skip to Main Content

টেকসইি I অরণ্যের আর্তি

বিশ্ব পরিবেশ ও প্রকৃতির জন্য মার্চ বেশ গুরুত্বপূর্ণ মাস। বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস পালন করা হয় এ মাসে। এর বেশির ভাগই বন, বন্য প্রাণীর সঙ্গে জড়িত। স্বাধীনতার ৫০ বছর পার করে, কেমন আছে বাংলার প্রাণপ্রকৃতি—চলুন, একটু নজর বোলানো যাক। লিখেছেন আল মারুফ রাসেল

৩ মার্চ তারিখ বিশ্ব বন্য প্রাণী দিবস। ২১ মার্চ বিশ্ব বন দিবস। এর মাঝে ১৪ তারিখ আন্তর্জাতিক নদী রক্ষা দিবস। ২০ তারিখে বিশ্ব চড়ুই দিবস, বিশ্ব ব্যাঙ দিবস আর বিশ্ব পুনর্বন্যকরণ দিবস, অর্থাৎ যে প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাকে আবারও প্রকৃতিতে ফিরিয়ে দেওয়ার দিন। অন্যদিকে, ২৩ মার্চ বিশ্ব ভালুক দিবস। বিশ্ব পুনর্বন্যকরণ দিবসটা ছাড়া বাকিগুলো আমাদের দেশে বেশ ঘটা করেই পালিত হয় পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
আমাদের বন ভালো নেই। বলা বাহুল্য, অরণ্য ভালো না থাকলে তার অধিবাসীরাও ভালো থাকে না। বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় থেকে বর্তমানে ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে এই ভূখণ্ডের বন্য প্রাণীর অবস্থা এবং ৫০ বছর পরে কী দাঁড়াবে—তা নিয়ে কথা বলেছিলেন এক আড্ডায়। তিনি জানান, ঢাকার আশপাশেও বন ছিল। তার ছেলেবেলায়, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর-টাঙ্গাইলের লাল মাটির জঙ্গল, এসব এলাকার পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী ৫০ বছর আগে বেশ ভালো ছিল।
বন্য প্রাণী ছিল আমাদের সহ-বাসিন্দা, প্রতিবেশী। বাংলাদেশের গ্রামেও এখন জোনাকি বিরল হয়ে উঠেছে। অথচ গ্রামীণ ঝোপঝাড়, বাড়ির পেছনের জংলা হয়ে থাকা জায়গায় সন্ধ্যা নেমে এলেই খেঁকশিয়াল আর পাতিশিয়ালের হাঁকডাক শুরু হতো। ছিল বনবিড়াল, বাগডাশ। মেছো বিড়াল পুকুরের পাড়ে এসে হানা দিত রাতে।
আটের দশক পর্যন্ত ঢাকার আশপাশেই গড় এলাকায় শোনা যেত চিতা বাঘের উৎপাতের কথা। পাঁচের দশকে ঢাকার মিরপুরে এনায়েত মাওলা শিকার করেছিলেন একটা চিতা বাঘ। এখন তো চিতা বাঘ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকা ছাড়া নেই বললেই চলে। বাঘও ছিল দেশজুড়ে। এখন নেই। এই যে হুট করে নাই হয়ে গেল, এর কারণ কী? ইতিহাস বলে, রাজশাহী এলাকায় ঘুরে বেড়াত হায়েনা। ছিল তিন প্রজাতির গণ্ডারও। গত ১০০ বছরে এখনকার বাংলাদেশ বলে যে এলাকাটাকে জানি, সেখান থেকে হারিয়ে গেছে ৩১ প্রজাতির প্রাণী।
গল্প থাক। ২০১৬ সালে শেষবারের মতো লাল তালিকা প্রস্তুত করেছিল আইইউসিএন। এই হিসাব বলছে, ৩৯০ প্রজাতির বন্য প্রাণী কোনো না কোনোভাবে বিপন্ন। তবে ১৪টি নতুন প্রাণীও যুক্ত হয়েছে, যা আগে বাংলাদেশে দেখার তথ্য নেই। তালিকা থেকে জানা যায়, আগের ১৫ বছরে পাখি প্রজাতি সবচেয়ে বেশি বিলুপ্ত হয়েছে। প্রায় ৭০০ প্রজাতির পাখির মধ্যে ১৯টি গত ১০০ বছরে হারিয়ে গেছে। এই হারিয়ে যাওয়ার দৌড়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে স্তন্যপায়ীরা। ১১ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী হারিয়েছে এই শতবর্ষে। আর সরীসৃপ হারিয়েছে একটি প্রজাতি।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ভেতরে হারিয়ে গেছে ডোরাকাটা হায়েনা, ধূসর নেকড়ে, নীলগাই, বান্টিং, বনমহিষ, সুমাত্রা গণ্ডার, জাভা গণ্ডার, ভারতীয় গণ্ডার, বারোশিঙা হরিণ, কৃষ্ণসার, মন্থর হরিণ। এই ১৩টি প্রাণী গত শতাব্দীতেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বলা হয়, স্বাধীনতার পরে দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে মন্থর ভালুক।
মহাবিপন্ন প্রাণীদের তালিকায় আছে বেঙ্গল টাইগার, হাতি, ভোঁদড়, লামচিতা, চিতা বাঘ, বনরুই, উল্লুক, চশমা হনুমান, বনগরু, সাম্বার হরিণ, প্যারাইল্লা বানর, হিমালয়ী ডোরা কাঠবিড়ালি ও কালো ভালুক। বিলুপ্ত হওয়া কিংবা মহাবিপন্ন হয়ে ওঠার কারণ বনাঞ্চল ধ্বংস হয়ে ওদের বাসস্থান হারিয়ে যাওয়া।
লালমুখ দাগিটানা পাখিটা ছিল সিলেটের। সেখানকার পাহাড়ি বাঁশঝাড় শেষ হয়ে যাওয়ায় এই পাখিও বাংলাদেশ থেকে শেষ হয়ে গেছে। এ দেশ থেকে হারিয়ে গেছে সারস পাখিও, শিকারিদের উৎপাতে। এই তালিকায় আরও আছে ধূসর মেটে তিতির, বাদা তিতির, বাদি হাঁস, গোলাপি হাঁস, বড় হাড়গিলা, ধলাপেট বক, সাদা-ফোঁটা গগনবেড়, রাজ শকুন, দাগি-বুক টিয়াঠুঁটি, লালমাথা টিয়াঠুঁটি, গাছ আঁচড়া, সবুজ ময়ূরের মতো পাখিগুলো।
উভচর প্রাণীর মধ্যে বিপন্ন হয়ে উঠেছে চিত্রিত ব্যাঙ, ঝরনা সুন্দরী ব্যাঙ, বেলুন ব্যাঙ, চ্যাপ্টা-মাথা ব্যাঙ, বড় গেছো ব্যাঙ। জলাশয়, নদীর পাড় ধ্বংস, দূষণে বাসস্থান হুমকির মুখে পড়ায় উভচরেরাও ভালো নেই।
সুন্দরবনের অনেক গাছ লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে ও পর্যটকদের উৎপাতে হুমকির মুখে এখন। আর তাই এসব গাছের ওপর নির্ভরশীল প্রতিটি পশু, পাখি, কীট—বিশেষত প্রজাপতি হুমকির মুখে পড়েছে। এর মধ্যে অন্যতম সুন্দরবন ক্রো।
এ তো গেল জঙ্গলের কথা। মোবাইল টাওয়ারের তেজস্ক্রিয়তা, বিশ্রাম ও খাবারের জন্য পর্যাপ্ত গাছের অভাব, মানুষের সঙ্গে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পাখিগুলোর জন্য আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টে ভেন্টিলেটরের অভাব—সব মিলিয়ে ভালো নেই চড়–ইয়ের মতো পাখিরাও। সঙ্গে যোগ করা যেতে পারে শালিক, বুলবুলি, দোয়েল প্রভৃতির নাম। বানরেরা গাছের বদলে ইলেকট্রিক তারে তাদের কসরত দেখায়। সন্ধ্যা হলেই চিলের দল আশ্রয় নেয় বড় গাছে; আর তা না পেলে মোবাইলের টাওয়ারে। ঢাকা শহরে আরবান ওয়াইল্ডলাইফ বলতে রমনা আর মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে আশ্রয় নেয় গুটিকয় পশুপাখি।
করোনার আপদকালে বিপদ আরও বেড়েছে। সুন্দরবনে বিষটোপ দিয়ে মাছ ধরা বেড়েছে। দেশের উত্তর-পশ্চিম আর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হাতি হত্যা বেড়ে গেছে মারাত্মক হারে। মার্চ ২০২০ থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত বন বিভাগের তথ্য বলছে, ১৪ মাসে ৩টি বাঘ এবং ১২টি হাতি হত্যা করা হয়েছে; ২ লাখ ৫৭ হাজার একর বনভূমি হয়ে গেছে বেদখল। তবে গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে হাতি হত্যার প্রবণতা হুট করেই বেড়ে যায়। দুই সপ্তাহে সাতটি হাতি হত্যা করা হয়েছিল। পরে হিসাব করে দেখা যায়, ২০২০-২১ মিলিয়ে মোট ৩৮টি হাতির মৃত্যুর খবর ‘নথিভুক্ত’ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে সব সময় প্রকৃতি ও উন্নয়ন মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে; হাত ধরে চলেনি, বা চলার চেষ্টাও করেনি। এ ছাড়া জনসংখ্যার চাপের কারণে নিয়ত হারাতে হচ্ছে বনভূমি। এগুলো কখনো পরিণত হচ্ছে কলকারখানায়, লোকালয়ে; কখনো চাষের জমিতে বা শরণার্থীশিবিরে। তবে অনেক হতাশার ভেতরে আশার আলোও আছে। শকুন ফিরিয়ে এনে পরিবেশের ভারসাম্য ফেরানোর কাজ চলছে। নানা প্রজাতির কচ্ছপ, স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়েও চলছে এ ধরনের কাজ। আর এতে নেতৃত্বে আছে তরুণেরা। তবে যে দ্রুততার সঙ্গে বনভূমি, জলাশয়, প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে, সেই তুলনায় তাদের গতি হয়তো একটু মন্থর। তারপরও আশা করতে দোষ কী?

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top