skip to Main Content

টেকট্রেন্ড I ভার্চ্যুয়াল জীবন

এ এক আশ্চর্য জগৎ। সেখানকার গল্পগুলো অবিশ্বাস্য। এরই বাসিন্দা হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রোমাঞ্চকর
মৃত্যু প্রায় নিশ্চিত জেনেও বিশাল এক যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে ওয়েড ছুটে চলেছে তার যান্ত্রিক বাহনে। কোনো এক ফাঁকে, তার পাশে থাকা বৈদ্যুতিক বন্দুকটি সে হাতে নিয়ে বাহনের জানালা খুলে বের করলো। অনবরত আক্রমণ করে চললো তার সামনে চলে আসা দানবকে। এমনই একটি দৃশ্যের চিত্রায়ণ ঘটেছে সম্প্রতি মুক্তি পেতে যাওয়া ‘প্লেয়ার ১’ ছায়াছবিতে। এতে দেখানো হয় ভার্চ্যুয়াল জগতে ওয়েড নামের চরিত্রের নিজেকে খুঁজে ফেরার সংগ্রাম। কেমন হতো, যদি ছায়াছবির এই দৃশ্যের মতোই কাউকে এমন একটি সুযোগ করে দেয়া হতো! যেখানে শুধু একটি ছবির দৃশ্য দেখবে অথবা শব্দই শুনবে না, বরং নিজের ভেতরে জমে থাকা ইচ্ছেগুলো পূরণের সুযোগ পাবে। এমনকি, চারদিকের পৃথিবীর সঙ্গে তার অনুভূতিগুলো ভাগ করে নিতে পারবে। গল্পটা যে শুধু সে নিজের করে নেবে তা-ই নয়, এই গল্পের মূল চরিত্র হিসেবেও থাকবে। হ্যাঁ, এত দিন শুধু ভাবা হতো যে টেলিভিশনের পর্দাতেই বুঝি এমন দৃশ্যের বাস্তবায়ন সম্ভব। কিন্তু আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বদৌলতে এমন গল্পের মধ্যে প্রবেশ করা সবার জন্যই সম্ভব হয়ে উঠেছে। সাম্প্রতিককালে, ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির ‘রোলার কোস্টার’ রাইড জনপ্রিয় হলেও এর জন্ম সেই ১৯৫৮-এর দশকে মুক্তি পাওয়া ‘থিয়েটার অ্যান্ড ইটস ডাবল’ বইয়ে, যেখানে প্রথম এমন একটি জগতের কথা উল্লেখ করা হয়, যা বাস্তবের সমতুল্য। এরপর ১৯৯৪ সালে প্রথম ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি নিয়ে কাজ শুরু হয়। মূল নামকরণ ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি হলেও সবার কাছে তা ‘ভিআর’ বলেই পরিচিত। তখন এর নানা রকম সীমাবদ্ধতা ছিল। এখন বিশ্বাসযোগ্যতার সীমারেখাকেও এটি অতিক্রম করেছে।
ভিআর একজন ব্যবহারকারীকে ত্রিমাত্রিক অবাস্তব জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। তা ব্যবহারকারীর সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়, যাতে নতুন জগতের সঙ্গে সে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এতে অনেক সময় নানা বয়সের মানুষকে হেডসেট পরা অবস্থায় একটি স্ক্রিনের সামনে হাত-পা ছুড়তে দেখা যায়। সাধারণত ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির জগতে প্রবেশ করতে বিশেষ হেডসেট ব্যবহৃত হয়, যার মাধ্যমে শুধু সেই ব্যবহারকারীই তার চারপাশের জগৎকে উপভোগ করতে পারে। এটি দেখতে হেলমেটের মতো, যার সঙ্গে সংযুক্ত করা থাকে এক জোড়া পুরু চশমাবিশেষ এবং লেন্সসংবলিত স্ক্রিন। এ ছাড়া ব্যবহারকারী সাহায্য নিতে পারে বিশেষ ধরনের গ্লাভসের, যার মাধ্যমে ভিআরের জগতের কোনো বস্তুকে অনুভব করা সম্ভব। অথবা সাহায্য নিতে পারে অমনি-ডিরেকশনাল ট্রেডমিলের, যা থেকে ব্যবহারকারী বিচরণ করতে পারে ভিআর জগতে। এবং তা করা সম্ভব শুধু একটি স্থানেই হাঁটা অথবা দৌড়ানোর মাধ্যমে। অবস্থান ও শারীরিক পরিবর্তনের দিকে লক্ষ রেখে ভিআর তার চারপাশের জগৎকে প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকে, যা একজন ব্যবহারকারীকে বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা এনে দেয়।
কেন এই ভিআরের প্রয়োজন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে? উত্তর, বিনোদন। কিন্তু এর ব্যবহারের কারণ দিন দিন বেড়েই চলেছে। শুরুতে শুধু গেমিং অথবা ছায়াছবি দেখাতেই এর সীমাবদ্ধতা থাকলেও এখন ভবনের নকশা তৈরির কাজ থেকে শুরু করে চিকিৎসা-সংক্রান্ত জটিল কাজগুলোতেও এর ব্যবহার হচ্ছে। যখন কোনো বিপজ্জনক, ব্যয়বহুল অথবা অবাস্তব কাজের কথা ভাবা হয়, ভিআরকেই তার প্রধান সমাধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন ধরা যাক, একজন নব্য বিমানচালকের শুরুটা হতে পারে ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে, যা থেকে তাকে বিমান চালনার অভিজ্ঞতা প্রাথমিকভাবে দেয়া সম্ভব। অথবা ধরা যাক একজন শল্যচিকিৎসকের কথা, যার অস্ত্রোপচারের প্রশিক্ষণটা শুরু হতে পারে এর মাধ্যমে। ভিআরের সাহায্যে বিপজ্জনক সব কাজ সহজেই করা যায় কোনো বড় ধরনের ঝুঁকির আশ্রয় না নিয়ে। আর সময় যতই এগোচ্ছে, ভিআরের ক্রয়মূল্য কমতে থাকায় সবার মাঝে এর সহজলভ্যতা আরও অনেক সম্ভাবনার আশা জাগাচ্ছে।
এবার একটু জেনে নিতে পারি ভিআর ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো সম্পর্কে। প্রধান উপাদান হিসেবে প্রয়োজন একটি ভিআর হেডসেট, যা দিয়ে আমরা ভিআরের জগৎকে দেখতে পারবো। কিন্তু এতে প্রাণশক্তি দেয়ার জন্য দরকার একটি শক্তিশালী কম্পিউটার। যেসব বিষয়বস্তু একজন ব্যবহারকারীর সামনে ভিআরের মাধ্যমে উপস্থিত করানো হয়, সেগুলোর আবির্ভাব ঘটে কোনো স্মার্টফোন অথবা কম্পিউটারের শক্তি থেকেই। এ ক্ষেত্রে ভিআরের চিত্রের স্পষ্টতা নির্ভর করে কম্পিউটারের গ্রাফিকস কার্ডের ওপর। তা ছাড়া ব্যবহারকারীকে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একটি অনুভূতি দিতে সংযোজন করা যেতে পারে বাড়তি জয়স্টিক, ট্র্যাকিং-বল, অন-ডিভাইস বাটন ইত্যাদি।
এই অসম্ভব আবিষ্কার কীভাবে কাজ করে? প্রধানত মাথায় পরিহিত হেডসেটের মাঝে সংযুক্ত একগুচ্ছ সেন্সর, যেগুলোর একেকটির কাজ একেক জটিলতার সমাধান করা। এসবের মধ্যে তিনটি অপরিহার্য সেন্সর হলো ম্যাগনেটোমিটার, অ্যাক্সেলেরোমিটার ও জায়রোস্কোপ। ম্যাগনেটোমিটার পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠের চৌম্বক ক্ষেত্রের পরিমাপের মাধ্যমে ভিআরকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে, অনেকটা কম্পাসের মতো। পরিস্থিতি নির্ণয় করতে ব্যবহৃত হয় অ্যাক্সেলেরোমিটারের, যা থেকে ভিআর মহাকর্ষীয় বলের আকর্ষণ বুঝতে পারে। এবং জায়রোস্কোপ সাহায্য করে ব্যবহারকারীকে ভিআরের সঙ্গে সমতা ধরে রাখতে। এ ছাড়া হেডসেটে শক্তিশালী লেন্স ব্যবহৃত হয়, যেটি ভিআরের ছবিকে কেন্দ্রীভূত অথবা পুনর্নির্মাণে সহযোগিতা করে। লেন্সের আগে অবস্থিত ডিসপ্লে স্ক্রিনে ব্যবহারকারীর সামনে চিত্র প্রদর্শন করা হয়। মূলত তা করা হয় ওয়্যারলেস স্মার্টফোনে অথবা এইচডিএমআই ক্যাবলের সঙ্গে সংযোজনের মাধ্যমে। ভিআরের চিত্র প্রকাশের ব্যাপারটা বেশ জটিল হলেও এর শব্দ উৎপাদন এতটা জটিল নয়। সাধারণত তা পৌঁছে দেয়া হয় দুই কানের দুই পাশে থাকা দুটি স্পিকারের মাধ্যমে।
ভিআরের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলছে। যেমন গবেষকেরা কাজ করে চলেছেন, কী করে ভিআরের মাধ্যমে কোনো অবাস্তব বস্তুর স্বাদ অথবা ঘ্রাণ দেয়া যায়। এমনকি আই-ট্র্যাকিং প্রযুক্তির মাধ্যমে ব্যবহারকারীর চোখের ইশারাতেই ভিআর বুঝে নেবে পরের পদক্ষেপ কী হতে চলেছে, যা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবস্থাতেই রয়েছে। এ ছাড়া আমরা বিশেষ ক্যামেরা ও সফটওয়্যার ব্যবহার করে ভিআরের জগৎকে নিজে থেকেই তৈরি করতে পারি, যদিও তা এখনো তা নাগালের বাইরে, ব্যয়বহুল হওয়ার কারণে। এটা নিশ্চিত, ভিআরের মাধ্যমে আমরা এমন এক বিস্ময়কর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে বিশ্বজয়ের গল্পগুলোর অংশ হয়ে উঠবে যে কেউ, চার দেয়ালের মাঝেই।

 আবু আল মাহাদি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top