skip to Main Content

ফিচার I খিচুড়িবিলাস

আষাঢ়স্য প্রথম দিবস হোক বা বছরের যেকোনো দিন— বাঙালি আর খিচুড়ি যেন মেড ফর ইচ আদার। উৎপত্তি যেখান থেকেই হোক না কেন, বাংলার হেঁশেলে এর মনমাতানো উপস্থিতি। লিখেছেন সামীউর রহমান

আষাঢ়ের প্রথম মেঘ দেখে কালিদাসের বিরহী যক্ষের প্রেমিকহৃদয় আকুল হয়েছিল সুদূর অলকাপুরীতে অবস্থানরত প্রিয়ার জন্য। আর আধুনিক যুগে, নাগরিক প্রেমিক আষাঢ়ের বৃষ্টি দেখে হাতে তুলে নেয় স্মার্টফোন। আবছায়া জানলার কাচের ছবি তুলে ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে সে আঙুল বুলিয়ে চলে কোনো ফুড ডেলিভারি অ্যাপের মেনুতে। যক্ষ মেঘকে কাতর কণ্ঠে অনুরোধ করেছিল বিরহী প্রিয়ার কাছে তার হৃদয়ের আকুতি পৌঁছে দিতে। আধুনিক প্রেমিককে অবশ্য এত কাকুতি-মিনতি করতে হয় না, স্মার্টফোনে আঙুল বুলিয়ে দিলেই বাড়ির ঠিকানায় হাজির হয়ে যায় গরমাগরম খিচুড়ি। অমৃতের অপেক্ষা চলে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে।
বর্ষা হচ্ছে কবিতা আর খিচুড়ির ঋতু। সেই কালিদাস থেকে আজকের প্রায় সব কবিই একবার হলেও মেতেছেন বৃষ্টিবন্দনায়। তেমনি এমন কোনো বাঙালি বোধ হয় নেই, বর্ষাদুপুরে যার মন খিচুড়ির জন্য উতলা হয়নি। এই আবেগ আমরা বহন করে চলেছি সুপ্রাচীনকাল থেকেই। মধ্যযুগে রচিত মনসামঙ্গলে এই বর্ণনা আছে যে, পার্বতীর কাছে ডাবের জল আর মুগ ডাল দিয়ে রাঁধা খিচুড়ির আবদার করেছিলেন শিব। দেবদেবীরা সত্যিই এসব খেয়েছেন, নাকি ভক্তরা নিজের ইচ্ছের কথা দেবতার মুখে বসিয়ে দিয়েছেন, সেই প্রশ্ন আপাতত থাক। বাদশাহ আকবর আর বীরবল, এরা তো সত্যিকারের মানুষ, তাদের গল্পেও যে খিচুড়ির বয়ান রয়েছে। গাছের মগডালে হাঁড়ি ঝুলিয়ে নিচে খড়কুটোয় আগুন ধরিয়ে বাদশাহকে জব্দ করার সেই গল্পে হাঁড়ির ভেতর তো খিচুড়িই ছিল! একই গল্প অবশ্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র আর গোপাল ভাঁড়ের সংস্করণেও প্রচলিত। গল্পের মানুষেরা বদলে গেলেও হাঁড়ির খিচুড়ি কিন্তু বদলায়নি!
খিচুড়ি মানেই এলোমেলো, নানান উপাদানের সমাহার। সুকুমার রায় তাঁর খিচুড়ি কবিতায় তো হাঁসের সঙ্গে শজারুকে জুড়েছেন, সিংহের সঙ্গে হরিণকে আর হাতির সঙ্গে তিমিকে। তাই বলে খিচুড়ি রাঁধতে গেলে খাদ্য-অখাদ্য যা হাতের কাছে পাওয়া গেল, সবই এক হাঁড়িতে সেদ্ধ বসিয়ে দিলেই হয়ে যাবে, তেমনটা একদমই নয়। সুস্বাদু খিচুড়ির আছে নিজস্ব রসায়ন। উপলক্ষ, অনুপান ও ঋতু— এসবের তারতম্যে খিচুড়ির চেহারাও বদলে যায়। শিশুর প্রথম শক্ত খাবার খিচুড়ি, সরস্বতী পূজার ভোগের খিচুড়ি কিংবা সিলেট অঞ্চলে ইফতারে প্রচলিত পাতলা খিচুড়ি— তিনটিই একই গোত্রের হলেও এগুলোর মধ্যে ততটাই মিল যতটা আম আর আমলকীতে! বাংলাদেশ এবং ওপার বাংলার খিচুড়িতেও অনেকটাই ফারাক। কলকাতার ডেকার্স লেনের বিখ্যাত চিত্তদার দোকানে, অ্যালুমিনিয়ামের খোপকাটা ট্রেতে, গোবিন্দভোগ চালের যে খিচুড়ি লোকে বেগুনি ও পাপড় দিয়ে হরদম খাচ্ছে, ঢাকায় সেটির খদ্দের জোটানোই হয়তো দুষ্কর হবে। কারণ, ওপারে খিচুড়িটা আমাদের ভাষায় ল্যাটকা খিচুড়ি বা গলা খিচুড়ি। ট্যালটেলে সেই খিচুড়ির চাইতে ঝরঝরে কিংবা মাখো মাখো ভুনা খিচুড়িই যে আমাদের ‘রেইনি ডে ডেলিকেসি’!
খিচুড়ি এমন একটা খাবার, যার ব্যাপ্তি দোলনা থেকে মৃত্যুশয্যা পর্যন্ত। শিশুর মুখে প্রথম যে শক্ত খাবারটা ওঠে, সেটা খিচুড়ি। তারপর একটু বড়বেলা, বাড়িতে ছুটির দিনে সকালের নাশতায় খিচুড়ি আর ডিমভাজা। কৈশোরে বন্ধুদের নিয়ে বনভোজনে খিচুড়ির সঙ্গে মাংস না হয় ডিমের কষা। কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের পর আড্ডা কিংবা টিউশনির ফাঁকে দুপুরের খাবারটা সেরে নিতে হয় ক্যানটিনেই। সেখানেও মামাদের হাতের ভুনা খিচুড়ি ছাড়া ছাত্রজীবন রীতিমতো অসম্ভব। উচ্চশিক্ষায় বিদেশে গেলেও বাংলাদেশের ছেলেটি বা মেয়েটি ইউটিউব দেখে (আগে প্রত্যেকেই এক কপি করে সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি নিয়ে যেতেন!) যে রান্নাটা করতে গিয়ে হাত পাকান (পড়ুন পোড়ান!) সেটাও বেশির ভাগ সময়েই খিচুড়ি। আর চাকরি জীবনে ঢুকে গেলে পোস্টিং যদি হয় বাড়ি থেকে দূরে, তখন অন্নজলের ভরসা রান্নার বুয়া কামাই দিলে ব্যাচেলর মেসের বাসিন্দাদের ভরসা খিচুড়ি আর ডিমেই। তারপর দুজনের ছোট্ট সংসারে মায়ের আদুরে কন্যাটি হাত পুড়িয়ে মেঘলা দিনে খিচুড়ি বসান চুলোয়, রেইনি ডের ছুটিতে চুলোয় টগবগ করে ফোটে খিচুড়ি আর হৃদয়ে ভালোবাসা। হাসিকান্নায় জীবনটা কাটিয়ে বার্ধক্যে উপনীত হয়ে যখন দাঁতগুলো নড়ে যায়, কিংবা রোগব্যাধি থাবা বসায় শরীরে, তখন ডাক্তার পথ্য হিসেবে লিখে দেন মসলাবিহীন নরম খিচুড়ি। নশ্বর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে যাবার পর মৃতের স্মরণে আয়োজিত মিলাদ মাহফিল কিংবা কাঙালি ভোজে খিচুড়ি খাওয়ানোর রেওয়াজ আছে। জীবনচক্রের প্রতিটি ধাপেই খিচুড়ি স্বমহিমায় বিরাজমান। এখানেই শেষ নয় খিচুড়িনামা। এর ধর্মীয় গুরুত্বও কম নয়। পূজার ভোগ হিসেবে নিরামিষ অর্থাৎ পেঁয়াজ-রসুনবর্জিত খিচুড়ি পরিবেশিত হয়। বাংলায় জগাখিচুড়ি অর্থ এলোমেলো, নানান রকম জিনিসের সমাহার বা বিশৃঙ্খলা। অথচ এই শব্দের উৎপত্তি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের ভোগ থেকে! সেখানে ভক্তদের দেওয়া নৈবেদ্য নানান রকম শাকসবজি, ডাল-চাল একসঙ্গে মিলিয়ে বিশাল পাত্রে রান্না করে যে প্রসাদ দেওয়া হতো, সেটাই জগন্নাথ দেবের খিচুড়ি থেকে কালক্রমে হয়ে গেছে জগাখিচুড়ি। পোলাও, বিরিয়ানি যদি উৎসবের খাবার হয়, একে বলা যায় দুর্যোগের খাবার। বর্ষায় নদীর দুকূল উপচে বন্যা দেখা দিলে বন্যার্ত মানুষদের ত্রাণ হিসেবে লঙ্গরখানায় যে রান্না করা খাবারটা দেওয়া হয়, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা হয় খিচুড়ি। হুমায়ূন আহমেদের ‘ফজলুল করিম সাহেবের ত্রাণকার্য’ ছোটগল্পে আছে সেই ত্রাণের খিচুড়ি বিতরণের সরেস বর্ননা। আবার কমফোর্ট ফুড হিসেবেও কিন্তু এটি এগিয়ে রয়েছে অনেক খাবারের চেয়ে। এমনকি এটা একটা পরিপূর্ণ আহার বা কমপ্লিট ফুডও বটে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কিংবা কবিতায়, বর্ষা নিয়ে যতই মাতামাতি হোক না কেন, আষাঢ়-শ্রাবণের এই দুটো মাস যে জনজীবনে দুর্ভোগও বয়ে আনে, এ প্রসঙ্গে খুব কম লোকেই দ্বিমত করবেন। বৃষ্টিতে মাঠঘাট জলে টইটম্বুর, বাজারে যাবার পথে ভোগান্তি। এখানেই খিচুড়ির আগমন ত্রাণকর্তা হিসেবে। ঘরে ঘরে ফ্রিজের প্রচলন হবার আগে আমাদের বাবারা শাকসবজি কিংবা মাছটা রোজই কিনতেন। বর্ষাকালে রাস্তাঘাটে কাদা, দিনভর বৃষ্টি আর সকালের ঘুমের আলসেপনায় বাজারে যেতে ইচ্ছে না করা থেকেই মায়েদের সহজ সমাধান ছিল খিচুড়ি। তখন তো আর গ্যাসের উনুন ছিল না, ইন্ডাকশন কুকার বা মাইক্রোওয়েভ আভেনের তো প্রশ্নই আসে না! প্রতিটা বাড়ির কোণেই গাদা করা থাকত মাটির চুলার জন্য জ্বালানি, যার নাম চ্যালাকাঠ আর কথ্য লাকড়ি। সেই জ্বালানিও ভিজে একশেষ। ভেজা কাঠ থেকে ধোঁয়াও ওঠে ভকভকিয়ে। গিন্নিরাও তাই চুলোয় চাল, ডাল, তেল, মসলা মাখিয়ে গরমমসলার ফোড়নে চড়িয়ে দিতেন খিচুড়ি। সঙ্গে হাঁসের ডিমের ঝালঝাল কষা। গরম গরম খিচুড়ির সঙ্গে পাতে পড়ত গাওয়া ঘি নয়তো গ্রীষ্মের শুরুতেই তৈরি কাঁচা আমের আচার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তি হয়েছে সুলভ। ঘরে ঘরে ফ্রিজ, এক দুই দিন কেন, এক মাস বাজারে না গেলেও অসুবিধে নেই। আর তা না হলে সুপারস্টোর, অনলাইন ডেলিভারি তো আছেই। কিন্তু ডিএনএতেই যে লেখা হয়ে গেছে, বর্ষা মানেই খিচুড়ি!
গান গাইতে হারমোনিয়ামের সঙ্গে তবলা না হলে জমে না, ঠিক তেমনি খিচুড়ির সঙ্গে খানিকটা ভাজাভুজি না হলে স্বাদের খোলতাই হয় না। এ ক্ষেত্রে খিচুড়ির চিরায়ত সহোদর বেগুন। চালের গুঁড়া, বেসন, লঙ্কাগুঁড়া আর একটু জিরাগুঁড়ার ব্যাটারে মাখামাখি হয়ে গরম তেলে গা ডুবিয়ে উঠে আসা মুচমুচে বেগুন ভাজা আর খিচুড়ি যেন সাক্ষাৎ রাম-লক্ষ্মণের জোড়। বেগুন না হলে চাকচাক করে পাতলা আলুর ফালির মুচমুচে ভাজাও জমে যায় খিচুড়ির সঙ্গে। শীতকালে খিচুড়িতে যোগ হয় মটরশুঁটি আর ভাজার তালিকায় ফুলকপির ফুলুরি। কুমড়ো ফুলের ভাজাও অনবদ্য। ভরা বর্ষায় ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উজান বেয়ে সাগর থেকে চলে আসে নদীতে। তখন তাদের পেট ভারী হয়ে থাকে ডিমে। যখন বরফকলের এত প্রাচুর্য ছিল না, তখন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়লে খুব সস্তা হয়ে যেত আজকের মহার্ঘ ‘রুপালি শস্য’। অফিসফেরত লোকজন কানকোয় দড়ি বেঁধে হালিকয়েক ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরতেন বিকেলে। অমন দিনে খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশের পেটি আর ডিম ভাজার গন্ধে ম-ম করত গোটা পাড়া। এখন তো ধরা পড়া ইলিশ ঘাট থেকেই চলে যায় কোল্ড স্টোরেজে, নয়তো প্যাকিং বাক্সে ভরে চালান হয়ে যায় বিদেশে। এত সব ঝক্কিঝামেলা পেরিয়ে যে ইলিশগুলো রাজধানীর বাজারে বরফের বিছানায় শুয়ে থাকে, তাতে সেই স্বাদগন্ধ কিছুই যে আর অবশিষ্ট নেই। তবু স্মৃতিটুকু তো আছে! তাই ছুটির দিনে আকাশে মেঘ জমলে কেউ কেউ কাদা মাড়িয়ে বাজারমুখো হন। বেজারমুখো বিক্রেতার সঙ্গে তর্কে জিতে এক মণ ধানের বেশি দামে খোকা ইলিশ কিনে বাড়ি ফিরে ইলিশ-খিচুড়ি খেয়ে স্মৃতির জাবর কাটেন।
খিচুড়ি আর মাংস ছিল বনভোজনের বাঁধা মেনু। শীতকালে স্কুল-কলেজ কিংবা পাড়ার বনভোজনে খিচুড়ি ও মাংসের ঝোলের সঙ্গে একটা করে কমলা সন্দেশ— এই মেনুই চলেছে বছরের পর বছর। একসময় স্কুলের অ্যানুয়াল স্পোর্টের দিনে এতেই সেরে নেওয়া হতো মধ্যাহ্নভোজ। সেখানে শীতের সবজির সঙ্গে ডাল আর চালের মধুর মিলন। অবশ্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলো এখন বনভোজনের দায়িত্বও কাঁধে তুলে নেওয়ায় সাবেকি সেই মেনু হারিয়ে গেছে। বাড়িতে অতিথি আপ্যায়নে পোলাও কোর্মা আর রোজকার মাছভাতের মাঝে খিচুড়ি মাংস জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষ করে মাংসটা যদি হয় নতুন ধান খেয়ে গায়ে চর্বি জমা হাঁসের! এখনো অনেক বাড়িতে শুক্রবার সকালের নাশতায় নিয়ম করে খিচুড়ি রান্না হয়। সঙ্গে থাকে পোড়া মরিচ, ধনেপাতা আর পেঁয়াজকুচির সঙ্গে সর্ষের তেলে মাখানো টাকরা গরম করা ঝাল ভর্তা, ডিম ভাজা। শহরের বাইরে গ্রামাঞ্চলে বিয়েবাড়িতে অনেক অতিথি সমাগম হলে বিয়ের দিন সকালে সবার জন্য নাশতা হিসেবে রান্না করা হয় খিচুড়ি। যেটা বিয়ের রান্না করতে আসা রাঁধুনিরাই করে থাকেন। সঙ্গে থাকে মুরগির গিলা-কলিজার ঝাল চচ্চড়ি! তাও কম উপাদেয় নয়।
সেই খিচুড়ি এখন পরিবেশন করা হচ্ছে রেস্তোরাঁর অনিন্দ্য অন্দরে। রাজধানীর রসনা মানচিত্রে ভোজনরসিকেরা তাই খুঁজে বের করেছেন বেশ কিছু খিচুড়ির ঠেক। কারওয়ান বাজার সার্ক ফোয়ারা মোড়ের কুকার্স সেভেন-এর প্রচুর ধনেপাতাকুচি ছিটানো ইলিশ খিচুড়ির কথা ভেবে, এখনো স্মৃতিকাতর হন যৌবনের সোনালি দিনগুলোতে ঢাকার মিডিয়াপাড়ায় দৌড়ঝাঁপ করা অনেক গণমাধ্যমকর্মী। স্টার হোটেলের মাটন খিচুড়িও দামের সঙ্গে স্বাদের একটা ভারসাম্য মেনে চলেছে অনেক দিন। ইদানীং অবশ্য দামটা বাড়তি আর মানটা পড়তির দিকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের অনেকের কাছেই দুপুরের খাবার মানে ছিল হাকিম চত্বরের খিচুড়ি। কোয়ার্টার প্লেটে পরিবেশন করা কালিজিরা চালের ঝরঝরে খিচুড়িটা ঝাল না গরম এই নিয়েই তর্ক জমে যেত কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে। খিচুড়ির সঙ্গে মুরগির ঝোল, ডিম, নাকি আলুর চপ— সেটা অবশ্য নির্ভর করত মাসের কত তারিখ তার ওপর। ডাকসু ক্যাফেটেরিয়াতেও সপ্তাহের নির্দিষ্ট কয়েকটা দিনে পাওয়া যেত খাসির মাংসের খিচুড়ি, যেটা খেতে দেওয়া লাগত লম্বা লাইন আর শেষ হয়ে যেত পাশের মসজিদ থেকে জোহরের আজান ভেসে আসার আগেই। মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় হীরাঝিল, ঘরোয়া— এসব হোটেল বেশ নাম করেছিল ভুনা খিচুড়ির জন্য। ঘরোয়ার সুনাম হারিয়ে গেছে নানান ডামাডোলে, হীরাঝিল এখনো ধরে রেখেছে মানটা। কাছাকাছি এলাকায় নতুন করে সুনাম কুড়াচ্ছে সেগুনবাগিচার ভোজ রেস্তোরাঁ। প্রথাগত চাল, ডাল আর মসলার সঙ্গে আমের আচার, ধনেপাতা ও পুদিনাপাতা দিয়ে বানানো আচারি খিচুড়িতে গরু, খাসি অথবা মুরগির মাংস। গুলশান এলাকায় বিদেশি খাবারের দাপটের ভিড়েও জমিয়ে ব্যবসা করছে ওয়েস্টিনের পাশের ক্যাফে গুলশান প্লাজা রেস্তোরাঁ। এখানকার খিচুড়ি ও চা খেতে মাঝরাতেও ছুটে আসেন অনেকে।
বিরিয়ানির জন্য বিখ্যাত পুরান ঢাকা। সেখানে হাজি বিরিয়ানি, হানিফ বিরিয়ানির মতো শমশের আলীর ভুনা খিচুড়ির বেশ নামডাক। শমশের আলী ভুনা খিচুড়ির সঙ্গে দেন বড়ইয়ের টকমিষ্টি আচার আর খাসির লেগরোস্ট। চানখাঁরপুলের আফতাব রেস্টুরেন্টের খিচুড়িরও বেশ কদর। এখানকার বেশির ভাগ গ্রাহকই বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দামটা কম, স্বাদে ভালো, তাই ভিড় লেগে থাকে।
তবে সকালে নাশতা করতে চাইলে একটু উজিয়ে টিপু সুলতান রোডের ষোলআনায় যেতে পারেন। এখানে মাত্র ৪৫ টাকায় ঝরঝরে খিচুড়ির সঙ্গে ১০ পদের ভর্তা সকালটাকে জমিয়ে দেবে সন্দেহ নেই।
এ ছাড়া সোবহানবাগের তেহারি ঘর, লালমাটিয়ার কুটুমবাড়ি, তেজগাঁওয়ের ক্যাফে সুফিয়া হোটেল, মৌচাক মোড়ের সাদ রেস্তোরাঁসহ অনেক জায়গাতেই আছে মজাদার খিচুড়ির আয়োজন। এর বাইরে নয়। তারকা হোটেলগুলো। বিশেষত বর্ষার মৌসুমে ইলিশ খিচুড়ির নানান আয়োজন থাকে এগুলোয়। তাই সাধ ও সাধ্যের সমীকরণ মিলিয়ে বেরিয়ে পড়ুন খিচুড়ি অভিযানে। আর বৃষ্টিতে যদি বেরোতে ইচ্ছে না করে, তাহলে অনলাইন ডেলিভারি তো আছেই!

লেখক: কালের কণ্ঠের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার এবং রসনালিখিয়ে
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top