skip to Main Content

কভারস্টোরি I বিজ্ঞাপনের ভাষা

পণ্যের সঙ্গে ভোক্তার প্রথম সংযোগটি ঘটে বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে। ভাষার ভূমিকা এতে প্রবল। শোনা ও দেখা- উভয়তই। লিখেছেন ড. ইসলাম শফিক

বিজ্ঞাপনের মধ্যে বয়ে চলছে সময়। নানা মাধ্যমে। তথ্যপ্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষের ফলে মানুষের সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, শিল্পসাহিত্য, গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম- সবকিছুই যেন চলে গেছে বিজ্ঞাপনের দখলে। চোখ মেললেই দেখা যায় চারদিকে মানুষের অবিরাম ব্যস্ততা, আধুনিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রভাব আর বিচিত্র বিজ্ঞাপন। চোখ বন্ধ করলেও কানে ভেসে আসে বিজ্ঞাপন। ঘর থেকে বাইরে পা বাড়ালেই শুরু হয় বিজ্ঞাপনের সঙ্গে চলা। রাস্তায়, বাড়ির ছাদে, মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে বিলবোর্ডের। দেয়ালে বিজ্ঞাপন না লেখার জন্যও দিতে হয় বিজ্ঞাপন। চাকরির বিজ্ঞাপন, বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন, পড়াতে চাই, পাত্রী চাই, গাড়ি-ফ্ল্যাট-জমি বিক্রি; মোবাইল মেসেজে বিজ্ঞাপন, অনলাইনে, অফলাইনে বিজ্ঞাপন- এসব আমাদের নিত্য ঘিরে রাখে। শূন্য আকাশেও ঠাঁই করে নিয়েছে বেলুন বিজ্ঞাপন। রঙবেরঙের সাইনবোর্ড, ব্যানার, পোস্টার, লিফলেট, ফ্লায়ার, ব্রুশিয়ার, নিয়ন সাইন, এলইডি ডিসপ্লে- সবই জানান দিচ্ছে এর উপস্থিতি। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট, ইউটিউব, ফেসবুক, টুইটার- সর্বত্রই দেখা যায় বিজ্ঞাপনের দাপট। এটি নিয়ন্ত্রণ করছে মানুষের আবেগ, ভাবাবেগ। মানুষের রুচি ও সাজসজ্জা, পোশাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা, জীবনধারার সবকিছুই চলে গেছে বিজ্ঞাপনসংস্কৃতির দখলে; এমনকি মানুষ কথা বলছে বিজ্ঞাপনের ভাষায়। এর শৈলী বিচিত্র। ভাষার জাদুতেই যোগাযোগের প্রাণ পায় বিজ্ঞাপন।
বিজ্ঞাপনের ভাষা নির্ধারিত হয় মূলত পণ্যের ধরন ও ক্রেতাসাধারণের জীবনমানের ওপর ভিত্তি করে। এটি মূলত পরিকল্পিত যোগাযোগ। বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পণ্য-সম্পর্কিত তথ্য জনসাধারণকে অবহিত করা হয়। এই যোগাযোগ প্রক্রিয়ার কল্যাণে পণ্য ও ভোক্তার মাঝে পারস্পরিক অদৃশ্য একটি সেতু তৈরি হয়। বিজ্ঞাপনের সাহায্যে সাধারণ মানুষের মনে পণ্যের প্রতি আগ্রহ জাগিয়ে তোলা হয়। আগ্রহী ব্যক্তি ক্রেতায় রূপান্তরিত হন। বিজ্ঞাপিত পণ্য কেনার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন। ক্রেতা বা ভোক্তার শ্রেণি নির্ণীত হয় তার আয়, জীবনধারা ও বসবাসের অঞ্চল বিবেচনায়। ভোক্তার জীবনমান, চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা- এসবের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞাপনের কাহিনি বা প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়ে থাকে। সে জন্য আইডিয়া তৈরি, শিরোনাম, বর্ণনা, সংলাপ, পে-অফ লাইন প্রভৃতি রচনার সমন্বিত কাজকে বলা হয় ‘কপিরাইটিং’। যিনি এই সৃষ্টিশীল কাজটি করেন তাকে বলা হয় ‘কপিরাইটার’। বিজ্ঞাপন এজেন্সির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টরের তত্ত্বাবধানে কাজ করেন বেশ কয়েকজন কপিরাইটার। নির্মাণের প্রস্তুতি পর্বে একজন কপিরাইটার বেশ কয়েকটি আইডিয়া তৈরি করেন। প্রাক্-পর্যায়ের আইডিয়াগুলো থেকে প্রাথমিক বাছাইয়ের পর কাজ শুরু হয়। কাহিনি, ভাষা, চরিত্র, বর্ণনা, জিঙ্গেল ও পণ্যতথ্য প্রভৃতির সমন্বয়ে রচিত হয় পূর্ণাঙ্গ একটি কপি। কপি লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্ত জায়গাটা হলো ‘সময়ের গন্ডি। একজন কপিরাইটারের প্রধান চ্যালেঞ্জই হলো নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিজ্ঞাপনটি সম্পন্ন করা। সংবাদপত্র, রেডিও, টেলিভিশন অর্থাৎ যেকোনো গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ বা প্রচারের ক্ষেত্রে প্রতিবার নির্দিষ্ট পরিমাণ অঙ্কের অর্থ গুনতে হয়। অর্থের বিনিময়ে প্রচারের কারণে এর সময়ের পরিসর খুবই সংক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। তাই বিজ্ঞাপন কপিলিখন কৌশলে সময় সংক্ষিপ্ততার বাধ্যবাধকতাগুলো সচেতনভাবেই অনুসরণ করা হয়ে থাকে। এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যেই একজন কপিরাইটার বিজ্ঞাপনের কাহিনিচিত্রে তুলে আনেন বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ, জীবনসংগ্রাম, প্রেম-প্রকৃতি, সমাজ-সংস্কৃতি, মানবতা, দেশপ্রেম ও বিশ্বলোক। পণ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহ সৃষ্টির জন্য বিজ্ঞাপনে ভাষার সাহায্যে তৈরি করা হয় ‘জাদুফাঁদ’। এর আবহ তৈরি হয় কথা, কাব্যময় বর্ণনা ও সংগীতের মিশেলে। বিজ্ঞাপনের ভাষা নির্ধারণে প্রধান ভূমিকা পালন করে পণ্যের ধরন, ক্রেতাশ্রেণির জীবনসংস্কৃতি ও প্রচারমাধ্যমের বৈশিষ্ট্য।
ভাষা সব সময় সমকালীন জীবনসংস্কৃতির অংশ। সমাজ সম্পর্কে এটি বিশ্বাসযোগ্য ধারণাও দেয়। বিজ্ঞাপনের ভাষাও সমকালীন জীবনের বাইরে নয়। একটি বিজ্ঞাপনের বিষয় ও ভাষা নির্বাচনে প্রধানত গুরুত্ব দেওয়া হয় পণ্য বা সেবার ধরন, ক্রেতার শ্রেণি ও প্রচারমাধ্যমের ওপর। গণমাধ্যমভেদে বিজ্ঞাপনের রকমফের রয়েছে। মুদ্রণমাধ্যমের বিজ্ঞাপনকে বলা হয় ‘প্রেসঅ্যাড’, রেডিও বিজ্ঞাপন হলো ‘আরডিসি’ অর্থাৎ রেডিও কমার্শিয়াল, টেলিভিশন বিজ্ঞাপনকে বলা হয় ‘টিভিসি’ অর্থাৎ টেলিভিশন কমার্শিয়াল, ইন্টারনেটের বিজ্ঞাপন হলো ‘ইঅ্যাড’ বা ‘ওয়েবঅ্যাড’। পণ্য ও প্রচারমাধ্যমভেদে ক্রেতার শ্রেণি আলাদা হয়ে যায়। সংবাদপত্রের পাঠক, বেতার শ্রোতা ও টিভি দর্শকশ্রেণির অবস্থান ও জীবনমান ভিন্নতর। বিজ্ঞাপনের এই মাধ্যমবৈচিত্র্যের কারণে নিশ্চিতভাবেই পাঠক, শ্রোতা ও দর্শক ভিন্ন ভিন্ন বয়স, লিঙ্গ ও মর্জির হয়ে থাকে। সংবাদপত্র, বিলবোর্ড, রেডিও, টেলিভিশন ও ইন্টারনেট- এসব গণমাধ্যমের প্রযুক্তিগত ভিন্নতার ফলে বিজ্ঞাপনের কপিলিখনের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য আলাদা হয়ে থাকে। যেমন কাপড় কাচা বল সাবানের বিজ্ঞাপন। তৈরির জন্য প্রথমেই ভাবনায় আনতে হবে পণ্যটির ধরন, বিক্রয়মূল্য ও কোন শ্রেণির ভোক্তাসাধারণ পণ্যটি ব্যবহার করবে- এই কটি বিষয়। ধরে নেওয়া যাক গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ এই পণ্যের প্রধান টার্গেট। অন্যদিকে স্মার্টফোনের বিক্রয় টার্গেট ‘কাপড় কাচা বল সাবান’ থেকে আপনাতেই ভিন্ন হয়ে যাবে। এর মূল কারণ পণ্যের ধরন, মূল্যমান ও ব্যবহারকারীর শ্রেণিপার্থক্য। দুটি পণ্যের ধরনবৈশিষ্ট্য, মূল্যমান ও ভোক্তাশ্রেণি সবই ভিন্ন। বিজ্ঞাপনচিত্রের কাহিনি, চরিত্র, ভাষা ও নির্মাণশৈলী সম্পূর্ণ আলাদা হবে। এ ক্ষেত্রে টার্গেট জনগোষ্ঠীর জীবনধারা ও ভাষাসংস্কৃতিকে অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। ‘কপি’ পণ্যের উপযোগী না হলে কোনোভাবেই একটি ভালো বিজ্ঞাপন নির্মাণ করা সম্ভব নয়। ক্রেতাকে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সংযুক্ত করতে সাহায্য করে এই কপি। পণ্যসম্পর্কিত তথ্য দেওয়া বিজ্ঞাপনের প্রাথমিক ও প্রধান শর্ত। তা এমনভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়, যাতে ভোক্তাদের মধ্যে পণ্যটি বিশেষ সাড়া তৈরি করে। মুগ্ধতা সৃষ্টির মধ্য দিয়ে অভীষ্ট ক্রেতাকে মোহাচ্ছন্ন করে। টার্গেট ক্রেতাশ্রেণির রুচি বিবেচনায় এনে তাদের যাপিত জীবনের গল্পকথা ও নিত্যদিনের ব্যবহৃত ভাষা একজন কপিরাইটার তাঁর কপিলিখনে ব্যবহার করেন। বিজ্ঞাপনের ভাষায় তাই বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। মুগ্ধ দর্শকশ্রোতা পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিজ্ঞাপনের ভাষার শৈল্পিক ব্যবহার মন কাড়ে সব বয়সী মানুষের। বারবার প্রচারের কল্যাণে বিজ্ঞাপন অল্প সময়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মানুষের মনের আয়নায় গেঁথে যায়, ফেরে মুখে মুখে। আধুনিক সমাজের ভাষারুচি নির্মাণে বিজ্ঞাপনের ভাষা অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা পালন করছে।
সময় পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাচ্ছে বিপণনকৌশল। আধুনিক বিপণনকৌশলের প্রধান একটি হাতিয়ার হলো বিজ্ঞাপন। মাধ্যমভেদে বিজ্ঞাপন নানান ধরনের হয়ে থাকে; তবে লক্ষ্য অভিন্ন- ক্রেতাকে আকৃষ্ট করা এবং উৎপাদিত পণ্যের বিক্রি বাড়ানো। পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সাধারণত বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে না। বিজ্ঞাপনদাতা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলো পেশাদার বিজ্ঞাপন নির্মাতা এজেন্সিকে এই কাজে নিয়োজিত করে। পণ্যের বিজ্ঞাপন পরিকল্পনা, নির্মাণ ও প্রচারের দায়িত্ব নির্দিষ্ট কোনো বিজ্ঞাপনী সংস্থা বা এজেন্সিকে দেওয়া হয়। সৃজনশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত বিজ্ঞাপনসংক্রান্ত শিল্পকর্মের একটি স্বতন্ত্র ব্যবসা পরিকল্পনা করে এজেন্সিগুলো। ব্র্যান্ডিং পরিকল্পনা থেকে শুরু করে প্রচার পর্যন্ত সব ধরনের কাজ এই প্রতিষ্ঠানগুলো করে থাকে। এ ব্যাপারে পরামর্শও দিয়ে থাকে। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান বা ক্লায়েন্ট প্রথমে তাদের পণ্য বা ব্র্যান্ড সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত ও চাহিদার ধারণা বিজ্ঞাপন এজেন্সিকে দেয়। সে অনুযায়ী গবেষণা ও পরিকল্পনা চলে। পণ্য ও কোম্পানির নাম, ধরন, মূল্য এবং পণ্যটির ক্রেতা-ভোক্তার শ্রেণিচরিত্র মাঠপর্যায়ের গবেষণায় পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণের আলোকে বিজ্ঞাপনের ডিজাইন উপস্থাপন করে। তা আলোচনা-পর্যালোচনা, মতামত ও পরামর্শের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের আঙ্গিক ও কপি চূড়ান্ত করা হয়। ক্লায়েন্টের পরামর্শ অনুযায়ী সংযোজন-বিয়োজন করে বিজ্ঞাপন নির্মাণের জন্য এজেন্সি একটি বাজেট তৈরি করে। তা অনুমোদন করার পর বিজ্ঞাপন এজেন্সি প্রডাকশন হাউজকে বিজ্ঞাপনটি নির্মাণের জন্য ওয়ার্ক অর্ডার দেয়। বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠান, বিজ্ঞাপন এজেন্সি ও প্রডাকশন হাউজ- এই ত্রিপক্ষীয় মতামতের ভিত্তিতে একটি বিজ্ঞাপনের কাঠামো, বিষয়, ভাষা, কলাকুশলী ও বাজেট চূড়ান্তভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়। এই কর্মযজ্ঞ সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। নেপথ্যে থাকেন একদল সৃষ্টিশীল মানুষ। অনেকেই মনে করেন বিজ্ঞাপন একটি ‘মিশ্রমাধ্যমের ফরমায়েশি শিল্পকর্ম’। অর্থাৎ একটি পণ্যের প্রচার ও বিক্রির প্রসারের প্রয়োজনে আদিষ্ট হয়ে অর্থের বিনিময়ে সৃজিত একটি শিল্পকর্ম। এ কারণে বিজ্ঞাপনের কাঠামো, বিষয়, ভাষা ও কলাকুশলী নির্বাচনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের চিন্তা, মতামত বা পরামর্শকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হয়। কপিরাইটারের লিখিত চিন্তা, ভাবনা, গল্প বা জিঙ্গেলকে নান্দনিকভাবে দৃশ্যায়ন করে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। বিজ্ঞাপনের ভাষালিখন ও নির্ধারণে কপিরাইটারই প্রধান ভূমিকা পালন করে থাকেন। তবে শীর্ষ কর্তাব্যক্তিদের অভিমত ও বিজ্ঞাপন নির্মাতা নির্দেশকের ভূমিকা এতে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশেই এখন নির্মিত হচ্ছে বিশ্বমানের বিজ্ঞাপন। প্রাচীন গুহাচিত্র, দেয়ালগাত্র, মৌখিক ঘোষণা, মুদ্রণমাধ্যম, বেতার, টেলিভিশন প্রভৃতির হাত ধরে আজকের বিজ্ঞাপন আধুনিক গ্রাফিক ও ক্যামেরাবন্দি হয়ে প্রবেশ করেছে ইন্টারনেট দুনিয়ায়। প্রতিযোগিতার টিকে থাকার জন্য বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি ও সমসাময়িক কাহিনি, বিষয় ও ভাষা।
আধুনিক জীবনের সঙ্গে বিজ্ঞাপন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্তমানে পণ্যের প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে এর বিকল্প নেই। গণমাধ্যমে বারবার প্রচারের সূত্রে এর ভাষাগত দিকটি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। বিজ্ঞাপনেরও রয়েছে নৈতিকতা এবং আর্থসামাজিক দায়বদ্ধতা। ফলে এর ভাষা ও উপস্থাপনায় দেশের প্রচলিত আইন, রীতি-নীতি, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক বিবেচনায় রাখতে হয়। বিজ্ঞাপন যেহেতু কোনো একটি পণ্য বা সেবা সম্পর্কে প্রচার, সেহেতু এর সঙ্গে নীতিনৈতিকতার প্রশ্নটিও গভীরভাবে জড়িত। কেবল ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে সম্পর্কই এটি স্থাপন করে না, মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও সমাজসংস্কারমূলক চিন্তার বিস্তারও ঘটায়, ইতিবাচক ভাবনাগুলোকে উসকে দেয়, পরিবর্তন আনতে সাহায্য করে সনাতন চিন্তা-চেতনার। এর একটি জাদুকরি শক্তি রয়েছে যা সমাজকে প্রভাবিত করে। তাতে সমকালীন ভাবনার বিকাশ ঘটে। ভাষা প্রয়োগের চমৎকারিত্বেই এমনটি ঘটে’। বিজ্ঞাপনের ভাষা যত সরল ও আকর্ষণীয় হবে, মানুষ তত মনে রাখতে পারবে। তবে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী বিজ্ঞাপনের ভাষার বদল ঘটে। সময় বদল হলেও মানুষ মনে রেখেছে কিছু বিজ্ঞাপনকে, যেগুলোর ভাষা চিরন্তন, সহজ ও মার্জিত। যেমন ‘মাছের রাজা ইলিশ বাত্তির রাজা ফিলিপস’, ‘ইকোনো লেখে চমৎকার এক কলমে মাইল পার’, ‘কাছে থাকুন’, ‘চুলের যত্নে আর একচুলও ছাড় নয়’, ‘যেখানে দিনবদলের চেষ্টা সেখানেই বাংলালিংক’, ‘নতুন কিছু করো’, ‘সৌন্দর্য গায়ের রঙে নয়- ফ্রেশ মানেই সুন্দর’, ‘চলো বহুদূর’, ‘সিলন চা- কাপ শেষ তবু রেশ রয়ে যায়’, ‘জ্বলে উঠুন আপন শক্তিতে’, ‘আমাদের আগামী বেড়ে উঠুক আলোয় আলোয়’। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত এ ধরনের ভাষা মানুষকে উদ্দীপ্ত করে, সচেতন করে, প্রেরণা দেয়। সমাজের অন্ধ কুসংস্কার ও কূপমন্ডূকতা দূর করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। হাল আমলের বিপণনকৌশলে বিজ্ঞাপনকে এখন শুধু পণ্য বিক্রির উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে না।
সামাজিক মূল্যবোধ বা নৈতিকতার প্রতিকূল বিজ্ঞাপনও বাংলাদেশের গণমাধ্যমে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে। ব্যবহৃত সংলাপ, ভাষা বা আচরণ প্রভাব ফেলছে জনজীবনে। অনুকরণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত সংলাপ বা পে-অফ লাইন মানুষ অনুকরণ করে, এসবের প্রতিফলনও যায় দৈনন্দিন জীবনে। বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত নেতিবাচক বিষয়, সংলাপ বা জিঙ্গেল সাধারণ মানুষ বিভিন্ন আড্ডা, বিতর্ক বা আলোচনা-সমালোচনায় নানা বিষয়-ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে প্রয়োগ করে। বহুল প্রচারিত বিজ্ঞাপনের নেতিবাচক ভাষা খুব সহজেই মানুষ মনে রাখে। এসব কদর্য ভাষা দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করার কারণে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের অশুভ চিন্তা প্রবেশ করে, কৃত্রিম চাহিদা বৃদ্ধি পায়, হতাশায় নিমজ্জিত হয় যুবসমাজ। ক্রমশই হ্রাস পাচ্ছে মান ভাষার কদর, সামাজিক ও মূল্যবোধ। চলতি সময়ে নান্দনিক বিজ্ঞাপন নির্মাণের পাশাপাশি কিছু অপবিজ্ঞাপনও নির্মিত হচ্ছে। অল্প সময়ে পণ্যের দ্রুত প্রচার-প্রসার লাভের প্রত্যাশায় ভাষার বিকৃতি, ভুল ও গোলমেলে ব্যবহার, আঞ্চলিক ভাষার অপপ্রয়োগ, অরুচিকর শব্দ ও কদর্য বাক্য অবলীলায় ব্যবহৃত হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে ভাষা বিকৃতির ফলে শিশু-কিশোর ও তরুণসমাজে অশোভন ভাষাচর্চা স্বাভাবিকতায় রূপ নিচ্ছে। এখনকার প্রচারিত বিজ্ঞাপনে ভাষার অপপ্রয়োগের কতিপয় নমুনা: ‘এটম খাও চাপার জোর বাড়াও!’; ‘আর কত কুপাইবেন? এবার থামেন, একটু জিরান, জিরাপানি খান’; ‘আউট দে নইলে কাঁচাই খাইয়া ফালামু’; ‘ব্যাম্বো ইজ অন, এরপর আর কেউ বাঁচাইতে পারবো না- ডাইরেক ভাইঙ্গ্যা দিমু’। এভাবেই চারদিকে চলছে ভাষাদূষণের নানা আয়োজন। বাংলা ভাষা আজ বিপর্যস্ত। নতুন প্রজন্মের একটি অংশ বাংলা ভাষার বিকৃত উচ্চারণ করে চলেছে, কেউ কেউ আবার এটাকে বাহবাও দেয়। ইংরেজি ও বাংলার মিশেলে বাংলাকে আর চেনা যায় না। অথচ অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলা ভাষায় আমাদের বলা ও লেখার অধিকার।

লেখক: শিক্ষক ও গণমাধ্যম গবেষক
mishafique@gmail.com
মডেল: অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া মাজহার
মেকওভার: পারসোনা
কৃতজ্ঞতা: মিথিলা
ছবি: সৈয়দ অয়ন

This Post Has 3 Comments
  1. দারুন লেখা। তরুণ প্রজন্ম পেশা হিসেবে এখানে জায়গা করে নিতে পারে। শুধু খোঁজের অভাবে অনেক সৃষ্টিশীল প্রতিভা এইখানটায় আসতে পারেনা।

  2. বিজ্ঞাপনের ভাষা নিয়ে অনেক সুন্দর একটা প্রবন্ধ পড়লাম৷ খুবই চমৎকার একটা প্রবন্ধ ৷ ধন্যবাদ ক্যানভসকে এবং লেখকে৷

  3. বিজ্ঞাপনের ভাষা নিয়ে আপনার লেখনী চমৎকার হয়েছে। ধন্যবাদ যুক্তিযুক্ত এরকম একটি লেখনীর জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top