skip to Main Content

এডিটর’স কলাম I মহাঐক্যের উৎসব

প্রতিটি বস্তুর আলো ও অন্ধকার দিক আছে। কিন্তু প্রকৃত মানুষ অন্ধকারের পঙ্কিলতা সরিয়ে আলোর ঐশ্বর্যে পৌঁছতে চায়, সেখানেই প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলন, কেউ কারও থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার স্থান সেটি নয়

গোটা পৃথিবী এখন গ্যালারি। মানে, বিশ্বকাপ ফুটবলের উন্মাতাল হাওয়া বইছে দুনিয়াজুড়ে। বাংলাদেশের পালেও তা লেগেছে। মিডিয়া, রেস্তোরাঁ, ক্যাম্পাস, পাড়ার চা-দোকান, অফিস, গণপরিবহন, রেলের অপেক্ষাঘর– কোথায় নেই এই খেলা নিয়ে আলোচনা? এই তো, অসুস্থ এক আত্মীয়কে দেখতে দিন কয়েক আগে একটা হাসপাতালে গিয়েছিলাম। রিসেপশনে ঢুকতেই দেখি, সবাই দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই তাকানো আর সব তাকানোর মতো নয়। উত্তেজনা, উদ্বেগ, কৌতূহল, আশা, আনন্দ– সব তাতে একাকার হয়ে আছে। কারণ, বড় পর্দার একটা টিভিতে রাশিয়া বিশ্বকাপের লাইভ চলছে। দর্শকদের ঔৎসুক্য দেখে মনে হলো বড় কোনো দলের খেলা চলছে। হঠাৎ চিৎকার– ‘গোল!’ উল্লাসের শব্দ, প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত স্বর– ‘দারুণ’, ‘দুর্দান্ত’, ‘অসাধারণ’, ‘সাংঘাতিক’ ইত্যাদি শব্দে জড়ানো। ভাবলাম, এখানকার দর্শকদের মধ্যে অনেকেই ডাক্তার দেখাতে এসেছেন। কারও কারও স্বজন হয়তো দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। ফুটবল তাদের ক্লেশ-ব্যথা-উদ্বেগ কত দ্রুত ভুলিয়ে দিয়েছে! হয়তো ওষুধের পক্ষে এত তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব হতো না এটা, কিংবা কোনো মনোরোগ চিকিৎসকও হয়তো পারতেন না অসুখ ভুলিয়ে দেওয়ার এমন চটজলদি কাজ।
কিন্তু উল্টো চিত্রও তো আছে। খেলা চলাকালে মাত্রাছাড়া উৎকণ্ঠায় হার্ট অ্যাটাকে স্টেডিয়ামের মধ্যেই মৃত্যু ঘটেছে সমর্থকের– এমন খবর আমরা পাই। প্রিয় দলের পরাজয়ের শোকে হৃদ্যন্ত্র থেমে গেছে, এ-ও তো ঘটে বলে জেনেছি। এমনকি, হেরে যাওয়ার বেদনা সামলাতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে, এমন নজিরও আছে। আবার আত্মঘাতী গোলদাতা মাঠের বাইরে সমর্থকের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন– সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার কথা ভাবলে বুকটা কেঁপে ওঠে। ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপে কলম্বিয়ার আন্দ্রেস এস্কোবার সেই মর্মান্তিক ঘটনার শিকার হয়েছিলেন, এত দিনে আপনাদের ভুলে যাওয়ার কথা নয়।
প্রতিটি বস্তুর আলো ও অন্ধকার দিক আছে। কিন্তু প্রকৃত মানুষ অন্ধকারের পঙ্কিলতা সরিয়ে আলোর ঐশ্বর্যে পৌঁছতে চায়, সেখানেই প্রাণের সঙ্গে প্রাণের মিলন, কেউ কারও থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার স্থান সেটি নয়। অন্ধকারে মানুষ একা, কারণ সেখানে কেউ কারও নয়; বিপন্নতা আর স্থবিরতা এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা ছাড়া কোনো অভিপ্রায় নেই সেখানে। খেলার সময় খেয়াল করবেন, কেউ একা খেলছে না। চাইলেও বেশিক্ষণ তা ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। একটা আক্রমণ পরিণতি অর্জন করছে তখনই, যখন তা সম্মিলিত, পরিকল্পিত। আর আক্রমণটি প্রতিহত হচ্ছে তখনই, যখন প্রতিরোধ সংঘবদ্ধ ও সমন্বিত। এর প্রাসঙ্গিকতা আমাদের বাস্তব জীবনে প্রশ্নাতীতভাবেই রয়েছে। এবং এর সৌন্দর্য বর্ণনাতীত। খেয়াল করেছেন নিশ্চয়, গ্যালারিতে যারা, তাদের আনন্দ ও বেদনা, হর্ষ ও বিষাদ, উল্লাস ও নীরবতা– সব যূথবদ্ধ, কেউ নিঃসঙ্গ নয়, কেননা সবার অনুভূতি এবং এর প্রকাশ এক সুতায় বাঁধা। সব সুর একই বাদ্য থেকে যেন বেজে চলেছে। ভাবি, দুনিয়াটা যদি মানুষের এমন মহামিলনের তারে বাঁধা থাকতো চিরকালের জন্য! কী সুন্দরই না হতো!
হার-জিত খেলায় থাকবেই। তা একটা ফল কিংবা নিকাশ মাত্র। কিন্তু এর সৌন্দর্যটাই শেষ পর্যন্ত মনে গেঁথে থাকে– বল পজেশন, ড্রিবলিং, ট্যাকল, রিসিভিং, ইন্টারসেপশন– সবই তো সুন্দর। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি সুন্দর খেলার পরের সেই দৃশ্য, যখন উভয় দলের খেলোয়াড়েরা হাত মেলান পরস্পর, জড়িয়ে ধরেন একে অন্যকে। তখন মনে হয় এরা কেউ কারও প্রতিপক্ষ ছিলেন না; তারা শেষ পর্যন্ত এক; জার্সির রঙটাই কেবল আলাদা। মাঠে দুটো দলের মধ্যে যেহেতু খেলা হয়, অংশ তো নিতেই হবে কোনো একটায়! সত্যি, তাই অনুভব করি আমি।
আরেকটা ব্যাপার খুব ভালো লাগছে আমার। তা হলো, সারাদিন চাকরি বা পেশা নয়তো নানা কাজের সূত্রে একে অন্যকে কাছে না পেলেও সন্ধ্যার পর আপনজনের সঙ্গে ঠিকই মিলছি, বাড়ির ড্রয়িংরুমকে গ্যালারি বানিয়ে তুলছি, উপভোগ করছি মুহূর্তগুলো। রাত জাগা হলেও ক্লান্তি আসছে না। কারণ, কাছের মানুষদের সান্নিধ্য টনিকের মতোই কাজ করে।
আপনারাও উপভোগ করুন। সবাইকে নিয়ে। জীবনের সৌন্দর্য সবাইকে নিয়েই উপভোগ করতে হয়। খেলায়ও তাই। নইলে গ্যালারি থাকতো না, টিভিতে সম্প্রচারিতও হতো না বিনোদনময় এই মহোৎসব। তবে খেলা নিয়ে বেশি উদ্বেগ আর উত্তেজনার কিছু নেই। ওই যে একটু আগে বললাম, মাঠে জার্সিটাই শুধু দু’রকম। বলও কিন্তু একটাই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top