skip to Main Content

ঘরেবাইরে I বর্ষায় বসতি

বৃষ্টিসিক্ত বাড়ি। রোম্যান্টিক মনের আশ্রয়। প্রকৃতি আর মানুষের যোগ সেখানেই। লিখেছেন স্থপতি সুপ্রভা জুঁইমানুষ যখন নিজের স্বপ্নের বাড়ির কথা বলে, তখন দরজা-জানালার আগে প্রকৃতির উপস্থিতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। সেই বাড়ির জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট এসে পড়ে। বাঙালির রোম্যান্টিক স্বভাব কিছুটা বৃষ্টিনির্ভর। এই যে ঢাকা শহরে যেখানে প্রতিবেশীর চেহারাও কখনো যার দেখা হয়নি, সেও বৃষ্টি পড়লে অন্যমনস্ক হয়ে যায়, বারান্দায় দেখা তরুণ বা তরুণীর দিকে তাকায়।
গোষ্ঠীবদ্ধভাবে মানবজাতির পথচলার শুরুটা সেই নদীর ধারেই। দীর্ঘদিন পেরিয়ে এখন এই নগরের আরও সূক্ষ্ম বিভাজনে চলে আসে একটি বাড়ির চিন্তা, একটি ঘরের ভাবনা। অন্যদিকে, আমাদের শরীরের ৮০ শতাংশই পানি। জন্মের সময় মায়ের জঠরেও সেই তরল।
মানুষ, দেহ, প্রকৃতি, ধর্ম, সংস্কৃতি– এ সবকিছুর প্রভাব স্থাপত্যে আছে বলেই এতখানি ভূমিকা টানতে হলো। নগরজীবনে ঘেঁষাঘেঁষি করে একটার উপরে একটা ঘর তুলে রাখা এই সব বহুতল ভবনে বৃষ্টির আস্বাদ কল্পনাবিলাস মাত্র। একটা বাগানবাড়ি, মানে যেখানে নির্মিত ভবনের চেয়ে সবুজ মাঠ বা কিছু গাছপালা মিলিয়ে ‘মানুষের নির্মিত নয়’ এমন সবুজ থাকলেই সেখানে বর্ষাকে পরিপূর্ণ রূপে পাওয়া সম্ভব। কিন্তু তা সবার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই বর্ষাবাড়ি নিয়ে স্থাপত্যের দৃষ্টিকোণে ভাবা হয়েছে এমন কিছু উদাহরণ হাজির করা যায়।
ফ্র্যাংক লয়েড রাইট নামে আমেরিকান এক প্রথিতযশা স্থপতির সেরা স্থাপত্যগুলোর একটি হচ্ছে ‘ফলিং ওয়াটার’ বলে একটি আবাসিক ভবন। ছুটির দিনগুলো কাটানোর জন্য পাহাড়ের মাঝে একটি ঝর্নার ধারে এই ভবন নির্মিত হয়েছিল ১৯৩৬ সালে। ফ্র্যাংকের ৬৭ বছর বয়সে করা এই কাজ এখনো বিশ্বনন্দিত এবং সর্বকালের সেরা স্থাপত্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। জাপানি স্থাপত্য প্রভাবিত ডিজাইনের এই বাড়ির অন্দরসজ্জাকেও ছাড়িয়ে যায় চারপাশের প্রকৃতির শব্দ। ঘন সবুজ গাছের মায়াময় আমেজ, জলের ধারা, বাতাসে গাছেদের ঘর্ষণের মৃদুমন্দ আওয়াজ সেখানে সৃষ্টি করেছে সুখকর আবহ। পাথুরে পাহাড়ের উপরে পাথরকে মূল উপাদান ধরে সাজানো এই বাড়ির দেয়াল। ফলে আশপাশের জায়গার সঙ্গে চমৎকার এক সহাবস্থান সৃষ্টি হয় ভবনটির। একেবারেই আরোপিত বলে মনে হয় না। আর ঝর্নার দিক একটুও পরিবর্তন না করে তাকে ভবনের নিচ দিয়েই বইতে দেওয়ার জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। এবং সেখানে সিঁড়ি দিয়ে বাড়ির লোকজনের জন্য সেই জলপ্রবাহ দেখার বিস্ময়কর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। পা ডুবিয়ে তা ছোঁয়া যায়। এত চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশে স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ধরে রেখে ভবনটির অনুভূমিক পৃষ্ঠতল। স্থাপত্যের যে দায়িত্ব মানুষের দেখভালের জন্য দরকার, তা পূরণ করতেই হবে। কিন্তু একই সঙ্গে তার চারপাশের পরিবেশের আনুকূল্য তাকে অর্জন করতে হয়। সেই জায়গা থেকেই ফলিং ওয়াটার স্থাপনাটি বৃষ্টি, জলাধার, ঝর্না, সবুজ, পাহাড় তথা আমাদের জন্য এক চমৎকার সৃষ্টি!
এ তো গেল বনজঙ্গলের কথা। কিন্তু এই শহুরে জীবনেই যদি বৃষ্টির স্বাদ আমরা পেতে চাই, তাহলে কী করতে হবে? বৃষ্টির সঙ্গে কাক্সিক্ষত সবুজের মাখামাখি এই ঢাকা শহরেরই বাড়িতে করে দেখিয়েছেন স্থপতি রফিক আজম। সেটাকে স্পষ্টত কেবল বৃষ্টি আখ্যা না দিয়ে তিনি বলতে চাইছেন, এটি হলো অধরাদের ধরবার একটি প্রক্রিয়া। বলছেন–
‘যখন সূর্যের আলো দেয়ালে আলতো করে ধরা দেয়, যখন জলরাশি জাপটে ধরে মাটিতে থাকা সবুজদের, আর সেই সবুজ দোলা দেয় হাওয়ায়; যখন সেই হাওয়ারা ফিসফিস করে মৃদু স্বরে কথা বলে… এই গোটা অনুভবই হলো নিজ আত্মাকে ছুঁতে পারার মতন এক অপার্থিব প্রাপ্তি! অধরার মাঝেই গন্তব্য, যেখানে আত্মা এবং তার খোলস পাশাপাশি অবস্থান করে এবং একে অন্যকে পরিশুদ্ধ করে। সেই আত্মা যেন গৃহে প্রবেশ করে তার ডালপালা মেলে অধরাকে আলিঙ্গন করে।’
স্থপতি রফিক আজমকে যা সব থেকে উৎসাহ জুগিয়েছে ’পানি’ ও ‘সবুজ’ নিয়ে কাজ করতে, তা হলো আমাদের বাংলাদেশের ছবি। বর্ষার মৌসুমে এ দেশের চিত্র পাল্টে যায়। স্থপতি এখানে লালনের কথার সূত্রে বলছেন, মানব দেহের দুটি অংশ আছে; এক হলো আত্মা, আরেকটি হলো তার খোলস। তেমনি একটি স্থাপত্যের দুটি অংশ থাকে, একটি হলো তার আত্মা যা বলা যায় ‘প্রকৃতিমাতা’; আরেকটি হলো তার খোলস, অর্থাৎ স্থাপত্য। এই খোলস এবং আত্মা একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল এবং একই সঙ্গে স্বনির্ভরও।
এই বাড়ির একেবারে কেন্দ্রে রয়েছে প্রকৃতি মাতার আত্মাসূচক স্থানটি, একটি পুকুর এবং তাকে ঘিরে জঙ্গল আর সবুজাভ পানির উপরে ছৈ-বিহীন একটি নৌকা। এর চারপাশ ঘিরে রয়েছে বাড়ির অন্যান্য জায়গা। কেন্দ্রে এই জায়গা থাকায় বাড়ির সদস্যরা চারপাশের উঁচু ভবনগুলোর আড়ালে থেকে নিজেদের উপস্থিতি উপভোগ করতে পারেন। কেবল কংক্রিট দিয়ে বানানোর ফলে বাড়িটি একটি নৈসর্গিক চেহারা ধারণ করেছে। মানুষনির্মিত একটি জায়গার মাঝেও অকৃত্রিম এক সৃষ্টির স্বাদ এখানে পাওয়া সম্ভব। এর বৃষ্টিবারান্দা আর উঠানে যেভাবে বর্ষাকে উদ্যাপন করা হয়, সেভাবে আর কোথাও ঘটে কি না, বলা মুশকিল। নৌকাটি দেখলে মনে ভিড় করে ফেলে আসা দিনগুলির কত গল্প! কে জানে বাড়ির গুরুজনেরা এখানে বসে সেসব গল্পই হয়তো পরের প্রজন্মকে শোনান কোনো এক বৃষ্টিবিকেলে চা পান করতে করতে। মানুষে মানুষে বন্ধন, নিজের সঙ্গে নিজের বন্ধন ঘটাতে পারলেই স্থাপত্যের সার্থকতা আর সেখানে যদি প্রকৃতি-মায়ের আশীর্বাদ থাকে, তবে তো কথাই নেই!
সাসটেইনেবল সলিউশনের বা টেকসই সমাধানের জায়গা থেকে গ্রিন আর্কিটেকচার এখন বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। এই চর্চার পদ্ধতিতে পানি প্রধান এক হাতিয়ার। বর্তমান বিশ্বের পরিবেশের বিরূপ প্রভাবের চ্যালেঞ্জকে সামলে উঠতে পরিবেশবান্ধব বাড়ি বানানোর ক্ষেত্রে স্থাপত্যে কিছু নীতিমালা অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। এগুলোর একটি হলো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বা রেইন ওয়াটার হারভেস্টিং। এই প্রক্রিয়ায় মূলত বাড়ির ছাদে জমা হওয়া বৃষ্টির পানিকে ধারণ করা হয় আলাদা করে। যা পরবর্তীকালে দৈনন্দিন নানা কাজে ব্যবহার করা সম্ভব। বর্ষার ঋতুতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে অনেক পরিমাণে খনিজ পানি বাঁচানো সম্ভব। তা ছাড়া যেসব এলাকায় খাওয়ার পানির ভীষণ সংকট রয়েছে, সেখানে বৃষ্টির পানি ধারণ করে তা খাওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের আধুনিক স্থাপত্যে, হোক সেটা আবাসিক ভবন বা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভবনে, এই চিন্তার প্রয়োগ ঘটছে। কারণ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে– বিশেষ করে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভবনগুলোতে বৃষ্টির পানি ব্যবহারকে আবশ্যিক করা হয়েছে।
মোদ্দা কথা হলো, স্থাপত্য কেবল একটি নিরেট আকৃতি নয়। বর্ষায় তা ভিজে যায়, কিন্তু তা অনুভব করার ব্যবস্থা রাখতে হয়। কেবল দরজা-জানালার সৌন্দর্যে তা সম্ভব নয়। যখন একটা বাড়ি প্রকৃতির আশ্রয় হয়ে ওঠে, তখন সেই ভবনে বসবাসরত মানুষটি মানবিক না হয়ে পারে কি?
Shuprava.jui.arch@gmail.com
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top