skip to Main Content

কভারস্টোরি I বাংলাদেশের বয়নশিল্প

নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজও টিকে আছে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প। তাঁতিরাই টিকিয়ে রাখছে বস্ত্রবয়নের এই ধারা। শত শত বছর ধরে। লিখেছেন শাওন আকন্দ
প্রাচীনকাল থেকে বাংলাদেশ নামক এই ভূখণ্ড যেসব কারণে পৃথিবীব্যাপী খ্যাতি লাভ করে আসছে, সেগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো তাঁতশিল্প। খ্রিস্টজন্মের আগে থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত কালপর্বকে বলা যায় বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সোনালি সময়। কিংবদন্তির মসলিন কিংবা বৈচিত্র্যময় নকশার জামদানির কথা সবারই কমবেশি জানা। সম্প্রতি ঢাকা এবং আশপাশের অঞ্চলে উৎপাদিত জামদানি (ঢাকাই জামদানি নামে অধিক পরিচিত) ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ অব হিউম্যানিটি হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি লাভ করেছে।
সুলতানি (খ্রিস্টীয় তেরো থেকে ষোলো শতক) ও মোগল আমলে (খ্রিস্টীয় ষোলো থেকে আঠারো শতক) বঙ্গের বস্ত্রশিল্প বিশেষ প্রসার ও প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। এখানকার আর কোনো শিল্প এত প্রাচীনকাল থেকে এবং এত দীর্ঘকাল ধরে পৃথিবীতে সুনাম অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে কি না বলা কঠিন। ১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইউরোপে উদ্ভূত শিল্পবিপ্লব এবং বাংলায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠার ফলে উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়। তথাপি আজও তা টিকে আছে।
সংস্কৃত ‘তন্তু’ থেকে বাংলা ‘তাঁত’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে বলে বঙ্গীয় শব্দকোষে উল্লেখ করা হয়েছে। ‘তন্তু’ শব্দের অর্থ সুতা বা তার। কখনো কখনো ‘পরম্পরা’ বা ‘অবিচ্ছেদ্য’ অর্থেও ‘তন্তু’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। তন্তু বা সুতা দিয়ে যারা কাপড় তৈরি করে, তাদেরকে ‘তন্তুবায়’ বা ‘তাঁতি’ বলা হয়। আর যে যন্ত্রের সাহায্যে সুতা দিয়ে কাপড় উৎপাদন করা হয়, তা ‘তাঁতযন্ত্র’ (লুম) নামে পরিচিত। খুব সংক্ষেপে এই হলো তন্তু, তাঁত ও তাঁতি বা তন্তুবায় শব্দের আভিধানিক অর্থ। আর মূলত এই তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে যে শিল্প গড়ে উঠেছে, তা তাঁতশিল্প নামে পরিচিত।
আভিধানিক অর্থ যা-ই হোক না কেন, তন্তু, তাঁত ও তাঁতি- এই তিনটি প্রসঙ্গ কিন্তু সরল ও একরৈখিক নয়; বরং এগুলোর নানা শ্রেণীকরণ ও প্রকারভেদ আছে। যেমন তাঁতশিল্পে ব্যবহৃত তন্তু বা সুতা অনেক রকম হতে পারে। তুলা থেকে একধরনের সুতা হয়, যা বাংলাদেশে সুতি (কটন) নামে পরিচিত। আবার, রেশমগুটি থেকে হয় রেশমি সুতা (সিল্ক)। সেই রেশমি সুতার আছে আবার নানা রকম ভেদাভেদ। কোনোটা গরদ, কোনোটা তসর, কোনোটা মুগা কিংবা কোনোটা মটকা নামে পরিচিত। আবার গাছের বাকল থেকে হয় লিনেন, পশুর লোম থেকে হয় উলজাতীয় সুতা। এ ছাড়া আরও নানা ধরনের সিনথেটিক সুতার কথা আমরা জানি, যেমন- রেয়ন, পলিয়েস্টার, নাইলন ইত্যাদি। তাঁত ও তাঁতিসমাজ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। যেমন তাঁতযন্ত্রের আছে নানা ভেদাভেদ ও সুবিধা-অসুবিধা। আবার তাঁতিসমাজের ভেতর আছে বিভিন্ন শ্রেণি, তাদের প্রতিটির আছে আলাদা ইতিহাস।
তাঁতশিল্পের সূত্রপাত : বাংলাদেশ পর্ব
অবিভক্ত বাংলায় ঠিক কবে থেকে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত ঘটেছে, তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত, বিভিন্ন সাহিত্যিক সূত্র এবং ভাষাতাত্ত্বিক উপাদান থেকে এ সম্পর্কে আলোচনার রসদ সংগ্রহ করা যেতে পারে।
অবিভক্ত বাংলায় সবচেয়ে প্রাচীন তাম্র-প্রস্তর যুগের মানব বসতির প্রমাণ পাওয়া গেছে পশ্চিম বাংলার অজয় নদীর তীরবর্তী বর্ধমান জেলার পান্ডুরাজার ঢিবি থেকে। পরীক্ষাগারে দেখা গেছে, এর আদি স্তরটির কাল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১২৫০-১২০০ অব্দ। এই স্তরে বাংলার তাঁতশিল্পের নিদর্শন অনুপস্থিত। তবে এই প্রত্নস্থলের দ্বিতীয় স্তর থেকে একটি মৃৎখণ্ডের গায়ে রেশম-সুতি বস্ত্রের ছাপ পাওয়া গেছে বলে কোনো কোনো গবেষক উল্লেখ করেছেন। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ অব্দ (কিংবা তার আগেই) অবিভক্ত বাংলায় তাঁতশিল্পের প্রচলন হয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান করা যায়।
খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের গুরুত্বপূর্ণ মানব বসতির যে চিহ্ন পাওয়া গেছে নরসিংদী জেলার উয়ারী-বটেশ্বরে, তা থেকে এখনো এমন কোনো নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়নি, যার ওপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে যে এখানে তাঁতশিল্পের প্রচলন ঘটেছিল। তবে গবেষকেরা দাবি করছেন, এটি ছিল একটি বন্দরনগরী এবং ‘সুদূর ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে উয়ারী-বটেশ্বরের একটি সমৃদ্ধিশালী বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল’। শুধু তা-ই নয়, তারা এই প্রত্নস্থানকে মিসরীয় ও গ্রিক সূত্রে বর্ণিত সৌনাগড়া বা গঙ্গাঋদ্ধি হতে পারে বলে প্রস্তাব করেছেন। সে হিসেবে তৎকালীন উয়ারী-বটেশ্বরেও তাঁতশিল্পের কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে বলে দূর-অনুমান করা সম্ভব। কেননা, ভিনদেশি সাহিত্যিক সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, সৌনাগড়া বা গঙ্গাঋদ্ধি থেকে প্রচুর উন্নত শ্রেণির সূক্ষ্ম তাঁতবস্ত্র বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো।
অবিভক্ত বাংলায় তাঁতশিল্পের প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উপাদান পাওয়া গেছে বগুড়ার মহাস্থানগড় (খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতক), পশ্চিম বাংলার চন্দ্রকেতুগড় (খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতক) ইত্যাদি প্রত্নস্থান থেকে। এসব স্থানে মৌর্য-সুঙ্গ কালপর্বের (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক) কিছু পোড়ামাটির ফলক পাওয়া গেছে, যেগুলোয় সে সময়ের বস্ত্র বা পোশাকের নিদর্শন দেখা যায়। এ ছাড়া বিহারের দিদারপুর থেকে প্রাপ্ত খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের যক্ষী মূর্তিটির কথা উল্লেখ করা যায়। এই মূর্তির পোশাকের ধরনের সঙ্গে শাড়ি পরার সাদৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে শুরু করে পরবর্তীকালের যেসব পুরাতাত্ত্বিক বাস্তব প্রমাণ (পোড়ামাটির ফলক, ভাস্কর্য ইত্যাদি) পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলোয় লক্ষ করলে সে সময় সূক্ষ্ম ও স্বচ্ছ বস্ত্রের ব্যবহার ছিল বলে সহজেই অনুমান করা যায়। পোড়ামাটির ফলক বা ভাস্কর্যগুলোতে যে ধরনের স্বচ্ছ ও মিহি বস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়, তা উন্নত কৌশল ও দক্ষতার পরিচয় বহন করে। হঠাৎ করে এমনটি হতে পারে না। দীর্ঘদিনের শ্রম ও অধ্যবসায়ের ফলে তৎকালীন মানুষ বস্ত্রশিল্পে এই উৎকর্ষ অর্জন করেছিল। সে হিসেবে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের বয়স আরও প্রাচীন হওয়া খুবই সম্ভব। কিন্তু সে বিষয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো প্রত্নপ্রমাণ নেই।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষার্ধে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের হাত ধরে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় (খ্রিস্টপূর্ব ৩২১)। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের অংশবিশেষ সেই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, তা নিশ্চিত হওয়া গেছে মহাস্থানগড় থেকে প্রাপ্ত শিলালিপির মাধ্যমে। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্তের প্রধানমন্ত্রী বলে প্রচারিত কৌটিল্য (আরেক নাম চাণক্য) রচিত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁতশিল্প, বস্ত্র উৎপাদনব্যবস্থা, তাঁতিসমাজ ইত্যাদি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিবরণ রয়েছে। অর্থশাস্ত্র-এর রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ দিক কিংবা তৃতীয় শতক হিসেবে ধরা হয়। সবচেয়ে পুরোনো কিন্তু বিস্তারিত বিবরণ হিসেবে অর্থশাস্ত্র বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এ ছাড়া ভিনদেশি সূত্র হিসেবে মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা নামক গ্রন্থের বর্ণনা (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতক), নাম না জানা লেখকের দ্য পেরিপ্লাস অব এরিথ্রিয়ান সি নামক গ্রন্থের বিবরণ (খ্রিস্টীয় প্রথম শতক), টলেমির ভূগোল (খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতক) ইত্যাদির কথা উল্লেখ করা যায়। এসব বিবরণ থেকে বুঝে নেয়া যায়, মৌর্য আমলে বাংলাদেশে তাঁতশিল্প যথেষ্ট বিকশিত হয়েছিল। ফলে এ কথা বলা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না যে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের অনেক আগেই বাংলাদেশ ভূখণ্ডে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক সূত্র আমাদের সে রকমই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
ঐতিহাসিক ও ভাষাতাত্ত্বিকদের বিবরণ অনুযায়ী প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে যেসব ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অবিভক্ত বাংলা অঞ্চলে বসবাস করেছে, তাদের একটি হলো আদি-অস্ট্রোলয়েড বা অস্ট্র্রিকভাষী জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীর মাধ্যমেই বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক সভ্যতার পত্তন হয় বলে ঐতিহাসিকদের অভিমত। অস্ট্রিকভাষীদের মাধ্যমেই বাংলাদেশে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত বলে মনে করা হয়। নীহাররঞ্জন রায় লিখেছেন, ‘তুলার কাপড়ের ব্যবহারও অস্ট্রিকভাষীদের দান। কর্পাস (কার্পাস) শব্দটিই মূলত অস্ট্রিক।… পট (পট্টবস্ত্র, বাংলা পট্, পাট), কর্পপ (= পট্টবস্ত্র) এই দুটি শব্দও মূলত অস্ট্রিক ভাষা হইতে গৃহীত। মেড়া বা ভেড়ার সঙ্গে ইহারা পরিচিত ছিল।… “কম্বল” কথাটিও কিন্তু মূলত অস্ট্রিক, এবং আমরা যে অর্থে কথাটি ব্যবহার করি, সেই অর্থেই এই ভাষাভাষী লোকেরাও করে।’
কিন্তু অস্ট্রিকভাষী জনগোষ্ঠী ঠিক কখন থেকে এই অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে, তা নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্য-প্রমাণ নেই। প্রত্নতাত্ত্বিকেরা তাম্র-প্রস্তর যুগের প্রত্নস্থান পান্ডুরাজার ঢিবি ও সমসাময়িক অন্যান্য প্রত্নস্থানের মানুষেরা নৃতাত্ত্বিক বিচারে আদি অস্ট্রোলয়েড বা অস্ট্রিকভাষী হতে পারে বলে অনুমান করেছেন। কিন্তু নিশ্চিত করে বলার মতো তথ্য আজও উদ্ধার হয়নি।
তারপরও ঐতিহাসিকেরা নানাভাবে বাংলাদেশে এই অস্ট্রিকভাষী জনের সময় নির্ধারণ করার প্রয়াস করেছেন। যেমন জৈনগ্রন্থ আচারাঙ্গসূত্রতে উল্লেখিত মহাবীর-এর (খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক) লাঢ় (রাঢ়দেশ), বজজ্‌ভূমি ও সুব্ভভূমি (মোটামুটি দক্ষিণ-রাঢ়) ভ্রমণের বিবরণ থেকে অনেক বিশেষজ্ঞ অনুমান করেছেন যে রাঢ়ে-সুহ্মে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অস্ট্রিক গোষ্ঠীর ভাষা প্রচলিত ছিল। এই বক্তব্যের পক্ষে নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন, ‘আর, ছিল যে তাহার অন্য প্রমাণ, এই দুই ভূখণ্ডে এখনো অস্ট্রিক ভাষাভাষী পরিবারভুক্ত অনেক সাঁওতাল ও কোলদের বাস দেখিতে পাওয়া যায়’। এই বিবরণ থেকে বলা যায় যে অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক (কিংবা তার আগেই) অস্ট্রিকভাষীদের মাধ্যমে বাংলাদেশে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে।
বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সূত্রপাত বিষয়ে যে আলোচনা হলো তাতে দেখা যাচ্ছে, এই ভূখণ্ডে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ বা পঞ্চম শতকে ঘটেছিল বলা হলে সম্ভবত তা ভুল হবে না। তবে আগেই বলা হয়েছে, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় বা দ্বিতীয় শতকের আগের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এখনো কিছু পাওয়া যায়নি (পান্ডুরাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত রেশম-সুতিবস্ত্রের ছাপযুক্ত মৃৎখন্ডটি কিংবা সুতার চিত্রবিচিত্র মাটির পাত্রগুলোকে এখানে হিসাবে ধরা হচ্ছে না)। যদিও এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত বিভিন্ন পোড়ামাটির ফলক ও ভাস্কর্যে সে সময়ের যেসব সূক্ষ্ম বস্ত্রের ব্যবহার দেখা যায়, তাতে এই অনুমান আরও জোরালো হয় যে, বাংলাদেশে তাঁতশিল্পের উদ্ভব ও সূত্রপাত অন্তত আরও কয়েক শতক আগে হওয়াই স্বাভাবিক। বিশেষ করে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বিবরণ আমাদের সে রকম ইঙ্গিত দেয়। সব মিলিয়ে এই সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে, অন্তত খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে (কিংবা তার আগেই) বাংলাদেশে তাঁতশিল্পের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে। ভবিষ্যতে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে আরও অনেক অজানা তথ্য উদ্ঘাটিত হলে এই সময়ের পরিধি আরও বাড়তে পারে- সেই সম্ভাবনা এখনো রয়েছে।
বাংলাদেশের তাঁতশিল্প : পরিবর্তনের রূপরেখা
বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন ও গৌরবোজ্জ্বল। বিশেষ করে সুতিবস্ত্রের জন্য এখানকার তাঁতশিল্পের সুনাম ও কদর ছিল পৃথিবীজুড়ে। আমরা আগেই বলেছি, খ্রিস্টের জন্মের কাছাকাছি সময় থেকে অন্তত উনিশ শতক পর্যন্ত এই তাঁতশিল্প, কিছু উত্থান-পতন সত্ত্বেও, ধারাবাহিকতা রক্ষা করে কাজের মান ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাটতি ও চাহিদা বজায় রেখেছিল। তবে এই দীর্ঘ কালপর্বে বাঁকবদলের ঘটনাও যে কিছু ঘটেনি, তা নয়। ব্যাপক কোনো পরিবর্তন না ঘটলেও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও রাজনীতি, যুদ্ধবিগ্রহ, নতুন বাণিজ্যিক পথ চালু হওয়া, প্রযুক্তির বিকাশ, বিভিন্ন সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন- সবকিছু বিভিন্ন মাত্রায় বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে প্রভাবিত করেছে। যেমন- গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ (খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দ) ভারতের সঙ্গে বাইরের দেশগুলোর যোগাযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অনুমান করা যেতে পারে, বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যেও এর প্রভাব পড়েছে। আবার মৌর্য সম্রাট অশোকের আমলে (খ্রিস্টপূর্ব ২৭২-২৩২ অব্দ) যে বিশাল সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটেছিল, নিশ্চিতভাবেই বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের কিছু অংশ ছিল তার সেই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। ফলে সেই সাম্রাজ্যের অংশ হিসেবে বাংলাদেশের তাঁতপণ্য দেশে এবং দেশের বাইরে বিপণন হতে পারে। অন্তত কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রর বিবরণে বঙ্গের বিভিন্ন ধরনের তাঁতবস্ত্রের প্রশংসা এবং সে সময়কার রপ্তানি-বাণিজ্যের যে চিত্র পাওয়া যায়, তা আমাদের এমনটা ভাবতে সাহায্য করে। স্থল ও জলপথে সে সময় এসব রপ্তানি বাণিজ্য হতো বলে মনে করা হয়। অন্তত খ্রিস্টীয় সপ্তম শতক পর্যন্ত এই ধারা বজায় ছিল। এবং সে সময় বাংলাদেশের তাঁতশিল্পজাত বিভিন্ন পণ্যও যে তাতে অন্তর্ভুক্ত ছিল, সেটা অনুমান করা যায় সহজেই।
তবে গবেষকেরা মনে করেন, খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের পর বাংলার সমৃদ্ধ সমুদ্রবাণিজ্য হীনবল হয়ে পড়েছিল বা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। খ্রিস্টীয় সপ্তম থেকে বারো শতক পর্যন্ত আর তেমন কোনো বাণিজ্যের তথ্য মেলে না। তবে তেরো-চৌদ্দ শতকের দিকে আবার তা বিকশিত হয়ে ওঠে। সোনারগাঁ, সাতগাঁও, চট্টগ্রামের উত্থান ঘটে এই সময় থেকেই। কয়েক শতক পর আবার বাংলার সমুদ্রবাণিজ্য শুরু হবার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো মোঙ্গলদের আক্রমণ, ক্রসেড ইত্যাদি কারণে এশিয়া ও ইউরোপের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ওপরেও যে এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছিল, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
তবে পনেরো শতকের শেষে ভাস্কো-দা-গামা নামক একজন পর্তুগিজ নাবিক আফ্রিকা ঘুরে ভারতের কালিকট বন্দরে এসে নামেন (১৪৯৮)। এই ঘটনার প্রায় ১১০ বছর পর পূর্ব বাংলা মোগলদের অধীনস্থ হয় এবং ঢাকা হয় নতুন প্রাদেশিক রাজধানী। বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের নিরিখে এই দুটি অন্তত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
ইউরোপের সঙ্গে ভারতের সরাসরি বাণিজ্যপথ আবিষ্কৃত হওয়ার পর বিভিন্ন ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠী দলে দলে ভারতে এসেছিল। তারা যেসব পণ্যের ব্যবসায় নিজেদের নিযুক্ত করেছিল, তার একটি ছিল বিভিন্ন ধরনের তাঁতপণ্য। তবে বিদেশি বণিকদের কথা বলার আগে সুলতানি ও মোগল আমলের শাসকশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতার কথা বলে নেয়া যাক।
সুলতানি আমলের (তেরো থেকে ষোলো শতক) বিভিন্ন শাসক বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। বিদেশি পর্যটক বা বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানির নথিপত্রে আমরা যেসব বিবরণ পাই, তাতে নির্দ্বিধায় বলা যায়, সুলতানি আমলে বাংলাদেশ তাঁতপণ্যের একটি সমৃদ্ধ উৎপাদন কেন্দ্র ছিল। তবে বাংলাদেশ মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে এবং ঢাকা নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ার পরে এখানকার তাঁতশিল্প বিশেষ গতি লাভ করেছিল। মোগল সম্রাট এবং সভাসদেরা বাংলার তাঁতপণ্যের অত্যন্ত গুণগ্রাহী ছিলেন এবং তাঁরা অকুণ্ঠভাবে এই শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। ফলে মোগল আমলকেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল পর্ব বলা যেতে পারে।
তবে সুলতানি আমলেই বিভিন্ন বিদেশি বণিক বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের রপ্তানি বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে শুরু করেছিল। মোগল আমলে এই বাণিজ্যের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পায়। ফলে মোগল পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি এই বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধিও বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। সে ক্ষেত্রে বিদেশি বণিকদের ভূমিকাও অস্বীকার করা যাবে না।
তবে মোগল আমল শেষে বাংলাদেশে ব্রিটিশ উপনিবেশ স্থাপন (১৭৫৭) বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসে যেমন, তেমনি তাঁতশিল্পের ইতিহাসেও গুরুত্বপূর্ণ বাঁকবদল হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। যদিও প্রাথমিকভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশ হবার পর বাংলাদেশের তাঁতশিল্পে এর তেমন কোনো বিরূপ প্রভাব পড়েনি। উল্লেখ্য, মোগল আমলেও বাংলাদেশের তাঁতিরা যে খুব সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে দিন কাটাত, তা নয়। কিন্তু ব্যাপক কোনো অনিয়ম-অত্যাচার না হওয়ায় তারা সহজ-সরলভাবে জীবনযাপন করতে পারতো। কিন্তু ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজনৈতিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের হটিয়ে দিয়ে তাঁতের ব্যবসায় তারা অনেকাংশে একচেটিয়া প্রভাব বিস্তার করেছিল। এ ছাড়া বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের জন্য বৈরী রাজস্ব নীতি তৈরি করে নিজেদের দেশের তাঁতশিল্পের উন্নতি করলেও এ দেশের তাঁতশিল্পের রক্ষা ও উন্নতিতে কোনো অবদান রাখেনি। আঠারো শতকের শেষার্ধে এই অবক্ষয় শুরু হয়েছিল এবং উনিশ শতকের মধ্যে বা বিশ শতকের আগেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সোনালি দিন শেষ হয়ে গিয়েছিল।
স্বদেশি আন্দোলন এবং ঔপনিবেশিক উদ্যোগের গল্প
বিশ শতকের শুরুতেই স্বদেশি আন্দোলনের ফলে দেশে আবার চরকায় সুতা কাটা ও দেশি কাপড় ব্যবহারের জোয়ার বয়ে যায়। এমনকি বিদেশি পণ্য- বিশেষ করে বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোর কথাও জানা যায়। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, ভদ্রলোক শ্রেণির ভেতর তাঁত সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হয়। যদিও সেটা অচিরেই বিনষ্টও হয়। তা ছাড়া এ সময় দেশি উদ্যোক্তারা কলের সুতা ও বিদেশি প্রযুক্তি আমদানি করে মোটা কাপড় তৈরি করতে শুরু করেছিল, সেটাও স্বদেশি আন্দোলনেরই ফসল।
স্বদেশি আন্দোলনের পাশাপাশি আমরা লক্ষ করি যে বিশ শতকের শুরু থেকেই বাংলাদেশের তাঁতশিল্পকে বাঁচানোর কিংবা পুনরুদ্ধারের জন্য নানা রকম সরকারি উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর ফলে ঘটেছে করণকৌশলগত পরিবর্তন। বিশ শতকের শুরুতে, প্রথম ৩০ বছরের মধ্যেই, বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের সনাতনী পদ্ধতিগুলোর বদলে নতুন নতুন কৌশলের সূত্রপাত ঘটে। ফলে শত শত বছর ধরে বাংলাদেশের তাঁতিরা যে পদ্ধতি ও কৌশল অবলম্বন করে বস্ত্র বয়ন করত, তার পরিবর্তন ঘটে। এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের তাঁতশিল্পে। তৎকালীন বঙ্গীয় কৃষি ও শিল্প বিভাগ এগ্রিকালচার অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ ডিপার্টমেন্ট, গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল এবং কারিগরি শিক্ষাসংক্রান্ত সরকারি নথিপত্র দেখলে এই পরিবর্তনের কারণ ও উপলক্ষ সম্পর্কে জানা যায়। সেখানে দেখা যাচ্ছে, বিশ শতকের প্রথম দশকেই এ বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল এবং ১৯০৮ সালে সেই উদ্যোগের ফলস্বরূপ শ্রীরামপুরে একটি বয়ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্র্তীকালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আরও অনেক স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ বয়ন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এগুলোর মাধ্যমে তাঁতশিল্পের বেশ কিছু গুরুতর পরিবর্তন ঘটে। তা ঘটেছিল ১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর মধ্যেই। প্রথমত সনাতন গর্ত তাঁতে হাতে ছোড়া মাকুর বিকল্প হিসেবে ফ্লাই সাটল লুম বা ঠকঠকি তাঁতের প্রচলন ঘটে। এর ফলে বস্ত্র উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। দ্বিতীয়ত, ডবি ও জ্যাকার্ড মেশিনেরও অল্পবিস্তর প্রচলন ঘটে। এর ফলে তাঁতের কাপড়ে বিভিন্ন ধরনের নকশা করা সহজ হয়ে যায়। তৃতীয়ত, কৃত্রিম রঞ্জন পদ্ধতির সূচনা ঘটে। এর ফলে সুতা ও কাপড়ে নানা ধরনের রঙ করা সহজ হয়ে ওঠে। রঙে বৈচিত্র্য আসে।। পাশাপাশি সনাতনী প্রাকৃতিক রঞ্জনশিল্প ক্রমশ বিলুপ্ত হয়ে যেতে থাকে। এভাবে, বিশ শতকের প্রথমার্ধেই, বাংলাদেশের তাঁতশিল্প ব্যাপক কৃৎকৌশলগত পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল, যার প্রভাব এখনো বিদ্যমান।
দেশভাগের প্রভাব ও পাকিস্তান পর্ব
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের মধ্য দিয়ে দেশভাগের ফলে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের তাঁতশিল্পে প্রাথমিক যে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তা হলো তাঁতিদের দেশান্তরের গল্প। এ দেশের তাঁতিদের একটা বড় অংশ ছিল হিন্দুধর্মাবলম্বী। যেমন- বসাক তাঁতি, বঙ্গ তাঁতি, যোগী, কাপালী ইত্যাদি। তা ছাড়া আর্থিক লাভজনক এই বিবেচনায় কিংবা স্বদেশি আন্দোলনের কালে অনেক নমঃশূদ্র ও অন্যান্য জাতের লোক তাঁতের কাজ বেছে নিয়েছিল পেশা হিসেবে। তাঁতবস্ত্রের ব্যবসার সঙ্গেও যুক্ত ছিল অনেক হিন্দু ব্যবসায়ী। দেশভাগের পর তাঁতের সঙ্গে যুক্ত এই হিন্দুধর্মাবলম্বীদের একটা বড় অংশ নিজেদের ব্যবসা, বসতবাড়ি ও মাতৃভূমি ত্যাগ করে ভারতের পশ্চিম বাংলাসহ অন্যান্য প্রদেশে চলে যায়। স্বাভাবিক কারণেই এ দেশের তাঁতশিল্পের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
পক্ষান্তরে, দেশভাগের কারণে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে অনেক ইসলাম ধর্মাবলম্বী বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) চলে আসে নতুন জীবনের খোঁজে। এদের মধ্যে তাঁতের কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিল অনেকেই। অবাঙালি মুসলমান তাঁতিদের মধ্যে বেনারস থেকে আসা বেনারসি তাঁতিদের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেননা, এদের মাধ্যমে বাংলাদেশে, প্রধানত ঢাকায়, বেনারসি শাড়ির একটা নতুন ঘরানা চালু হয়। এ ছাড়া পশ্চিম বাংলা বা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বাঙালি মুসলমান তাঁতিদের অনেকে বাংলাদেশে এসেছিল। তবে তারা এ দেশের মূল তাঁতশিল্পের ধারার সঙ্গে মিশে গেছে। বেনারসি তাঁতিদের মতো তাদের এখন আলাদা করে চিহ্নিত করা মুশকিল। তা ছাড়া বিশেষ কোনো ঘরানাও তারা তৈরি করতে পারেনি।
পাকিস্তানপর্বে (১৯৪৭-১৯৭১) বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের ইতিহাসে আরও যে পরিবর্তন ঘটে সেগুলো হলো, এই কালপর্বে বাংলাদেশে অনেক কটন মিল তৈরি হয়। কেননা, দেশভাগের পর এ দেশের তাঁতশিল্পের চাহিদা মেটানোর মতো সুতার কারখানা বা কটন মিল ছিল না। সুতার অভাব দূর করার জন্য মূলত এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। তারপরও সুতার চাহিদা সে সময় পুরোপুরি মেটেনি। তৎকালীন পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে এ ধারণা পাওয়া যায়। আর পাকিস্তানপর্বে বাংলাদেশে তুলা চাষের তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। পাকিস্তানের দুই অংশের তুলায় মূল উৎপাদনকেন্দ্র ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। এর প্রতিক্রিয়া দেখা গিয়েছিল দেশ স্বাধীন হবার পর, সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে। আসলে পাকিস্তান সরকারের অনাগ্রহ ও বিরুদ্ধনীতির কারণে এ দেশের তাঁতশিল্প সেভাবে বিকশিত হয়নি।
বাংলাদেশ পর্ব
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করলে আরও অনেক ক্ষেত্রের মতো তাঁতশিল্পেরও নানা সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। তবে প্রাথমিকভাবে সবচেয়ে বড় যে সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তা হলো তুলার অভাব। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের তাঁতশিল্প তুলার জন্য পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পর সেখান থেকে তুলা আসার পথ বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিকভাবে এই সংকট মোকাবিলার জন্য সত্তরের দশকে সরকারি ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু তা নানা কারণে অচিরেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশে তুলা চাষের লক্ষণীয় কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর তুলার কল বা কটন মিলের সংখ্যা বাড়লেও তুলার জন্য বাংলাদেশ আশির দশক থেকে এখন পর্যন্ত (২০১৮) প্রায় পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল।
আশির দশক থেকে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক রঞ্জন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। খুব সীমিত পরিসরে হলেও নাগরিক মহলে এ বিষয়ে সচেতনতা বেড়েছে। তবে এখনো তা একটি গন্ডির ভেতর আবদ্ধ হয়ে আছে।
বাংলাদেশে পাওয়ার লুমের সংখ্যা আরও বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে হস্তচালিত তাঁতশিল্পের ওপর। সত্তর ও আশির দশকেও মিলের কাপড় ও হস্তচালিত তাঁতের কাপড়- উভয়েরই বাজার ছিল। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে পাওয়ার লুমের প্রভাবে এবং পাওয়ার লুমে উৎপাদিত তাঁতপণ্যের সঙ্গে টিকতে না পেরে হস্তচালিত তাঁতশিল্প ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু। এই সময় থেকেই ব্যাপক পরিমাণ হস্তচালিত তাঁতে কাপড় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং ব্যাপকসংখ্যক তাঁতি কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় যুক্ত হয়।
তবে সবচেয়ে বড় যে পরিবর্তনটি ঘটেছে, সেটা হলো বাঙালি-সংস্কৃতি ও চেতনার ওপর ভিত্তি করে হস্তচালিত তাঁতশিল্পের নতুন বাজার তৈরি হয়েছে শহরে। প্রধানত মধ্যবিত্ত ও দেশি এলিট শ্রেণি এবং কিছু বিদেশি এই বাজারের মূল ক্রেতা। সত্তরের দশকে এই বাজার তৈরি শুরু হলেও আশি ও নব্বইয়ের দশকে তা বিকশিত হয়। বর্তমানে নগরের এই নতুন বাজার দেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্পের জন্য অনেকাংশে সহায়ক হয়েছে। অনেক তাঁত কারখানায় আবার কাজ শুরু হয়েছে শহরের নতুন বাজারকে কেন্দ্র করে। নগরের এই বাজার তৈরিতে শহরের বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
তবে এখনো হস্তচালিত তাঁতশিল্পের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে শহর ও গ্রামের অগুনতি মানুষ। প্রধানত কম দামি লুঙ্গি, শাড়ি, গামছা, চাদর ইত্যাদি হস্তচালিত তাঁতশিল্পের মূল পণ্য। ছোট-বড় বিভিন্ন হাটে পাইকার ও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে এসব পণ্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
শেষ কথা
কিংবদন্তির মসলিন বিলুপ্ত হয়ে গেছে বহু আগে। তাঁতশিল্পের সোনালি দিন, পৃথিবীজুড়ে রপ্তানি বাণিজ্য- তা-ও অতীতের গল্প। শেষ হয়েছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন, পাকিস্তানি শাসনেরও অবসান হয়েছে- সেটিও বছর চল্লিশেক আগের কথা। স্বাধীন বাংলাদেশে কেটে গেছে অনেক সময়। শেষ হয়েছে বিংশ শতাব্দী। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে দাঁড়িয়ে (২০১৮) যদি বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি কিংবা ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তাহলে কি খুব বেশি আশ্বস্ত হওয়া যায়?
গত ১০০ বছরের ইতিহাস যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দেখতে পাবো, খুব বেশি আশাহত হওয়ারও কিছু নেই। এত চড়াই-উতরাইয়ের পরও এই শিল্প যে টিকে আছে, তার কারণটি কী? আগেই বলা হয়েছে, যে তুলা এখন আমরা ব্যবহার করি, তা উৎপাদন করি না, যে সুতা ব্যবহার করি, তার একটা বড় অংশ আসে দেশের বাইরে থেকে আর যে সুতা আমরা তৈরি করি, তার প্রযুক্তি আমরা আমদানি করেছি অন্য দেশ থেকে। কখনো কখনো সুতাও আনি বিদেশ থেকে। যে রঙ দিয়ে আমরা সুতা বা কাপড়গুলো বিচিত্র বর্ণে রঙিন করি, তা অন্য দেশ থেকে আমাদের আনতে হয়। জ্যাকার্ড, ডবিসহ যেসব তাঁতযন্ত্র আমরা এখন ব্যবহার করি, তার বেশির ভাগ দেশি প্রযুক্তি নয়; যদিও তা এখন দেশেই তৈরি হচ্ছে (পাওয়ার লুমের কথা এখানে বলা হচ্ছে না)। তাহলে কী আছে আমাদের নিজেদের, যা নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করতে পারি, আশাবাদী হয়ে উঠতে পারি? হ্যাঁ, আছে- তা হলো এ দেশের তাঁতি সমাজ। নানা রকম পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েও বাংলাদেশের তাঁতশিল্প, বিশেষত হস্তচালিত তাঁতশিল্প এখনো যে টিকে আছে, এর প্রধান কৃতিত্ব দিতে হবে এদেরকেই। তাঁতিরাই বাংলাদেশের তাঁতশিল্পের সবচেয়ে বড় ভরসা। নানা রকম পরিবর্তনের সঙ্গে তারা বারবার নিজেদের মানিয়ে নিয়েছে, নতুন প্রযুক্তি ও কৌশল আত্মস্থ করেছে এবং এভাবেই টিকিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের হস্তচালিত তাঁতশিল্প।

লেখক: শিল্পী ও গবেষক
মডেল: অভিনেত্রী জাকিয়া বারী মম, শ্রাবস্তী ও শান্ত
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: লা রিভ
ছবি: মাহিনুজ্জামান পিয়ান
কৃতজ্ঞতা: মাহমুদা শাড়ী হাউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top