skip to Main Content

ফিচার I এক যুগের ক্যাফে

নর্থ এন্ড কফি রোস্টার্স। বাংলাদেশের কফি সংস্কৃতি পাল্টে দেওয়া প্রতিষ্ঠান। এক যুগের পথচলা। প্রতিষ্ঠানের বিপণনপ্রধান রেজোয়ান হাসান ও ক্যাফেপ্রধান প্রচ্ছদ দের সঙ্গে কথা বলেছেন আল মারুফ রাসেল

২০১১ সালের ৩১ মার্চ ঢাকা তথা বাংলাদেশের কফির ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এই দিনেই ঢাকার প্রগতি সরণি, শাহজাদপুরে পথ চলতে শুরু করে আমেরিকান দম্পতি রিক হাবার্ড ও ক্রিসের নর্থ এন্ড। তারা জাতে আমেরিকান হলেও তাদের প্রতিষ্ঠানটি পুরোপুরি দেশি।
অবশ্য এই প্রতিষ্ঠানের পরিকল্পনা আরও ১০ বছর আগেকার। ২০০১ সালে যখন তারা প্রথম ঢাকায় এসেছিলেন, জহুরির চোখ দিয়ে চিনে নিয়েছিলেন বাণিজ্যক্ষেত্র হিসেবে এ শহরের সম্ভাবনা। কারণ, দেশের প্রধান দুই শহর ঢাকা আর চট্টগ্রাম ঘুরেও ফ্রেশ ব্রিউ কফির সন্ধান পাননি তারা! আগে বারিস্তা আর কফি রোস্টার হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা ছিল রিকের; ক্রিসের ছিল বেকিংয়ে দক্ষতা। সেটাকে পুঁজি করে, আট বছরের গবেষণা আর তা ঘষামাজা করে খসড়া পরিকল্পনা দাঁড়ায় ২০০৯ সালে এসে।
খুব অল্প সময়ে ঢাকার প্রবাসী এবং তাদের সঙ্গে মেলামেশা করা ঢাকাবাসীর কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই ক্যাফে। প্রথমে ছোট ছোট ব্যাচে তাজা কফি পরিবেশনের উদ্দেশ্য ছিল। পরে দেখা গেল, কফির সঙ্গে ‘টফি’ হিসেবে সবাই হালকা স্ন্যাকসও চান। আগে থেকেই মেনুতে থাকা সিনামন রোলের সঙ্গে যোগ হলো ব্যাগলস, কোয়াসোঁ আর ব্রাউনির মতো খাবার। এরপর ঢাকার মানুষের কাছে প্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করে এই ক্যাফে। ঢাকার চা-খোর বাঙালি যেভাবে কফিকে আপন করে নিয়েছিল, তাতে মুগ্ধ না হয়ে পারেননি রিক ও ক্রিস। ফলে পরের দুই বছরে আরও দুটি কফি শপ হয়ে গেল ঢাকা শহরে। এখন ঢাকাতেই আছে দশটি আর কক্সবাজারের উখিয়ায় আছে একটি কফি শপ। এসব ক্যাফেতে প্রতিদিন প্রায় সাড়ে তিন হাজার কাপ কফি তৈরি হয়।
এই এগারোটি কফি শপ কিন্তু একটি সংস্কৃতিকে গড়ে তোলার ইঙ্গিত দেয়। হয়তো সময়ের হাত ধরে সেটাকে ইন্ডিয়ান কফি হাউসের মতো ক্ল্যাসিকের পর্যায়ে ফেলা যাবে না; তবে কফির সঙ্গে তো সম্পর্ক আড্ডার, গানের, মুক্তবুদ্ধির চর্চার আর বিপ্লবের—সেটাই-বা ভুলি কী করে? সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা ক্যাফে দো জেনি বা নাইল ক্যাফের আড্ডা, ফরাসি বিপ্লবের আঁতুড়ঘর, উসমানীয় খিলাফাতের বিদ্রোহীদের আস্তানা হিসেবে কফির গল্প পড়ে বা শুনেই তো আমাদের এক প্রজন্মের বেড়ে ওঠা। মান্না দের ক্ল্যাসিকটা কি বাদ পড়ে গেল লিস্ট থেকে?
সেই কফি কালচার বাংলাদেশে শুরু হয়েছে মূলত নর্থ এন্ডের হাত ধরে। আড্ডা যে কফির সমার্থক, সেটাকে ঢাকায় প্রথম পরিপূর্ণভাবে দেখিয়েছে এই ক্যাফে। কফি বা স্ন্যাকস অর্ডারের পরিমাণ যত কমই হোক না কেন, ক্রেতা তার ইচ্ছেমতো সময় এখানে কাটাতে পারেন। ফলে নর্থ এন্ডকেই ওয়ার্ক স্টেশন কিংবা ক্লাস বানিয়ে নেওয়া লোকও দেখা যায়। এই ক্যাফেতে এমন ক্রেতাও আছেন, যারা সকালবেলায় এসে রাতে ক্যাফে বন্ধ হওয়ার সময় বের হন। করোনার সময়ে কিছু ক্রেতা তো রীতিমতো পাগলই করে দিয়েছিলেন, দ্রুত ক্যাফে খোলার দাবি তুলে! ঢাকায় চা ‘খাওয়া’ মানুষের মাঝে এই পরিবর্তন কিন্তু বেশ বড় ধরনের সামাজিক হাওয়া বদলের গল্প শোনায়। নর্থ এন্ড কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে, কফি এখানে কোনো বিলাসী পণ্য নয়, তাই কফির মূল্যও কফি-খোর শ্রেণির মানুষের নাগালেই নির্ধারণ করা হয়েছে। আরেকটি ব্যাপার হলো, এই ক্যাফেতে অনেকেই খণ্ডকালীন কাজ করেন পড়াশোনার পাশাপাশি।
এই কফি সংস্কৃতি তৈরি শুধু কফি পান করার ভেতরেই নয়, বরং সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে দিতেই কাজ করছে নর্থ এন্ড। এর প্রথম শাখায় এখন ক্যাফের পাশাপাশি রোস্টারও রয়েছে। কাউন্টার উজিয়ে একটু নজর দিলেই দেখা যায় কফি রোস্টিং আর প্যাকেজিংয়ের কাজ চলছে পুরোদমে। পাশাপাশি এই শাখাতেই একটি কফি একাডেমিও খোলা হয়েছে। স্থানীয় অনেক ব্যবসায়ী এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এভাবে তারা বাংলাদেশে ক্যাফের বিস্তারেও ভূমিকা রাখছে। নিজেদের ব্যবসা তো অবশ্যই চলছে, পাশাপাশি বাজারে অন্যদেরও সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে নর্থ এন্ড।
নর্থ এন্ডের শেলফে নানা ধরনের কফি দেখা যায়। তবে যে কফি সবাইকে বেশি আকর্ষণ করে, সেটি সিএইচটি ব্লেন্ড; পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার কফি। ব্রাজিলের কফির সঙ্গে ব্লেন্ড করে এটি তৈরি করা হয়। কেন ব্লেন্ড, সিঙ্গেল অরিজিনে বাধা কোথায়—এমন প্রশ্নের জবাবে নর্থ এন্ড কফির ক্যাফেপ্রধান প্রচ্ছদ জানালেন, বাংলাদেশে যে কফি উৎপাদিত হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। তাই দেশি কফির সঙ্গে আঁতাত করে ব্রাজিলের কফি। আপাতত দেশি কফির উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে তারা কাজ করে চলেছেন। তবে একটি প্রশ্ন করেই ফেললাম তাকে, বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় কোনো কিছু চাষ করতে গেলেই যে জঙ্গল উজাড় করার ব্যাপার চলে আসে, কফির ক্ষেত্রেও কি তা-ই? তিনি অবশ্য আশ্বস্ত করলেন, সেখানকার বাগানগুলোয় বড় বড় আম-কাঁঠালের ছায়াতেই হচ্ছে এই কফির চাষ। কফি চাষের জন্য বড় গাছের ছায়া লাগবেই। আর যখন কফির বিন সংগ্রহ করা হয়, সেখানে কোনো মধ্যস্বত্বভোগী থাকে না। ফলে কফির পুরো দামটাই পান কৃষক। নর্থ এন্ডের অন্য বিনগুলো আসে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, কেনিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পানামা, হন্ডুরাস ও পাপুয়া নিউগিনি থেকে। এসব কফি নর্থ এন্ডের নিজেদের ক্যাফে ছাড়াও প্রায় ৪০০ পাইকারি বিক্রেতার কাছে পৌঁছে যায় নিয়মিতভাবে।
প্রতিষ্ঠানের বিপণনপ্রধান রেজোয়ান হাসান ২০১২ সালে নর্থ এন্ডে যোগ দিয়েছিলেন বারিস্তা হিসেবে। সে হিসেবে বলা যায়, তিনি প্রায় পুরোটা সময় ধরেই এখানে রয়েছেন। জানালেন, কখনো নিতান্ত কফির দোকান হিসেবে ক্রেতারা এখানে আসেননি; অনেকের কাছেই এটা তাদের ‘দ্বিতীয় বাসা’ বা ‘সেকেন্ড হোম’। আরও বললেন, একের পর এক ক্যাফে খোলা নর্থ এন্ডের উদ্দেশ্য নয়; নয় বিধেয়ও! তারা ক্রমবর্ধমান কফি সংস্কৃতিকে একটু মজবুত ভিত্তি দিতে চান; আর চান সেই সংস্কৃতিটার কেন্দ্রে থাকবেন স্থানীয় কফিচাষিরাই।
গত বারো বছরে নর্থ এন্ডের প্রাপ্তির কথা জানতে চাইলে রেজোয়ানের উত্তর, ‘অবশ্যই কফিপ্রেমীদের ভালোবাসা আর আস্থার জায়গাটায় যেতে পারা।’ তবে প্রচ্ছদ অল্প করে একটু আক্ষেপের কথা বললেন, ‘স্থানীয় কফির উৎস যে হারে বাড়ার কথা ছিল, সেভাবে বাড়েনি; পাশাপাশি কফি লিটারেসিও আশানুরূপ বাড়েনি।’ এর পরেই অবশ্য আশার কথা শোনালেন, বড় কয়েকটি দাতা ও উন্নয়ন সংস্থা পার্বত্য এলাকায় কফি নিয়ে ভাবছে, কাজও করতে শুরু করেছে। সেখানে নর্থ এন্ড রোস্টার্স রয়েছে সহযোগীর ভূমিকায়। তিনি আশাবাদী, বান্দরবানের যেসব এলাকায় এখন তামাকের চাষ চলছে, আগামী ১২ বছরে তার অন্তত অর্ধেক জায়গা দখল করে নেবে কফির বাগান। একই সঙ্গে রেজোয়ানের আশা, বাংলাদেশের কফির বাজার অন্তত দ্বিগুণ হবে আগামী এক যুগে। আর বাংলাদেশি কফির এই ব্র্যান্ড শিগগির দেখা যাবে উপমহাদেশের অন্য কোনো দেশে।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top