skip to Main Content

ছুটিরঘন্টা I যেখানে যিশুর জন্ম

বেথলেহেম; যেখানে একদা যিশুর জন্ম। মা মেরি। বেথলেহেমের দ্য নেটিভিটি অ্যান্ড পিলগ্রিমেজ রুট চার্চ আবিশ্ব খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের মহাতীর্থ। যিশুর সূতিকাগারটি দেখার অপূর্ণতা থাকলেও ওই গির্জার চারপাশ আর অন্দরের অনেকটাই দেখার চমকপ্রদ অভিজ্ঞতা বড়দিন সামনে রেখে পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন পরিব্রাজক তানভীর অপু

চাররাস্তার মোড়! একেকটি রাস্তা আমাকে নিয়ে যাবে একেক দেশে। তা ভেবেই শিউরে উঠেছি। নিজের ভেতরে বোধ করেছি অপরিমেয় উত্তেজনা। অনেক স্বপ্নের জাল বোনা মিসরের মিথ আর পিরামিডকে পেছনে ফেলে এখন এক নতুনের উদ্দেশে যাত্রা করছি। এখন আমার গন্তব্য আপাতত ফিলিস্তিন।
মিসরের সীমান্ত শহর তাবা। সেখান থেকে প্যালেস্টাইনের বর্ডারের দিকে এগোবার সঙ্গে সঙ্গে মনের ভেতরটা কেমন যেন ভয়ে কাতর হয়ে যেতে লাগলো। নতুন দেশ বলে এমন লাগছিল নাকি নতুন গন্ধ, আর নিষিদ্ধ অক্সিজেন ভেতরে পোড়াচ্ছিল, সেটা বুঝতে না-বুঝতে পৌঁছে গেলাম বর্ডারে। তারপর তিন ঘণ্টার অপেক্ষা; কিছুক্ষণের প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে ঢুকে পড়া সীমান্তের ওপারে। মানে প্যালেস্টাইনে। ডানে লোহিত সাগর, আর সামনে উন্নত এক শহর। পেছনে রেখে আসা শহরের তুলনায় অনেক বেশি উন্নত। মানুষের আতিথেয়তাও তুলনারহিত।
আমাদের প্রথম গন্তব্য বেথলেহেম। দ্য নেটিভিটি অ্যান্ড পিলগ্রিমেজ রুট চার্চ। যেখানে যিশুর জন্ম। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৯ সালে এই গির্জার প্রতিষ্ঠা। যদিও এর অনেক পরে ষষ্ঠ দশকে অগ্নিকান্ডে ধ্বংস হওয়ার পর পুনঃসংস্কার করা হয়। তা সত্ত্বেও ইতিহাসের সব চিহ্ন বেঁচে আছে সগৌরবে। সে জন্যই এই গির্জা এখনো ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানদের কাছে প্রাণের চেয়েও প্রিয়। গির্জার কাছাকাছি যেতেই প্রথমে চোখে পড়ে মসজিদ। এটি মসজিদে ওমর নামে পরিচিত। পাশাপাশি চার্চ আর মসজিদ! এক জায়গায় যিশুর জন্ম আর ঠিক পাশেই আছে মসজিদ। এতে কারও কোনো সমস্যা বা আপত্তি নেই! যে যার মতো ধর্ম পালন করে চলছে।
আমরা পৌঁছে যাই গির্জায়। ভেতরে তখন অন্য রকম এক অনুভূতি। যেন এযাত্রায় এক নতুন অধ্যায় যোগ হচ্ছে আমার পরিব্রাজন জীবনে। সামনে কী আছে! মনে চাইছে এক দৌড়ে ভেতরে গিয়ে একনজরে সব দেখে ফেলি। আমার মন অনেক আগেই ভেতরে চলে গিয়েছে। গির্জার সামনে যেতেই ঢুকবার রাস্তাটা দেখে একটা সুড়ঙ্গ মনে হয়। এ দেশে খ্রিস্টানদের সংখ্যা খুব কম। চার্চে ঢুকবার আগে লাইনে দাঁড়াবার সময় কিন্তু তা মনে হচ্ছিল না। হাজারো মানুষের লাইন; আর ভেতরের কথা ভাবতেই মনে হচ্ছিল লাখো মানুষের বিশাল সমাবেশ- যেতে পারবো কি না, তা নিয়ে সংশয়ে ছিলাম। প্রবেশপথের কাছে যাওয়ার পর কয়েকটা সিঁড়ি ভেঙে নামলে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা জায়গা। মাথাটা বেশ নিচু করে ঢুকে গেলাম ভেতরে। এক অদ্ভুত শব্দ সেখানে অনুরণিত হতে লাগল। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আমার মনে নয়, বরং মানুষের সমবেত প্রার্থনার মধুর সুর ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে।
প্রথম আমার দৃষ্টি কাড়ে ক্রুশবিদ্ধ যিশু। দেয়াল আর ফটকের চারদিকে ইতিহাস বলা সব ছবি। মরিয়ম ধরে আছে শিশু যিশুকে, অথবা যিশু আর তার অনুসারীদের ছবি। সবাই যে যার মতো দেখছে, ছবি তুলছে। আমি অভিভূতের মতো দাঁড়িয়ে। দেখার চোখ না ফিরছে, না মন ফেরাতে দিচ্ছে। আলোকে সজ্জিত চারদিক। এটা মূলত একটা পাহাড়ের গুহা। পরে উপাসনালয়ে রূপান্তর করা হয়েছে।
চারদিকে মানুষ আর মানুষ; সবাই যে যার মতো প্রার্থনা করছে; অথবা সামনে যাবার জন্য লাইন ধরছে। আমিও এক লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম। সামনে কী দেখবো অপেক্ষা আর নতুন করে মুগ্ধ হবার জন্য প্রস্তুত হওয়া। এগিয়ে গেলে কিছু ভাস্কর্য চোখে পড়ে। ঘোড়ার উপরে আরোহিত এক সৈনিকের লড়াইয়ের রূপকদৃশ্য দেখে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই ভিড় আর মানুষের লাইন আমাকে দাঁড়াতে দেয় না। সামনে যেতেই এক বারান্দার মতো জায়গায় এসে পৌঁছাই। পাথরের তৈরি দেয়াল যেন প্রাচীনতার ছোঁয়া রেখে গেছে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে কল্পনা করে ফেলি, আমি কোনো সিনেমার দৃশ্যের মাঝে বাস করছি। বারান্দার এক পাশে খোলা আকাশ আর অন্য পাশে কামরায় প্রবেশের জন্য কাঠের দরজা। উপর থেকে শিকল দিয়ে ঝুলছে কিছু লন্ঠন। এই লন্ঠনগুলোতে এখন মোমবাতি জ্বালানো হয় না; বিজলি বাতিই জ্বলে। বাইরে অনেক উপরে একখানা ঘণ্টা ঝুলছে। দেখে ইচ্ছে করছিল যদি একটু ছুঁয়ে দিতে পারতাম! বারান্দা ধরে হাঁটা শুরু করি। সামনেই যিশুর ঘর। এগোতেই চোখে পড়ে ছোট একটা ঘণ্টা। মনে হলো আমার অন্তরের কথা বাতাসে উড়ে গিয়ে হাজির হয়েছে তার কাছে। ছুঁয়ে দেখলাম, তবে ছবি তোলা নিষেধ ছিল। মান্য করলাম।
এবার উদ্দেশ্য যিশুর ঘরে পৌঁছানো।

এক বিশাল হলরুমে হাজির হই। এখান দিয়েই যেতে হয় সে ঘরে। যেখানে মরিয়মের কোলে এসেছিলেন যিশু। হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ। কেউ এসেছে তাদের পবিত্র স্থানে, কেউবা উৎসাহের তোড়ে, কেউ আবার আমার মতোই ভবঘুরে। প্রবল উৎসাহে এগিয়ে যাই। এবারও একটা লাইনে দাঁড়াতে হবে। লাইনের কাছে গিয়ে দেখি যেখান থেকে লাইন শুরু বলে মনে হয়েছে, আসলে তা সেখানে নয়। হাঁটতে হাঁটতে আরও কিছুটা পেছনে গিয়ে দেখি লাইন অনেক দীর্ঘ। কতটা? জিজ্ঞাসা করে বসি একজনকে। তিনি জানান, তিন ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে এখানে এসে পৌঁছেছেন। যথাস্থানে পৌঁছতে আরও দুই ঘণ্টা লাগবে। এর আগে তিনি এখানে দুবার এসেছেন। এ কথা শুনে এবং লোকটার ভক্তি দেখে অবাক হলেও, বেশ হতাশ হয়ে পড়ি। আমার হাতে যে সময় খুব কম। কিছু করবার ছিল না। আমাকে ফিরতে হবে।
বেরিয়ে আসি গির্জা থেকে। তবে ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। জানি, ভেতরে অনেক কিছু যে আছে, সে সম্পর্কে যেকোনো সময়ে জেনে নিতে পারবো। কিন্তু আমি সে মানুষ নই। যে জানা আমার মনকে শান্ত করে না, যে জানাতে চোখের শান্তি নেই, তাতে আমার আগ্রহ নেই। সে জন্যই তো বারবার ফিরে আসতে হয়। দূর করতে হয় অপূর্ণতা।

অনুলিখন: আহমেদ মুহতাসিম মিশাল
ছবি: লেখক

This Post Has One Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top