skip to Main Content

ফিচার I কালচারড মিট

প্রায় ৯০ বছর চেষ্টার পর এই শতকের শুরুতে এসেছে সফলতা। যদিও কৃত্রিম মাংস অপ্রতুল; দামও বেশি। তবে পরিবেশ রক্ষায় উপযোগী। ভবিষ্যতে এর চাহিদা বাড়ার আশায় সংশ্লিষ্টরা

ভোজ্যমাংসের চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর প্রায় ৭ হাজার ২০০ কোটি প্রাণী ও পাখি দরকার পড়ে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ২০১৭ সালের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ করেছিল। সামুদ্রিক প্রাণী থেকে প্রাপ্ত মাংস বাদ দিয়েই এই হিসাব ছিল রিপোর্টে। নানান ধরনের উৎসব-পার্বণে এত মাংসের প্রয়োজন পড়ে মানুষের। এই চাহিদা দিনে দিনে আরও বাড়ছে। বিপুল মাংসের জোগান দিতে গবাদিপশু পালন বাড়াতে হয়। এতে কর্মসংস্থান ও উপার্জনের ব্যবস্থা হলেও পরিবেশে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ বাড়ে, যা জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর। কেননা তা কার্বন ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ২৫ গুণ বেশি তাপ ধরে রাখতে সক্ষম। ফলে বাড়ে বৈশ্বিক উষ্ণতা। গবাদির পরিপাক প্রক্রিয়ায় এই গ্যাস উৎপন্ন ও নিঃসরণ ঘটে। অন্যদিকে গবাদিপশু পালনে খরচও অনেক। প্রায় ৭ কেজি মাংস পাওয়ার জন্য ৪৬ কেজি পশুখাদ্য ব্যয় করতে হয়।
বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ করে মানুষের জন্য মাংসের জোগান দেওয়া বেশ চ্যালেঞ্জিং। বিষয়টি বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলেছে। গবাদিপশু পালন না করে মাংস পাওয়া গেলে পরিবেশ রক্ষা পেত হয়তো। শুনতে কল্পকাহিনির মতো লাগলেও তা বাস্তব রূপ পেয়েছে ৯০ বছরের প্রচেষ্টায়। তৈরি হচ্ছে কৃত্রিম মাংস। বায়োটেকনোলজি ব্যবহারের মাধ্যমে। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে বানানো হয় কৃত্রিম মাংস। এগুলোর রয়েছে বিবিধ নাম। যেমন ইন-ভিট্রো, ভ্যাট মিট, সিনথেটিক কিংবা কালচারড মিট। কোথাও কোথাও পরিষ্কার মাংস অথবা ল্যাব উৎপাদিত মাংসও বলা হয়।
যে প্রাণীর মাংস তৈরি করা হবে, সেটির শরীর থেকে একটি বর্ধনশীল কোষ নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে স্টেম সেলই বেশি বাড়ে। তা জীবাণুমুক্ত করে প্রোটিনপূর্ণ গ্রোথ মিডিয়ামে রাখা হয়। ওই আমিষই কোষের বৃদ্ধি ঘটাতে দরকারি শক্তি জোগায়। এরপর তৈরি করতে হয় লেয়ার। এর ফলে ত্রিমাত্রিক মাংস তৈরি হয়। তেমন না হলে কৃত্রিম মাংস খাওয়ার উপযোগী না-ও হতে পারে। তাই একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর মাংসে স্ক্র্যাচ ফেলা হয়। তারপর সোডিয়াম বেনজয়েটে ডুবিয়ে রাখা হয়। কেননা, সাধারণ অবস্থায় রেখে দিলে তাতে ইস্ট কিংবা ফাঙ্গাস আক্রমণ করতে পারে। তা ছাড়া ওই কোষে ম্যানিটল, জ্যান্থান গাম ও কোলাজেন পাউডারও যুক্ত করা হয়।
নকল মাংস তৈরির চিন্তা বোধ হয় প্রথম চেপেছিল উইলিয়াম চার্চিলের মাথায়। ১৯৩১ সালে তিনি বলেছিলেন, মুরগির ব্রেস্ট কিংবা উইংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে পুরো মুরগি পালন না করে ল্যাবে উন্নত মিডিয়ামে মুরগির আলাদা আলাদা অংশ তৈরি করা যেতে পারে। এরপর যার অবদান, তিনি রাসেল রস। ১৯৭১ সালে একটি মিডিয়ামে প্রায় আট সপ্তাহের প্রচেষ্টায় মাস্কুলার ফাইবারের চাষ করতে সক্ষম হন তিনি। শুরুতে এক স্তরবিশিষ্ট মাংসপেশি তৈরি করলেও ধীরে ধীরে তিনি ওভারল্যাপিংয়ের মাধ্যমে স্তরের সংখ্যা বাড়িয়ে তোলেন। এরপর অবশ্য টানা ১৯ বছর বন্ধ ছিল এ ধরনের স্টেম সেল উৎপাদনের কাজ।
ভোজ্য কৃত্রিম মাংস তৈরি হয়েছিল ২০০২ সালে। গোল্ডফিশের কোষ দিয়ে। আগের বছর ডাক্তার উইলিয়েম ভ্যান এলেন, ডার্মাটোলজিস্ট অয়েস্টারহাফ এবং বিজনেস ম্যান উইলিয়েম ভ্যান-কুতেন সম্মিলিতভাবে ঘোষণা করেন, তারা কৃত্রিম মাংস উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন। তারা যে প্রণালি দিয়েছিলেন, সেটি ছিল টিস্যু কালচারের মতো। পরে এ ধরনের মাংস উৎপাদনে উৎসাহ দিতে এক মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়। বলা হয়েছিল, ২০১২ সালের মধ্যে যে প্রতিষ্ঠান কৃত্রিম মাংস আনতে পারবে, তারাই পাবে এই পুরস্কার। আরেক দিকে ডাচ সরকার কালচারড মিট উৎপাদনে খরচ করে চার মিলিয়ন ডলার। বিশ্বের নানান জায়গায় থাকা ৩০টি গবেষণাগারে তারা এ ধরনের মাংস উৎপাদনের কাজ চালিয়েছিল। এরপর ২০১৩ সালে কৃত্রিম মাংস যোগে তৈরি হয় বার্গার। লন্ডনে তা নিয়ে একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করা হয়। নেদারল্যান্ডসের একটি প্রতিষ্ঠান গরুর কোষ নিয়ে তৈরি করে কালচারড বিফ। তা দিয়েই তৈরি হয়েছিল বার্গারটি। উৎসবে দুজন ব্যক্তি সেই বার্গার খেয়ে পরখ করেছিলেন।
বিশ্বের খ্যাতিমান খাদ্যসমালোচকেরাও কৃত্রিম মাংসে তৈরি বার্গার খেয়ে স্বাদ সম্পর্কে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তেমনই একজন হ্যানি রুজলার। তিনি জানিয়েছেন, কৃত্রিম মাংসে ফ্যাট না থাকায় তা সাধারণ মাংসের মতো রসাল না হওয়াই স্বাভাবিক। তবে এটিকে মাংস বলে স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি তিনি। তবে তা আরেকটু নরম হলে ভালো হতো বলে জানান। আরেক খাদ্য সমালোচক জোস সোনাল্ড জানিয়েছেন, কালচারড বিফ মাংসের মতোই। তা ছাড়া হেলেন ব্রিড নামের একজন এই ধরনের মাংসে লালচে বর্ণ আনতে অনুরোধ করেন। কেননা কৃত্রিম মাংস সাধারণত সাদাটে হয়।
ধীরে ধীরে অন্যান্য খাবারেও যোগ হতে থাকে কালচারড মিট। ২০১৭ সালে মেমফিস মিট প্রতিষ্ঠান তা দিয়ে তৈরি করে বিফ মিটবল। পরের বছর তারাই বাজারে আনে মুরগি ও হাঁসের কালচারড মিট। যদিও সেগুলোর দাম বেশি। প্রতি কেজি প্রায় ১৮ লাখ টাকা। পরে ‘ইট জাস্ট’ নামের একটি কোম্পানি মুরগির কোষ দিয়ে কালচারড মিট তৈরি করে। তারা তা নিয়ে চিকেন নাগেট বানায়। যার প্রতিটির দাম রাখা হয় ৫০ ডলার।
পুষ্টিমানের দিক থেকে কালচারড মিট সাধারণ মাংস থেকে পিছিয়ে। এতে চর্বি ও হাড় না থাকায় ক্যালসিয়াম ও ফ্যাটের ঘাটতি থাকে। কিন্তু যাদের কোলেস্টেরল ও অ্যালার্জির সমস্যা আছে, তাদের জন্য এ ধরনের মাংস উপাদেয় হতে পারে। আমিষের বিপুল চাহিদা মাথায় রেখে বিকল্প মাংস হিসেবে এর প্রচলন ঘটানো গেলে মানুষের খাদ্যাভ্যাসে বড়সড় পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে তা ক্রয়সীমার মধ্যে থাকা চাই। নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় কৃত্রিম মাংস নিয়ে আসা গেলে বাস্তুসংস্থানের ওপর পড়া মন্দ প্রভাব কেটে যেতে পারে।

 ফুড ডেস্ক
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top