skip to Main Content

ফিচার I তেল ছাড়া রান্না

দোষ-গুণ দুটোই আছে তেলের। কিন্তু তেল ছাড়া রান্না করা খাবার খাবেন কীভাবে? জানাচ্ছেন শিবলী আহমেদ

দৈনন্দিন রান্নায় তেল ব্যবহার অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। সব দেশেই। তেলের যে পুষ্টিমান নেই, তা নয়। বিপরীতে এটি হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতি ওজন, বদহজম, গ্যাস্ট্রিক, ক্যানসারসহ নানা রোগের সৃষ্টি করতে পারে। অর্থাৎ, তেল খাওয়ার পক্ষে যুক্তি যেমন আছে, বিপক্ষেও আছে। শুধু মনে রাখতে হবে, পুষ্টিহীনতা ও অতি পুষ্টি গ্রহণ উভয়ই সমস্যা। দোষ-গুণে ঠাসা এ তরলের আবিষ্কার তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে। বিভিন্ন উদ্ভিদ, ফল, শস্য রোদ বা আগুনের তাপে রেখে তেল বের করার পদ্ধতি মানুষ আয়ত্ত করেছিল প্রাচীনকালেই। ওই সময় ইউরোপিয়ানরা জলপাই থেকে তেল তৈরি করতে পারত। দুই হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে চীন ও জাপান সয়াবিন তেলের হদিস পায়। এর আগে মানুষ সম্ভবত তেল ছাড়াই রান্না করত। কেননা, রান্না করে খাওয়ার চল শুরু হয় আরও ১ লাখ ২০ হাজার বছর আগে। দক্ষিণ আফ্রিকায়। মানুষ আবার তেল ছাড়া রান্নার দিকে ঝুঁকছে। তেলের অপ্রাপ্তির জন্য নয়, স্বাস্থ্য সুরক্ষায়। বিশেষ করে কোলেস্টেরল যাদের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাদের জন্য তেল ছাড়া রান্না যেন রন্ধনশিল্পের আশীর্বাদ।
এ রান্না সম্ভব। খাবারের স্বাদ আর পুষ্টিমান থাকে অটুট। এ সত্য মানতে অনেকেই নারাজ। কিন্তু তেল ছাড়া রান্না করলে খাদ্যের পুষ্টিমানের কোনো হেরফের হয় না। দ্বিতীয়ত, রান্নার স্বাদ ও পুষ্টিমান নির্ভর করে মসলায়, তেলে নয়। গবেষক ও শেফরা এসব কথা স্বীকার করেছেন।
তেলের ট্রাইগ্লিসারাইড নিয়েই যত ভয়। সব ধরনের ভোজ্যতেলেই এই উপাদান বিদ্যমান। মানুষের রক্তে নানা ধরনের চর্বি থাকে। ট্রাইগ্লিসারাইড সেগুলোর একটি। খাদ্য গ্রহণের ফলে শরীরে যে অতিরিক্ত ক্যালরি সৃষ্টি হয়, সেগুলো ট্রাইগ্লিসারাইডে রূপান্তরিত হয়ে মেদকোষে শক্তি হিসেবে সঞ্চিত থাকে। প্রয়োজনের সময় বেরিয়ে এসে শক্তির জোগান দেয়। কিন্তু শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বেড়ে গেলে বিপদ। ভাত বেশি খাওয়া, চিনিজাতীয় খাবার অতিরিক্ত খাওয়া, কায়িক শ্রমের ঘাটতি, হাইপোথাইরয়েডিজম, ডায়াবেটিস, লিভারের রোগ, জিনগত সমস্যা, ধূমপান, মানসিক চাপ, অ্যালকোহল এবং রান্নায় তেল খাওয়ার জন্য শরীরে ট্রাইগ্লিসারাইডের পরিমাণ বাড়তে পারে।
শরীরে পুষ্টির জন্য দৈনন্দিন খাবারের মাত্র ১৮ শতাংশ তেল প্রয়োজন। লিভারে কিছু পরিমাণ তেল উৎপন্ন হয়। বাকিটা শাকসবজি ও ফলমূল থেকেই পাওয়া সম্ভব। খাবারে এমনিতেই চর্বি লুকানো থাকে। তাই রান্নায় তেল ব্যবহার না করলেও চলে। যাদের বয়স ২০ পেরিয়ে গেছে এবং যারা বৃদ্ধ, তাদের জন্য তেল ছাড়া রান্না উপকারী।
তেল ছাড়া রাঁধতে মূলত পানি ব্যবহৃত হয়। আমিষ-নিরামিষ রাঁধতে প্রয়োজন হবে নন-স্টিকি প্যান। এ ধরনের কড়াই ছাড়া রান্না হবে না। কেননা, এর তলানিতে মসলা বা রান্নার অন্যান্য উপাদান আটকে যায় না। কড়াই গরম করে তাতে জিরা ভেজে নিন। জিরাগুলো যতক্ষণ না সশব্দে ফাটছে এবং লাল রঙ ধারণ করছে, ততক্ষণ ভাজুন। তাতে পেঁয়াজবাটা দিন এবং মাঝেমধ্যে পানি ছিটিয়ে দিতে থাকুন। এরপর আদা ও রসুনবাটা দিন। এ উপাদানগুলো ভাজতে ভাজতে ধূসর বর্ণ ধারণ করবে। ভাজার মাঝে মাঝে অল্প পরিমাণ পানি যোগ করে নাড়তে থাকুন। বেশি পানি একসঙ্গে দেওয়া যাবে না। এরপর হলুদগুঁড়া মিশিয়ে দিন। শেষে অন্যান্য মসলা, যেমন লবণ, লাল মরিচের গুঁড়া, ধনেগুঁড়া যোগ করুন। এভাবে তেল ছাড়া মসলা কষানো হবে। মূল কাজ শেষ। এবার সবজি রাঁধতে চাইলে কষানো মসলায় সবজি দিয়ে নাড়তে থাকুন। প্রয়োজনমতো পানি দিয়ে ফুটিয়ে নিলেই হয়ে যাবে তেল ছাড়া সবজি রান্না। ওই মসলা দিয়ে ডালও রান্না করা যাবে। সে ক্ষেত্রে সেদ্ধ বা ভেজানো ডাল মসলায় দিন। পরিমাণমতো পানি দিয়ে ফুটিয়ে নিলেই তেল ছাড়া ডাল রান্না হয়ে যাবে। মাছ বা মাংস রান্না করতে চাইলে ওই মসলার মধ্যে মাছ বা মাংস ঢেলে দিয়ে নাড়তে থাকুন। প্রয়োজনমতো পানি দিয়ে ঝোল তৈরি করে নিন। তাতে গরমমসলা, লবঙ্গ, জায়ফল, জয়ত্রী, এলাচিসহ পছন্দের মসলা যোগ করুন। কিছুক্ষণ চুলার উপর রেখে দিলেই তেল ছাড়া আমিষ রান্না হয়ে যাবে। আমিষ-নিরামিষ ছাড়াও তেল ব্যবহার না করে স্যুপ, ডেজার্ট, খিচুড়ি, পোলাও রান্না সম্ভব। এ ছাড়া হালুয়া, ফিরনি, সেমাইসহ প্রায় সব ধরনের মিষ্টান্নই হয় তেল ছাড়া।
ডাক্তারের পরামর্শ না নিয়ে তেল ছাড়া রান্না না খাওয়াই ভালো। আগেই বলেছি তেলের কিছু ভালো দিক আছে। ভিটামিন কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন এ, বি, সি, ডি, ই ও কে। এসব ভিটামিনের মধ্যে বি এবং সি হচ্ছে পানিতে দ্রবণীয়। বাকিগুলো তেল বা চর্বিতে। অর্থাৎ, ভিটামিন এ, ডি, ই এবং কে আমাদের শরীরে তখনই কাজ করে, যখন এগুলো তেলের সংস্পর্শে আসে। রান্নায় তেল যোগ না করলে এ চারটি ভিটামিন মানুষের শরীরে অকেজো হয়ে যেতে পারে। হিতে বিপরীত হতে পারে। কারণ, এ চারটি ভিটামিন আমাদের শরীরে অসামান্য ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন এ দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। রাতকানা রোগের বিরুদ্ধে এ ভিটামিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রায় সবাই অবগত। হাড়ের গঠনে ভিটামিন ডি এর জুড়ি নেই। প্রজনন ক্ষমতার সুরক্ষায় চাই ভিটামিন ই। রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে ভিটামিন কে। এসব ভিটামিন যেন শরীরে যথাযথভাবে কাজ করতে পারে, সে জন্য তেল খাওয়া জরুরি। রান্নায় হোক কিংবা ড্রেসিংয়ে, কিছু পরিমাণ তেল খাওয়া চাই-ই চাই। লক্ষ রাখতে হবে পরিমাণ যেন বেশি হয়ে না যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, দৈনিক কতটুকু তেল গ্রহণযোগ্য। একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীরে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩৫ মিলিলিটার তেল প্রয়োজন। সয়াবিন, সূর্যমুখী কিংবা জলপাইয়ের তেল গ্রহণ করতে পারেন। কখনোই ডালডা, ঘি বা গরু-খাসির চর্বি নয়।
পরিশেষে বলা চলে, রান্নায় তেল ব্যবহার করা বা না করার সিদ্ধান্ত নিজের মতো করে না নেওয়াই ভালো। শরীরের পরিস্থিতি বুঝে একজন পুষ্টিবিদই এ বিষয়ে সঠিক উপদেশ দিতে সক্ষম।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top