skip to Main Content

এই শহর এই সময় I সুতায় বোনা বাংলাদেশ

শিল্পী তারশিতের জন্ম দক্ষিণ ইতালিতে। প্রাচ্যের শিল্প ও ঐতিহ্য সম্পর্কে এই শিল্পীর ছিল বিশেষ জ্ঞান ও আগ্রহ। স্থাপত্যবিদ্যায় স্নাতক ফ্লোরেন্সের আর্কিটেকচার ইউনিভার্সিটি থেকে। বিভিন্ন স্থাপনার নির্মাণ-অবশেষ তিনি পাঠ করেছেন। তখন থেকেই হয়তো তিনি জানতেন যে মানুষের মন আর স্থাপনার গড়নে রয়েছে এর নিগূঢ় সম্পর্ক। শিল্পচর্চার মধ্য দিয়ে তিনি ইতালি ও ভারতের মিল ও ঐক্য আবিষ্কার করেছেন। সংস্কৃত শব্দ তারশিত মানে হলো জ্ঞান ও সৃষ্টির তৃষ্ণা। এই নামটি তাকে দিয়েছিলেন ভারতের গুরু ভগবান শ্রী রজনীশ। তার ইতালীয় নাম নিকোলা স্তিপলি।
সম্প্রতি ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত হয়ে গেল শিল্পী তারশিতের দ্য রেড থ্রেড অব বাংলাদেশ নামক শিল্প প্রদর্শনী। তিনি বিভিন্ন স্থানীয় লোকজ ও আদিবাসী শিল্পীদের কাজ নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারপর তিনি তাদেরকে সৃষ্টিশীল ও ধারণাগত জায়গা থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন, যাতে করে দুয়ে মিলে একটা অর্থপূর্ণ ও সুন্দর কিছু সৃষ্টি হয়।
এই প্রদর্শনীতে হস্তশিল্পের কোনো ফর্মেরই পরিবর্তন না করে, ঐতিহ্যগত নিজস্বতা তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি উপাদান এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন পৃথিবীর সৌন্দর্য একই ছন্দে প্রকাশিত।
তারশিত মনে করেন, সাধারণের অংশগ্রহণই হলো শিল্পের সার্থকতা। শিল্পীর কাছে শিল্প মানেই ঐক্য, সংহতি; যেকোনো সীমারেখার ঊর্ধ্বে তা পৌঁছাতে পারে।
বছরের পর বছর তিনি সময় ব্যয় করেছেন ভারত, বাংলাদেশ ও নেপালের খাঁটি লোকজ শিল্প ও শিল্পকর্ম বের করে আনতে। তিনি এশীয় দেশগুলোর শিল্পী ও কারিগরদের সঙ্গে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও সমন্বিতভাবে কাজ করেছেন। সেই থেকে তিনি তার নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি করেছেন। তাঁর সঙ্গী শিল্পীদের উপস্থাপনে রয়েছে তাদের নিজস্ব প্রতীকী ভাষা এবং আলংকারিকতা। এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে তারশিত চেষ্টা করেছেন সৃষ্টিশীলতার পাশাপাশি তাদের সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে।
নিজের কাজের নাম তিনি দিয়েছেন ডিগনিটি অব এটারনিটি বা শাশ্বতের মাহাত্ম্য। উপাদানের সরাসরি প্রয়োগ তার ভাবনাকে স্পষ্ট করে তুলেছে। তিনি কাঁথা ও মৃৎপাত্র- দুটোকেই সমান মর্যাদায় রেখে শিল্প নির্মাণে ব্রতী থেকেছেন। তেমন কাজগুলো হলো ডিভাইন গিফট, দ্য উইসডম অব এম্পটিনেস, স্পিরিট অব গ্রেস, বিউটি অ্যান্ড পারফেকশন ইত্যাদি।
যশোরের কাঁথাশিল্প তার মন ছুঁয়েছে। বিশেষ করে কাঁথার ফোঁড় ও মোটিফ। ফোঁড়কে তিনি ব্যবহার করেছেন গতিশীল রেখার মতো করে। সেই ফোঁড়ে তৈরি করেছেন পাড়, তার ওপর রয়েছে মৃৎপাত্র। মৃৎপাত্রের গা ঘেঁষে চলে যাওয়া ফোঁড় দিয়ে সাজিয়েছেন ছবির চিত্রপটকে। যেন শূন্যতায় শান্তির মাঠ। স্বর্ণপত্র, কাঁথার কাপড়, ফোঁড়, পাড়- এসব উপাদান প্রয়োগে শিল্পী রচনা করেছেন এই সিরিজের কাজ।
ধর্মীয় বিশ্বাস ও লোকশিল্পের মিশ্রণ রয়েছে তারশিতের কাজে। তার অধিকাংশ শিল্পকর্মে রয়েছে নদী ও নৌকার গল্প। নোয়া বা নুহের বন্যার বর্ণনা তিনি করেছেন নতুন রূপে। যশোরের কাঁথার ফোঁড়ে ফুটিয়ে তুলেছেন সমুদ্রকে আর অ্যাক্রিলিক রঙে দেখিয়েছেন নৌকা ও নৌকাভর্তি বিভিন্ন গাছ, লতাগুল্ম ও ঘরবাড়ি।
পশু, পাখি, ফুল, গাছ ও লোকজ মোটিফ এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতীকী রূপ নিয়েই তার মগ্নতা। স্থপতি হওয়ার কারণে হয়তো নকশাকরণে অনেকটা জ্যামিতিক নিয়মকানুন মেনে চলেছেন অথবা হতে পারে সংস্কৃতিগত আন্তঃসম্পর্কের অভিজ্ঞতাকে নকশায় রূপান্তর করেছেন।
তার স্ক্রলের মতো শিল্পকর্মগুলোতে কাঁথা ফোঁড়ের মাধ্যমে মোটিফই শুধু নয়, রয়েছে বিভিন্ন রঙের মাধ্যমে অলংকৃত ভৌগোলিক চিত্র, মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা। এগুলোয় গ্রামীণ মানুষের জীবনচিত্র প্রকাশ পেয়েছে।
এজ গ্যালারিতে হয়ে যাওয়া তারশিতের প্রদর্শনীতে যে নতুন শিল্পকর্মের সমাবেশ ঘটেছে, তাতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, প্রাচীন ও সমকালীন শিল্পদৃষ্টির সমন্বয় লক্ষ্যযোগ্য।
তারশিতের কাজ এই বার্তা দেয় যে, প্রকৃতির ক্ষমতা অসীম। এর প্রকাশে তিনি অধ্যাত্মবোধ ও মানবতার আশ্রয় নিয়েছেন।

 উম্মে তানিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top