skip to Main Content

টেকট্রেন্ড I বাতাসে ফোর-জি!

ফোর-জি। দেশের টেলিকমিউনিকেশনে নতুন মাত্রা। তবে এখনো এটি রয়েছে চমক আর বাস্তবতার মধ্যবর্তী দোদুল্যমানতায়। নতুন এই সেবার নানা দিক নিয়ে লিখেছেন তৌহিদুল ইসলাম তুষার

বাতাসে ভাসছে চতুর্থ প্রজন্মের নেটওয়ার্ক ফোর-জি। কেউ কেউ আবার তা বাড়িয়ে সাড়ে চারও (ফোরপয়েন্টফাইভ) বলছেন। প্রযুক্তির বিবর্তনের এই যুগে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। টু-জি থেকে থ্রি-জি, থ্রি-জিকে ছাড়িয়ে এখন পা দিয়েছে ফোর-জি যুগে। অর্থাৎ সেলুলার টেলিকমিউনিকেশন বা দূরভাষ্য যোগাযোগপ্রযুক্তির চতুর্থ প্রজন্ম। কিন্তু ফোর-জি আমাদের কতটা দরকার বা চাহিদা পূরণে কতটুকু সক্ষম হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
সাধারণ মানুষের কাছে এর কার্যকারিতা এখনো অস্পষ্ট। যার প্রধান একটি কারণ থ্রি-জির ব্যর্থতা। দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখনো থ্রি-জির আওতায় আসেনি, সেখানে ফোর-জি! ৩০ শতাংশের যারা এই সুবিধা ভোগ করছেন, তাদের মধ্যেও রয়েছে ক্ষোভ। অপরিকল্পিত ইন্টারনেট ব্যবস্থা নিয়ে অবশ্য কম-বেশি সবাই অসন্তুষ্ট। যা হোক, এত সবের মাঝেও নতুন সম্ভাবনার কথা হলো, দেশে চালু হয়েছে ফোর-জি। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি গ্রামীণফোন, রবি, বাংলালিংক ও টেলিটককে দেয়া হয় ফোর-জির লাইসেন্স। অন্যদিকে রবি ও এয়ারটেল একীভূত হওয়ায় ফোর-জি সুবিধা পাচ্ছেন এয়ারটেল গ্রাহকেরাও। মোবাইল ফোন অপারেটর গ্রামীণফোন, রবি ও বাংলালিংক গ্রাহকদের জন্য লাইসেন্স পাওয়ার খুব কম সময়ের মধ্যে চালুও করেছে নতুন এই প্রযুক্তি। তবে টেলিটক ফোর-জির কার্যক্রম আপাতত স্থগিত রেখেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো জানিয়েছে, ফোর-জি আমাদের জীবনযাত্রার মান বাড়িয়ে দেবে বহুগুণে। থ্রি-জিতে যে ফাইলটি ডাউনলোড হতে সময় লেগেছে ২০ মিনিট, সেটা এখন হয়ে যাবে মিনিট পাঁচেকে। অনলাইনে মুভি দেখতেও আর থাকছে না বাফারিংয়ের বিরক্তিকর ঘূর্ণি। তবে ফোর-জি সেবা গ্রাহকদের কাছে এখনো সোনার হরিণ। এর কার্যকারিতা নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। যেখানে থ্রি-জি পেতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে ফোর-জি! সাধারণ গ্রাহকেরা থ্রি-জি সেবায় যথেষ্ট বিরক্ত। রাজধানীর অনেক জায়গাতেই থ্রি-জি নেটওয়ার্ক মেলে না ঠিকমতো। অনেক সময় তা নেমে আসে টু-জিতে। তাহলে ফোর-জি দিয়ে কী হবে? যদি নেটওয়ার্কই না পাওয়া যায়, তাহলে থ্রি-জি বা ফোর-জিতে কিছু আসে যায় কি? বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন খোদ টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারও। তিনি এরই মধ্যে অপারেটরদের হুঁশিয়ার করেছেন। ফোর-জি সেবায় কোনো ধরনের অজুহাত মানা হবে না। কারণ, পর্যাপ্ত স্পেকট্রাম অবিক্রীত থাকার পরও অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো তা কেনেনি। পাশাপাশি টেক নিউট্রালিটি দেয়া হয়েছে। এখন তারা স্পেকট্রাম ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারবে। অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, থ্রি-জিতে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ফোর-জিতে তা থাকবে না। ফলে গ্রাহক উন্নত সেবা পাবেন। মোবাইল অপারেটর রবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মাহতাব উদ্দিন আহমেদ জানান, দেশের থ্রি-জি প্রযুক্তির আরেকটি বড় বাধা ছিল স্পেকট্রাম। এই সেবা প্রযুক্তি স্পেকট্রামের ২১০০ ব্যান্ডে দেয়া হয়েছিল। তার বড় দুর্বলতা হলো, পাশাপাশি উঁচু ভবন থাকলে বেজ স্টেশন বা টাওয়ারের মাঝে একধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে যায়। তাই নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায় না। ফলে শহরের বড় বড় ভবনের অলিগলিতে নেটওয়ার্কও ভালো মিলতো না। ফোর-জিতে এখানেই বড় অগ্রগতি হবে। কারণ, অপারেটর কোম্পানিগুলো যেকোনো ব্যান্ডেই ফোর-জি সেবা দিতে পারবে। ফলে ভালো নেটওয়ার্কের বড় অগ্রগতি হবে এর মাধ্যমে। এবার প্রযুক্তি নিরপেক্ষতা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যেকোনো ব্যান্ডের স্পেকট্রাম দিয়েই সেবা দেয়ার সুযোগ মিলেছে। বাংলাদেশে এত দিন তা ছিল না। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি স্পেকট্রাম নিলামের সময় থেকে এটি উন্মুক্ত করা হয়েছে। ফলে অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলো হাতে থাকা স্পেকট্রাম দিয়ে ইচ্ছেমতো নেটওয়ার্কের ডিজাইন করতে পারবে। আর টেকনোলজিক্যাল নিউট্রালিটি এমনিতেই স্পেকট্রামের কার্যক্ষমতা দেড় থেকে দুই গুণ বাড়িয়ে দেয়। ফোর-জি সেবা চালু হলেও সবার হাতে পৌঁছায়নি নতুন প্রযুক্তি। তাই ব্যবহারকারীদের ফোর-জি সমর্থিত স্মার্টফোন থাকলেও নেটওয়ার্ক কাভারেজ নেই। আবার নেটওয়ার্ক থাকলেও স্মার্টফোন ফোর-জি সাপোর্ট করছে না। এলিট গ্রাহকের আইফোনেও মিলছে না ফোর-জি। সিম ফোর-জি হলেও অনেকের হ্যান্ডসেট ফোর-জি নয়। আবার হ্যান্ডসেট ফোর-জি হলে সিম থ্রি-জি বা আরও আগের। ফলে জটিলতা থেকেই যাচ্ছে। আবার সরকারি টেলিকম অপারেটর টেলিটকে আসেনি ফোর-জি। সে জন্য কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, তা অনিশ্চিত। ফলে বেশির ভাগ গ্রাহকই এই সেবার বাইরে রয়ে গেছেন। যদিও মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিগুলো বলছে, পর্যায়ক্রমে সারা দেশের মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের ফোর-জির আওতায় আনা হবে।
অপারেটরের অবস্থা
মোবাইল ফোন অপারেটর রবি ৬৪ জেলায় ফোর-জি সেবা চালু করেছে। রবির দাবি, এটা ফোর-জি নয়, ৪.৫জি। অন্য অপারেটরগুলোর চেয়ে তাদের গতি বেশি ও ভালো মানের। গ্রামীণফোনের ডেপুটি সিইও ইয়াসির আজমান জানিয়েছেন, বিভাগীয় শহরগুলোতে ফোর-জি চালু হয়েছে। কিন্তু এখনই এটি শতভাগ কাভার করছে না। তিনি বলেন, ‘আমরা একটা পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ডিভিশনাল শহরগুলোতে নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করতে যে সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে, তার আগেই আমরা শতভাগ নেটওয়ার্ক কাভারেজের আওতায় নিয়ে আসবো।’ বাংলালিংক জানিয়েছে, ফোর-জি নেটওয়ার্ক দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের গ্রাহকদের উচ্চমানের বাফার-ফ্রি ভিডিও স্ট্রিমিং, ভিডিও কলিং, হাই ফিডেলিটি মিউজিক স্ট্রিমিং, অনলাইন গেম, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংসহ সব ধরনের ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করবে। আর্থসামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ফোর-জি স্বাস্থ্যসেবা, ভিডিওর মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ, যোগাযোগব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক সেবার মান বৃদ্ধিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী গোলাম কুদ্দুস জানিয়েছেন, খুব শিগগির ফোর-জি সেবা নিয়ে আসবে টেলিটক। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছে ফোর-জি পৌঁছে দেয়া হবে। তবে কবে নাগাদ তা চালু হবে, সেই দিনক্ষণ তিনি বলতে পারেননি। তিনি বলেন, আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। বিটিআরসির নির্দেশনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে দেশের বিভাগীয় শহরগুলোতে ফোর-জি সেবা চালুর জন্য ৯ মাস সময় পাবে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো। সারা দেশে বিস্তৃতির জন্য তিন বছর সময় দেয়া হয়েছে।
ফোর-জি পেতে তিনটি তথ্য
দেশে ফোর-জি সেবা চালু হলেও মোবাইল ফোন গ্রাহকদের সবাই এটি ব্যবহার করতে পারবেন না। এর জন্য তাদের তিনটি বিষয়ে ধারণা থাকতে হবে। তা হলো, সিম ও মোবাইল হ্যান্ডসেট ফোর-জি কি না এবং ব্যবহারকারী যে এলাকায় থাকেন সেই এলাকা ফোর-জির আওতায় এসেছে কি না। কোম্পানিগুলো বলছে, এলাকা ফোর-জি কাভারেজের মধ্যে না এলে অপেক্ষা করতে হবে। গ্রাহকের সিম ফোর-জি কি না, সেটি বিনা মূল্যে জানা যাবে। এর জন্য গ্রামীণফোন ব্যবহারকারীদের ডায়াল করতে হবে *১২১*৩২৩২# নম্বর। তাহলে কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রাহককে একটি টেক্সট মেসেজের মাধ্যমে জানিয়ে দেবে সিমটি ফোর-জি কি না। রবির গ্রাহকদের ডায়াল করতে হবে *১২৩*৪৪#। তবে বাংলালিংকের গ্রাহকদের ফোর-জি লিখে ৫০০০ নম্বরে পাঠাতে হবে। ফিরতি বার্তায় ফোর-জি সিমের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যাবে। যদি সিমটি ফোর-জি না হয়, তাহলে তা সংশ্লিষ্ট মোবাইল ফোন অপারেটরের গ্রাহকসেবা কেন্দ্র থেকে পরিবর্তন করে নিতে হবে। এই কাজে জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি, ছবি ও আঙুলের ছাপ দিতে হবে। অন্যদিকে হ্যান্ডসেটটি ফোর-জি উপযোগী কি না, সেটি জানা ব্যবহারকারীর পক্ষে সম্ভব। এ জন্য স্মার্টফোনের ‘সেটিংস’ অপশনে যেতে হবে। সেখানে নেটওয়ার্ক অথবা ‘ওয়্যারলেস অ্যান্ড নেটওয়ার্কস’-এ গেলে দেখা যাবে ফোনটি ফোর-জি প্রযুক্তির কি না। এ ছাড়া মোবাইল ফোন অপারেটরের সেবাকেন্দ্র ও বিভিন্ন স্মার্টফোন ব্র্যান্ডের বিক্রয়কেন্দ্র থেকেও জানা যাবে। তবে দেশের আইফোন ব্যবহারকারীরা ফোর-জি ব্যবহার করতে পারবেন না। আইফোনে ফোর-জি বা এলটিই সেবা লক থাকায় তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আইফোনে ফোর-জি ব্যবহার করা গেলে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা এক লাফে কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।
ফোর-জি প্রযুক্তির সুবিধা
ফোর-জি বা চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তির প্রধান একটি সুবিধা হলো উচ্চগতির ইন্টারনেট। একটি আদর্শ ফোর-জি নেটওয়ার্কে ইন্টারনেটের গতি থ্রি-জি ইন্টারনেট অপেক্ষা পাঁচ থেকে সাত গুণ দ্রুত। এতে প্রতি সেকেন্ডে ১.৫ গিগাবাইটের বেশি গতি পাওয়া সম্ভব। তবে বাস্তবে এই নেটওয়ার্কে প্রতি সেকেন্ডে ৩০০ মেগাবাইট গতি পাওয়া সম্ভব হয়েছে। আগে থ্রি-জি ইন্টারনেট চালু করতে ডেটা কানেকশন এনাবল বাটনে চাপ দিয়ে ২ থেকে ৩ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হতো। কিন্তু ফোর-জি ইন্টারনেটে তা হবে বাটনে চাপার সঙ্গে সঙ্গেই। থ্রি-জি ইন্টারনেটে যেখানে ল্যাটেন্সি ছিল ১২০ মিলিসেকেন্ড, সেখানে ফোর-জি ইন্টারনেটে কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬০ মিলিসেকেন্ডে। ফলে লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং কিংবা অনলাইন গেমিং হবে আরও সহজ। ফোর-জি নেটওয়ার্কের চমকপ্রদ একটি সুবিধা হলো ‘ভয়েস ওভার এলটিই’। স্কাইপি, ফেসবুক কিংবা হোয়াটসঅ্যাপে আমরা ভয়েস বা ভিডিও কল করি ‘ভিওআইপি’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ফোর-জিতেও বলতে গেলে একই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে। ফলে এই নেটওয়ার্কে পরিষ্কার ও হাই কোয়ালিটির ভয়েস বা ভিডিও কল করা যাবে। এ ছাড়া কমে আসবে ভয়েস কলের খরচও। পৃথিবীর বহু দেশে এই প্রযুক্তি চালু রয়েছে। তবে বাংলাদেশে ফোর-জি নেটওয়ার্ক এলেও ‘ভয়েস ওভার এলটিই’ প্রযুক্তিটি এখনো চালু হয়নি। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশেও এটি চালু হবে।
ফোর-জি প্রযুক্তির অসুবিধা
এত সুবিধা থাকার পরও রয়েছে কিছু অসুবিধা। যেমন, ফোর-জি ইন্টারনেটের গতি অতি দ্রুত হওয়ায় ইন্টারনেট ব্যান্ডউইটথও দ্রুত শেষ হবে। আগে ১জিবি ইন্টারনেট এক সপ্তাহ ব্যবহার করা যেত, ফোর-জি নেটওয়ার্কে সেটি ৩ থেকে ৪ দিনেই শেষ হয়ে যাবে। অন্যদিকে, দ্রুত ডেটা ব্যবহৃত হওয়ার ফলে ফোনের ব্যাটারিও অনেক দ্রুত শেষ হবে। ফলে ফোনের চার্জ কিছুটা আগেই শেষ হতে পারে ফোর-জি নেটওয়ার্কে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top