skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I সাগরপাড়ের ড্রাগন

সে দেশে ভ্রমণ মানেই ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা। প্রকৃতির মধ্যে তার সব ঘটনা মিশে আছে। হ্রদ, গুহা, পাহাড়, সমুদ্র—সব মিলিয়ে মনোরম এক দেশ। লিখেছেন বিধান রিবেরু

এক
দক্ষিণ চীন সাগরের পাড়ে একটি ড্রাগন শুয়ে আছে। মাথা সে রেখেছে চীনের কোলে। আর তার পেছনে ঠেকা দিয়ে আছে লাওস ও কম্বোডিয়া। ড্রাগনের মতো দেখতে দেশটির নাম ভিয়েতনাম। চীনা ভাষায় ভিয়েতনাম কথাটির অর্থ ‘আরও দক্ষিণে’। তো চীনের দক্ষিণে অবস্থিত তিনটি দেশ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়াকে লোকে ইন্দোচীন বলেই চেনে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশ ফরাসি উপনিবেশের সঙ্গে লড়াই করেছে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। যুদ্ধের সুযোগে মাঝে জাপান থাবা বসায় সাগরপাড়ের এই ড্রাগনের ওপর। থাবার সঠিক জবাব দিলেও ফরাসিরা ফিরে আসে দখলের লালসা নিয়ে। তারা এবারে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে পশ্চিমা অন্য মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে জেনেভা চুক্তির মাধ্যমে উত্তর আর দক্ষিণ এই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলে ভিয়েতনামকে। দক্ষিণে পশ্চিমাদের তাঁবেদার সরকার গঠন করে দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক সম্রাট বাও দাই ও নগো দিন দিয়েমকে। ফরাসিদের সাহায্যের নামে যুক্তরাষ্ট্র সে সময় ভিয়েতনামে প্রবেশ করে। পুতুল হিসেবে বেছে নেয় নগো দিন দিয়েমকে। ফুঁসে ওঠে দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষ। আর তাদের সাহস ও বল জোগায় উত্তরের মানুষ এবং তাদের নেতা হো চি মিন।
মানবেতিহাসের কলঙ্কজনক একতরফা যুদ্ধে যথেষ্ট বল প্রয়োগ করে মার্কিন সরকার। লাখ লাখ মার্কিন সেনা দক্ষিণ ভিয়েতনামের তাঁবেদার সরকারের সহায়তায় খুন করে লাখ লাখ মুক্তিফৌজ। নিজেরাও নিহত হয়। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে। খোদ মার্কিন সেনারাও এই যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বাধ্য হয়ে অনেক টালবাহানা ও জানমালের ক্ষতির পর সত্তর দশকের মাঝামাঝি সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম ছাড়ে। অথচ হলিউডের ‘র‌্যাম্বো’ ছবি কতটা মিথ্যাচার করেছে একসময়। তবে এসব মিথ্যা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি উত্তর ও দক্ষিণের মিলনকে। ভিয়েতনামিরা এই পুনর্মিলনকে বলে ‘থান নাট’।
বর্ণিত ইতিহাসের পুনর্দর্শন ঘটল ভিয়েতনাম ভ্রমণের বদৌলতে। যদিও কপাল মন্দ এবার হো চি মিন সিটি, যা আগে সায়গন নামে পরিচিত ছিল, সেখানে যাওয়া হয়নি। তারপরও যতটুকু দেখেছি, তাতে সংগ্রামের ইতিহাস আমার মনে উঁকি দিয়ে গেছে, আর মনে হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা।
পার্থক্য হলো, বাংলাদেশ ভিয়েতনামের আগে স্বাধীন হলেও নগর-পরিকল্পনা ও যোগাযোগব্যবস্থা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে ভিয়েতনাম। শুধু তা-ই নয়, গত দুই দশকে তারা বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। অন্যদিকে পর্যটকের সংখ্যাও বেড়েছে ব্যাপক হারে। সেই ছাপ দেখেছি রাজধানী হ্যানয় ও বন্দরনগরী দানাংয়ে।
দুই
আমরা ছিলাম হ্যানয়ের একটি হোটেলে। হোয়ান কিয়েম লেকের কাছে। লেকটির নামের অর্থ ফিরে পাওয়া তরবারি। মানে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই লেক ঘিরে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন উদ্যান, পার্ক, ফুটপাত ও স্থাপনা।
রাজধানী হ্যানয়ের আরেকটি ব্যাপার আমাকে অবাক করেছে, সেটি হলো পুলিশের স্বল্পতা। স্বয়ংক্রিয় সংকেতের মাধ্যমে যানবাহন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। ঢাকার কথা মনে পড়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সমাজতান্ত্রিক সরকার কী সুন্দর করে দেশ পরিচালনা করছে। যদিও নব্বই দশকের শেষ ভাগ থেকে বড় শত্রু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের বাণিজ্য বেড়েছে বৈ কমেনি। ইদানীং চীনও ব্যাপক হারে বিনিয়োগ করছে দেশটিতে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বৈরিতার সুযোগ নিচ্ছে ভিয়েতনাম। তাতে দোষের কিছু দেখি না।
রাজধানীতে এক রাত কাটিয়ে, সকালে ঘণ্টা তিনেকের পথ পেরিয়ে আমরা যাই হা লং বে-তে। হা লং মানে ডুবন্ত ড্রাগন। তার পিঠে বড় নৌযান অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। এটি তীরে ভেড়ে না। পোতাশ্রয় থেকে ছোট ট্রলারে করে যাত্রীদের ক্রুজে তোলা হয়। আমাদের সেভাবেই নেওয়া হলো। সাগরের মাঝে গিয়ে বিকেলেই নিয়ে যাওয়া হলো হাং-লুয়নের গুহায়। গুহার ছাদে যেন মহাকাল ইতিহাস লিখে গেছে, পাথরে খোদাই করা সেই ইতিহাস। গুহার ওপারে লুকানো আরেক দুনিয়া। রূপকথার মতো। দ্বীপ গুহার মাঝে অথই পানি, উপরে খোলা আকাশ, কিন্তু যতটুকু ডাঙা আছে, তাতে শাখামৃগদের রাজত্ব। আমার অর্ধাঙ্গিনী মণি ও পুত্র মনের সঙ্গে শামীম-ফারিন দম্পতিও ছিলেন, আর ছিল তাদের কন্যা ফারিবা। ফারিবার আধখাওয়া একটি কলা যেভাবে ট্রলারে লাফ দিয়ে এক বানরশাবক ছোঁ মেরে নিয়ে গেল, তা দেখে ছেলেবুড়ো সবাই বেশ আমোদ পেল।
কাছেই টিটভ দ্বীপ। গেরম্যান স্পেতানভিচ টিটভ রুশ মহাকাশচারী। তিনি হো চি মিনের বন্ধু ছিলেন। ভিয়েতনামি জনযুদ্ধেরও বন্ধু ছিলেন। তাই তার নামে এই দ্বীপ। সামনে অর্ধচন্দ্রাকৃতি বালুকাবেলা। পেছনে ১১০ মিটার উঁচু পর্বত। মনে প্রথমে সাগরের পানিতে দাপাদাপি করে, এরপর বায়না ধরে পাহাড়ের উপর উঠবে। কিন্তু কোলে চড়ে। তাকে আইসক্রিম দিয়ে শান্ত করা হয়। শেষ বিকেলের আলোয় দ্বীপের আকাশ আভা ছড়াতে শুরু করে। একটু পরই ক্রুজে ফেরার জন্য ট্রলারে উঠি। সামনে বিস্তৃত জলরাশি, তার উপরে হলুদ, নীল, লালচে নানা রঙের আকাশ। এমন সুস্নিগ্ধ সন্ধ্যার অনুবাদ আমার জানা নেই।
ক্রুজে ফেরার পর চাল থেকে তৈরি করা একধরনের টিস্যু পেপারের মতো কাগজ দিয়ে রোল বানানো শেখায় আমাদের গাইড। লম্বালম্বি করে কাটা ডিম ভাজা, স্যালাড, মাংস দিয়ে একটি রোল বানাই। দ্বিধায় ছিলাম, এই কাগজসুদ্ধ খেয়ে ফেলব? গাইড অভয় দিল, এটা চালের তৈরি, কাজেই খেলে কোনো সমস্যা নেই। পাশে এক ফরাসি সুদর্শনা দেখি খেয়ে হাত চাটছে আর বলছে, সে বোঁ। আমি সাহস পেয়ে মুখে পুরে দিই। সুস্বাদু।
রাতটা কাটে ক্রুজেই। ভাসতে, ভাসতে। আমাদের জানালা দিয়ে দেখা যায়, আরও ক্রুজ ভাসছে হা লং বে-তে। যৌথ জলযাপন।
হা লংয়ের সকাল ছিল মেঘাচ্ছন্ন। শান্ত জলরাশি। পানি ফুঁড়ে পাহাড় উঁকি দিয়ে আছে যত দূর চোখ যায়। পাহাড়ের পেছনে পাহাড়। সে যেন এক অচিন ছায়ারাজ্য। সকালেও একটি গুহা দেখতে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে আমরা ক্রুজের ডেকে বসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করি। কোথাও এসে শুধু ছুটে বেড়াতে ভালো লাগে। একটু থিতু হয়ে বসে যদি কোনো জায়গার রূপ-রস-গন্ধ উত্তম রূপে না নিই, তাহলে সেটা ভালো খাবার শুধু গিলে ফেলার মতোই হয়।
ব্রাঞ্চ করে আমরা হার্বারে চলে আসি দুপুর নাগাদ। এরপর হ্যানয়ের উদ্দেশে যাত্রা। এদের যাত্রাবিরতিতে গা ঝাড়া দেওয়ার যে ব্যবস্থা, সেটাও আন্তর্জাতিক মানের। বাঙালি মন শুধু তুলনা করছিল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যাওয়ার পথে যেখানে যাত্রাবিরতি হয়, সেসব রেস্তোরাঁর কী করুণ অবস্থা। কবে আমরা কথায় বড় না হয়ে কাজে বড় হবো! ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে লাখ লাখ টন বিস্ফোরক ফেলেছে, রাসায়নিক বোমা ছুড়েছে, সেসবের ক্ষত আজও শুকায়নি, আর তাই দেশটির এখনো অনেক পিছিয়ে থাকার কথা। জাপানের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কিন্তু তারা বিশ্বের বড় বড় খেলোয়াড়ের সঙ্গে খেলতে শিখে গেছে। সেটার সুফল জনগণ পাচ্ছে।
তিন
হ্যানয় থেকে এক ঘণ্টার উড়ানে দানাং। ভিয়েতনামের প্রধান বন্দরনগর। ফরাসিদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই বন্দর। সেখানে পৌঁছে রাতের খাবার শেষ করে সমুদ্রের পাড়ে গেলাম। দক্ষিণ চীন সাগর। এই সাগরেই কৃত্রিম দ্বীপ তৈরি করছে চীন। এ নিয়ে ভিয়েতনাম উদ্বিগ্ন। যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই। কয়েক বছর ধরেই এই সাগরে চীনের তৎপরতা নিয়ে চলছে উত্তেজনা। তবে উত্তেজনাকে সামাল দিয়েই ভিয়েতনাম নিজের অর্থনীতিকে সংহত করছে। দানাংয়ে একটি ক্যানসার হাসপাতাল আছে, যেখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসা করা হয়। হ্যাঁ, এখানে বিনা মূল্যে শিক্ষা পায় না লোকে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীও আছে, কিন্তু এটাও ঠিক, সাড়ে তিন ডলারে একজন মানুষ সারা দিনের খাওয়াদাওয়া সারতে পারে। খাবারের দাম সস্তা হওয়ায় জীবনযাত্রায় খরচও কম।
যে হোটেলে উঠেছি, সেখান থেকে রাস্তা পেরোলেই সাগর। সকালে গেলাম সেখানে। মনে হলো, আহা, একসময় কত ভিয়েতনামি মুক্তিযোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত হাত নিয়ে মার্কিন সেনারা এই মাই খে সৈকতে এসে স্নান করেছে। প্রকৃতি রক্তের দাগ মুছে ফেলে, কিন্তু ইতিহাস তা করে না। এখন এই সমুদ্রসৈকত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ফোর্বস ম্যাগাজিনে একবার দুনিয়ার সবচেয়ে লাক্সারিয়াস সি বিচ হিসেবেও এর নাম এসেছিল। পরিচ্ছন্ন বালুকাবেলায় হাঁটতে হাঁটতে দূরে পাহাড়ের গায়ে আটকে পড়া মেঘেদের দিকে চোখ চলে যাচ্ছিল। যেন সাগরের হাত ছেড়ে পাহাড়ের কোলে আশ্রয় নিয়েছে মেঘমালা। সাগরে তাই অশ্রুর ফেনায়িত জল।
এসব সাগর ও পাহাড়কে কেন্দ্র করে একটি গল্প এখানে প্রচলিত আছে। সমুদ্র থেকে উঠে এসে নন নুয়ক বা মাই খে সৈকতে ডিম পাড়ে এক ড্রাগন। সহস্র দিবস ও রজনী শেষে সেই ডিম ফেটে বেরিয়ে আসে এক ফুটফুটে রাজকন্যা। ফাটা ডিমের পাঁচটি খোসা থেকে জন্ম নেয় ধাতু, কাষ্ঠ, পানি, অগ্নি ও মৃত্তিকা নামের পাঁচটি রহস্যময় পাহাড়। লোককাহিনি তাই বলে। এই পঞ্চপর্বত পরিচিত মার্বেল পর্বতমালা হিসেবে। মর্মর আর চুনাপাথর দিয়ে গঠিত। আমরা দুপুরের পর গিয়েছিলাম পানি পর্বতে। খাড়া ছয় শ ধাপ ডিঙিয়ে উঠেছি এক প্রাচীন প্যাগোডায়। সপ্তদশ শতকে তৈরি। প্যাগোডার প্রাঙ্গণে রয়েছেন হাস্যমুখ বুদ্ধ। তার কান বড়। কারণ, তার সবার কথা শুনতে হয়। তার পেট বড়, কারণ তার সবার কথা জমা রাখতে হয়। বিশাল সেই বপুতে হাত বোলালে নাকি আনন্দ হয়। হাত বোলালাম। আনন্দ হলো না, কারণ এখানে পৌঁছাতে খাড়া খাড়া সিঁড়ি ভাঙতে হয়েছে মনকে কোলে নিয়ে। বান্দা একমুহূর্তের জন্যও কোল ছাড়েনি।
প্যাগোডার উঠোনের পেছনের দিকে রয়েছে গুহা। ঝরনার পানি সেই গুহার ভেতরে ধরে আসা বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে। সেখানে তথাগত বসে আছেন। আশীর্বাদ করছেন। বিশাল সেই মর্মর ভাস্কর্যের উপরে গুহার ছাদে পাঁচটি ছিদ্র। দেখে মনে হবে বুদ্ধের পাঁচ আঙুল বুঝি। কিন্তু না। মার্কিনদের বোমার আঘাত বহন করছে এরা। এসব গুহার ভেতর থেকে সৈকতে স্নানরত মার্কিন সেনাদের ওপর নজর রাখত ভিয়েতনামি গোয়েন্দারা। তাই এই হামলা। যুদ্ধের ক্ষত বাদ দিলে বিশাল গুহাটি নির্বাণ লাভের জন্য যথাযথ স্থান বলেই মনে হয়।
ধ্যানমগ্ন প্রকৃতি থেকে বেরিয়ে গেলাম হইয়ান গ্রামে। সেখানে গিয়ে ভিয়েতনামের ঐতিহ্যবাহী খাবার খেলাম। খাবার শেষে পরিবেশন করা হলো মিষ্টান্ন, মানে ডেজার্ট। চাল, মুগ ডাল ও চিনি দিয়ে বানানো সেই গোল্লা পাকানো হয় কলাপাতায় মুড়িয়ে। বেশি মিষ্টি নয়। দেখতে যেমনই হোক, খেতে ভালো। এরপর হইয়ানের রাস্তায় ঘোরাঘুরি। কেনাকাটা। রাস্তায় দেখা আস্ত চিংড়ির পিৎজা! বাহারি লন্ঠন বাতি। রাত্রি ঘন হয়ে আসছিল। আমরাও হোটেলের উদ্দেশে রওনা দিই।
চার
ঔপনিবেশিক ফরাসিরা নিজেদের আমোদ ও ভিয়েতনামের গরম আবহাওয়া থেকে বাঁচার জন্য বিংশ শতাব্দীর প্রথম সিকি ভাগে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় দেড় হাজার মিটার উপরে, বানা হিলে একটি রিসোর্ট বানায়। সেখানে দ্রাক্ষারস থেকে ওয়াইন বানানোর জন্য চুলাও স্থাপন করে তারা। পরে স্বাধীনতাকামীরা সেসব ধ্বংস করে ফেলে। কিন্তু কী পরিহাস, সেই ভিয়েতনামি স্বাধীনতাকামীদের বংশধরেরাই এই বানা হিলে নতুন এমিউজমেন্ট পার্ক বানিয়ে সেখানে ‘ফ্রেঞ্চ ভিলেজ’ গড়ে তুলেছে। ফরাসি গ্রাম বলতে থিম পার্ক আরকি। সেখানে ফরাসি স্থাপত্যকলার অনুকরণে নানা স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। প্রমোদ ভ্রমণে আপনি পাবেন ফরাসি কেতার বুফে। আছে ‘ল জাখদা দা মুর’, মানে ভালোবাসার বাগান। সেখানে যেতে ২০ মিনিটের মতো ক্যাবল কারে চড়তে হয়। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ও একটানা ক্যাবল কার। মাঝে আছে গোল্ডেন ব্রিজ। পর্বত দেবতা নিজ হাতে সেই সেতু ধরে রেখেছেন। এই গল্প বছরখানেক হলো পর্যটনশিল্পের জন্য প্রচার করা হচ্ছে।
আমরা বানা হিলে গিয়ে মেঘের ভেতর হারিয়ে গিয়েছিলাম। আবার ছিল বৃষ্টি। এই মেঘবৃষ্টি মাথায় নিয়েই পর্বতের প্যাগোডা, মন্দির, গির্জা, ফরাসিদের ওয়াইন তৈরির কারখানা, তাদের আদি স্থাপনা ঘুরে ঘুরে দেখি। বানা হিলের সঙ্গে বানানা কথাটি যুক্ত। পর্বতের গায়ে অসংখ্য কলাগাছ জন্মে আছে দেখলাম উপর থেকে। ক্যাবল কারে পর্বতে ওঠার সময় খরস্রোতা ঝরনাও দেখেছি। তার নাম জিজ্ঞেস করা হয়নি।
সান ওয়ার্ল্ড নামের এক কোম্পানি এই এমিউজমেন্ট পার্ক বানিয়েছে, অনেকটা ওয়াল্ট ডিজনি পার্কের মতো করে। বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছে তারা। সাধারণ পর্যটকদের এসব কৃত্রিম বাগান, গ্রাম ইত্যাদি আকর্ষণ করলেও আমাকে অতটা টানেনি। শুধু ফরাসিদের বিধ্বস্ত একটি ঘরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। সেটা কৃত্রিম ছিল না। সান ওয়ার্ল্ডের লোকজন ঘরটিকে আলাদা মর্যাদা দিয়ে টিকিয়ে রেখেছে। পর্বতের উপর এক টুকরো উপনিবেশ, এক টুকরো ইতিহাস। সেটাই আমাকে বেশি টেনেছে।
পরের দিন সকালে দানাংয়ের অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর থেকে উড়াল দিই হ্যানয়ে। সেই বিমানবন্দরও আন্তর্জাতিক মানের। যা হোক, হ্যানয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকেল। সেই প্রথম দিন একটি বইয়ের দোকান পেয়েছিলাম, আর এই শেষ বেলায়ও পেলাম। তবে এগুলোকে ভালো বইয়ের দোকান বলা যাবে না। হয়তো সে রকম আছে। খোঁজার সময় পাইনি। হ্যানয়ে শেষ সন্ধ্যায় বইয়ের দোকানটি পেয়েছিলাম ভিনকম নামের এক বড় শপিং মলে। বই সব ভিয়েতনামি ভাষায়। আর ইংরেজি বই গোটা বিশেক যা আছে, সেগুলো জনপ্রিয় ধারার। লাভের মধ্যে ভিয়েতনামের ক্ল্যাসিক ওয়ার ফিল্ম ও সাম্প্রতিক সময়ের আলোচিত চলচ্চিত্রের ডিভিডি পেয়েছি। আমি এতেই খুশি। দোকানে ইংরেজি জানা কাস্টমার ধরে ধরে, জিজ্ঞেস করে তারপর এসব ডিভিডি কিনেছি। ঘাম ছুটে গেছে! প্রথম দিনেও চারটি বই কিনেছিলাম ভিয়েতনাম যুদ্ধের ওপর। সবচেয়ে ভালো বইটি হলো দাং থুই ট্রামের একটি দিনলিপি, নাম লাস্ট নাইট আই ড্রিমড অব পিস। দাং থুইকে ভিয়েতনামের আনা ফ্রাংক বলা হয়।
ঢাকার পথে রওনা দিই পরদিন ৪ নভেম্বর সকালে। যাত্রা শুরুর কয়েক মিনিট পর খেয়াল হলো, হোটেলে পাসপোর্ট ফেলে এসেছি। ভাগ্যিস, আমার স্ত্রী মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। দৌড়ে পাসপোর্ট নিয়ে আসি। ট্রানজিটসহ দীর্ঘ প্রায় দশ ঘণ্টা পর যখন ঢাকায় ফিরি, তখন মাঝরাত। বাসায় ফিরছি আর ভিয়েতনামের স্মৃতিও আমাদের তাড়া করে ছুটছে। একসময় এই স্মৃতি ফিকে হয়ে যাবে, তাই তাকে ধরে রাখার এই ছোট্ট প্রয়াস।

কৃতজ্ঞতা
মোরশেদ শফিউল হাসান, অবাক নাম ভিয়েতনাম, (ঢাকা: মুক্তধারা, ১৯৮৪)

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top