skip to Main Content

কভারস্টোরি I ভাষাবদল

কালস্রোতে ভাষাও যায় পাল্টে। কেমন করে তা ঘটে? চেহারাটিই-বা কী রকম? সাম্প্রতিক কালে বদলে যাওয়া বাংলা ভাষা সম্পর্কে লিখেছেন আশরাফুল হক

ভাষাবিজ্ঞানে সাবস্ট্র্যাটাম থিওরি বা অবস্তরিক তত্ত্ব বলে একটি টার্ম রয়েছে। ভাষা বদলে যাওয়ার কারণ-সম্পর্কিত প্রত্যয় হিসেবে এটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এ নিয়ে বিতর্ক আছে। এতে বলা হয়, বয়স্ক মানুষ যখন কোনো নতুন ভাষা শেখেন, তখন নিজের ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্য তিনি তাতে আরোপ করেন। বাঙালিদের ইংরেজি অনেক ভিন্ন ইংরেজদের বা ফরাসির বা জর্মনভাষীর ইংরেজি থেকে। কোনো জনগোষ্ঠী যখন অন্য একটি ভাষা আয়ত্ত করে, তখন তারা নিজেদের ভাষার অনেক বৈশিষ্ট্যের সাহায্যে এর পরিবর্তন ঘটায়। যেমন ফরাসি ও পর্তুগিজদের আনুনাসিক স্বরধ্বনিগুলো। মনে করা হয়, ‘গল’দের ওপর লাতিন ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল; এবং তারা নিজেদের আনুনাসিক স্বরধ্বনি চাপিয়ে দেয় লাতিনে। ভাষাবিবর্তনে অবস্তরিক প্রভাব সম্পর্কে বিস্তর বিতর্ক হলেও একে অস্বীকারের উপায় নেই। বাংলায় ব্যবহৃত ইংরেজি বহু শব্দ এই তত্ত্বে চিহ্নিত করা যায়। বাঙালি যেভাবে ‘কলেজ’, ‘চেয়ার’, ‘কমপিউটার’ ইত্যাদি বলে, উৎসভাষায় সেভাবে এই শব্দগুলো উচ্চারিত হয় না। কিন্তু সমকালীন বাংলা ভাষার দিকে তাকালে দেখা যায়, বাংলা ক্রিয়াপদগুলোর ওপর কথ্য ও লেখ্যভাবে আরোপিত হচ্ছে ইংরেজি ভাষার উচ্চারণ। যেমন—কোরসে, খাইসে, গ্যাসে, আমাড়, কড়ে ইত্যাদি। তরুণ প্রজন্মই এই পরিবর্তনের বাহক। এটা হলো অবস্তরিক তত্ত্বের বিপরীত ক্রিয়া।
জীবনধারা বদলে যায়, সঙ্গে ভাষাও। এই বদল প্রথমে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে মৌখিক ও কথ্য ভাষায়, লিখিত রূপে পরিবর্তনটি ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। ১৯১৪ সালে প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্র পত্রিকায় চলিত গদ্যরীতি প্রবর্তন ও প্রতিষ্ঠার আগপর্যন্ত সাধুরীতিতে বাংলা লেখা হতো। এটা ছিল কথ্য ভাষার এককগুলোকে লেখ্য ভাষায় যুক্ত করার অনুশীলন, যা প্রচলিত সাহিত্য ও প্রতিবেদনের ভাষাকে প্রভাবিত করেছিল। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গদ্যভাষায় এর সাক্ষ্য মেলে। একটু আগেই বলা হয়েছে, জীবনধারায় পরিবর্তন ঘটলে ভাষায়ও তা সঞ্চারিত হয়। কেন্দ্র থেকেই এমনটি ঘটে। ঔপনিবেশিক কলকাতার নগরজীবন বদলে যাচ্ছিল, সরকারি কর্মজীবীর পাশাপাশি লগ্নিপুঁজি থেকে সৃষ্ট একটি শ্রেণির উদ্ভব ও বিকাশ ঘটছিল। জীবনধারার চালিকাশক্তি অর্থনীতি; এর গতিশীলতাই ভাষাকে বদলে দিতে থাকে। নতুন নতুন একক এসে সেই পরিবর্তনকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। তবে স্থবির সমাজের ভাষাও গতিশীল, সমাজ পতনশীল হলে ভাষাতেই তা ধরা পড়ে, এটাও একধরনের গতিশীলতা—যা বুঝতে হলে ব্যবহৃত ভাষার আগের ও বিদ্যমান প্রয়োগ বা অর্থের দিকে তাকাতে হয়।
ভাষাতাত্ত্বিকেরা জানিয়েছেন, ভাষার পরিবর্তন-পরম্পরার একটি প্রধান কারণ বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন প্রক্রিয়া। যদি একই ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠী একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং কদাচিৎ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বা দেখাসাক্ষাৎ ঘটে, তবে তাদের মধ্যে বিশাল ভাষাগত পার্থক্য সৃষ্টি হয়ে চলে। এই বিচ্ছিন্নতার কারণ বহুবিধ, যেমন ভৌগোলিক দূরত্ব, রাজনৈতিক পৃথক্করণ, পারস্পরিক মতপার্থক্য এবং অপর্যাপ্ত যোগাযোগ। এসবের ফলে দুটি ভিন্ন ভাষা বা উপভাষার জন্ম হয়।
বিশ্বের বহু ভাষার ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটেছে এবং এর সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উদাহরণ হলো ইংরেজি। আমেরিকান, কানাডীয়, অস্ট্রেলীয় এবং অন্যান্য দেশের ইংরেজি পরস্পর আলাদা, বিশেষত উচ্চারণের দিক থেকে। এগুলোর চেয়ে ভিন্ন যুক্তরাজ্যের ইংরেজি, যাকে এই ভাষার মূল উৎপত্তি স্থান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলা ভাষায়ও তাই ঘটেছে; কারণ, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলার মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত ও ব্যবহারিক পার্থক্য রয়েছে লক্ষণীয়।
অন্যদিকে, একই ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যেও সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের প্রভাবে ভাষাগত বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন ঘটতে পারে। যদি বিভিন্ন উপভাষা একই ভৌগোলিক সীমারেখা কোনো একটি ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে অবস্থান করে, তবে এই ভাষাগুলো পরস্পরকে বিভিন্ন স্তরে প্রভাবিত করে এবং সব ভাষাতেই কমবেশি পরিবর্তন আসে। এটি মূলত একে অন্যের বোঝাপড়া বা আপোসের প্রয়োজনে। বাংলা ভাষার আজকের রূপটা এই পরিবর্তনেরই ফল।
সংস্কৃতকেই বাংলা ভাষার উৎস বলে ধরা হয়; কিন্তু ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের সদস্য হওয়ায় বাংলা ভাষা ইংরেজি ভাষার আত্মীয়। তবে বাংলা মূলত সরাসরি প্রাকৃত ভাষার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং আমরা জানি, একসময় একে নিচু জাতের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। ইংরেজি ভাষার ইতিহাসও প্রায় একই রকম; নিম্নবিত্তের ভাষা ছিল এটি।
দেখা যায়, বাংলা ও ইংরেজি উভয়ই বিচ্ছিন্নতা ও বিভাজন প্রক্রিয়ার ফল এবং এই দুটি ভাষা সুস্পষ্ট পরিবর্তন-পরম্পরার মধ্য দিয়ে আজকের জায়গায় এসেছে। উভয়ই ঐতিহাসিকভাবে সামাজিক মর্যাদায় নিচু জনগোষ্ঠীর ভাষা বলে পরিচিত ছিল। এ কারণেই আজকাল অনেকেই বলছেন, প্রমিত বাংলা সমাজের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠীর নির্ধারণ করা একটি উপভাষা মাত্র। মানুষের প্রয়োজনে মানুষই সৃষ্টি করেছে ভাষা, যা মানব মনস্তত্ত্ব, আচার-আচরণ, জীবনধারা এবং উন্নয়নের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বিচ্ছিন্নতা বা বিভাজন উপভাষারও জন্ম দেয় এবং এগুলোর প্রতিটিরই নিজস্ব মর্যাদা রয়েছে। এ কারণেই বলা হচ্ছে, নিম্নবর্গের ভাষা বলে কিছু নেই। উপভাষার ধারণাটি কেন্দ্রের সৃষ্টি। তা যতটা ভাষাগত, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক। এসব অন্য বিতর্ক। এটা অনস্বীকার্য, যেকোনো ভাষাই এর অন্তর্গত জনগোষ্ঠীর সব ধরনের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য যথেষ্ট। নগরকেন্দ্রিক শিক্ষিত সমাজ কেন্দ্রসৃষ্ট ‘শুদ্ধ’, ‘প্রমিত’ বা ‘মান ভাষা’র অনুগামী; কিন্তু মানুষ ভাষার বিশুদ্ধতার চেয়ে ব্যবহারিক দিকটির ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়। এই বক্তব্যের যথার্থতা বোঝা যায় বিশ্বের সব ভাষায় রচিত সাহিত্যকর্মের দিকে তাকালে।
গত চার দশকে বাংলা ভাষার প্রয়োগে দুটি প্রবণতা স্পষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে : বিকৃত বা কৃত্রিম উচ্চারণে বাংলা বলা এবং বাক্যিক কাঠামোয় অতিমাত্রায় দ্বিভাষিক শব্দের মিশ্রণ। এর কারণগুলো জানা দরকার। প্রথমত, বিকৃত বা কৃত্রিম উচ্চারণে কথা বলার অভ্যাস গড়ে ওঠে ব্যক্তিবিশেষের মনস্তত্ত্ব, পরিবেশ ও সামাজিক চাহিদা থেকে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর মূল কারণ তথাকথিত ফ্যাশনেবল হওয়ার চেষ্টা। সেলিব্রিটিদের নির্বিচার অনুকরণের প্রয়াসও এর একটি কারণ। বাংলাদেশে ডিস্ক জকি অথবা রেডিও জকিদেরকে এই প্রবণতার জন্য দায়ী করা যেতে পারে। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ক্ষণস্থায়ী, যদিও দু-একটি উচ্চারণ দীর্ঘমেয়াদি হওয়ার দৃষ্টান্ত লক্ষ করা যায়।
দ্বিতীয়ত, বাক্যে দ্বিভাষিক শব্দের সংমিশ্রণ ঘটে যখন একটি দেশে মাতৃভাষা ছাড়াও অন্য এক বিশ্বপর্যায়ের প্রভাবশালী ভাষার ব্যবহার দৈনন্দিন জীবন ও শিক্ষাব্যবস্থায় প্রচলিত থাকে। বাংলাদেশে সেই ভাষাটি হলো ইংরেজি। আমরা কমবেশি এই দ্বিভাষিক শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে থাকি কথোপকথনে। এমনকি অর্ধশিক্ষিত ও অশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এই প্রবণতা রয়েছে।
এ বিষয়ে পরিগ্রহণের মনোভাবই শ্রেয়, ভাষাবিদেরা বলছেন। কারণ, ভাষা মূলত যোগাযোগের জন্য। শেষ পর্যন্ত মানুষের প্রয়োজনই ভাষার নিয়ন্ত্রক। কালে কালে এর রূপ বদলে যায়। তবে শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার অঙ্গনে সচেতনভাবে এই সংমিশ্রণ এড়ানোই ভালো।
বিশ্বের সব জীবিত ভাষাই পরিবর্তনশীল। এর সঙ্গে রয়েছে জীবনধারা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতির বদল ও গতিশীলতার সম্পর্ক। ইতিহাস আমাদের কাছে স্পষ্ট করেছে যে ভাষার অন্তর্গত সচলতা নতুন শব্দ, নতুন বাক্যবিন্যাস, প্রকাশভঙ্গি, পুরোনো অভিব্যক্তির নতুন রূপ, পরিবর্তিত উচ্চারণ একে পাল্টে দিয়েছে। এমনকি নতুন ভাষার জন্ম দিয়েছে। বিভিন্ন ভাষাপরিবার এর সাক্ষ্য দেয়। ভাষার শক্তিকে শৃঙ্খলিত করার ক্ষমতা কারও নেই। আইন করেও বিকৃত ও কৃত্রিম উচ্চারণ, ভুল ও অশুদ্ধ কিংবা দ্বিভাষিক শব্দ ও বাক্য সংমিশ্রণের প্রবণতাকে রোধ করা সম্ভব নয়।

কেন বদলে যায় ভাষা? প্রশ্নটি প্রথম তুলেছিলেন জে এইচ ব্রেডসড্রোফ। উত্তর দিতে চেষ্টা করেছিলেন তিনি নিজেই; এবং তারপর অনেকে দিয়েছেন আরও বহু উত্তর। প্রণয়ন করা হয়েছে এ-সম্পর্কে বেশ কিছু তত্ত্ব; কিন্তু কোনোটিতেই ভাষা পরিবর্তন বা বিবর্তনের সব দিক সম্পর্কে ব্যাখ্যা নেই। ব্রেডসড্রোফ নির্দেশ করেছিলেন ভাষা পরিবর্তনের এ কারণগুলো : ভুল শোনা ও বোঝা, ভুল স্মরণ, ত্রুটিপূর্ণ বাক্‌প্রত্যঙ্গ, আলস্য, সাদৃশ্যপ্রবণতা, স্বাতন্ত্র্যপ্রয়াস, নতুন ভাবপ্রকাশ ও বিদেশি প্রভাব। এ কারণগুলোর কিছু শারীরতাত্ত্বিক ও কিছু মনস্তাত্ত্বিক। এগুলো অনেকটা ব্যাখ্যা করে, ভাষা কেন বদলায়। বক্তারা বিচলিত হয় ধ্বনি উচ্চারণে, শব্দ ও বাক্যগঠনে; শ্রোতারাও নানা মানস-শারীর কারণে ভাষার অবিকল রূপটি গ্রহণ করতে পারে না। এভাবে বদলে যায় ভাষা। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে ভাষা কীভাবে সঞ্চারিত হয়, প্রক্রিয়াটি লক্ষ করলে ভাষাপরিবর্তনের কারণ বেশ স্পষ্ট ধরা পড়ে।
এ প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে ভাষা সঞ্চারিত বা সংক্রমিত হয় নানা বাধাবিঘেœর ভেতর দিয়ে। একে বলা হয় ‘বিঘিœত সঞ্চরণ বা সংক্রমণ’। শিশু ব্যাকরণ পড়ে ভাষা শেখে না। ভাষার ধ্বনি-শব্দ-বাক্য-অর্থের সমস্ত সূত্র নির্ভুল জেনে তারা কথা বলা শুরু করে না। ভাষা আয়ত্ত করার বিশেষ শক্তি নিয়ে শিশু জন্ম নেয় পৃথিবীতে; এবং ওই শক্তির সাহায্যে সে প্রতিবেশ থেকে আয়ত্ত বা অর্জন করে ভাষা। সে চারপাশে যাদের কথা বলতে শোনে, তাদের থেকে আয়ত্ত করে ভাষা। সহজাত শক্তির সাহায্যে সে তৈরি করে নেয় মাতৃভাষার বিভিন্ন সূত্র। ভাষা এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে সংক্রমিত হওয়ার এই যে পদ্ধতি, এতে ভাষার আগের রূপটি অবিকল সংক্রমিত হতে পারে না পরের প্রজন্মের ভেতর। প্রতিটি প্রজন্মের ভাষার কিছুটা বদল ঘটে; এবং প্রজন্মপরম্পরায় পরিবর্তিত হয়ে একসময় কোনো একটি ভাষা বেশি ভিন্ন হয়ে ওঠে আগের থেকে।
রোমান্স ভাষাগুলো ভিত্তি করে এ-পর্যন্ত প্রস্তাবিত হয়েছে ভাষাবিবর্তনের কারণ সম্পর্কে বেশ কয়েকটি তত্ত্ব। যেমন কালানুক্রমিক, শ্রেণিতত্ত্ব, কেন্দ্রাতিগ তত্ত্ব, অবস্তরিক তত্ত্ব, শাব্দ ঋণ ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে প্রথমটি এখন গ্রাহ্য নয়। উনিশ শতক পর্যন্ত টিকে ছিল তত্ত্বটি। দ্বিতীয়টি কেবল ভাষার ইতিহাসকে খানিকটা তুলে ধরতে পারে এবং তা ভাষার প্রাকৃত বা অমার্জিত রূপের বিস্তার সম্পর্কেই। তবে পরিবর্তনসংক্রান্ত কোনো ব্যাখ্যা এতে পাওয়া যায় না। কেন্দ্রাতিগ তত্ত্বে মনে করা হয় যে আগে লাতিনে ঔপভাষিক বৈচিত্র্য বিশেষ ছিল না; সর্বত্র মোটামুটি একই ধরনের লাতিন প্রচলিত ছিল। তবে কেন্দ্রের পতনের পর বিভিন্ন অঞ্চলে উপভাষা বিস্তৃত হতে থাকে। ৪৭৬ সালে রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর লাতিনের সংহতি নষ্ট হয়ে যায়, বিভিন্ন উপভাষা দেখা দেয়। অবস্তরিক তত্ত্বের কথা শুরুতেই বলা হয়েছে।
বিভিন্ন সংস্কৃতি পরস্পরের সংস্পর্শে এলে এক ভাষা আরেক ভাষা থেকে প্রধানত শাব্দ ঋণ নিয়ে থাকে। এমন ঋণের উদাহরণ সব ভাষায়ই পাওয়া যায়। এ ঋণের ফলে ঋণগ্রাহী ভাষা কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়। নানাভাবে এমনটি ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, নেপোলিয়ন ইংল্যান্ড জয়ের সময় নিয়ে গিয়েছিলেন তার বাবুর্চি দল। ফলে রান্না ও খাদ্যসংক্রান্ত ফরাসি শব্দগুলোর বেশির ভাগই ইংরেজিতে ঢুকে পড়ে এবং স্থায়ী হয়ে যায়। যেমন—শেফ, বিফ, মাটন, বুফে ইত্যাদি।
বাংলা ভাষায়ও পরিবর্তন ঘটেছে গত চার দশকে। অনেক নতুন শব্দ ঢুকেছে এতে। পুরোনো প্রচলিত শব্দের অর্থ বদলে গেছে। নতুন বাগধারাও সৃষ্টি হয়েছে। বিদায় নিয়েছে পুরোনো অনেক শব্দ ও সম্বোধন। সবই জীবনধারায় পরিবর্তনের ফল। ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রভাবও যুক্ত হয়েছে এই পরিবর্তনে।
ভাষাবদল মূলত সমাজের কোন অংশের হাতে ঘটে? উত্তর: তরুণেরাই এ পরিবর্তনের বাহক। একটা প্রজন্ম এসে বদলে দেয় সমকালীন ভাষাজগৎ, তবে চটজলদি তা বোঝা যায় না। কেননা, প্রচলিত বাক্যিক কাঠামোর মধ্যেই পরিবর্তনটি ঘটে। তাদের ব্যবহৃত ধ্বনি, শব্দ, বাগধারা ও সম্বোধনের দিকে লক্ষ করলেই তা টের পাওয়া যায়। সাধারণত দেখা যায়, এক প্রজন্ম ভাষায় যে পরিবর্তনটি নিয়ে আসে, নিকট-পরবর্তী তরুণেরা তা কেবল প্রতিষ্ঠিত করে না, যোগও করে নতুন কিছু। সামাজিক পরিস্থিতি এর প্রধান অনুঘটক। সাহিত্য, গণমাধ্যম, বিনোদনের বিভিন্ন শাখা একে প্রতিষ্ঠা ও প্রসারতা দেয়। সাম্প্রতিক কালে তরুণদের মধ্যে প্রচলিত ‘লিটনের ফ্ল্যাট’ তেমন একটি বাগধারা। এর অর্থের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিদ্যমান সামাজিক বাস্তবতা, নিষেধের চাপ ও যৌনতা। উল্লেখ প্রয়োজন, কোনো সময়ে ভাষাবদলের রূপটি খেয়াল করলে তখনকার পরিস্থিতি বোঝা যায়। অবরুদ্ধ সমাজে, বিশেষত যৌন ও মাদকসংক্রান্ত বিষয়ে যেখানে নিষেধের চাপ বেশি, সেখানে ভাষাবদলের প্রবণতা সেদিকেই যায়। শব্দ ও বাগধারা সেখানে সংকেত, তা পরিচিত ও পুরোনো হয়ে গেলে বাতিল হয়ে যায় এবং সেই শূন্যতা পূরণ করে নতুন একটি সংকেত। যেমন আশির দশকে গাঁজাকে বলা হতো ‘গ্রাস’, নব্বইয়ের মাঝামাঝিতে হয়ে গেল ‘সাল্টু’, এখন এর বিকল্পে যুক্ত হয়েছে একটি ক্রিয়াপদ, বলা হচ্ছে ‘স্কোর করা’। মদ আশি ও নব্বই দশকে ছিল ‘মাল’, ‘লাল পানি’; নতুন শতাব্দীতে তা হলো ‘লিকার’; আর এখন বলা হয় ‘বোতল’, ‘পানি’। প্রেম আশির দশকে ছিল ‘লাইন’, ‘সম্পর্ক’, নব্বইয়ে ‘টাংকি’, ‘অ্যাফেয়ার’, ‘ফিটিং কেস’, নতুন শতাব্দীতে ‘ইটিশপিটিশ’, ‘লটরপটর’ ইত্যাদি। তবে ‘অ্যাফেয়ার’ এখনো টিকে আছে।
অনুভূতি, উচ্ছ্বাস ও সম্বোধনবাচক শব্দ বেশি যুক্ত হতে দেখা যায় পরিবর্তিত ভাষায়। যেমন সমকালীন বাংলায় যোগ হয়েছে ‘প্যারা’, ‘প্যানা’, ‘ঝাক্কাস’, ‘সেক্সি’, ‘জটিল’, ‘জোস’, ‘হেব্বি জোস’, ‘ফিদা’ ইত্যাদি। ব্যবহারিক জীবনের উপাদান ‘বাথরুম’, ‘টয়লেট’ এখন ‘ওয়াশ রুম’। আজকাল নতুন একটি শব্দ শোনা যায়—‘ভাইরাল’। ছড়িয়ে পড়ার অর্থেই এটি ব্যবহৃত হয়। পরিবর্তন এসেছে সম্বোধনেও। এখন কেউ আর ‘ওগো’, ‘ডার্লিং’, ‘প্রিয়তম’ বলে না; ‘জানু’, ‘বাবু’, ‘হাবি’, ‘বাবু সোনা’ বলে। ক্রিয়াপদে দেখা যাচ্ছে লক্ষণীয় পরিবর্তন। যেমন—‘খায়ে’, ‘দেখায়ে’, ‘বসায়ে’, ‘আনায়ে’, ‘শোয়ায়ে’, ‘গেসি’, ‘দেখসি’, ‘করতেসিলাম’, ‘খাইসি’, ‘গেসে’, ‘হইসে’ ইত্যাদি।
পৃথিবীর কোনো ভাষা স্থবির নয়। প্রতিটিরই রয়েছে নিজস্ব গতি; চলার পথে যা এর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে আসে, তা সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। জীবনধারার পরিবর্তনে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে একসময় ভাষার মৃত্যু ঘটে। বিকৃতি, অশুদ্ধতা, বিদেশি ভাষার মিশ্রণ—যা কিছুই সমকালীন ভাষায় ঘটুক না কেন, প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে মেনে নেওয়াই শ্রেয়। বা, ফ্যাশনের যেমন ট্রেন্ড থাকে, ভাষায়ও তেমনি। বেশির ভাগই কালের আবর্তে হারিয়ে যায়। অভিধানে জায়গা করে নেয়। অনেক সময় তা-ও ঘটে না। ভাষার গতিশীলতার রূপ এমনই।

মডেল: অভিনেতা আবীর ও স্পর্শিয়া
আসবাবপত্র: বহু
ওয়্যারড্রোব: চন্দন
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top