skip to Main Content

ফিচার I জগন্নাথ ভোজনালয়

পুষ্পান্ন, সাদা অন্ন, সাগুদানা ভুনা, ছানার রসা, শ্যামা দানার মিষ্টান্নসহ আরও অনেক ব্যঞ্জনে ভোজনরসিকদের তৃপ্ত করছে রাজধানীর তাঁতীবাজারের কিছু নিরামিষ হোটেল। সেখানকার শিবমন্দিরের আশপাশে এ রকম প্রায় সাতটি হোটেল আছে। সব কটি পরিচালনা করছেন ইসকন ভক্তরা। কারও সঙ্গে কারও বিদ্বেষ নেই, নেই অসুস্থ প্রতিযোগিতা। যার ব্যবসা সে সামলে নিচ্ছে, অর্জন করছে গ্রাহকপ্রিয়তা। নিরামিষভোজীদের এই ঠিকানা থেকে জগন্নাথ ভোজনালয়ে রসনাবিলাসের অভিজ্ঞতা জানাচ্ছেন শিবলী আহমেদ

তাঁতীবাজার বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশাযোগে শিবমন্দির পৌঁছালে নাক বরাবর শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বর বাসুদেব ভবন। এর উল্টো পাশের দালানের দোতলায় অনাড়ম্বর পরিবেশে জগন্নাথ ভোজনালয়। বড় বড় রেস্তোরাঁর মতো এখানে গদি আঁটা চেয়ার নেই। অন্দরসাজের চাকচিক্য চোখ ধাঁধায় না। ড্রেসকোড মেনে চলা বেয়ারা মেনুচার্ট হাতে নিয়ে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ান না। তবে এখানে আছে মুখরোচক নিরামিষের প্রতুলতা। শুধু নিরামিষ পদের এত প্রকরণ হতে পারে, তা জগন্নাথ ভোজনালয়ে না গেলে বোঝা যাবে না। তবে একাদশীর দিনে গেলে সব পদ পাওয়া যাবে না। কাকতালীয়ভাবে আমরা সেদিনেই হাজির হয়েছি। তবু যে কটি পদের আয়োজন ছিল, তা নেহাত কম নয়।
একাদশীর দিন ছাড়া অন্যদিনে এখানে মিলবে সয়াবিন রসা, বড়া, কাঁচকলার রসা, শুক্ত, শজনে তরকারি, কলার মোচার তরকারি, কাঁঠালের ঋতুতে কাঁঠাল তরকারি, বুট, মাষকলাই ও মুগ ডাল, লাউয়ের তরকারি ও বেগুনি। একাদশীর দিনে পাওয়া যাবে পুষ্পান্ন, খিচুড়ি, ছানার রসা, বাদাম ভুনা, ফুলকপির রসা, সাগুদানা ভুনা ও পাঁচ তরকারি। মিষ্টান্ন হলো শ্যামা দানার পায়েস। একাদশীর দিন ছাড়া অন্যান্য দিনেও এ পদগুলো মিলবে।

জগন্নাথ ভোজনালয়ের কর্ণধার নিতাই চন্দ্র পাল

এই দিনের পদগুলোর সঙ্গে অন্যদিনের পদগুলোর পার্থক্য হচ্ছে মসলা ও তেলে। এ দিনে মসলা বলতে শুধু আদা ও কাঁচা মরিচ ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া সয়াবিন তেলের বদলে ব্যবহার করা হয় সূর্যমুখীর তেল। সাধারণ দিনে সয়াবিন তেল ও সাধারণ মসলাদি দিয়েই রান্না করা হয়। তবে পেঁয়াজ ও রসুনের ব্যবহার হয় না কোনো দিনই। হয় না মাছ, মাংস ও ডিমের কোনো পদ। দৈনিক গড়পড়তা ১৬ থেকে ১৭টি নিরামিষ পদ রান্না করেন জগন্নাথ ভোজনালয়ের রন্ধনশিল্পী অভি ঘোষ। রেস্তোরাঁর কর্ণধার নিতাই চন্দ্র পালের কাছে জানা গেল, এখানে অন্নের পদগুলোগুলোর মধ্যে পুষ্পান্ন ও শ্যামা দানার খিচুড়ির চাহিদা বেশি।
পুষ্পান্ন নামটি শ্রুতিমধুর। শুনে কৌতূহলও হয়। ‘পুষ্প’ যোগ ‘অন্ন’, পুষ্পান্ন। তাই এক থালা পুষ্পান্ন নিয়ে বসে পড়লাম টেবিলে। শ্যামা দানা দিয়ে তৈরি হয় এ পদ। দানাগুলো পাওয়া যায় শ্যামা নামের একপ্রকার ঘাসের ফুল থেকে। ভারত থেকে আমদানি হয়। রাঁধতে হয় পোলাওয়ের মতো করেই। সবজি হিসেবে যুক্ত করতে হয় গাজর। সামান্য কাঁচা হলুদ ব্যবহারের কারণে পুষ্পান্নের রঙ হলুদ হয়। এ তথ্য দিয়েছেন অভি ঘোষ। সহপদ ছাড়াই পুষ্পান্ন খাওয়া যায়। তবে সহপদ থাকলে স্বাদ বাড়ে। একজন বেয়ারা একটি ট্রেতে করে ছোট ছোট বাটিতে ছানার রসা, ফুলকপির রসা, সাগুদানা ভুনা, বাদাম ভুনা, এক বাটি আলু ভাজা, পাঁচ তরকারি, আমড়ার চাটনি ও মিষ্টান্ন সাজিয়ে টেবিলে দিয়ে গেলেন। শুরু হলো মধ্যাহ্নভোজ।
কিছুটা সাগুদানার তরকারি পুষ্পান্নে মাখিয়ে নিলে খেতে বেশ লাগে। সাগুদানা ভুনা তৈরিতে ধকল আছে। এ জন্য আগের দিন রাত থেকে দানাগুলো পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হয়। এতে পানি শুষে সেগুলো ফুলে ওঠে। পরদিন সকালে আলুর সঙ্গে মসলাদি মাখিয়ে ভালো করে কষিয়ে তাতে সাগুদানা ঢেলে দিতে হয়। পুষ্পান্নের আরেকটি সহপদ হচ্ছে ছানার রসা। ছানাকে ছোট ছোট কিউব করে কেটে ভালো করে ভেজে নিতে হয়। তারপর সাগুদানা তৈরির কায়দাতেই রান্না করতে হয়। এ ক্ষেত্রে আলুর জায়গায় নিতে হয় কাঁচা পেঁপে। বাদাম ভুনার পদ্ধতিও তাই। তবে এ পদে আলু ও পেঁপে উভয়ই ব্যবহৃত হয়। মুখরোচক আরেকটি পদ হচ্ছে পাঁচ তরকারি। গাজর, পেঁপে, আলু, কচু ও ফুলকপি- এই পাঁচে তৈরি হয় এটি। যা পুষ্পান্নের স্বাদ বাড়ায়। তবে সবচেয়ে বেশি জমে আলু ভাজা দিয়ে খেতে। মুচমুচে আলু ভাজাগুলো পুষ্পান্নের সঙ্গে খেলে একধরনের কুড়মুড়ে স্বাদ পাওয়া যায়। একটু টক স্বাদ পেতে চাইলে নিতে পারেন আমড়ার চাটনি। সব ঋতুতেই তা পাওয়া যাবে না। এখন আমড়ার ঋতু, তাই এই চাটনি। কাঁচা আমের ঋতু হলে চাটনি হতো কাঁচা আমের।
পুষ্পান্ন খেতে না চাইলে শ্যামা দানার খিচুড়িও খেতে পারেন। পার্থক্য হচ্ছে, পুষ্পান্ন হলো ভুনা খিচুড়ির মতো আর শ্যামা দানার খিচুড়ি হয় পাতলা। পাতলা খিচুড়িতেও কাঁচা হলুদ যোগ করা হয়। তবে যা-ই খান, শেষ পাতে পাবেন দই ও শ্যামা দানার পায়েস। দই তো হরহামেশাই খাই। তাই মিষ্টিমুখ করলাম শ্যামা দানার পায়েশ দিয়ে।
জগন্নাথ ভোজনালয়ের নিরামিষের পদগুলো খেয়ে তাদের খাবার বিষয়ে লিখতে বসেছি। স্বাদ এখনো জিভে লেগে আছে। খাবারের দামও আহামরি নয়। পদ বুঝে নিরামিষের একেক বাটির দাম পড়বে ১৫ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে। মাত্র ২০০ টাকায় দুজন মানুষের ভরপেট খাওয়া হয়ে যাবে। রয়েছে পার্সেল সুবিধাও। এ ছাড়া এখান থেকে সূর্যমুখী তেল, শ্যামা দানাসহ নিরামিষ রান্নার বিভিন্ন উপকরণ কেনা যেতে পারে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের অনেকেই এখানে সপরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব নিয়ে খেতে আসেন। বেলা ২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভিড় থাকে।
সামনেই দুর্গাপূজা বলে তাঁতীবাজারে পূজার শপিং করতে আসা মানুষ এখানে ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন। তাই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভিড় লেগেই আছে। ছয় বছর আগে অর্থাৎ ২০১২ সালে যাত্রা শুরু করেছিল জগন্নাথ ভোজনালয়। সেই থেকেই তাঁতীবাজারের ওই ১১০ নম্বর ভবনের দোতলাতেই আছেন তারা। এর কোনো শাখা নেই। আপাতত শাখা বিস্তারের ইচ্ছাও নেই নিতাই চন্দ্র পালের। মাত্র পাঁচজন কর্মচারী নিয়ে পরিচালিত হয় নিরামিষের এই আয়োজন।

ছবি: দেবরাজ দেব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top