skip to Main Content

কভারস্টোরি I ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বাঁকবদল

ক্রান্তি বা ক্রসরোড- যেটাই বলি, এমনই এক সময় পার করছে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি। পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে বন্ধ করে দিতে হচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বিশেষত ছোটগুলো। তবে বড়দের সবাইও যে খুব ভালো আছে তা নয়; বরং অনেকেই হাতবদল করছে। কিংবা জুতসই ক্রেতা খুঁজছে। বাংলাদেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং এর পশ্চাৎপট অনুসন্ধানের প্রয়াস করেছেন শেখ সাইফুর রহমান

দিন কয়েক আগের ঘটনা। কোনো একটা কাজে গুলশানে গিয়েছি। ফেরার সময় বনানী ১১ নম্বর রোড দিয়ে আসতে নতুন একটা ফুডশপের নাম চোখে পড়লো। সুন্দর গ্রাফিকস। মনহরা। হঠাৎ ধন্ধে পড়ে গেলাম। এখানে না সোল ড্যান্স ছিল? তাহলে কি বন্ধ হয়ে গেল! মনটা বিষণ্ন হলো। নতুন শতকের সূচনায় সোল ড্যান্স রীতিমতো ক্রেজ। তরুণদের কাছে এই হাউজের পোশাক তখন পরম কাক্সিক্ষত। ডিজাইন, প্যাটার্নের বদৌলতে। নামেও চমক। এমনকি ভিজ্যুয়াল মার্চেন্ডাইজিংও আকর্ষক, আধুনিক। তৈরি পোশাকশিল্পের নেপথ্য সহায়তায় সোল ড্যান্স একটা অবস্থান নির্মাণে সক্ষম হয়। আমার কাছে এখনো এই ব্র্যান্ডের একটি প্যান্ট আছে। অথচ কিনেছিলাম ২০০৭ সালে। সেটাও তাহলে বন্ধ হয়ে গেল? খবর নিয়ে সেটাই নিশ্চিত হলাম। মনটা খারাপ হলো। তবে ব্র্যান্ডটির ফেসবুক পেজটা আছে। ছবিগুলো নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন করে।
তৈরি পোশাক খাতের শীর্ষ কুশীলবেরা যখন একে একে এসে দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির মার্কেট শেয়ার দখলের লড়াইয়ে জোরেশোরে নেমেছেন, তখন সোল ড্যান্সের এই পরিণতি বিমর্ষ করে বৈকি।
সোল ড্যান্স প্রসঙ্গে মনে পড়ে অভিন্ন পরিণতির আরেকটি ফ্যাশন হাউজের কথা। মাঝ আশি থেকে নব্বইয়ে একই রকম সাড়া জাগিয়েছিল। অনেকেই নামটা মনে করতে পারবেন। শুনে আবার স্মৃতিকাতর হতে পারেন। বিশেষ করে ১৯৮৪-’৮৫ সালের ঈদে তাদের টিভি কমার্শিয়াল। ঠিকই ধরেছেন, পিয়ারসন্স। সেই সময়ে তাদের ট্রেন্ডি অ্যাপ্রোচ অনবদ্য। বাংলাদেশে বলতে গেলে প্রথম বড় ফ্যাশন শোও করে তারা। সেটা নব্বইয়ের শুরুর দিকে। সম্ভবত ’৯২ সালে। ’৮৪ সালে ছোট করে শুরু হয়েছিল হোসেনি দালানে। এরপর এক বছরের মধ্যেই বড় আউটলেট করে এলিফ্যান্ট রোডে। ১৯৮৯ সালে সেরা হাউজ হিসেবে পেয়েছিল বিচিত্রা কাপ। সেবার বিচিত্রায় শামীম আজাদ লেখেন, পুরান ঢাকার বারোজন সর্দারের অন্যতম পিয়ারু সর্দারের স্মৃতি এবং একটি পায়ে চালানো সেলাই মেশিন, তিনজন কর্মী আর সামান্য পুঁজি নিয়ে হোসেনি দালানের একটি বাড়ি থেকে যাত্রা শুরু পিয়ারসন্সের। এক বছর পর রপ্তানি মেলায় সর্বাধিক পোশাক বিক্রি করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
টানা ৮ বছর পিয়ারসন্স ছিল সাড়া জাগানো নাম। কিন্তু হঠাৎ করেই বন্ধ হয়ে যায় আধুনিক এই ব্র্যান্ড। এই মৃত্যু বাংলাদেশের ঘরোয়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য দুর্ভাগ্যের। তবে কিছু ক্ষেত্রে পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, এ দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে আধুনিক করে তোলার ক্ষেত্রে পিয়ারসন্সের অবদান অনস্বীকার্য।
সোল ড্যান্স আর পিয়ারসন্সের মধ্যে মিল অনেকটাই। দুটো দুই সময়ে দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য দিকসূচক।
নব্বই দশকে ক্যাটস আইয়ের পাশাপাশি তরুণদের প্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হয় আরেকটি ফ্যাশন হাউজ। সিল। এলিফ্যান্ট রোডে শুরু। পরে আরেকটি শাখা করে বনানীর মৈত্রী মার্কেটে। এলিফ্যান্ট রোডের আউটলেটটা অনেক আগে বন্ধ হয়ে গেলেও মৈত্রী মার্কেটেরটা অনেক দিন পর্যন্ত ছিল। পরে কেবলই ফরমাল শার্ট, টাই ইত্যাদি বিক্রি হতো।
এ দেশের ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি হয়তো বিস্মৃত হয়েছে আরও একটি হাউজের নাম। তবে পুরো মাত্রায় ফ্যাশন হাউজ নয়, বলা যায় শাড়ি স্টোর। পাবনা স্টোর। বর্তমানের বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামের নিচতলায় ছিল দোকান। পরে সেটা হাতিরপুলে চলে যায়। একসময় সুবিধা করতে না পারায় বন্ধ হয়ে যায়। পাবনার বিখ্যাত কাজী পরিবারই ছিল এর উদ্যোক্তা। সেই দোকান এখন আর নেই। তবে আছে তাদের অন্য ব্যবসা। প্রিন্স কনফেকশনারির পাশাপাশি রেস্টুরেন্ট আর সুপারপশ আছে তাদের। রানি এলিজাবেথ ঘুরে যাবার ২৫ বছর পর সেই বিষয়কে নিয়ে তারা বিচিত্রায় একটা ছবিহীন বিজ্ঞাপনও দেয়। সেই সময় বিয়ে বা অনুষ্ঠানে দামি শাড়ি কেনার জন্য দোকান ছিল দুটো- পাবনা স্টোর আর ফ্যাব্রিক হাউজ। পরেরটির আউটলেট এখনো নিউমার্কেটে আছে। তবে এখন আর শাড়ি নয়, বিক্রি হয় হোম ফার্নিশিং প্রডাক্ট।
এরপর আসে টাওয়ার ফ্যাশনের কথা। আশির দশকে শওকত সাহেব বলে একজনের এই উদ্যোগ স্থায়ী হয় মাত্র বছর দুয়েক। টাওয়ার ফ্যাশনের ডিজাইনার হিসেবে সে সময় কাজ করেন হুমায়রা আফরিন উর্মি। একটা ফ্যাশন শোও হয় সেই সময়ে। প্রসঙ্গত কয়েকটি দোকানের নাম উল্লেখ করা যায়। খাদি বিতান, রং বিতান, মুসা ডাইং। এসব নাম আমাদের প্রজন্মের পাঠককে অতীতাশ্রয়ী করবে।
এরপর ফ্যাশন হাউজ তৈরির উদ্যোগ নেন কাওসার মাহমুদ। তার হাউজের নাম ছিল কারুজ। ১৯৯২ সালে এর শুরু শুধু পাঞ্জাবির দিনব্যাপী প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে। প্রচলিত ধারণার বাইরে নানা রঙের পাঞ্জাবিতে এম্বসপ্রিন্ট আর বাটিক ও ব্লক প্রিন্টের সমন্বিত ডিজাইনে মাত্র ২০০ পাঞ্জাবি এতে স্থান পেয়েছিল। সাদামাটা পাঞ্জাবিতে লাটাই, ঘুড়ি, জ্যামিতিক নকশা, দাবার ঘুঁটি নজর কাড়ে। মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ফুরিয়ে যায় সব পাঞ্জাবি। এরপর একাধিক প্রদর্শনী তিনি করেন। বিবি রাসেলকে নিয়ে একটি আর ভারতের শর্বরী দত্তকে নিয়ে আরেকটি। বর্তমানে বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার শাহরুখ আমীন ছিলেন কারুজের সঙ্গে। কারুজের মূল বিষয় ছিল প্রদর্শনী। পুরুষ ও নারী উভয়েরই পোশাক নিয়ে। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত হাউজটির নিয়মিত আয়োজন ছিল মূলত ঈদকেন্দ্রিক। পঁচানব্বইতেই ধানমন্ডিতে খোলা হয় এর আউটলেট। কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পরে কাওসার মাহমুদ প্রথম উপগ্রহ টিভি চ্যানেল একুশে টেলিভিশনে চলে যাওয়ায় কারুজের অকালসমাপ্তি ঘটে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান ফ্যাশন ফটোগ্রাফার ডেভিড বারিকদারের ফ্যাশন ফটোগ্রাফির হাতেখড়ি হয় কারুজের মাধ্যমে। সে সময়ে বিচিত্রা, অন্যদিন, আনন্দধারা, সাপ্তাহিক ২০০০সহ বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে একাধিক পুরস্কার অর্জন করে কারুজ।
ইয়েলো ২০০০-এর কথা মনে পড়ে কারও? বনিএম, অ্যাবার শিল্পীদের মতো পোশাক বানাতো হাউজটি। ধানমন্ডি ৪-এর এই হাউজ ছেলেদের অন্য ট্রেন্ডি পোশাকও তৈরি করত। ব্র্যান্ড হয়ে বন্ধ হওয়ার সংখ্যাও কম নয়। নাসরিন করিমের দিয়া, আফসানা মিমি আর টনি ডায়েসের রঙ (বর্তমানে বিজিবি সদর দপ্তরের মূল ফটকের সামনে। সেখানে এখন ভাগ্যকুল মিষ্টান্ন ভান্ডার), বুনন, ভূষণ, সেতুলি। অনেক আগেই বন্ধ হয়েছে মালিবাগ মোড়ের চম্পক, পল্লব ও শৈলী। একসময় একসঙ্গে উচ্চারিত হতো কে ক্র্যাফট, অঞ্জন’স আর ওজি। অথচ সেই ওজিও নেই। কির্তনখোলা, পিদিম, চিলেকোঠা, ম্যাকয়, ইন্ডিগো, গ্রামীণ চেক, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ ফ্যাশন বাজার, ইয়াসমিন, অরভিস বন্ধ হয়েছে। নেই রূপায়ণ, সারি ও, মে ফেয়ার, সপ্তডিঙা, ফিয়েস্তা। এসব নাম এখন আর নতুন প্রজন্ম জানবেও না। নেই ফ্যাশন ডিজাইনার শাহরুখ শহীদের হেনরিজ হেরিটেজ ও শাহরুখ’স কালেকশন। হালে বন্ধ হয়েছে মায়াসির, লাবণ্য।
তবে কয়েক বছর আগে বন্ধ হওয়া ঢাকার একমাত্র বুটিক কনসেপ্টের ফ্যাশন হাউজ অ্যান্ডেজ ফ্যাশনপ্রিয়দের আক্ষেপের কারণ হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশে অ্যান্ডেজই প্রথম এবং বরাবর অক্ষরকে মোটিফ হিসেবে বিবেচনায় রেখে গ্রাফিক্যাল প্রেজেন্টেশনে লে-আউট করেছে।
এভাবে অনেক হাউজই বন্ধ হয়েছে। কিছু কিছু ছিল যথেষ্ট সাড়া জাগানো।
তবে ডিজাইনার আনিলা হকের অ্যান্ডেজ বন্ধের কারণ ভিন্ন। তিনি জার্মানিতে থিতু হওয়ায় তাঁর পক্ষে দূরে বসে ফ্যাশন আউটলেট চালানো সম্ভব হয়নি। অ্যান্ডেজের শুরুটা ছিল পঁচানব্বই সালে। শান্তিনগরে। বর্তমানে সেখানে রয়েছে আইএফআইসি ব্যাংক। এরপর গুলশানে। একাধিকবার ঠিকানা বদল হয়ে ইউনিলিভার বিল্ডিংয়ের নিচতলাতেই ছিল। এ ছাড়া র‌্যাডিসন ব্লু হোটেলের শুরুতে সেখানে ছিল ছোট একটা আউটলেট, যেটা পরে বন্ধ হয়ে যায়। আর আনাম র‌্যাংগ্স প্লাজায় ছিল আরেকটি। তবে মূল ছিল গুলশানেরটাই। আনিলার ডিজাইন অনুসরণ করেছেন এবং এখনো করেন অনেকেই। এ-লাইন পাঞ্জাবি আর কামিজ সেই কবেই তিনি প্রচলন করেন। তাঁর ফ্যাশন ডিজাইনে পূর্বের সঙ্গে পশ্চিমের মেলবন্ধন ঘটেছে। তাঁর ট্যাগলাইন ছিল ইস্ট মিটস ওয়েস্ট। পরে তিনি সিগনেচার কালেকশনও লঞ্চ করেন।
এভাবে অনেক হাউজই বন্ধ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ছিল যথেষ্ট সাড়াজাগানো। কিন্তু কেন বন্ধ হয়? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা প্রয়োজন। মোটা দাগে সবাই বিদেশি পোশাকের আগ্রাসনকে দায়ী করে থাকে। কিন্তু ২০১০ পরবর্তী বৈশ্বিক পরিবর্তন, প্রযুক্তির শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি বিশ্বকে আমাদের হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। বদলে দিয়েছে আমাদের মনোভাব। সমান্তরালে পাল্লা দিতে পারছে না আমাদের ফ্যাশন হাউজগুলো। এরই পরিণতি এই বন্ধ হয়ে যাওয়া। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক ট্রেন্ডের সঙ্গে তাল মেলাতে না পারার পাশাপাশি শখে কিংবা অন্যকে দেখে শুরুর ব্যবসা হিসেবে পরিচালনার জন্য যেসব পূর্বশর্ত, তা-ও পালনে ব্যর্থতা এই অকালসমাপ্তির কারণ। এমনকি ক্রেতাদের মনোভাব বুঝতে না পারার ব্যর্থতাকেও খাটো করে দেখা যাবে না কোনোভাবে। অধিকন্তু ডিজাইনে বৈচিত্র্য না থাকা, একঘেয়েমিতে ভরা প্রডাক্ট লাইন, ইউনিকনেস তৈরিতে অদক্ষতা আর ব্র্যান্ডিংয়ে অপারঙ্গমতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে একটা নতুন মেরুকরণও দেখা যাচ্ছে। কিছু হাউজ বন্ধ হচ্ছে বটে। সেটা হাতবদলের মাধ্যমে। অ্যান্ডেজ এই তালিকায় ছিল। কিন্তু ব্র্যান্ড হাতছাড়া করেননি আনিলা হক। তবে অন্যমেলা হাতবদল হয়েছে। উত্তরা আর যমুনা ফিউচার পার্কের স্বদেশীতে রয়েছে অন্যমেলার আউটলেট।
এরই মাঝে বিক্রি হয়েছে একটি জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউস- অরণ্য। রুবি গজনবী ব্যক্তি উদ্যোগে এবং বিসিকের সহায়তায় ১৯৭৮ সালে অরণ্য প্রতিষ্ঠা করেন। এর বিশেষত ভেষজ রঙে রাঙানো পণ্য। এই হাউস কয়েক বছর আগে কিনে নেয় আবুল খায়ের লিটুর বেঙ্গল গ্রুপ। এরপর বনানী থেকে শাখা ছড়ায় ধানম-িতে। এবার যাচ্ছে উত্তরায়। তবে বিক্রি করে দিলেও অরণ্যের সাথে হিসেবে এখনো সম্পৃক্ত আছেন রুবি গজনবী।
এরপর মালিকানা বদল হয় স্টুডিও এমদাদ-এর। তৈরি পোশাক খাতের বড় একটি প্রতিষ্ঠান মন্ডল গ্রুপ কিনে নেয় ডিজাইনার এমদাদ হকের এই প্রতিষ্ঠান। পরে এমব্রেলা নাম দিয়ে তা চালু করা হয়েছে। এমদাদ হক অবশ্য ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন। উল্লেখ প্রয়োজন, বাংলার মেলার অন্যতম পরিচালক এমদাদ হক ওই প্রতিষ্ঠানের পণ্য উন্নয়নের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে শুরু করেন স্টুডিও এমদাদ।
তবে এই হাতবদলের চেয়েও উল্লেখযোগ্য বলতে হবে মেনজ ক্লাব বিক্রি হয়ে যাওয়া। এই ব্র্যান্ডের সাফল্যের নেপথ্যে ছিল তাদের ফরমাল শার্ট। অন্য পোশাক থাকলেও ফরমাল শার্টই মানুষকে বেশি টেনেছে। অল্পদিনেই এই প্রতিষ্ঠান ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে ছড়িয়ে যায়। ক্রেতাদের সন্তুষ্টিবিধানে সক্ষম হয়। কিন্তু একটা নির্দিষ্ট সময় পর থেকে উন্নতির পারাটা আর ঊর্ধ্বমুখী ছিল না। ফলে হাতবদলকেই সমাধান হিসেবে মেনে নিয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ।
রঙ, ফুড, তৈরি পোশাক, অ্যাকসেসরিজসহ বহুমুখী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ডেকো গ্রুপ। দেশের অগ্রগণ্য এই প্রতিষ্ঠানই কিনে নিয়েছে মেনজ ক্লাব। নতুন নাম দিয়েছে ক্লাবহাউজ। তবে মেনজ ক্লাবের মালিক মাহমুদুল হেলালের সামান্য পরিমাণ অংশীদারিত্ব রেখেই হয়েছে মালিকানা পরিবর্তন। আর এই নতুন প্রতিষ্ঠানের প্রডাকশনের দায়িত্বও তিনি পালন করবেন বলে জানা গেছে। ক্লাবহাউজ- এর চারটি আউটলেট মিরপুর ২, বসুন্ধরা শপিং মল, ওয়ারী আর যমুনা ফিউচার পার্কে। এর মধ্যে বসুন্ধরার আউটলেটটি মেনজ ক্লাবেরই ছিল।
হাতবদল বা মালিকানা বদলে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারাই যোগ দিচ্ছেন। অন্যদিকে অন্যের প্রতিষ্ঠান না কিনে সরাসরি উপস্থিতির সংখ্যাও কম নয়। তৈরি পোশাক খাতের কুশীলবদের ঘরোয়া ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে আনাগোনা শুরু হয়েছে বেশ আগেই। সোল ড্যান্সের পর আসে জায়ান্ট গ্রুপের টেক্সমার্ট ও অকাল্ট, ব্যাবিলন গ্রুপের ট্রেন্ডজ। এ ক্ষেত্রে ইদানীংকালের সফল উদ্যোগ বলা যেতে পারে রিভটেক্সের প্রতিষ্ঠান লা রিভ-এর। এরপর এপিলিয়ন গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান সেইলরও সাড়া জাগিয়ে শুরু করে। সম্প্রতি এই তালিকায় যোগ হয়েছে আরেকটি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান স্নোটেক্সের সারা। দীর্ঘ অভিজ্ঞতাই তাদের স্থানীয় বাজারে পা রাখতে উৎসাহী করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ফ্রান্সের একটি ঘটনা। সেটাই বললেন স্নোটেক্স আর সারার ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ। ফ্রান্সে একসময় গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি ছিল এমন একটি এলাকার মানুষ রিটেইলে গিয়ে সাসটেইন করেছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাকশিল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর।
বিষয়টি তাঁকে ভীষণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। বাংলাদেশের বাজারে সারা কারও প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং নিজেই নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে চায়। এমনকি কেবল বাংলাদেশেই নয়, দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়াও লক্ষ। মূল বিদেশিদের নির্দেশনা এখন অনুসরণ করতে হয়। ভবিষ্যতে সেখান থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের ব্র্যান্ডকেই বিশ্বের কাছে পরিচিত করাতে চাই- বলছিলেন খালেদ। সম্প্রতি তাদের প্রতিষ্ঠানকে শ্রম মন্ত্রণালয় সম্মানিত করেছে অকুপেশনাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি গুড প্র্যাকটিস অ্যাওয়ার্ড ২০১৭তে।
এসব অভিজ্ঞতাই স্থানীয় বাজারে তাদের টিকে থাকতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি খালেদ মনে করেন, ট্র্যাডিশনাল হাউজগুলোর সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য হলো কাঁচামালের উৎস, গুণগত মান, আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে পণ্যের মূল সমন্বয়। তৈরি পোশাক খাতে এসব বিষয় বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে দেখা হয়। দেশীয় ফ্যাশন খাতের ট্র্যাডিশনাল হাউজগুলোর এই খামতি রয়েছে।
এই তালিকায় আরও যোগ হতে যাচ্ছে স্কয়ার আর ওরিয়নের মতো প্রতিষ্ঠান। তারাও স্থানীয় বাজারে পা রাখতে উদ্যোগী হয়েছে। ভবিষ্যতে সংখ্যা আরও বাড়বে।
এই সংখ্যা বৃদ্ধি একদিকে ইতিবাচক। কারণ, সরকারের সঙ্গে স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে দরকষা সহজ হবে। বিদেশি আগ্রাসন কমবে। তবে যে প্রতিষ্ঠানগুলো বা তাদের উদ্যোক্তারা সেই স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে এই খাতকে আজকের অবস্থানে উন্নীত করেছেন, তাদের অনেকেরই অস্তিত্ব বিপন্ন হতে পারে। ফলে তারাও হয়তো বিক্রি করে দিতে চাইবেন তাদের প্রতিষ্ঠান। এখনই অনেকে খদ্দের খুঁজছেন বলে জানা গেছে। অবশ্য এর মধ্যেও কোনো কোনো হাউজ টিকে থাকবে। তবে সঠিকভাবে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন সময়ের সঙ্গে থাকা আর যুগের দাবি মেনে চলা। তবে সমান্তরালেও চলতে পারে দুটো ধারা। সেটাই স্বাস্থ্যকর ও বৈচিত্র্যময় বৈকি ইন্ডাস্ট্রির চলমান প্রতিযোগিতায়।

ছবি: কারুজ, এমব্রেলা, সারা, ক্যানভাস, লেখকের আর্কাইভ ও সংগ্রহ
কৃতজ্ঞতা: কাওসার মাহমুদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top