skip to Main Content

কভারস্টোরি I ইতিবাচকতার জয়

‘না’কে হটিয়ে গড়ে উঠুক ‘হ্যাঁ’র জগৎ। বিষাদ, বিপন্নতা, বাধা ঠেলে আনন্দময় সার্থকতার পথে চলুক জীবন। লিখেছেন সাগুফতা শারমীন তানিয়া

অন্ধকারের উৎস হতে
প্রতিটি দিন শেষ হওয়া মানে অফেরতযোগ্যভাবে একটি দিনের সমাপ্তি, একখানা চকচকে পয়সা টুং করে কূপের অতল গহ্বরে পড়ে যাওয়ার মতন হারিয়ে যাওয়ার গল্প। এর মানে আয়ুক্ষয়, নির্বিকল্প মৃত্যুর দিকে পায়ে পায়ে আরেক কদম এগিয়ে যাওয়া। কী হবে এই দিন ক্ষয় করে? কী হয় এইভাবে বেঁচে থেকে, যখন মরেই যেতে হবে? এসব ভাবনা শহরের ওপর ঝুঁকে থাকা শীতের সন্ধ্যার চেয়ে দ্রুত নামে, আপনার চনমনে মনকে স্যাঁতা ধরা বিস্কুটের মতন কিংবা মিইয়ে আসা মুড়ির মতন করে দেয়, চাউনিতে ধরিয়ে দেয় একটি অদ্ভুত চালশে, তার নাম বিষাদ। ভাবনার এই নেতির দিকে যাওয়ার কি কোনো বিকল্প নেই?

ভাবতে পারি না কি, এই যে একটু একটু করে জীবনের বৃত্ত পুরো হতে চলেছে, এর একটি আকার সমাপ্ত হবে! একটি উদ্দেশ্য ছিল বলে এর শুরু হয়েছিল প্রথম দিনের সূর্যকে সাক্ষী করে, একদিন যখন মৃতু্যুর অবারিত দরজায় হাঁক পড়বে- তখন জীবনযাপনের গভীর কৃতজ্ঞতায় পূর্ণ হৃদয়ে নিজের হাতটি মৃত্যুর বাড়িয়ে দেয়া হাতে সমর্পণ করবো, বড় প্রসন্নতায়। ভাবতে পারি না। আমাদের জীবনের গতি এবং প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেবনিকেশ সেই প্রসন্ন পূর্ণতার পায়ে স্থান মাগতে দেয় না। অর্থ-কীর্তি-সচ্ছলতা ইত্যাদির অমোঘ টানে আমরা কবে ছিটকে পড়েছি জীবনের কেন্দ্র থেকে আমূল পরিধির দিকে, সেখান থেকে কক্ষপথ চলেছে আরও দূরের অন্ধকারে, বিপন্নতায়। ছোট ছোট প্রাপ্তি আমাদের হৃদয়কে নবায়িত করে তোলে না আর, আঘাতে জর্জর ক্লান্ত মানুষের কাফেলায় আমরা চিরযাত্রী, কত দূর আর কত দূর…, আমাদের প্রতিটি প্রচেষ্টাকে বিফল করে দিতে বাদুড়ের ডানার মতোন অন্ধকার আসে, প্রতিটি বিফলতায় আমরা আরও নিমজ্জমান হই। কিটস বলেছিলেন, এই বিষণ্নতা নামে ক্রন্দনশীলা মেঘের মতন করে, সেই মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় বসন্তের সবুজ পাহাড়, ঢাকা পড়ে যায় ফুল কিংবা রামধনু, ঢাকা পড়ে যায় প্রিয়তমের মুখ। এমিলি ডিকিনসন বলেছিলেন, এ হলো মৃত্যু অথচ যখন আপনি দন্ডায়মান, এ হলো রাত্রি-তুষার-আগুন সবকিছু একসঙ্গে অথচ কোনো কিছুই নয়। যেন আপনাকে কামিয়ে, ছুতারের যন্ত্রে ছেঁটে দিয়ে কাঠের কফিনে পুরে দেয়া হয়েছে, আবার কবে বুক ভরে দম নেবেন সেটা নির্ভর করছে একটিমাত্র চাবির ওপর। আর নাই-বা বলি, ফিলিপ লারকিন থেকে সিলভিয়া প্লাথ হয়ে জীবনানন্দ দাশ- এঁরা সবাই আপনার নেতিবাচকতাকে আরও বিচিত্র বিমর্ষতায় টেনে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।

রুদ্ধ বাণীর অন্ধকারে

ঋষিরা, বাগ্মীরা, চিন্তকরা বলে গেছেন নির্বাণ লাভের কথা, মনকে নির্লোভ-নির্মোহ-নিরাসক্ত করে তুলতে পারলে এই জাগতিক লাভ-ক্ষতি আর আমাদের এমন করে আঘাত করতে পারবে না। কিন্তু নির্বাণে সবার লাভ হয় কি? গৃহত্যাগে প্ররোচনা দেবার মতন জোছনা বারবার ওঠে আকাশে, গৃহস্থ তা দ্যাখে না, তার ঘরে জ্বলছে টাংস্টেনের হলদে বাতি, সে বাতির নিচে কলাবাদুড়ের মতন ঝুলতে ঝুলতে সে হিসাব করছে, আর কতটুকু হলে কী কী সম্ভব। মাঠের ইঁদুরের মতন সে আপনার গর্তে খুদকুঁড়ো জোগাড় করতে ব্যস্ত। যার খুদ জোগাড় হয়নি সেও যেমন ব্যস্ত, যে অঢেল খুদের টিলায় বসে আছে সেও ব্যস্ত। এই ব্যস্ততা আসক্তের ব্যস্ততা। ফলে সবকিছু ছেড়েছুড়ে নির্বাণ কি বাণপ্রস্থ ইত্যাদি নেয়া সম্ভব হয় না আর। পৃথিবী বড় চমৎকার, সুনীল-শ্যামল উত্তাল উদ্বাহু, মানুষের কীর্তি বড় বিস্ময়কর- প্রতিদিন কত উপচার নতুন করে জন্ম নিচ্ছে, এসব কিছুর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার নিরাসক্তি সহজে আয়ত্ত হবার জিনিস নয়। সুন্দরকে দেখে, বিস্ময়করকে দেখে যে হৃদয় অভিভূত হয় না, নড়েচড়ে ওঠে না, তা ঋষির হতে পারে, কিন্তু সেটি তো মরে গেছে। ফলে নির্বাণ লাভের বিষয়টিও তত্ত্বের বাইরে বেশি দূর যেতে পারে না। খাদের সামনে দাঁড়ালেই জোছনা এখনো ‘আয়-আয়’ করে ডাক দেয় বটে, জলে ভেসে যায় কার শব, তবু মানুষ ভাবতেই থাকে ‘যেতে পারি কিন্তু কেন যাব/ সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাব’। সংসারীর বড় জ্বালা, সে কৌপীন ধারণ করে একদিকে চলে যেতেও পারে না, অপ্রাপ্তির জ্বালাও সইতে পারে না, প্রাপণীয় সবকিছুর সঙ্গে ক্রমবর্ধমান দূরত্বও কমাতে পারে না। তাকে জিতিয়ে দেবার কেউ নেই, হারিয়ে দেবার জন্য আর পরাস্ত করবার জন্য আছে বড় বড় শত্রু, যেমন দারিদ্র্য, যেমন সুযোগের অভাব। ফলে অবিরাম আঘাতপ্রাপ্ত হয় সে, বিষাদক্লিষ্ট হয়, জগতের সবকিছুই যে তাকে ঠকিয়ে যেতেই বদ্ধপরিকর- সেই প্রত্যয়ই তার মনে দৃঢ়বদ্ধ হয়।

আলোকের এই ঝর্নাধারায়
ভেবে দেখলে এই যে ইতিবাচকভাবে দেখতে শেখা, ঘা খেয়েও আবার দাঁড়িয়ে উঠে কাপড় থেকে ধুলো ঝাড়তে শেখা, প্রত্যয়ের সঙ্গে গড়তে শেখা, এটি কি কেউ জন্মের সময় সঙ্গে করে নিয়ে আসে? নাকি এটি একটি চর্চা? এই যে ধনাত্মক মনোভাব এবং সেই মনোভাবকে সম্বল করে এগিয়ে যাওয়া, এর শুরুটা কোথায়, কীভাবে? ‘পজিটিভ এনার্জি’ কারও কারও জীবনে সফলতা আসবার আগেরই মন্ত্র, সাফল্য হয়তো তাই ধরা দেয় তাদের কাছে। এই যেমন মোহাম্মদ আলী বলতেন, ‘এই যে আমি বলি “আমিই সর্বশ্রেষ্ঠ”, এটা আমি শ্রেষ্ঠ হবার আগ থেকেই বলছি, শ্রেষ্ঠ কি না জানবার আগ থেকেই বলছি।’ ভেবে দেখুন, আদরের কনিষ্ঠ পুত্রের মৃত্যুর পর রবীন্দ্রনাথ ট্রেনে করে ফিরছেন, রাতের ট্রেনের জানালার বাইরে বিপুল জোছনা আছড়ে পড়েছে, সন্তানশোকের চেয়ে বড় শোক তো আর নেই, সেই প্রচ- শোকে কবির মনে হলো, এই তো বিশাল প্রকৃতির আধারাধেয়- এতেই সব আছে, কিছুই লোপ পায়নি, মৃত্যুও এর উপাদান, এখানে জীবিত-মৃত সবারই স্থান হয়ে যায়। মৃত্যুর প্রতিদিনকার যাতায়াত সত্ত্বেও আমরা জীবনে তার গভীর পদসঞ্চার শুনতে অপারগ, কবি ভাবতে পারলেন, ‘আমারে যে জাগতে হবে/ কী জানি সে আসবে কবে/ যদি আমায় পড়ে তাহার মনে/ বসন্তের এই মাতাল সমীরণে’… (এই গল্প নিয়ে দ্বিমত রয়েছে, আমি শুনেছি শ্রীমতী প্রমিতা মল্লিকের মুখে।) এই যে শোকের অভিসারী মনকে ঘুরিয়ে কর্মের পথে, সৃষ্টির পথে ফিরিয়ে আনবার প্রচ- শক্তি, এটি একটি চর্চাই তো। জীবনের এত দুঃখ-বেদনা-অপ্রাপ্তি, একে ছাপিয়ে বড় আনন্দ, বড় কর্মযজ্ঞের আহ্বানে সাড়া দেয়ার যে মানসিক শক্তি, সেটা চর্চায় বাড়ে, চর্চায় বাঁচে। স্টিফেন হকিং শারীরিক সব প্রতিকূলতাকে জয় করে আজও বেঁচে আছেন, কর্মক্ষম আছেন, এখনো মানুষের ইতিহাসে ক্রমাগত অবদান রেখে চলেছেন তিনি; হকিংকে নিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একখানা কবিতা লিখেছিলেন, অনুপুঙ্খভাবে মনে নেই, মনে আছে কেবল এমন একটি লাইন- মৃত্যু তোমায় ধন্যবাদ, তুমি আমার জেদকে অসীম করেছ!

অতল জলের আহ্বান
জীবন মূলত ট্র্যাজেডি- এই অভিজ্ঞান থেকে সত্যিকারের জীবনযাপনের শুরু, বলে গেছেন ইয়েটস। নেতিবাচক এই কথাটিকে আপাতসত্য হিসেবে ধরে নেয়া যায় কি না, উড়িয়ে দেয়া যায় কি না, সেই তর্কে যাবার আগে চলুন আরও কিছু প্রসঙ্গে দৃকপাত করি। জাতি হিসেবে আমরা বড় অতীতচারী, আমাদের প্রিয় গানগুলো ভেবে দেখুন, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’ কিংবা ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’… (অবশ্য আমাদের মধুরতম গানগুলো বিধুরতম বেদনার, একথা ইংরেজ কবি শেলি উচ্চারণ করে গেছেন। তারপরেও শেলি আকাশচারী চাতকের গানের মতন উৎফুল্ল হতে চেয়েছিলেন, প্রসন্ন-পাগলামিতে ভরে দিতে চেয়েছিলেন আকাশ-বাতাস)। জাতিগতভাবে বা ব্যক্তিগতভাবে আমরা নিজেদের যাবতীয় বিষণ্নতা এবং অপারগতাকে ভুলতে চাই আমাদের অতীতের সোনালি রঙে অবগাহন করে। অতীত আদৌ সোনালি ছিল কি না, সে কথা ভেবে দেখি না। অতীতচারণে আজকের এ মুহূর্তের কী উপকার সাধন করা যেতে পারে, তা-ও ভেবে দেখি না। বর্তমান যত বেদনাদায়ক হয়ে ওঠে, আমরা ততই অতীতে ডুবতে থাকি। ততই ভবিষ্যতের যাত্রাপথ আমাদের জন্য দূরের এবং দুস্তর হতে থাকে। অবসাদ এমন বস্তু, যা মানুষের ইতিবাচক সব রকম সক্ষমতাকে দুমড়ে-মুচড়ে তাকে জরদ্গব করে দিতে পারে। অবসন্ন মানুষ একপর্যায়ে শয্যা ত্যাগ করতেও অক্ষম হয়ে পড়ে, বাড়ি থেকে বের হয়ে দুই পা ফেলাটাও তার কাছে অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। লক্ষ্যের দিকে যাত্রার প্রথম পদক্ষেপটুকুই সবচেয়ে দুরূহ হয়ে ওঠে, লক্ষ্যের সঙ্গে দূরত্বও হয়ে ওঠে অলঙ্ঘ্য। মানুষের মন অসম্ভব শক্তিশালী, সে তার চৌখুপি আলো জ্বালা দেয়ালের একেকটা আলো নিভিয়ে দিতে থাকলে শরীরও একই অনুপাতে অসম্মত, অপারঙ্গম হতে থাকে। ভয়-অনিচ্ছা-অক্ষমতা-অনীহা-অবিশ্বাস- এসব এসে জেঁকে বসে, মানুষ তার শারীরমানসিক সকল সক্ষমতা হারায়। ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব, ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবনে নব নব’, এইই তো মানুষ, মন মরে গেলে বোধ হয় এই একটি জীবই অকর্মণ্য হয়ে পড়ে; অথচ সারা পৃথিবী শাসন করার শারীরিক ও মানসিক বল নিয়ে সে জন্মেছে। জগদীশচন্দ্র বসুর কথা লিখতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘নিজের প্রতি শ্রদ্ধা মনের মাংসপেশী। তাহা মনকে ঊর্ধ্বে খাড়া করিয়া রাখে এবং কর্মের প্রতি চালনা করে।’ বড় সত্যি কথা, এবং সে আত্মপ্রত্যয় বজায় রাখাটা বড় কঠিন।
এমন কোনো বীর, সাধক, কর্মী জন্মায়নি ইহপৃথিবীতে, যাকে অজস্র বাধাবিপত্তি পাড়ি দিতে হয়নি। অর্ধপৃথিবী শাসন করে গেছে যে দস্যুসম্রাট নির্ভয় দৃঢ়তায়, সেই চেঙ্গিস খানের শৈশব ভেবে দেখুন- দুঃসহ দারিদ্র্যের তাড়নায় খাবারের ভাগাভাগি নিয়ে ভাইয়ের সঙ্গে প্রাণঘাতী মারামারি, যৌবনে বিয়ের রাত্রিতে প্রিয়তমা স্ত্রীকে লুট করে নিয়ে গেছে দস্যুরা গোত্রান্তরে, প্রাণাধিক প্রিয় বন্ধু হয়ে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে বড় শত্রু, এর কিছুই তাকে দমিয়ে দিতে পারেনি। পৃথিবী তাকিয়ে থাকবে অপলক- এমন ইতিহাস রচে গেছেন তিনি। সাধে কি আর বলে ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’? যে জো’ন অব আর্ককে পুড়িয়ে মেরেও তাঁর বীরগাথা নস্যাৎ করা যায়নি, তাঁর সম্বল ছিল সাহসমাত্র, দরিদ্র ঘরের গেঁয়ো মেয়েটির ছিল শত্রুর ভিত কাঁপিয়ে দেবার মতন আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয়। স্টিফেন হকিংয়ের কথা আগেই বলেছি। বলেছি রবীন্দ্রনাথের কথা। বলা হয়নি আসানসোলের রুটির দোকানে সারা দিন কায়িক শ্রম করে রাত জেগে পড়াশোনা আর লেখালেখি করা কিশোর নজরুলের কাহিনি। ঊহ্য রাখা যায় না বাতে এবং হাড়ের যাতনায় ক্লিষ্ট মাইকেলেঞ্জেলোর কথা। কিংবা ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত মনীষা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, থমাস আলভা এডিসন বা রোয়াল্ড ডালের গল্প। বলা হয়নি একটি ছবি জীবদ্দশায় বিক্রি করতে না পারা শিল্পী ভ্যান গঘের জীবনকথা। বাদ পড়ে গেছে হুইলচেয়ারে বসে থাকা শিল্পী মাতিসের কথা। ফ্রিদা কালোর জীবনালেখ্য, হেলেন কেলারের কথা, স্টিভি ওয়ান্ডারের কথা, সুধা চন্দ্রনের সংগ্রামের কাহিনি। বলা হয়নি পা হারিয়েও মাউন্ট এভারেস্ট জয় করা অভিযাত্রী অরুণিমা সিনহার কথা। এমনকি, অজস্র পপতারকার কিংবা চলচ্চিত্রতারকার নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁরা এ জীবনে জন্মেই পরিত্যক্ত হয়েছেন, সৎবাবা-মায়ের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন, আধুনিক দুনিয়াতেও দাসদের মতন বিক্রি হয়েছেন, প্রিয়তম মানুষের কাছে চরম নির্যাতিত হয়েছেন, এরপরেও ঘুরে দাঁড়িয়েছেন, কাজ করেছেন, শিল্পকীর্তি গড়েছেন, স্রষ্টা হয়েছেন এবং অবশেষে আলোর ঝালরের নিচে সহাস্যে দাঁড়িয়ে নিজের জীবনকাহিনি অকুণ্ঠভাবে বলে যাওয়ার সাহস রেখেছেন। আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছিলেন, মানুষ ধ্বংস হতে পারে, কিন্তু পরাজিত হয় না। সেই অপরাজিত স্পৃহার জয়গান কতভাবে কত বৃহদাকারে এসব মানুষের মহিমান্বিত জীবনে লেখা আছে, পড়েই দেখুন।

আনন্দ-মাঝে মন আজি করিব বিসর্জন

জীবনযুদ্ধে যতবার গুঁড়িয়ে যাবেন বলে মনে হবে, ততবার আরও একটিবার ভেবে দেখুন এই জীবন, এই সক্ষমতা, এই শরীর এবং চিন্তার জঙ্গমতা একত্রে কী অসম্ভব নবায়নক্ষম একটি শক্তি। যতবার ভূলুণ্ঠিত হবেন, ততবার আরও একবার বাঁচবার কারণের অভাব হবে না। শুধু দৃষ্টিভঙ্গিটুকু যদি পাল্টাতে পারেন। আজকাল কত কী উপায় বেরিয়েছে মনকে সুসংহত করবার, মাইন্ডফুলনেস, ধ্যান, যোগ, আকুপাংচার; মন যেন বারবার জীবনের দহনের গল্পই চোখের সামনে এনে না দেয়, বঞ্চনাই যেন এর একমাত্র সুর না হয়। আগেই বলা হয়েছে, ইতিবাচকতা একটি চর্চা, একটি পন্থা যাতে মনকে চালিত করতে হয়। পরনিন্দা-পরচর্চা-দোষারোপ- এসব অভ্যাস থেকে বের হয়ে এসে দৈনিকভাবে চেষ্টা চালাতে হয় নেগেটিভ শব্দ না বলবার, নিজেকে নিয়ে গ্লানিকর চিন্তা না করবার, সার্বিক বিষাদময়তার স্রোতে ভেসে না গিয়ে কার্যকারণ নিরপেক্ষভাবে বিচার করবার, নিজেকে ক্ষমা করবার এবং নিজের ভেতরকার ভালোটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট হবার, মনকে বেপথুমতী হতে না দেবার। এই যে, অনন্ত ষড়যন্ত্রে আপনার চারদিকের বিপুল বিশ্ব পরিচালিত হচ্ছে, আপনাকেই ঠকিয়ে-বিনাশ করে-উচ্ছন্নে নিয়ে যাবার জন্য, সেই মন্ত্র থেকে বের হয়ে আসুন। ভালো থাকবার ব্যক্তিগত লড়াইটুকু ছড়িয়ে দিন নিজের কর্মক্ষেত্রেও। ইন্দিরা গান্ধী বলতেন, জগতে দুই শ্রেণির মানুষ রয়েছে- ‘কেউ কাজ করে আর কেউ ওজর অজুহাত দেয়।’ আপনি সেই দুই শ্রেণির কোনটিতে? প্রতিকূলতা থাকবে, প্রতিবন্ধকতা থাকবে, তার ভিতর দিয়ে আপনি কি নিজের সৃষ্টিশীল, গঠনমূলক কাজটুকু করতে সক্ষম? দেখুন, মানুষের কল্যাণভাবনা আজ জরাকে দূর করছে, চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষমতা দিন দিন মানুষের জীবনের মেয়াদ বাড়িয়ে চলেছে, কল্পনা যতটুকু যায়, তার চেয়ে বেশি দূরে বিজ্ঞান তাকে টেনে নিয়ে যেতে পারছে। এই অসম্ভব পজিটিভিটির স্রোতে নিজের ইতিবাচক চিহ্নটুকু রেখে গেলেন তো? সামান্য যত্নে যে শরীর হিল্লোলিত হয়ে ওঠে, যে মন চনমন করে ওঠে আরও একবার বাঁচবার প্রেরণায়, সেই দেহমনে মনোযোগ দিলেন তো? জীবনে অপরের কুশলসাধন করে গেলেন তো? প্রাণের অবিনাশিতার প্রমাণ হিসেবে যাদের রেখে গেলেন, সেই সন্তানদের হাতে যুক্তি-সত্য-নিষ্ঠার চাবিগুলো দিয়ে যেতে পারলেন তো? মৃত্যুতে আপনার রক্ত-মাংস-যকৃৎ-বৃক্ক-প্লীহা-চক্ষু-ত্বক যা কিছুতে মরণোত্তর অন্যের উপকার সাধিত হয়, সেইটুকু করে গেলেন তো? ছোট ছোট ইতিবাচক কাজ করে আমরা আমাদের জীবনকে এবং আমাদের স্পর্শ করে থাকা আরও অজস্র জীবনকে উজ্জ্বল করে তুলতে পারলাম তো? ‘একটু স্নেহের কথা প্রশমিতে পারে ব্যথা’, সেটুকুও উপেক্ষা করে চলে গেলাম না তো? শুধু বেদনায়, নেতিবাচকতায়, হতাশায় ডুবে থেকে জীবনের অজস্র দানকে অস্বীকার করলাম না তো?
উপনিষদের আনন্দবাদী ঋষিদের প্রতিধ্বনি করে আপনিও ভাবতে পারলেন কি, আনন্দই অমৃত, জগৎ এক অনন্ত আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণলিপি, যাঁর ছায়া অমৃত, তাঁর ছায়াই মৃত্যু। ‘সকল দৃশ্যে সকল বিশ্বে আনন্দনিকেতন।’ সেই যে ঋষিরা বলে গেছেন, ‘আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি’- তিনি পরমানন্দ- সেই আনন্দ হতে এই আকারসম্পন্ন সব বস্তু উৎপন্ন হচ্ছে, সেই আনন্দেই এরা জীবিত রয়েছে এবং ধনী-দরিদ্র, রাজা-প্রজা, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, সচেতন-অচেতন যা কিছু আছে- সবই অহরহ আনন্দের প্রতি গমন করছে এবং আনন্দের মধ্যেই প্রবেশ করছে। আনন্দম! আনন্দম! আনন্দম!
আমাদের গান হোক সমবেত,
‘আনন্দ চিত্ত-মাঝে আনন্দ সর্ব কাজে,
আনন্দ সর্বকালে দুঃখে বিপদজালে,
আনন্দ সর্বলোকে মৃত্যুবিরহে শোকে
জয় জয় আনন্দময়।’
আমাদের গান হোক একান্তে- ব্যক্তিগত অনুভবেও হোক ইতিবাচকতার জয়-
‘সন্ধ্যে নামার সময় হলে পশ্চিমে নয়, পূবের দিকে,
মুখ ফিরিয়ে ভাববো আমি কোন দেশে রাত হচ্ছে ফিকে’

মডেল: মৌসুম, ওশিন ও তিথি
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: ট্রাস্ট মার্ট
ছবি: তানভীর খান

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top