঠখোদাই নকশার এমব্রয়ডারি। আর রিফাত রহমান নকশি কাঁথার ফোঁড় আর জাপানি সাশিকো সূচিকর্মের মিশেলে নিয়ে এসেছেন শতভাগ সুতির পোশাক।
ভারতের ডিজাইনার অনুজ শর্মার আবিষ্কার ‘বাটন মাসালা’ টেকনিকের সেলাই ছাড়া শুধু বোতাম আর রাবার ব্যান্ডের ব্যবহারে তৈরি পোশাকগুলো ছিল অসাধারণ। নেপালি ডিজাইনার অজয় গুরুং তার প্রিয় সেলিব্রিটি ফ্যাশন আইকনদের ইন্সপায়ারড মেনসওয়্যার কালেকশন নিয়ে হাজির হয়েছেন। আর ভারতীয় ডিজাইনার রিধি জৈন তার ট্রান্সজিশনাল কালেকশনের জন্য অনুসরণ করেছেন জাপানি শিবোরি টেকনিক আর পোশাকে ব্যবহার করেছেন জিরো ওয়েস্ট কাপড়।
জমজমাট দ্বিতীয় দিন
দ্বিতীয় দিন পোশাকে বাঙালি সংস্কৃতিকে উদ্‌যাপন করা হয়। কাপড় বুননের বিলুপ্তপ্রায় শিল্প বাঁচিয়ে রাখার প্রয়াস নিয়ে ডিজাইনাররা তৈরি করেছেন তাক লাগানো সব পোশাক। দেশের শীর্ষ সাতজন ডিজাইনারসহ তিনজন বিদেশি ডিজাইনারের সংগ্রহ পরে র‌্যাম্পে হাঁটেন মডেলরা। শৈবাল সাহার সংগ্রহে ছিল হ্যান্ডলুম ওয়েভিংয়ের কাপড়ে তৈরি সর্ষে, বাদামি এবং মেরুন রঙের শাড়ি, কুর্তা, মিডি গাউন, প্যান্ট টপ, স্যুট জ্যাকেট, পাঞ্জাবি। একই থিমে কমলা-লাল, সাদা-গোলাপি, কালো-বাদামি রঙের নানা শেডের উৎসবের পোশাকের সম্ভার ছিল শাহরুখ আমিনের কালেকশনে। ক্লোরাল ক্লজেটের স্বত্বাধিকারী রুপো শামস গালিচায় এনেছেন উজ্জ্বল রঙের সারারা, কুর্তা, শাড়ি, পাঞ্জাবি সমৃদ্ধ কতুর কালেকশন। পূজা আর বৈশাখীর মোটিফ ও শখের হাঁড়ির থিমে মুমু মারিয়ার সংগ্রহে ছিল বাইকার শর্টস, সঙ্গে দেশি ডিজাইনের টপ, ফ্লেয়ার শাড়ি, ডাবল ব্রেস্টেড স্যুট স্টাইল পাঞ্জাবি। ফারাহ আনজুম বারি জামদানি মোটিফে তৈরি করেছেন চোখজুড়ানো সব শাড়ি, গাউন, কামিজ, পাঞ্জাবি, ওয়েস্টার্ন ফিউশন ড্রেস। জ্যেষ্ঠ ডিজাইনার এমদাদ হক সুতি, সিল্ক, খাদিতে প্যাস্টেল শেড ব্যবহার করে বানিয়েছেন দারুণ সব পোশাক। এই সংগ্রহে নজর কাড়ে হালকা এমব্রয়ডারি, শাড়ির সঙ্গে মেয়েদের লং ব্লাউজ, আর ছেলেদের সাবেকি ধারায় পরা পাঞ্জাবির সঙ্গে ধুতি সালোয়ার। ডিজাইনার মাহিন খান শুধু সুতি কাপড়ের মিনিম্যালিস্ট গাউন শাড়ি আর নতুন কাটের পাঞ্জাবিই প্রদর্শন করেননি, দিয়েছেন পৃথিবী রক্ষার বার্তাও। তার তৈরি পোশাক পরিহিত মডেলদের হাতে ছিল গাছ, যা বদল হয়েছে এক হাত থেকে অন্য হাতে। পোশাকের পেছনে আলাদা কাপড়ে ঝোলানো ছিল ‘লেস প্লাস্টিক ইস ফ্যান্টাস্টিক’, ‘গো গ্রিন গেট গ্রিন’, ‘দেয়ার ইজ নো প্ল্যানেট বি’ এর মতো কিছু বোল্ড স্লোগান।
এদিন আরও প্রদর্শিত হয় ভারতের ডিজাইনার উজ্জ্বল দুবেইয়ের লেবেল অন্তর অগ্নির শিলুয়েটে ভরপুর বিচিত্র কাটের সাদা-কালো ফিউশনধর্মী জেন্ডার ফ্লুইড পোশাক। সুতি, লিনেন, সিল্ক কাপড়ে বাটিক প্রিন্ট সংবলিত ইন ইয়াং অনুপ্রাণিত শ্রীলঙ্কান ডিজাইনার সোনালি ম্যারি আর ফার্নান্দো পোশাকগুলো ছিল এককথায় অসাধারণ। তার কালেকশনে ছিল লুঙ্গি, শার্ট, শাড়ি, গাউন, জাম্পস্যুট, স্কার্ট, ক্রপ টপ। কলকাতাভিত্তিক ডিজাইনার সৌমিত্র মন্ডলের অনুপস্থিতিতেই মঞ্চে দেখানো হয় সিল্ক, সুতি খাদিতে তৈরি তাঁর দারুণ সব শাড়ি পাঞ্জাবির কালেকশন।
শেষ দিনের উজ্জ্বলতা
শেষ সন্ধ্যায় দেশীয় কৃষ্টি ও পশ্চিমা প্রেরণা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কুহু প্লামন্দনের ডিজাইনে সিল্কের তৈরি পাশ্চাত্য ধাঁচের পোশাকে মুখ্য ছিল সুন্দরবন রক্ষার তাগিদ। মোটিফ পশুপাখি। চন্দনা দেওয়ান শখের হাঁড়ির মোটিফে ডুপিয়ান, সুতি ও রেমি কটন ব্যবহার করে তৈরি করেছেন উজ্জ্বল রঙের শাড়ি, শেরওয়ানি আর ফিউশনধর্মী পোশাক। লিপি খন্দকারের শুভ্র পোশাকগুলো গ্রামবাংলার বিয়েতে ঘর সাজানোর কাগজের ঝালরের অনুপ্রেরণায় তৈরি। জামদানির ওপর জারদৌসি ও গোটাপাত্তি কাজের জমকালো ডিজাইনের বাহার ছিল সারাহ করিমের সংগ্রহে। ফারাহ দিবার পোশাকে প্রাধান্য পেয়েছে মরা গাছের বাকল আর আসবাবের কাঠের নকশা। ফাইজা আহমেদের ক্ল্যাসিক ট্র্যাডিশন, সঙ্গে পপ কালচারের মিশ্রিত কালেকশনের প্রতিটি পোশাকে ছিল টেপা পুতুলের প্রিন্ট। ডিজাইনার রাকার সংগ্রহে ছিল হালকা প্যাস্টেল শেডের মসলিন ও সুতি কাপড়ের শাড়ি, কামিজ, পাঞ্জাবি, মিডি গাউন; সঙ্গে শর্ট ও লং জ্যাকেট।
অন্যদিকে দেশি ডিজাইনারদের পাশাপাশি তাক লাগিয়েছে আমন্ত্রিত বিদেশি ডিজাইনারদের সংগ্রহ। ভুটানিজ সাসটেইনেবল ডিজাইনার চন্দ্রিকা তামাং পশ্চিমা ধাঁচের পোশাকে তুলে ধরেন নিজের দেশের আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী বুনন ও প্যাটার্ন। ভারতীয় ডিজাইনার অলকা শর্মার কালেকশন ছিল ডাবু প্রিন্টের মোগল ঘরানার আনারকলি, শাড়ি, স্কার্ট-টপস, পাঞ্জাবি, টুপি। তবে এই সন্ধ্যার সবচেয়ে বেশি মনোমুগ্ধকর কালেকশন ছিল ভারতীয় ডিজাইনার আসিফ শেখেরই। চমকজাগানিয়া সূচিকর্মের কারুকাজপূর্ণ পোশাকের মোটিফ বিভিন্ন রকমের পাখি। সাদা সিল্ক ও সুতি জমিনে নীল রঙের পাখিগুলো ধাতুর সুতায় ফুটিয়ে তুলতে বয়নশিল্পীদের খরচ হয়েছে পঞ্চাশ হাজার ঘণ্টা। মোহনীয় কালেকশনের শাড়ি, লেহেঙ্গা, সালোয়ার-কামিজ, পাঞ্জাবিগুলো দেখে হাততালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে হল।
বাংলাদেশের ফ্যাশন ও সংস্কৃতিকে আন্তর্জাতিক পরিসরে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে অনেক দিন ধরে কাজ করছে ফ্যাশন কাউন্সিল অব বাংলাদেশ। সেই প্রয়াসে তাদের সহযোগিতায় আয়োজিত এই ফ্যাশন উইকের বয়স মাত্র দুই বছর হলেও আয়োজনে অপরিপক্বতার ছাপ নেই বললেই চলে।

 ফাহমিদা শিকদার
ছবি: স্টুডিও লরেঞ্জো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top