skip to Main Content

কভারস্টোরি I সেলফ লাভ

শুধু একটি ধারণা নয়, বরং প্রত্যেক মানুষের জীবনেই অনিবার্য। নিজেকে ভালো রাখতে, অন্য সবাইকে ও সবকিছু ভালো রাখতে। লিখেছেন রুদ্র আরিফ

টিক-টিক-টিক…চলছে ঘড়ি। জীবনঘড়ি। ব্যস্ত সময়। এতটুকু ফুরসত যেন নেই নিজেকে দেওয়ার। চাইলেও যাচ্ছে না পারা জীবনের বেদম ঘোড়ার দৌড় সামলানো। হিমশিম সারা বেলা। আধুনিক জীবনে অনেকের জীবনচক্রই এমন। ফলে জীবনের আরেক নাম যেন নাভিশ্বাস! তবু একটুকু সময় বের করতে পারলে, তার ভেতর থেকে কতটুকু নিজেকে দিতে পারি আমরা? যদি দিতেও পারি, তাতে কতটুকু প্রতিফলন ঘটে নিজের প্রতি ভালোবাসার? এর প্রয়োজনও বোধ করি কি ঠিকঠাক?
‘নিজের ভেতর যা রয়েছে, তার প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন,’ বলে গেছেন নোবেলজয়ী ফরাসি সাহিত্যিক অঁদ্রে জ্যিদ। ‘যে ভালোবাসা অন্যদের কাছ থেকে পাওয়ার স্বপ্ন আমরা দেখে থাকি, সেই ভালোবাসা নিজের প্রতি দেখানোটা নিজেকে ভালোবাসার অন্যতম সেরা পথ হতে পারে,’ বলেছেন আমেরিকান সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী বেল হুকস। তার স্বদেশি কবি, নাট্যকার ও পেইন্টার ই. ই. কামিংস বলে গেছেন, ‘যে পৃথিবীতে বাকি সবাই আপনাকে অন্য কোনো ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে মরিয়া, সেই পৃথিবীতে আপনার পক্ষে আপনি হয়ে ওঠাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।’ ‘যতক্ষণ না নিজেই নিজেকে মূল্য দেবেন, ততক্ষণ নিজের সময়কেও মূল্য দেওয়া সম্ভব হবে না আপনার পক্ষে। যতক্ষণ না নিজের সময়কে মূল্য দেবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সময়কে কাজে লাগাতে পারবেন না,’ বলে গেছেন আমেরিকান সাইকিয়াট্রিস্ট ও লেখক এম. স্কট পেক।
এমন ভূমিকা হাজিরের, এত উক্তি টানার কারণ যে প্রসঙ্গ, তা সেলফ লাভ। সরল বাংলায় নিজেকে নিজেই ভালোবাসা। জানি বলবেন, পৃথিবীর সব মানুষই তো প্রথমত নিজেকে ভালোবাসে। আপেক্ষিকভাবে এই অনুমান সত্য মনে হলেও আসলে কি তাই? একটু গভীরে তলিয়ে দেখে যদি নিজেকেই প্রশ্ন করেন, ‘কতটুকু ভালোবাসি আমি আমাকে?’—কী পাবেন উত্তর? ভাবতে থাকুন, ভাবা প্র্যাকটিস করুন—যেমনটা বলে গেছেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রকার ঋত্বিক ঘটক। এই ফাঁকে আমরা একটু জেনে নিই, সখি, সেলফ লাভ কাহারে বলে! নিজেকে ভালোবাসা কারে কয়!
যেহেতু একেক মানুষ একেক রকম, তাই একেকজনের কাছে সেলফ লাভের অর্থ বা তাৎপর্যও একেক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক ‘ব্রেন অ্যান্ড বিহেভিয়ার রিসার্চ ফাউন্ডেশন’-এর ভাষ্যমতে, সেলফ লাভ হলো একজন ব্যক্তিমানুষের এমন একটি আত্ম-উপলব্ধিকর অবস্থা—আমাদের শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আত্মিকভাবে বেড়ে ওঠার সমর্থনের ভেতর থেকে যার আবির্ভাব ঘটে। সেলফ লাভ হলো নিজের মঙ্গল ও আনন্দের তরে একটি উন্নত স্তরের মর্যাদাবোধ অর্জন করা। আরও আছে! সেলফ লাভ হলো নিজের প্রয়োজনগুলোর যত্ন নেওয়া এবং অন্যকে খুশি করার জন্য নিজ কল্যাণের বিসর্জন না দেওয়া। আপনার যতটুকু প্রাপ্য, তাতে এতটুকুও ছাড় না দেওয়ার দাবিই সেলফ লাভ। একজন ব্যক্তিমানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ এটি।
সেলফ লাভ নিয়ে আপনি যদি নতুন করে ভাবতে বসেন, তাহলে সহজ করে বলি, আপনার ক্ষেত্রে এটি হলো নিজ সম্পর্কে ও নিজেকে নিজেই ব্যক্ত করার ক্ষেত্রে নিজের প্রতি মমতা ও ভালোবাসাভরা কথা বলা, নিজেকে অগ্রাধিকার দেওয়া, আত্মসমালোচনা থেকে খানিক সময়ের জন্য বিশ্রাম দেওয়া, নিজের ওপর আস্থা রাখা, নিজের প্রতি সত্যবান ও মমতাপূর্ণ থাকা, নিজের স্বাস্থ্যগত সীমারেখা নির্ধারণ করা এবং নিজের প্রতি কখনো কোনো কারণে সত্যবান কিংবা মমতাপূর্ণ হতে না পারলে নিজেকে ক্ষমা করে দেওয়া।
সেলফ লাভকে অনেকেই সেলফ কেয়ার হিসেবে গণ্য করেন। সে ক্ষেত্রে কিছু ব্যাপার আমাদের খেয়াল রাখা দরকার। যেমন ধরুন, নিজের শরীরের কথা শোনা, কাজ ও ব্যস্ততা থেকে সময়ে সময়ে বিরতি নেওয়া, ফোন সরিয়ে ও অন্যদের কাছ থেকে নিজেকে খানিকটা বিচ্ছিন্ন রেখে সৃজনশীল কিছুতে মগ্ন হওয়া, পছন্দের খাবার চেখে দেখার অভ্যাস কখনো কখনো জারি রাখলেও সব সময় স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের চেষ্টা চালানো প্রভৃতি।
সেলফ লাভের চর্চা পৃথিবীতে আদিকাল থেকেই ছিল। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও অনুশাসনেও একে দেওয়া হয়েছে গুরুত্ব। তবে আধুনিক সময়ে এর সর্বব্যাপী প্রচারণার সূত্রপাত ঘটে গত শতকের পঞ্চাশের দশকে, বিট জেনারেশনের হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে আমেরিকান সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে প্রভাববিস্তারী এই লিটারারি সাবকালচার মুভমেন্টের সূচনা ঘটায় অ্যালেন গিন্সবার্গ, নিল ক্যাসাডি, ডায়ান ডি প্রিমা, জ্যাক কেরোয়াক প্রমুখ সহকারে একটি কবি-সাহিত্যিক গোষ্ঠী। একে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায় পরবর্তী দশকের প্রবল প্রভাববিস্তারী ব্রিটিশ কাউন্টারকালচার গোষ্ঠী হিপ্পি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের দগদগে ক্ষত এবং এর পাশাপাশি তখনো চলমান ভিয়েতনাম যুদ্ধ—সব মিলিয়ে সমাজে ‘ভালোবাসা ও শান্তি’র বার্তা ছড়িয়ে দিতে থাকে গোষ্ঠীটি; তবে তা একান্তই নিজেদের ভঙ্গিমায়, যা কাঁপিয়ে দেয় প্রচলিত অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধ। এর ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠে ক্রাউড সাইকোলজি বা গণমানুষের মনস্তত্ত্বের ধারণা। যুদ্ধবিধ্বস্ত সমাজব্যবস্থার নাজুক পরিস্থিতিতে উজ্জ্বল ও অহিংস ভবিষ্যতের দাবিতে স্বাধীনতা ও ঐকতানের আওয়াজ হয়ে ওঠে জোরালো। সেই আন্দোলন প্রাথমিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি ও ক্যালিফোর্নিয়ায় শুরু হলেও ছড়িয়ে পড়ে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। মানবজীবনের প্রতি আত্মোৎসর্গ, অধ্যবসায় ও সমবেদনা এই প্রজন্মকে শান্তিকামী ও মুক্তমনা হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে দিয়েছে। আর তা থেকেই সেলফ লাভের ধারণাটি ব্যাপক পরিসরে মেলেছে পেখম। এ ছাড়া প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রে সামাজিক জীবনের একটি হাতিয়ারেও পরিণত হয় সেলফ লাভ, ১৯৭০-এর দশকে। সে সময়ে দেশটিতে চলমান ব্ল্যাক-পাওয়ার মুভমেন্টের স্লোগান ‘ব্ল্যাক ইজ বিউটিফুল’ এই ধারণাকে আরও শাণিত করেছে। (বলে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি বার্ষিক ‘সেলফ লাভ ডে’ পালিত হয় একটি জাতীয় দিবস হিসেবে।)
এই ব্যস্ত-ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত সময়ে, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, ‘দোহাই তোদের, একটুকু চুপ কর।/ ভালোবাসিবারে দে আমারে অবসর’ বলার মতো ফুরসত পাওয়া, সেলফ লাভের অনুশীলন করা কীভাবে সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। এর জন্য একটু সময় বের করে নিন একান্তই নিজেকে দেওয়ার জন্য। তারপর কল্পলোকে ডুব নিয়ে নিজেই নিজেকে করুন মৃদু আলিঙ্গন। পিঠ চাপড়ে দিন নিজের। আর অন্তস্তলের গহিন থেকে প্রথমেই খুঁড়ে আনুন নিখুঁতবিষয়ক যত আইডিয়া। ‘কোনো মানুষই নিখুঁত নয়,’ বলা হয়ে থাকে। তবু খুঁত ও নিখুঁতের দোলাচলে আমরা ক্ষণে ক্ষণে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ি; হাঁপিয়ে উঠি। কোনো কাজ ঠিকঠাক করা না হলে, কোনো স্বপ্ন পূরণ না হলে, কোনো চাওয়াকে পাওয়ায় পরিণত করতে না পারলে কখনো অজান্তেই, কখনোবা সজ্ঞানে নিজের ভেতর হাজারো খুঁতের অনুসন্ধান চালাতে থাকি। নিজেকে করতে থাকি দোষারোপ। শরীর, জীবন, বুদ্ধিবৃত্তি—নানা মাপকাঠিতে চলে এই খুঁত-নিখুঁতের হিসেবনিকেষ। বলি, অনেক তো হলো; এবার থামুন! সত্যি বলছি, নিখুঁতের প্রচলিত ধারণাটি একেবারেই ভ্রান্ত। তাই নিজেকেও নিখুঁত নামের কাল্পনিক ঘোড়ার পেছনে বেদম দৌড়ে নিয়োজিত করার দরকার নেই। পারফেকশন বা পরিপূর্ণতার কোনো আদর্শ মানদণ্ডের কামনা করার নেই প্রয়োজন; বরং প্রত্যেক মানুষই যে যার মতো। প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ও নিজস্ব ব্যক্তিত্ব। তাই অন্যের সঙ্গে, তৈরীকৃত কোনো মানদণ্ডের বিচারে নিজেকে না মেপে, নিজ সত্তার ইতিবাচক দিকগুলো লালন করুন। দেখবেন, নিজের প্রতি ভালোবাসা ডানা মেলছে আপনাআপনি।
যে সমাজে আমরা থাকি, না চাইলেও তার এক নিরন্তর চাপ নানাভাবেই পড়তে থাকে আমাদের ওপর। ‘বড় হয়ে তোমাকে “এটা” হতে হবে’, ‘তোমার মতো মানুষের কাছ থেকে “ওটা” প্রত্যাশা করিনি’, ‘ওর ছেলে বা মেয়ে বা স্বামী বা স্ত্রী বা ভাই বা বোন বা বাবা বা মা “এটা” বা “ওটা” পেরেছে, তোমাকেও পারতে হবে’…ইত্যাদি ধরনের চাপে অনেক সময় খেই হারিয়ে ফেলি আমরা। এমন চাপ যতই থাকুক, আপনার বোঝা চাই, যেহেতু পৃথিবী আপনি একজন স্বতন্ত্র মানুষ, তাই অন্য কারও সঙ্গে তুলনা টানাজনিত চাপে পিষ্ট হওয়ার কোনো মানে হয় না। বরং তুলনা যদি টানতেই হয়, নিজের সঙ্গে টানুন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট থিওডর রুজভেল্টের একটা কথা আছে, ‘তুলনা হলো আনন্দ কেড়ে নেওয়া চোর!’ আসলেই তা-ই। এমনকি আপনি যদি কখনো অন্যের সঙ্গে তুলনার রেসে ছুটতে গিয়ে অসাধ্য সাধন করে ফেলেন, দেখবেন তাতেও রয়েছে নানা খেদ। নানা অতৃপ্তি। তাই অন্যকে তুষ্ট করার লড়াইয়ে নিজেকে নিয়োজিত না করে, নিজের জন্যই লড়া উচিত বলে অভিমত বিশিষ্ট মনোবিদদের।
আরও আছে! জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যেমনটা পড়েছি ছোটবেলায় পাঠ্যপুস্তকে—‘সময় ও স্রোত কারও জন্য অপেক্ষা করে না।’ তাই প্রতিটি মুহূর্ত নিজের মতো উপভোগ করা শ্রেয়। একবার ভাবুন তো, এই যে প্রাত্যহিক পৃথিবীতে এত জঞ্জাল, এত গোলমাল, এত নেতিবাচকতার উল্লম্ফন, তার মধ্যেও আমি-আপনি এখনো নিশ্বাস নিতে পারছি—এই-বা কম কী! তাই ইতিবাচক চোখে জীবনকে দেখা ভীষণ দরকার। তাহলে ভালোবাসা বাড়বে জীবনের প্রতি, নিজের প্রতি। তা ছাড়া আমেরিকান ম্যাগাজিন ‘সাইকোলজি টুডে’ এক সমীক্ষায় জানিয়েছে, জীবন সম্পর্কে মনোযোগী মানুষের মধ্যে আত্মমর্যাদার প্রতি ঝোঁক বেশি থাকে; তারা অধিক সহানুভূতিশীল ও নিরাপদ হয়ে থাকেন। একই কথার সূত্র ধরে বলা যায়, নিজেকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে কালেভদ্রে নয়, বরং প্রতিনিয়তই কৃতজ্ঞতাবোধ লালন করা চাই। বলা হয়ে থাকে, মানুষ যখন কোনো কিছু পেয়ে যায়, পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন অনুকূল হয়ে ওঠে, তখন তার মধ্যে জেগে ওঠে অকৃতজ্ঞতা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এটি মানুষের আরও অনেকগুলো সহজাত নেতিবাচক প্রবৃত্তির একটি। তাই বলি, খেয়াল করে দেখুন তো, অতীতে—হোক নিকট কিংবা দূর-বহুদূর—কখনো কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার পর তাতে সহায়কের ভূমিকা রাখা মানুষগুলোর কথা বেমালুম ভুলে গেছেন কি না? যদি গিয়ে থাকেন, ক্ষমাপ্রার্থী হোন। আপনার ভেতর জেগে উঠুক কৃতজ্ঞতাবোধ। বিশ্বাস করুন, অন্যথায় নিজেকেও ভালোবাসতে পারবেন না ঠিকঠাক।
আরও আছে! আপনার পক্ষে, কারও পক্ষেই আসলে, জগতের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এমনকি নিজের জীবনেরও। তাই এই সত্যকে করুন আলিঙ্গন। পাশাপাশি দাম দিন আবেগের। তার আগে একটু যাচাই করে নিন—এই আবেগ আপনাকে কোথায় নিয়ে ফেলবে। কারও জন্য, কিছুর জন্য, এমনকি নিজের জন্যও ক্ষতিকর নয়, বরং উপকারী—এমন আবেগগুলোকে করুন লালন। দেখবেন, ভালোবাসা জেগে উঠবে নিজের প্রতি।
মোদ্দা কথা, মনোযোগী মানুষে পরিণত হয়ে, চাহিদার বদলে বরং প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিয়ে, নিজের যত্ন নেওয়ার ইতিবাচক চর্চা চালিয়ে, স্বাস্থ্যকর অভ্যাস লালন করার মাধ্যমে সেলফ লাভের সুফল আমরা অর্জন করতে সক্ষম।
সেলফ লাভকে অবশ্য অনেকেই সেলফিশনেস বা স্বার্থপরতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। আপাতদৃষ্টে কিছুটা মিল থাকলেও বস্তুত এ দুটি বিপরীত। স্বার্থপরতা হলো এমন একটি চর্চা, যাতে একজন মানুষ অন্যদের তুলনায় নিজের প্রয়োজনকেই অধিক গুরুত্ব দেন। আর তাতে সমবেদনা ও বিবেচনার ঘাটতি থাকতে পারে, যা তার নিজের ও তাকে ঘিরে থাকা মানুষদের জন্য হয়ে উঠতে পারে হানিকর। স্বার্থপর মানুষের পক্ষে স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক গড়া দুরূহই বলা চলে; কেননা, অন্যদের তুলনায় বরং নিজের স্বার্থকেই প্রাধান্য দেন তারা। অন্যদিকে, সেলফ লাভ যে ঠিক উল্টো, সে কথা তো বলাই বাহুল্য।
আমেরিকান স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ইনোভা সেন্টারের কনসালট্যান্ট ভ্যানেসা স্কটো বলেন, ‘কখনো কখনো কোনো কোনো শব্দ আপনার মাথা ঘুরিয়ে দিতে পারে! আমি যখন সাইকোলজি নিয়ে পড়তে গ্র্যাড স্কুলে প্রথম দিন গেলাম, এমনটাই ঘটেছিল। সিটে বসে কলম হাতে নিয়েছি, শিক্ষক বললেন, “সেলফিশনেস ও সেলফ লাভের মধ্যে পার্থক্য শিখতেই হবে তোমাদের।” রুমের বাতি যেন নিভে গেল! এত সহজ একটা কথা এক বৈপ্লবিক দোলা দিয়ে গেল মনে। কারও পক্ষে কি স্বার্থপর না হয়ে নিজেকে ভালোবাসা সম্ভব? ভাবুন তো: ভালোবাসার কোনো মানুষকে কোনো বিষয়ে ‘না’ বলতে আপনার হরদম খারাপ লাগে কি না? নিজের মর্জির বিরুদ্ধে ‘হ্যাঁ’ বলে দেন? নিজের যা কিছু দরকার, সেই তুলনায় বরং অন্যদের দরকারগুলো নিয়ে কিঃ উৎকণ্ঠায় ভোগেন? অন্যের জন্য কাজের চেষ্টা করতে গিয়ে নিজেকে গুরুত্ব কম দেন? যদি তা-ই হয়ে থাকে, তাহলে আপনার ভেতর সেলফ লাভ প্রকাশ ঘটানোর রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে স্বার্থপরতার ভয়। শুনুন বলছি, নিজের মর্জিকে মর্যাদা দিয়ে অন্যকে ‘না’ বলা, চারপাশে নির্দিষ্ট সীমারেখা গড়ে তোলা এবং নিজের প্রয়োজন ও স্বপ্নগুলোকে সম্মান জানানোটা স্বার্থপরতা নয়; বরং সেলফ লাভেরই বহিঃপ্রকাশ।’
তাই অন্য কেউ আপনার সেলফ লাভকে স্বার্থপরতা ভেবে ভুল করে আপনাকে ভুল বুঝলে তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন না যেন; ভুগবেন না দ্বিধায়। বরং নিজেকে ভালোবাসুন উদারচিত্তে। ওই যে, রকস্টার জন কবির যেমনটা গেয়েছেন: ‘ঘড়িতে এখন কতটা বাজে?/ খেয়াল করো ঘড়ির কাঁটা/ এখন কোন দিকে/ এই গান হয়তো তোমার/ কিছু সময় কেড়ে নিবে/ সময় কাড়ার আগে/ কিছু বলতে চাই/ আমি তোমাদের।…/ এই রোদ এই বৃষ্টি/ সবই তোমার অর্জন,/ বৃষ্টি হলে কেঁদো না/ রোদ আছে অপেক্ষায়…/ বাঁচো নিজেকে নিয়ে/ সময় থাকে না থেমে/ বিশাল আকাশের নিচে/ জীবন অনেক ছোট্ট/…আমি অনেক দিয়েছি অনেককে/ কেড়েও নিয়েছি অনেক কিছু/ সব কিছুর অংক মেলাতে গিয়ে/ ফিরে এসেছি নিজের কাছে…।’
এই ‘নিজের কাছে’ ফেরা শুধু নিজের কাছেই নয়, সবার কাছেই ফেরা। সেলফ লাভ মানে তাই শুধু নিজেকে ভালোবাসাই নয়; সবাইকে, ইতিবাচক সবকিছুকে ভালোবাসা।

মডেল: অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: পৌষী ও মুক্তা
জুয়েলারি: আমিসে
ছবি: কৌশিক ইকবাল

আমার উপলব্ধি

আজমেরী হক বাঁধন

আমরা অনেকেই নিজেদেরকে ভালোবাসার সঙ্গে স্বার্থপরতাকে একীভূত করে ফেলি, কিন্তু ব্যাপারটি মোটেই তা নয়। আমাদের সমাজে ছোটবেলা থেকে শিখি—নিজেকে ভালোবাসা মানে স্বার্থপর হয়ে যাওয়া। যেহেতু এসব শিখে বড় হই, তাই নিজেকে ভালোবাসা, নিজের ত্রুটিগুলো সংশোধন করার মতো ব্যাপারগুলো এড়িয়ে যাই। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে যখন আমার বয়স ৩৪ বছর, প্রথম অনুধাবন করি, নিজেকে ভালো না বাসলে কাউকে ভালোবাসা যায় না। মূলত সেই সময় থেকেই নিজেকে ভালোবাসার চেষ্টা শুরু করেছি। এখনো যে খুব একটা পারি, তা নয়।
নিজেকে ভালোবাসতে গেলে সুখ ও মানসিক প্রশান্তি খুঁজে পাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আর, সেটি তখনই খুঁজে পাব, যখন আমার সকল কাজে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারব। নিজের জীবনকে অন্যকে দিয়ে নিয়ন্ত্রণ হতে দেওয়া যাবে না। আমাদের সমাজে মানুষের নানা কথায় আমরা প্রভাবিত হই। বডি শেমিং, ব্যক্তিগত, পেশাগত ও ছাত্রজীবন নিয়ে নানা কটূক্তির মতো ব্যাপারগুলো আমাদের দমিয়ে দেয়। এসব কথা হয়ে দাঁড়ায় অনেক বড় প্রতিকূলতা। আর এই প্রতিকূলতা জয় করাটা গত কয়েক বছরে আত্মস্থ করতে শিখেছি আমি। দিনশেষে মানুষের কথায় কান না দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে, নিজেকে ভালোবাসলে আত্ম-উপলব্ধি করতে হবে। নিজের ভালো ও মন্দ—উভয় দিক গ্রহণ করতে হবে। সেই সঙ্গে যেসব ব্যাপার সংশোধনযোগ্য, সেগুলো পাল্টাতে হবে।
আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি কিন্তু আমি নিজেই। এরপরে অবশ্যই আমার সন্তান সায়রার কথা আসবে; পাশাপাশি মা-বাবার কথাও বলতে হবে। এদের নিয়ে থাকা, সময় কাটানোতে আমি মানসিক প্রশান্তি ও সুখ খুঁজে পাই। নিজের জীবনে যে ব্যাপারটি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করি, সেটি হলো আমার সততা।
নিজেকে খুঁজে পেতে এবং নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের নিমিত্তে ভ্রমণ গুরুত্বপূর্ণ। এই ভ্রমণ করার প্রবণতা আমাকে সোনার খাঁচায় বন্দি জীবন থেকে বের করে এনেছে।

অনুলিখন: ফুয়াদ রূহানী খান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top