skip to Main Content

পাতে পরিমিতি I নতুন মায়ের আহার

সদ্য সন্তান প্রসব করা মায়ের খাদ্যতালিকা নিয়ে আছে নানা সংস্কার, কুসংস্কার। কোন খাবার জরুরি আর কোনটা নয়, জানাচ্ছেন নিশাত শারমিন নিশি

কথায় আছে, সন্তান হলো নাড়িছেঁড়া ধন। সত্যিই তাই। সন্তান প্রসব বা জন্মদানে একজন মায়ের যে রকম ঝক্কি যায়, তা নাড়িছেঁড়ার চেয়ে মোটেই কম নয়। একজন নারীর জীবনে প্রতিটি ধাপেই রয়েছে পুষ্টির প্রয়োজনীয়তা। তিনি যদি হন সদ্য প্রসব করা সন্তানের মা, তাহলে তো কথাই নেই। নতুন মায়ের খাবার প্রসঙ্গে আলাপটি গর্ভকাল থেকেই শুরু করা যাক।
আমাদের দেশে গর্ভাবস্থা মানেই যেন অতিরিক্ত কিছু ভাবা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েদের নানা রকম কুসংস্কারের মধ্যে পড়তে হয়। অনেকেই পরামর্শ দেন, যেহেতু তার গর্ভে সন্তান রয়েছে, তাই বেশ কিছু খাবারের নিষেধাজ্ঞা না মানলে সন্তানের সমস্যা হবে। সে ক্ষেত্রে গর্ভবতী মায়েরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে অনেক ধরনের খাবার খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেন। যেমন:
 ডাবের পানি: গর্ভবতী নারীদের ডাবের পানি পান করা নিয়ে অনেকেরই, বিশেষত গ্রামের মানুষদের মাঝে এখনো ভুল ধারণা রয়েছে। তাদের ধারণা, গর্ভাবস্থায় ডাবের পানি গ্রহণে শিশুর চোখ ঘোলাটে হয়!
 বোয়াল মাছ: অনেকে মনে করেন, গর্ভবতী নারীর খাদ্যতালিকা থেকে বোয়াল মাছ একদম বাদ দিতে হবে। কেননা, কোনো নারী যদি গর্ভবতী অবস্থায় বোয়াল মাছ খান, তাহলে সন্তানের মুখের চোয়াল বোয়াল মাছের আকারের মতো হয়ে যেতে পারে!
গর্ভবতী অবস্থায় নানা রকম খাবারের নিষেধাজ্ঞার পর ওই নারী যখন সন্তান প্রসব করেন, তখন দেখা দেয় আরেক সমস্যা। অনেক সমাজেই এখনো সন্তান জন্মের তিন থেকে সাত দিন মূল ঘরে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকে। পাকপবিত্র নয়—এমন ধারণা থেকে মা ও সন্তানকে অনেক সময় ঘরের কোণে বা বারান্দায় রাখা হয়। অথচ এ ধরনের মিথ বা কুসংস্কার মানা একেবারেই ঠিক নয়। কেননা, সে ক্ষেত্রে পরবর্তীকালে নানা রকম শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। যেমন জন্মগ্রহণের পর নবজাতকের দেহের তাপমাত্রা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় প্রয়োজন পড়ে, যা বাইরের পরিবেশের সঙ্গে ব্যালেন্স না করায় অনেক সময় দেখা দিতে পারে নিউমোনিয়া। আর তা পরবর্তীকালে মারাত্মক আকার ধারণ করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটতে দেখা যায়। তাই অবশ্যই সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তান ও তার মায়ের জন্য বাড়তি যত্নের পাশাপাশি কিছু খাবার অবশ্যই খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে।
 দুধ ও দুধজাতীয় খাবার: অনেকের ধারণা, সন্তান যদি সিজারিয়ান হয়, সে ক্ষেত্রে দুধ ও দুধজাতীয় খাবারগুলো মাকে পরিহার করতে হবে। অথচ সার্জারির পর ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ভালো থাকলে মায়ের বুকের দুধ পর্যাপ্ত রাখার জন্য মাকে পর্যাপ্ত দুধ ও দুধজাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে। কোনো মায়ের যদি ল্যাকটোজ ইনটলারেন্স বা দুধে অ্যালার্জি থাকে, সে ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে বাদামের দুধ, নারকেল দুধ প্রভৃতি গ্রহণ করা যেতে পারে।
 প্রোটিন: মাছ, মাংস, ডাল, বাদাম ইত্যাদি প্রোটিনের ভালো উৎস। নতুন মাকে দ্রুত সেরে ওঠার জন্য অবশ্যই উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার রাখতে হবে খাদ্যতালিকায়। এ ক্ষেত্রে প্রতিদিন তিন থেকে চার টুকরো বড় মাছ কিংবা মুরগির মাংস, অথবা ছোট মাছের চচ্চড়ি, বাদাম ভর্তা, পাতলা ডাল কিংবা ডালের বড়া গ্রহণ করা যেতে পারে।
প্রকৃত অর্থে গর্ভাবস্থা হলো একটি শারীরিক অবস্থামাত্র। এ সময় নারীর শরীরে নানা রকম হরমোনাল পরিবর্তন দেখা দেয়। ফলে বিভিন্ন জটিলতাও তৈরি হতে পারে; যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ প্রভৃতি। গর্ভাবস্থায় এসব শারীরিক সমস্যা দেখা দিলে সন্তান প্রসবের পরপরই এগুলো নিয়ে অবহেলা করা যাবে না। অনেকের ধারণা, সন্তান প্রসবের পরপরই জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস মেলাইটাস [জিডিএম] ভালো হয়ে যায়। অথচ মনে রাখা জরুরি, গর্ভাবস্থায় যদি ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, সে ক্ষেত্রে অবশ্যই সন্তান প্রসবের পর দুই থেকে তিন সপ্তাহ তা নিয়ন্ত্রণের ডায়েট ফলো করা আবশ্যক। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় কারও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা দিলে অনেক সময় সন্তান প্রসবের পর রক্তচাপ আরও অস্বাভাবিক হতে পারে। এসব সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে কিছু টিপস:
 সদ্য প্রসূতি মায়ের যেসব শারীরিক সমস্যা গর্ভাবস্থায় ছিল, সেগুলো বর্তমানে স্বাভাবিক আছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। যদি কোনো কারণে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ অস্বাভাবিক থাকে, অবশ্যই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া চাই।
 গর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস থাকলে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরপরই অতিরিক্ত চিনি, মিষ্টি, মিষ্টিজাতীয় খাবার গ্রহণ বন্ধ রাখা ভালো। অনেক সময় ডায়াবেটিস না থাকলেও ল্যাকটেশন পিরিয়ডে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের ফলে ওজন বেড়ে গিয়ে ওবেসিটি বা স্থূলতার সমস্যা তৈরি হতে পারে। এর ফলে পরবর্তীকালে ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকি বাড়ে।
 ল্যাকটেট মায়েদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঝাল মসলা কম খাওয়াই উত্তম। এ ছাড়া শুঁটকি, প্রসেসড ফুড, অতিরিক্ত লবণ, চিপস প্রভৃতি যেসব খাবার উচ্চ রক্তচাপ বাড়াতে ভূমিকা রাখে, সেগুলো মা ও শিশুর সুস্থতা রক্ষায় খাদ্যতালিকায় না রাখাই ভালো।
প্রসূতি মায়ের মনে অনেক সময়ই ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা হানা দেয়। তাই এ সময় সর্বদা মায়ের সাপোর্টার হিসেবে পরিবারকে পাশে থাকা চাই। অনেক সময় সন্তানের বাড়তি যত্ন নিতে গিয়ে মা নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। শিশুর পর্যাপ্ত ঘুমের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি মায়েরও যেন যথেষ্ট ঘুম হয়, সেদিকে নজর দেওয়া দরকার।
প্রসূতি মায়ের আরও একটি দুশ্চিন্তার বিষয় থাকে, বুকে পর্যাপ্ত দুধ উৎপন্ন ঘিরে। মায়ের বুকে প্রয়োজনীয় দুধ তৈরিতে ভূমিকা রাখে, এমন কিছু খাবার বহুকাল ধরেই রাখা হয় নতুন মায়ের খাদ্যতালিকায়। সেসব খাবারের আবেদন বা প্রয়োজনীয়তা এখনো ফুরায়নি। যেমন:
 কালোজিরা: এর পুষ্টিগুণ অনেক। প্রতিদিন দুপুরে ভাতের সঙ্গে অল্প পরিমাণ কালোজিরা স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বাড়াতে সাহায্য করে।
 লাউ: লাউয়ে প্রচুর পানি থাকে। বলা হয়, ডাইজেস্টিভ সিস্টেম ভালো রাখতে লাউয়ের গুণের শেষ নেই। প্রতিদিন লাউ গ্রহণে প্রসূতি মায়ের বুকের দুধ বৃদ্ধি পায়। সে ক্ষেত্রে লাউয়ের স্যুপ ও কারি খাওয়া যেতে পারে।
নতুন মায়ের পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিত করতে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি রাখা চাই প্রচুর পরিমাণ তরল ও তরলজাতীয় খাবার। রাখা যেতে পারে ফলের জুস, ঘরে তৈরি ভেজিটেবল স্যুপ, চিকেন স্যুপ, মাশরুম স্যুপ ইত্যাদি। এ ছাড়া প্রসূতি মায়ের অবশ্যই প্রতিদিন আড়াই থেকে তিন লিটার পানি গ্রহণ করা প্রয়োজন।
প্রত্যেক মানুষেরই খাদ্যতালিকা ভিন্ন। তবে নতুন মায়ের যেহেতু একটু বেশি ক্যালরি গ্রহণ করা প্রয়োজন, তাই কার ঠিক কতটুকু দরকার, সে ক্ষেত্রে কোনো পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়াই শ্রেয়।

লেখক: প্রধান পুষ্টিবিদ ও বিভাগীয় প্রধান, পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ঢাকা
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top