skip to Main Content

ছুটিরঘণ্টা I সায়গনের স্মৃতি

ভিয়েতনামের একসময়ের ঔপনিবেশিক রাজধানী। সেখানে ইতিহাসের বিচিত্র ঘটনার চিহ্ন আজও অটুট। বিশেষত সে দেশের মানুষের স্বাধীনতাসংগ্রামের নিদর্শন। লিখেছেন ফাতিমা জাহান

হো চি মিন সিটি বা সায়গন। ভিয়েতনামের প্রধান শহর।
ছোটবেলা থেকে ভিয়েতনামের গল্প শুনে বড় হয়েছি। সে দেশের মানুষ কুড়ি বছর যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে।
সায়গন ছিল স্পেন উপনিবেশ আমলে ভিয়েতনামের রাজধানী ১৮৫৯ থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত। ১৮৬২ সালে স্পেন একটি চুক্তির মাধ্যমে ফ্রান্সকে সায়গন দেখভাল করার দায়িত্ব দেয়। ১৯৫৫ সালে ভিয়েতনাম স্বাধীনতা লাভ করার পর থেকেই উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনামের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ শুরু হয়, যা গৃহযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়। এই যুদ্ধের সময়কাল ছিল কুড়ি বছর। এত দীর্ঘ সময় যুদ্ধাবস্থায় থাকা সত্ত্বেও সায়গন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এশিয়ার অন্যান্য উন্নত শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
ভিয়েতনামে প্রথম দিন।

অপেরা হাউস

প্রথম গন্তব্য রিইউনিফিকেশন প্যালেস, যা ইনডিপেনডেন্ট প্যালেস নামেও পরিচিত।
হোটেল থেকে হেঁটে হেঁটে পৌঁছে গেলাম। টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। আশ্চর্য হলাম এই জেনে যে এখানকার স্থানীয় মানুষদের জন্যও প্রবেশমূল্য একই, অন্যান্য দেশে তো বিদেশিদের প্রবেশমূল্য অনেক বেশি। জয় হো সমাজতন্ত্র বলে বিশাল প্যালেস চত্বরে প্রবেশ করলাম। ১২ হেক্টর জায়গা নিয়ে তৈরি এ চত্বর এত বড় যে এখানে হেলিকপ্টার ল্যান্ড করার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রাসাদটি অপরূপ গাছগাছালি পরিবেষ্টিত আর এখানে ৮০০ অতিথি রাখার মতো শোবার ঘর রয়েছে। ১৮৬৩ সালে ফ্রেঞ্চ কলোনি স্থাপনের সময়ে এ প্রাসাদ নির্মাণ করা হয় একই জায়গায় একটি কাঠের প্রাসাদের স্থানে, যা তখনকার গভর্নরের কর্মস্থল ও আবাসস্থল ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ভিয়েতনাম অধিগ্রহণ করলে প্রাসাদটি জাপান সরকারের কর্মস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয় কিছুদিন। এরপর আবার ফ্রান্সের দখলে থাকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত। সে সময় ভিয়েতনাম ভাগ হয়ে যায় কমিউনিস্ট আর এন্টি-কমিউনিস্টে। উত্তর ভিয়েতনাম মনেপ্রাণে কমিউনিজমকে ধারণ করেছিল আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম যার প্রাণকেন্দ্র সায়গন ছিল এন্টি-কমিউনিস্ট রাজ্য।
ইনডিপেনডেন্ট প্যালেস কুড়ি বছরের ভিয়েতনাম যুদ্ধের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রাসাদে ঢুকতেই নিচতলায় কয়েকটি কনফারেন্স রুম, ব্যাংকোয়েট চেম্বার, মন্ত্রীদের কেবিনেট রুম, বিশাল আকারের রান্নাঘর যেখানে হাজারখানেক মানুষের খাবারের জোগান দেওয়া সম্ভব। দোতলায় অতিথিদের শোবার ঘরসহ আরও একটি বিশাল কনফারেন্স হল।
তৃতীয় তলায় প্রেসিডেন্টের নিজস্ব অফিস, শোবার ঘর ইত্যাদি।
ছাদে হেলিকপ্টার অবতরণের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা। যুদ্ধাবস্থার সময়ে যেমন ছিল, প্রাসাদটি ঠিক তেমনই রাখা হয়েছে আজও।
আমার কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে বেসমেন্টের ঘরগুলো। ওপরের তলাগুলো দেখতে সাধারণ প্রাসাদের মতো মনে হলেও বেসমেন্টকে একেবারেই হেলা করা যায় না। তদানীন্তন যুদ্ধাবস্থা মোকাবিলা করার জন্য সর্বাধুনিক সব ডিভাইসের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বেসমেন্ট বাংকার এতটা মজবুত করে নির্মাণ করা হয়েছে যে ২০০০ কিলোগ্রাম পরিমাণ ব্লাস্ট হলেও ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। দুটি শাখায় বিভক্ত এ বাংকারের প্রথমটি কমান্ডো সেকশন আর দ্বিতীয়টি কমিউনিকেশন সেকশন। প্রেসিডেন্টের তৃতীয় তলার অফিস থেকে বাংকারে পৌঁছানোর জন্য সরাসরি সিঁড়ি রয়েছে। বাংকারের দুটো সেকশনই আমেরিকান সরকার নিজ উদ্যোগে নির্মাণ করে দিয়েছে অত্যাধুনিক ডিভাইস বসিয়ে, যাতে দক্ষিণ ভিয়েতনাম যুদ্ধে এগিয়ে উত্তর ভিয়েতনামকে প্রতিহত করতে পারে। কিন্তু কুড়ি বছর যুদ্ধ শেষে দক্ষিণ ভিয়েতনামকেই সমর্পণ করতে হলো অনাধুনিক, অপটু, দেশপ্রেমী উত্তর ভিয়েতনামের কাছে। দিনটি ছিল ৩০ এপ্রিল ১৯৭৫ সাল। দক্ষিণ ভিয়েতনামের প্রেসিডেন্ট এই ইনডিপেনডেন্ট প্যালেসেই আত্মসমর্পণ করলেন আর সেই থেকে কমিউনিস্ট সরকার এলো ভিয়েতনাম নামের দেশটিতে।
ইনডিপেনডেন্ট প্যালেস দেখে হাঁটতে থাকলাম হোটেলের দিকে। পথে এ শহরের হাইকোর্ট পড়ল। এত ছোট কোর্ট অঙ্গন দেখে মনে হচ্ছিল কোনো সরকারি অফিস। জনমানবহীন এ ভবন দেখে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে বিচারকাজ চলছে। একে-তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, সেটাই হাইকোর্ট। মনে হয়, যে দেশে অপরাধ যত কম হয়, সে দেশের বিচারালয়ও ততটা ছোট হয়।
ফ্রেঞ্চ কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এ কোর্ট ভবন তৈরি হয়েছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে। সদর দরজায় ইউরোপীয় সেনাপতি আর সিংহের মাথা বসানো। এদের পাহারায় নিরাপদ থাকে বিচারব্যবস্থা। ভেতরে ঢোকা নিষেধ, তাই বাইরে থেকে সাদা আর হলুদ রঙ করা ভবনের সবুজ জানালা দেখে বিদায় নিলাম।

সায়গন পোস্ট অফিস

পরিচ্ছন্ন বিশাল বিশাল গাছের ছায়াঘেরা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হাজির হলাম হো চি মিন সিটি মিউজিয়ামে। এ ভবন আগে জিয়া লং প্যালেস নামে পরিচিত ছিল, যা ফ্রেঞ্চ কলোনিয়াল আমলে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়েছিল। প্রাসাদটি ফরাসি আমলে তদানীন্তন গভর্নরের বাসভবন ছিল।
দ্বিতল প্রাসাদটি ১৭০০ বর্গমিটার স্থানজুড়ে অবস্থিত। সামনে বাগানের জন্য একচিলতে জায়গা। পুরোনো আমলের ইমেজ আনার জন্য একটি ঘোড়ার গাড়ি আর বিংশ শতাব্দীর একটি মোটর গাড়িও রাখা হয়েছে।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মূল স্থাপত্যশৈলী ছিল ‘বারোক’, যা এ প্রাসাদটিতে অতি বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়েছে। গ্রিক মিথোলজিকে স্মরণে রেখে বাইরের দেয়ালে বিভিন্ন মোটিফ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। প্রাসাদটিতে কনফারেন্স কক্ষ, অফিস রুম, বেডরুম, ইলেকট্রিক্যাল রুম ইত্যাদি রয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর নিচে আন্ডারগ্রাউন্ড টানেল রয়েছে, যা শহরের অন্যান্য প্রান্তের সঙ্গে সংযুক্ত। টানেলে দুদিকে দিকে দুটি সিঁড়ি, ৬টি লোহার দরজা রয়েছে আর টানেলটির দেয়াল ১ মিটার পুরু। বেজমেন্টেও অফিস রুম, বাথরুম, ইলেকট্রিক রুম রয়েছে।
জাদুঘরের নিচতলায় ভিয়েতনামের আদিকালের জনসাধারণের জীবনচিত্র, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, ধর্মীয় রীতিনীতি ইত্যাদি ফুটিয়ে তোলার জন্য ডামি ব্যবহার করা হয়েছে। হাজার বছর আগে ভিয়েতনামের মানুষের জীবন-জীবিকা তখনো ছিল চাষবাস ও পশুপালন। নারী-পুরুষনির্বিশেষে সব কাজে সমান দক্ষ ছিল।
দোতলায় ভিয়েতনাম যুদ্ধকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ব্যবহৃত অস্ত্র, অন্যান্য সামগ্রী, যোগাযোগের মাধ্যম, বিভিন্ন সময়কার ছবি ইত্যাদি দেখে ও বর্ণনা পড়ে কুড়ি বছরের যুদ্ধের ভয়াবহতা খানিকটা হলেও আঁচ করা যায়।
বের হয়ে রেস্টুরেন্ট খুঁজতে থাকলাম। আমি ভোজন-বেরসিক মানুষ। কিন্তু তাই বলে না খেয়ে থাকব, তা তো হয় না। মাঝারি মানের একটা রেস্টুরেন্ট দেখে ঢুকে পড়লাম। এবং যথারীতি মেনু কার্ডের দুর্বোধ্যতা আমাকে মোটেও বিরক্ত করতে পারেনি। ছবি দেখে নুডল স্যুপ জাতীয় খাবার অর্ডার করলাম। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলে ‘ফা’।

ভিয়েতনামিজ খাবার ফা

ফুটন্ত চিকেন স্টকে কিছু শাকসবজি আর মুরগির মাংস ছোট ছোট পিস করে কেটে দেওয়া উপাদেয় খাদ্যটিই ভিয়েতনামের বিখ্যাত খাবারটিই। এক হাতে স্যুপের চামচ, অন্য হাতে চপস্টিক ধরে বিশেষ কায়দা করে খেতে হয় ‘ফা’।
সন্ধ্যা হতে চলল বলে। হাঁটা দিলাম হোটেলের দিকে।
হোটেলে পৌঁছাতেই দেখা মিলল ম্যানেজার লি এর সঙ্গে। তিনি আড্ডা দিচ্ছিলেন লবিতে বসে একজন ব্রিটিশ ভদ্রলোকের সঙ্গে। নাম হ্যারি, বয়স ষাটের কাছাকাছি। ভিয়েতনামের কন্যা বিয়ে করে এখন থাকেন সে দেশেই। বিবি বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে এসেছেন এ শহরে, থাকছেন এ হোটেলেই। লি আর হ্যারির সঙ্গে আমার আড্ডা জমে গেল।
আমি মাঝখানে উঠে গেলাম ডিনারের জন্য লি আর হ্যারিকে বিদায় জানিয়ে।
সায়গন শহরে দ্বিতীয় দিন। সকালে প্রস্তুতি নিলাম কাছেপিঠের মনুমেন্ট দেখার। হোটেলে নাশতা সারলাম। ইংলিশ ব্রেকফাস্ট। এর চেয়ে ভালো আর কীই-বা আছে!
হাঁটতে হাঁটতে পার্ক পেরিয়ে জিয়া লং প্যালেস পার হয়ে ডানে মোড় নিয়ে আরও খানিক দূর এগোলেই সামনে পড়বে নটর ডেম ক্যাথেড্রাল বেসিলিকা ডি সায়গন’। ফরাসি ঔপনিবেশিক আমলে গির্জাটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ফ্রেঞ্চ কর্মকর্তাদের প্রার্থনা ও ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের জন্য। কাজটি শেষ হয় ১৮৮০ সালে। উপকরণ আনা হয়েছিল ফ্রান্স থেকে। সামনে প্রায় গির্জার সমান উঁচু মাদার মেরির মূর্তি। গির্জা আর মাদার মেরি মিলে চারপাশকে মনে হচ্ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর কোনো ইউরোপীয় সিনেমার সেটে চলে এসেছি। মূর্তিটি আনা হয়েছিল রোম থেকে। নিও গথিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত গির্জাটির বাইরের লাল ইটের দেয়াল এখনো হুবহু একই রঙ ধরে রেখেছে, আরেকটি ব্যাপার হচ্ছে গির্জার রক্ষণাবেক্ষণের কারণেই এর দেয়াল, ছাদ—কিছুরই এতটুকু ক্ষয় হয়নি।
গির্জাটি শুধু বাইরের দিক থেকে দেখে সাধ মিটিয়ে এলাম। সংস্কারের জন্য গির্জা বন্ধ রয়েছে।
পাশেই সায়গন সেন্ট্রাল পোস্ট অফিস। ভবনটি নির্মিত হয় ১৮৯১ সালে। হলুদ রঙের দোতলা ভবনটিতে গথিক, রেনেসাঁস আর ফ্রেঞ্চ স্থাপত্যকলার ছাপ সুস্পষ্ট। ফরাসি ঔপনিবেশিক সময় থেকে শুরু করে আজ অবধি চিঠিপত্র আদান-প্রদানের কাজটা এই ডাকঘর করে আসছে একনিষ্ঠভাবে। ভেতরে ঢোকার মুখেই দুপাশের দেয়ালজুড়ে সারি সারি কয়েকটি টেলিগ্রাফ বুথ, যা এখন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। আরেকটু এগোলেই দুপাশের বসে রয়েছেন ডাকঘরের কর্মীরা। সবাই ব্যস্ত। এত এত দর্শনার্থী তাদের কাজের এতটুকু ব্যাঘাত ঘটাতে পারছে না। আর তারা এত উঁকিঝুঁকিতেও এতটুকু বিরক্ত হচ্ছেন না। প্রবেশদ্বারের মুখোমুখি দেয়ালে নেতা হো চি মিনের বিশাল ছবি ঘরটিকে আলোকিত করে রেখেছে।
সায়গন পোস্ট অফিসের আরেক অংশে স্যুভেনিরের সারিবদ্ধ স্টল।
সেখান থেকে থেকে বের হয়ে লাগোয়া গলিতে চললাম। সেটাকে স্থানীয়রা বুক স্ট্রিট বলেন। লম্বা, পরিচ্ছন্ন একটা রাস্তার দুপাশজুড়ে সারি সারি বইয়ের দোকান। বেশির ভাগই ভিয়েতনামিজ ভাষায় লেখা বই। কিছুক্ষণ দেখে রাস্তার মুখের রেস্তোরাঁয় ঢুকে পড়লাম। দুপুর হয়েছে, কিছু খেতে হবে। অবশ্য এখানে বসার আরেকটা কারণ, বাইরে বসে নটর ডেম ক্যাথেড্রাল ব্যাসিলিকা ডি সায়গন দেখতে পাওয়া যায়।
ভিয়েতনামিজ কারি দিয়ে ভাত খেলাম। আর এত সুন্দর জায়গায় বসে বই সামনে নিয়ে, ঊনবিংশ শতাব্দীর গির্জা দেখতে দেখতে খাওয়ার আনন্দই আলাদা।
খেয়ে আবার গির্জা চত্বরে ঘোরাঘুরি করে বেরিয়ে পড়লাম।
চললাম বেন ঠান মার্কেটের দিকে। হো চি মিন শহরের প্রধান একটি মার্কেট। একতলা বিশাল এ মার্কেটে সব পাওয়া যায়—কাপড়চোপড়, গয়না, ব্যাগ, জুতা, সব রকমের স্যুভেনির, চিত্রকর্ম, হোম ডেকোরেশন, তাজা ফুল, ফল, খাবার, স্ন্যাকস, কাঁচা শাকসবজি।
এখান থেকে বেরিয়ে খানিক এগোলেই টাও ডান পার্ক। আমার রোজ হোটেলে ফেরা হয় পার্কের ভেতর দিয়ে। গাছগাছালিতে ভরা ছায়াঘেরা এ পার্কে বিকেলে অনেকে হাঁটেন, ব্যায়াম করেন, কেউ আবার নাচ প্র্যাকটিস করেন মিউজিকের তালে তালে। আজ দেখলাম কাপল ড্যান্স প্র্যাকটিস হচ্ছে। একজন শিক্ষক, তিন জোড়া শিক্ষার্থী। অনেকক্ষণ দেখে আবার হাঁটা দিলাম।
হোটেলে ফিরে দেখি, লি আর হ্যারি লবিতে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। আমাকে দেখে এমনভাবে দুজন তাকালেন যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। সন্ধ্যা হওয়া মানেই আড্ডার আসর।

নটর ডেম ক্যাথেড্রাল ডি সায়গনের সামনে লেখক

পরদিন যথারীতি প্রাতরাশ হোটেলে সেরে ছক বাঁধলাম সারা দিনে কোন কোন স্থান ভ্রমণ করা যায়।
প্রথমে গেলাম পিপলস কমিটি বিল্ডিং বা সিটি হলে। চমৎকার স্থাপত্যকলায় নির্মিত ভবনটির ১৮৯৮ সালে যখন কাজ শুরু হয়, তখন এটি ছিল উচ্চমানের হোটেল, যার নাম ছিল হোটেল দ্য ভিলা দি সায়গন। অফ হোয়াইট রঙের ফ্রেঞ্চ কলোনিয়াল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত লম্বা দ্বিতল ভবনটি হো চি মিন শহরের সবচেয়ে সুন্দর বাড়ি। এখন ভবনটি বিভিন্ন সভা-সমাবেশের কাজে ব্যবহৃত হয়। ভেতরে ঢোকা নিষেধ। তাই বাইরে থেকেই দর্শনার্থীরা দেখে মনের শখ মেটায়। রাতের বেলায় নাকি এই আরও সুন্দর দেখায়। পিপলস কমিটি বিল্ডিং থেকে দু-তিন মিনিটের হাঁটা পথ পেরোলেই দেখা মিলবে সায়গন অপেরা হাউসের। ভবনটি হ্যানোয় অপেরা হাউসের আদলে নির্মিত, তবে আকারে ছোট।
১৮৯৭ সালে সায়গন অপেরা হাউস নির্মাণ করা হয় এখানকার ফ্রেঞ্চ ও স্থানীয়দের মনোরঞ্জনের জন্য। সাধারণত নাটক বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মঞ্চায়িত হতো ৫০০ দর্শক ধারণক্ষম এ থিয়েটারে। প্যারিসের অপেরা গারনিয়ারের স্থাপত্যকলা অনুসরণ করে নির্মাণ করা হয় এ নাট্যশালা।
অপেরা হাউস দেখে চললাম মিউজিয়ামের উদ্দেশে। এটা যে সেই জাদুঘর নয়, ওয়ার রেমনেন্ট বা যুদ্ধের ধ্বংসাবশেষের মিউজিয়াম।
ভিয়েতনাম দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল ফ্রেঞ্চ কলোনিয়াল সময় পার হবার পর, উত্তর আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম। সালটা ১৯৫৫। উত্তর ভিয়েতনাম চায় কমিউনিস্ট শাসন বা সমাজতন্ত্র আর দক্ষিণ ভিয়েতনাম চায় এন্টি-কমিউনিস্ট বা সাধারণ শাসন পদ্ধতি। এই নিয়ে বিবাদ। উত্তর ভিয়েতনামকে সমর্থন দিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন ইত্যাদি কমিউনিস্ট দেশগুলো আর দক্ষিণ ভিয়েতনামের দল ভারী সেখানে আমেরিকা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড ইত্যাদি এন্টি-কমিউনিস্ট রাষ্ট্র। যুদ্ধ বাধল দুই ভাগ হওয়া ভিয়েতনামের ভেতর। একে বহির্বিশ্ব কোল্ড ওয়ার বা স্নায়ুযুদ্ধ নামেও অভিহিত করেছিল। আমেরিকা সৈন্য পাঠাল দক্ষিণ ভিয়েতনামকে সাহায্য করার জন্য। উত্তর ভিয়েতনামের জন্য এগিয়ে এলো সাধারণ জনগণ। তারা গঠন করল গেরিলা গ্রুপ ভিয়েত কং। কোনো ধরনের বাইরের সাহায্য ছাড়াই ভিয়েত কং নিজেদের যুদ্ধকৌশল আর দেশি অস্ত্র, বোমা ব্যবহার করে যুদ্ধে জয়ী হলো।
কিন্তু কুড়ি বছর ধরে চলতে থাকা একটা যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অপরিসীম। আমেরিকা শুধু যে বিভিন্ন রাসায়নিক স্প্রে করে মানুষ আর ফসলের ক্ষতি করেছে তা নয়; জনগণের শরীরে রেখে গেছে তার দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতিকর প্রভাব। আর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে সর্বত্র। রেমনেন্ট মিউজিয়ামে এই নৃশংসতার অল্প কিছু নিদর্শন মেলে।
জাদুঘরটির চত্বরে রাখা আছে যুদ্ধে ব্যবহৃত আমেরিকার অত্যাধুনিক হেলিকপ্টার, ফাইটার প্লেন, ট্যাংকার ইত্যাদি। আর এক পাশে ছোট কয়েকটি লম্বা নৌকা, ভিয়েত কং গেরিলাদের।
মিউজিয়াম ভবনের নিচতলায় যুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন নেতার ছবি আর চিঠিপত্র সাজানো আছে।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ব্যবহৃত বিভিন্ন অস্ত্র ও ছবি ডিসপ্লে করা আছে, সঙ্গে সেসবের বর্ণনা। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত, মৃত মানুষের সারি, উদ্বাস্তু মানুষদের আহাজারির ছবি দেখে মনে হচ্ছিল, এই ঘরগুলো যুদ্ধাহত আর ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য কাঁদছে। দর্শনার্থীরাও নিঃশব্দে দেখছেন, সবার মুখে বেদনা ভর করেছে।
চতুর্থ তলার ঘরগুলোতে ছবি সাজানো আছে এজেন্ট অরেঞ্জ স্প্রে করার ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের ছবি। এজেন্ট অরেঞ্জ অসম্ভব ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ যা যুদ্ধের সময় ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছিল ভিয়েতনামের আনাচে-কানাচে। যার ক্ষতি এখনো ভিয়েতনাম বহন করে চলছে। এজেন্ট অরেঞ্জ নামের এই রাসায়নিক পদার্থ, মানুষের মৃত্যু ঘটাতে পারে। শারীরিকভাবে পঙ্গু করে দেয় অক্ষমতা, সবচেয়ে ভয়াবহ হলো এই রাসায়নিক বিষে ক্ষতিগ্রস্তদের পরবর্তী প্রজন্ম বিকলাঙ্গ বা মানসিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নেয়। পাশের ঘরেই এ রকম দুজনকে দেখলাম, যাদের শরীর তিন বছর বয়সের পর বাড়েনি, হুইলচেয়ারে বসে আছে, কথা বলতে পারে তবে নড়াচড়া করতে কষ্ট হয়। কারণ, তাদের বাবা-মা এজেন্ট অরেঞ্জের শিকার।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বের হলাম মিউজিয়াম থেকে।
হো চি মিন সিটি ভ্রমণ শেষে শ্রদ্ধা জানাই সেই সব বীর যোদ্ধাকে, যারা নিজের জীবন বাজি রেখে কুড়ি বছর ধরে যুদ্ধ করে গেছেন এবং তাদের যারা এখনো যুদ্ধের ভয়াবহ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে উদ্ভূত শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগছেন।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top