skip to Main Content

ফিচার I ডিজিটঅল ডিমান্ড

‘ডিজিটঅল: ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটি’। এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের থিম। জানিয়েছে জাতিসংঘের অঙ্গ সংস্থা ইউএনওম্যান। এই ডিজিটাল যুগে উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন, শিক্ষায় লৈঙ্গিক সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও বালিকার ক্ষমতায়নের দাবি রেখে। কীভাবে অর্জন করা সম্ভব? জানাচ্ছেন ইফফাত জাহান অন্তরা

এই বছরের নারী দিবসের স্লোগান—‘EmbraceEquity’ অর্থাৎ ন্যায্যতাকে আলিঙ্গন করা। সব ক্ষেত্রে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হলে এর ক্ষেত্রগুলো নিয়েও নতুন করে ভাবা দরকার। বর্তমান সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনলাইন স্পেস, যা শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সীমাবদ্ধ নয়; এটিকে সব ব্যবহারকারীর জন্য কীভাবে নিরাপদ ও সুরক্ষিত করা যায়, তা নিয়ে চিন্তাভাবনা ও কাজ করার পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন।
পড়াশোনা, চাকরি, ব্যবসা থেকে শুরু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন কাজ আমরা এখন অনলাইনে করে থাকি। আর্থসামাজিক ইস্যু হোক অথবা রাজনৈতিক আলাপ কিংবা প্রতিদিন ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনা নিয়ে অনলাইনে আলোচনা বর্তমানে খুবই সাধারণ বিষয়। আগে যেমনটা চায়ের দোকানে কিংবা পাড়ার মোড়ে আলাপ হতো, সময়ের বাস্তবতায় সে রকম অনেক আলাপ এখন অনলাইনে করে থাকি। এতে একদিকে যেমন আলোচনায় অংশ নেওয়া মানুষের সংখ্যা বেড়েছে, অন্যদিকে অনলাইন শুধু যোগাযোগের মাধ্যম থেকে ক্রমশ উন্মুক্ত সামাজিক স্থান বা বলা যায় পপুলার স্পেসে পরিণত হচ্ছে; যা আমাদের আর্থসামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রগুলোকে এবং চিন্তা-ভাবনা ও আচার-আচরণকে প্রভাবিত করছে।
আশঙ্কাজনক বিষয় হলো, এই স্থান বা স্পেসে সহিংসতা ও হয়রানিমূলক আচরণের মাধ্যমে খুবই নিয়মতান্ত্রিকভাবে নারী এবং লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের মানুষদের সমান অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর একটি গবেষণায় জানা গেছে, বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৭৩ শতাংশ নারী কোনো না কোনো রকম সাইবার সহিংসতার শিকার হয়ে থাকেন। কোভিড-১৯ সময়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে (বিটিআরসির পরিসংখ্যানমতে এপ্রিল-সেপ্টেম্বর ২০২০ সময়কালে প্রায় ২৮ মিলিয়ন নতুন মোবাইল ইন্টারনেট সাবস্ক্রাইবার যুক্ত হয়েছিল), তেমনি এই সময়ে নারী ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের মানুষের প্রতি সহিংসতা এবং হয়রানিমূলক আচরণও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, যা উঠে এসেছে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পরিচালিত গবেষণায়।
ব্ল্যাকমেলিং, অনুমতি ছাড়া ফটোশপড ছবি প্রকাশ, আপত্তিকর মেসেজ পাঠানো, উদ্দেশ্যমূলক অনুসরণ যা আগে থেকেই সাইবার অপরাধ ও হয়রানির মধ্যে ছিল। এগুলো ছাড়াও নতুন যে সহিংসতার ধরন আমরা দেখতে পাই, তা হলো নারী ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের মানুষদের পাবলিক প্রোফাইলে অথবা পাবলিক পোস্টে নোংরা গালি লেখা, যৌন হয়রানিমূলক কমেন্ট করা, ধর্ষণের হুমকি দেওয়া, যৌন উদ্দেশ্যমূলক মিম বা ট্রল করা, ধর্ম বা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে হয়রানিমূলক কমেন্ট করা, ইনবক্সে নোংরা ছবি বা মেসেজ পাঠানো এবং দলবদ্ধ আক্রমণ। হয়তো কোনো নারী তারকা কোনো ছবি পোস্ট করেছেন, সেখানে যেমন এসবের বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়; আবার নারী ইনফ্লুয়েন্সার, কনটেন্ট ক্রিয়েটর, ব্লগার অথবা সাধারণ একজন মানুষের পোস্টেও এ ধরনের সহিংসতা ঘটতে দেখা যাচ্ছে। আবার অনলাইন নিউজ পোর্টালের কমেন্টেও এই হয়রানি ঘটছে। নারীবাদ অথবা লৈঙ্গিক সমতা নিয়ে কথা বললে অথবা লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের কোনো মানুষ যদি নিজেকে বহিঃপ্রকাশ করেন, সে ক্ষেত্রে এই সহিংসতা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। কাপড় বিক্রির উদ্দেশ্যে ফেসবুকে লাইভ ভিডিও করা একজন তথাকথিত ‘মেয়েলি’ পুরুষ অথবা একজন ট্রান্সজেন্ডার নারী মেকআপ ভিডিও প্রকাশ করায় যেভাবে আক্রমণের শিকার হচ্ছেন, তাতে এটা সুস্পষ্ট, এই সহিংস আচরণের একটি লৈঙ্গিক পরিপ্রেক্ষিত রয়েছে এবং সেটি চিহ্নিত করা খুবই জরুরি।

যে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আমরা দেখছি, সেখানে এই ধরনের সহিংসতা একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে অনলাইন বা ডিজিটাল স্পেসে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। শিক্ষা ও কাজ, যা মানব উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য—দুটোই এখন প্রযুক্তিনির্ভর। অনলাইনের লৈঙ্গিকভিত্তিক সহিংসতা ও হয়রানি এই উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। তাই ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে অনলাইন স্পেসকে নারী, পুরুষ ও সব লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের মানুষের জন্য নিরাপদ এবং সবার সমান অংশগ্রহণের পথকে সুগম করতে হবে।
হয়তো দ্রুত এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন কঠিন, তবে কাজগুলোতে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে। প্রথমত ডিজিটাল লিটারেসির সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন, যাতে মানুষ নিজেকে নিরাপদ রেখে কীভাবে অনলাইন মাধ্যম ব্যবহার করবে, সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট জ্ঞান রাখতে পারে। দ্বিতীয়ত, অনলাইনের হয়রানি ও সহিংসতাকে লৈঙ্গিকভিত্তিক সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত করা এবং প্রয়োজনীয় আইনি সহায়তা নিশ্চিত করা। দেখা গেছে, অনলাইনে সহিংসতার একটি বড় কারণ, এখানে পর্দার আড়ালে থেকেই এ ধরনের আচরণ করা যায়, যা হয়তো সামনাসামনি করত না এবং এর কোনো সাজা হয় না। অপরদিকে, নারী সহিংসতার মুখোমুখি হলে তা চেপে যাওয়ার একটি মনোভাব থাকে; কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী নারী দোষারোপের শিকার হন। আর লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের মানুষের তো এসব ক্ষেত্রে কথা বলা এবং অভিযোগ জানানোর সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। এসব ঘটে নারী ও লৈঙ্গিক বৈচিত্র্যের মানুষদের হেয় করে দেখার মানসিকতা, সামাজিক কাঠামোতে তাদের দুর্বল বা নিচু শ্রেণির ভাবা এবং অসম্মান করার প্রবণতা থেকে।
সর্বোপরি আমাদের জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, পেশা ইত্যাদি নির্বিশেষে মানুষকে সম্মান করার সংস্কৃতি গড়ে তোলা প্রয়োজন, যার শুরু হতে পারে পরিবার ও শিক্ষাব্যবস্থায় লৈঙ্গিক সমতাভিত্তিক আচরণ অনুশীলনের মাধ্যমে।

লেখক: সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি), ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top