skip to Main Content

ফটোফিচার I বন্ধ প্রেক্ষাগৃহ

রাজশাহী মহানগরীর শেষ সিনেমা হল উপহার। যেটি বন্ধ করে দেওয়া হয় ২০১৮ সালের অক্টোবরে। এই সিনেমা হল নিয়ে ৯ মাস কাজ করেছেন আলোকচিত্রী রিফাত হোসেন রিহান। তার ছবিতে উঠে এসেছে হলটির কর্মচাঞ্চল্য, দর্শকহীনতা, বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ভেঙে ফেলার পূর্ণাঙ্গ চিত্র

চিত্তবিনোদনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও সাশ্রয়ী মাধ্যম চলচ্চিত্র। কিছুটা সময়ের জন্য বাস্তবতা থেকে মুক্তি ঘটে এর মধ্য দিয়ে। সম্ভব হয় অন্য এক জগতে হারিয়ে যাওয়া। তবে চলচ্চিত্র শুধু বিনোদনই দিয়ে থাকে তা নয়, তৈরি করে মানবিক মূল্যবোধ। শিশু-কিশোরদের জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করে। জীবনধারা, পোশাক ও সৌন্দর্যবোধের ওপর চলচ্চিত্রের প্রভাব ব্যাপক।
লাল সালু, পদ্মা নদীর মাঝি, হাজার বছর ধরে, শ্রাবণ মেঘের দিন, সূর্য দীঘল বাড়ি, জীবন থেকে নেয়া, ভাত দে, জয়যাত্রা, শ্যামল ছায়া, ওরা এগারো জন, হাঙর নদী গ্রেনেড, মুক্তির গান, মাটির ময়না, রানওয়ে, আমার বন্ধু রাশেদ, দীপু নাম্বার টু প্রভৃতি বাংলাদেশ চলচ্চিত্রজগতের সম্পদ। এগুলো আমাদের গৌরব। কিন্তু বাংলাদেশ চলচ্চিত্রজগৎ আজ বিপন্ন। সস্তা বিনোদন ও অশ্লীলতাকে পুঁজি করে একদল পরিচালককে দেখা গেছে মানহীন চলচ্চিত্র তৈরি করতে। ফলে একদিকে যেমন মানসম্পন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা রুপালি পর্দা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, অন্যদিকে সিনেমা হলগুলো হারিয়েছে রুচিশীল দর্শক।
সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখাকে ছেলেদের ‘বখে’ যাওয়ার লক্ষণ বলে ধরে নেওয়া হয়। নারী দর্শকের সমাগম সেখানে কল্পনাতীত। ‘সিনেমা হল ভদ্রলোকের যাবার জায়গা নয়’— এই হলো সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। এর কারণ তথাকথিত বাণিজ্যিক সফলতার লক্ষ্যে ছবিতে অশ্লীলতার প্রাদুর্ভাব। যার খেসারত দিতে হচ্ছে হলমালিকদের; বন্ধ হয়ে গেছে অসংখ্য সিনেমা হল। অনেকেই সিনেমা হল ভেঙে সেই জমি অন্য কাজে লাগিয়েছেন। চাকরি হারাচ্ছেন অসংখ্য চলচ্চিত্রকর্মী। কৈশোর-যৌবন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে সিনেমার দর্শকদের ছবি দেখার আর জায়গা নেই, কেননা হল ভেঙে বহুতল ভবন বানানো হচ্ছে। অথবা সিনেমা হল ব্যবহৃত হচ্ছে গোডাউন হিসেবে। কেউবা একে রূপান্তর করেছেন কারখানায় বা বাসস্থানে। এই যেমন রাজশাহীর উপহার সিনেমা হল। কিছুদিন আগেও এটি ছিল রাজশাহীর একমাত্র সিনেমা হল।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র তার কালো যুগ পেরিয়ে এখন আলোর পথে হাঁটতে শুরু করেছে। নবীন পরিচালকেরা আবার শিল্পের কদর করছেন। দেবী, মনপুরা, আয়নাবাজী, অজ্ঞাতনামা, দহনের মতো মানসম্মত চলচ্চিত্র আবার তৈরি হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের দর্শকও এগুলো সাদরে গ্রহণ করছে। অশ্লীলতা দিয়ে নয়, শিল্প দিয়েই ব্যবসাসফল ছবি উপহার দিচ্ছেন পরিচালক ও পরিবেশকেরা। কিন্তু চাহিদার তুলনায় মানসম্মত চলচ্চিত্রের সংখ্যা নগণ্য। ‘বছরে ৩/৪টা ভালো সিনেমা দিয়ে ব্যবসা চলে না। প্রতি সপ্তাহে নতুন সিনেমা প্রদর্শন করতে হয়, হল ফাঁকা রাখার উপায় নাই।’ তাই নিম্নমানের সিনেমা দিয়ে শূন্যস্থান পূরণ করতে বাধ্য হন হলমালিকেরা। সেগুলো চলে না, ফলে লোকসান গুনতে হয়। এ ছাড়া আছে পাইরেসি। প্রথম দিনেই পাইরেটেড হয়ে যাচ্ছে সিনেমা, পরের দিনই পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটে, পাড়া ও অলিগলির সব মাল্টিমিডিয়া দোকানে। একটি হল টিকিটের দামে পাওয়া যাচ্ছে ২/৩টা সিনেমা। দর্শক তাই হলের বদলে বাড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পারছে।
ভালো সিনেমার অভাব, প্রশাসনের দায়িত্বহীনতা মানুষের বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি— এসব কারণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন হলমালিকেরা। বছরের ৬/৮ সপ্তাহ ভালো সিনেমার বদৌলতে যা তারা আয় করেন, বাকি ৪৪/৪৬ সপ্তাহ লোকসানে বেরিয়ে যায় তার থেকে বেশি। আবার বড় শহরের বাইরের, বিশেষত গ্রামের হলগুলো নানা সময়ই অনেক ছবি প্রদর্শন করতে পারে না সিনেমা ভাড়ার উচ্চমূল্যের কারণে। আবার যত দিনের ভাড়া তাদের আওতার মধ্যে আসে, আগেই পাইরেসির কারণে ওই মুভির চাহিদা নষ্ট হয়ে যায়।
যেকোনো দেশের সংস্কৃতি ও বিনোদনের প্রধান একটি উপাদান চলচ্চিত্র। আর এর ধারক ও বাহক সিনেমা হল আমাদের দেশ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। বড় শহরের বাইরে সচল সিনেমা হল নেই বললেই চলে। সংস্কৃতির জায়গা দখল করে নিচ্ছে অপসংস্কৃতি। তবে আশার আলো জ্বলছে, যদিও তা যথেষ্ট নয়।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top