skip to Main Content

ফিচার I নিরপেক্ষতার পোশাক

মেয়েরা ছেলেদের পোশাক পরার চল শুরু করেছিল। ছেলেরা আজ সে পথেই যাচ্ছে। মানে, তারা পরতে শুরু করেছে মেয়েদের পোশাক। মুছে যাচ্ছে ফ্যাশনের লৈঙ্গিক সীমারেখা। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার

এখনকার আলোচিত ট্রেন্ড জেন্ডার নিউট্রাল আউটফিট। কয়েক বছর ধরে খুব দাপটের সঙ্গে চলছে এই ধারা। এটা কিন্তু পুরুষের পোশাকের মতো দেখতে নারীর পোশাক নয়, বরং এমন পরিধেয় যা নারী-পুরুষ সবাই পরতে পারে। ধারাটি চালু করে মেয়েরাই, এখন ছেলেরাও মেয়েদের পোশাক পরে ফ্যাশনে রীতিমতো একটা বিপ্লব ঘটিয়েছে। কিন্তু এক দিনেই ট্রেন্ডটি প্রতিষ্ঠা পায়নি। এর পেছনে রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের ইতিহাস। আধুনিক নারীদের কাছে সব সময় সমাদৃত হয়েছে পুরুষের পোশাক। যদিও আগে মেয়েদের প্যান্ট পরা আমাদের সমাজে প্রীতিকর ছিল না। আর এখন মেয়েরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের পছন্দের পোশাকটি মেন’স সেকশন থেকে কিনছে। আর ছেলেরা সাহস করে পরছে স্কার্ট, গাউন। সংশ্লিষ্ট গবেষকদের মতে ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ হচ্ছে জেন্ডার নিউট্রাল আউটফিট।
পটভূমির এক টুকরো
মধ্যযুগে নারী যোদ্ধারা পুরুষের পোশাক পরেই লড়াই করত। স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে নারী ভাইকিং যোদ্ধা আর নাবিকদের বলা হতো ‘শিল্ড মেইডেন’। এটা ১২০০ বছর আগের কথা। শিল্ড মেইডেনরা ছিল ভয়ংকর যোদ্ধা। পুরুষ ভাইকিংদের পোশাক পরেই তারা যুদ্ধ করত। হয়েছিলেন ফ্রান্সের ত্রাতা ‘জোয়ান অব আর্ক’-এর বেলায়েও ঘটেছিল তাই। সাহিত্যেও পাওয়া যায় নারীদের পুরুষের পোশাক পরার কথা। খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক শেক্সপিয়ারের মার্চেন্ট অব ভেনিস, টুয়েলফথ নাইট, অ্যাজ ইউ লাইক ইট—এই তিনটি নাটকে ক্রস ড্রেসিংয়ের উল্লেখ আছে। এগুলোয় নারীরা পুরুষ সেজেছিল। যাতে রক্ষণশীল সমাজে তারা অবাধে চলাফেরা করতে পারে, মুক্তভাবে কথা বলতে পারে এবং নিজের বুদ্ধি দিয়ে বিপদের মোকাবিলা করতে পারে।
সতেরো শতকের দিকে নারীদের মধ্যে রাইডিংয়ের অভ্যাস বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তখন তারা রেডিনগোট নামের লং কোট পরত, যা দেখতে অনেকটা মিলিটারি ইউনিফর্মের মতো ছিল। তখন অনেক নারীই তাদের যুদ্ধরত স্বামী বা আত্মীয়ের ইউনিফর্ম পরত দেশপ্রেম প্রকাশের জন্য।
উনিশ শতকে নারীরা সমাজে নিজেদের অবস্থানের ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠল। ভোটের অধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য দেশে দেশে আন্দোলন শুরু হলো। আমেরিকাতে প্রথম এলিজাবেথ স্মিথ মিলার টার্কিশ ট্রাউজার পরে জনসমক্ষে আসার সাহস দেখান। সেই সময় নারীদের সাধারণ পোশাক ছিল ভারী এবং পরতে গেলে অনেক সময় ব্যয় হতো। মিলার মনে করেছিলেন, প্রচলিত পোশাক নারীদের জন্য একটা ফাঁদ। পরবর্তীকালে তার বন্ধু এবং আমেরিকাতে নারী স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা এমেলিয়া ব্লুমার মিলারের এই টার্কিশ ট্রাউজার পরাকে সমর্থন করেন এবং অন্যান্য নারীকে এটি পরার জন্য উৎসাহিত করেন। তাই এই ট্রাউজারের নামই হয়ে যায় ‘ব্লুমারস’।
বিশ শতকের প্রথমার্ধে কিছু তথাকথিত ‘স্টাইল ট্রাইব’ নারী ছিলেন যারা পুরুষের পোশাক পছন্দ করতেন। আজকের সময় এসে তারা হয়ে উঠেছেন ফ্যাশন আইকন। কোকো শ্যানেল প্রথমে ফ্যাশনে নারীদের জন্য প্যান্ট নিয়ে আসেন। তার মতে, ঘোড়ায় চড়া আর ভ্রমণের জন্য প্যান্টের চেয়ে আরামদায়ক পোশাক আর একটাও হয় না। এ ছাড়া তিনি নাবিকদের স্ট্রাইপ টি-শার্টকে করেছেন জনপ্রিয়। ত্রিশের দশকে মারলিন দিয়েত্রিচ আর ক্যাথরিন হেপবার্নের মতো জাঁদরেল অভিনেত্রীরা স্পোর্টিং স্যুট আর বো টাই পরে মুভিতে হাজির হয়েছেন। চল্লিশের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৬ মিলিয়ন সৈন্য আমেরিকা থেকে ইউরোপে যান। তখন তাদের শূন্যস্থানগুলো পূরণের জন্য বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে নারী কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়। কাজের সুবিধার জন্যই তারা জিনস প্যান্ট, ওভারঅল বেছে নেন। ষাট ও সত্তরের দশকে তরুণদের মধ্যে বিদ্রোহ হয়ে ওঠে ‘ওয়ে অব লাইফ’। নারীরা পুরুষদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করে, কিন্তু প্রাপ্য সম্মান বা মজুরি তাদের দেওয়া হচ্ছিল না। এরই জের ধরে শুরু হলো নিউ ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট। আর হিপ্পি মুভমেন্ট তো ছিলই। এই সময়টাতেই ফ্যাশনে শুরু হলো ক্রস জেন্ডার লাইন। নারী-পুরুষ সবাই এক রকম টি-শার্ট, পঞ্চো, ওয়াইড লেগ ডেনিম প্যান্ট পরা শুরু করলেন। এভাবেই ফ্যাশন একই সঙ্গে হয়ে উঠল প্রতিবাদ আর নিজস্বতা উৎপাদনের ভাষা।
যা চলছে
ফেমিনিস্ট মুভমেন্ট থেকে যে জেন্ডার নিউট্রাল পোশাকের ধারা শুরু হয়, তা এখন অন্যমাত্রায় চলে গেছে। একসময় নারীরা পুরুষদের পোশাক বেছে নিয়েছিলেন। আর এখন পুরুষেরা ধারণ করেছেন নারীর পোশাক নিজেদের অন্যভাবে তুলে ধরতে এবং সুপ্ত নারীত্বকে প্রকাশের জন্য। শুরুটা ওই ৬০-৭০ দশকে। তাদের ক্ষেত্রে পথটা ছিল একটু কঠিন। সমকামী পুরুষদের থেকে শুরু হয়েছিল দেখে অনেকে ভাবে, শুধু তারাই নারীদের পোশাক পরে। কিন্তু না। যেসব পুরুষ সমকামী নয়, তারাও বেছে নিচ্ছেন এমন পোশাক। তারা মনে করেন, কেবল পোশাকে পৌরুষের প্রকাশ ঘটে না। জারেড লেটো, জাডেন স্মিথ, হ্যারি স্টাইল, ইজরা মিলারের মতো সেলিব্রিটিরা রেড কার্পেট আর ফ্যাশন শোর ফার্স্ট রো আলোকিত করছেন নারীদের পোশাক পরে। গুচি, এইচঅ্যান্ডএম, জারা, আলেক্সান্ডার ম্যাককুইন, প্রাডা, জ্য পল গতিয়েরের মতো বিখ্যাত ব্র্যান্ড জেন্ডার ইনক্লুসিভ ড্রেস প্রমোট করছে। এ ছাড়া আজেন্ডার, নিকোপান্ডা, টেলফার, টুগুড, ওয়ান ডিএনএ, র‌্যাড হওরানি ইত্যাদি ব্র্যান্ডের বিশেষত্বই হচ্ছে জেন্ডার নিউট্রাল বা ইউনিসেক্স আউটফিট।
ডেনিম বা লেদার জ্যাকেট, ব্লেজার, টাক্সিডো, ওভারঅল, ওভারসাইজড জিনস বা টি-শার্ট—এগুলোই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় জেন্ডার নিউট্রাল আউটফিট। আর বোল্ড স্টেটমেন্ট তৈরিতে ছেলেরা বেছে নিচ্ছে মেয়েদের স্কার্ট, ড্রেস, ব্লাউজ, পালাজো ইত্যাদি। তবে সব মহলে এর গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হতে আরও অনেক সময় লাগবে। শুধু পোশাকে নয়, অ্যাকসেসরিজেও। মেয়েরা তো অনায়াসে ছেলেদের বুট, বড় চেইনের ঘড়ি, বেসবল ক্যাপ নিজেদের করে নিয়েছে। অন্যদিকে ছেলেরা কান ফুটিয়ে দুল পরছে (যদিও এ ধারা অনেক আগে থেকেই চলছে) আর ফেমিনিন কাট নেকলেস, চুড়ি, ব্যাগ বেছে নিচ্ছে।
জেন্ডার নিউট্রাল পোশাক যারা পরেন, তাদের মতে ফ্যাশনে কোনো লৈঙ্গিক সীমারেখা থাকা ঠিক নয়। কে কী পরবে না পরবে, তা একদমই তার নিজস্ব নির্বাচন। নারীদের প্যান্ট পরা একসময় যেমন ছিল দৃষ্টিকটু, পুরুষের ক্ষেত্রেও এখন একই বাস্তবতা লক্ষ করা যাচ্ছে। তবে নারীদের মতো খুব বেশি কথা কিন্তু শুনতে হচ্ছে না তাদের। এভাবে ভবিষ্যতের ফ্যাশন ধীরে ধীরে জেন্ডার নিউট্রাল হয়ে উঠবে।

মডেল: আসিফ ও নাজ
ওয়্যারড্রোব: ব্রোক্
মেকওভার: পারসোনা
ছবি: সৈয়দ অয়ন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top