skip to Main Content

ফিচার I পয়লা পুরাণ

মা-ছেলের গল্পে গল্পে বাংলা, বাঙালি, বাংলা ভাষা আর বঙ্গরসনার চৌহদ্দি আমাদের ঘুরিয়ে দিলেন কলকাতার হ্যাংলা হেঁশেলের সাংবাদিক পাঞ্চালি দত্ত
-মা, হোয়াট ইজ নববর্ষ? বাপির মুখে ক’দিন ধরেই শুনছি- নববর্ষের প্ল্যানিং…খাবার-দাবার…ঘুরতে যাওয়া। ইজ ইট অ্যানি ফেস্টিভ্যাল?
সাত বছরের বিট্টুকে মা জড়িয়ে ধরে চকাস করে দুই গালে দুটো চুমু। আহা! কী মিষ্টি যে প্রশ্নটা। বিট্টু, ‘নব’, কথাটার অর্থ ‘নিউ’ আর ‘বর্ষ’ শব্দের অর্থ হলো ‘ইয়ার’। তার মানে নিউ ইয়ার অর্থাৎ নতুন বছর।
-মা, নতুন বছর সেলিব্রেশন তো অলরেডি শেষ। ৩১ ডিসেম্বর আমরা ক্রাকারস পোড়ালাম কমপ্লেক্সের সবাই মিলে, ডিনার করলাম, বেলুন ওড়ালাম, ড্যান্স করলাম।
-ওটা হলো খ্রিস্টীয় নিউ ইয়ার। আর ১৫ এপ্রিল হলো বাঙালিদের নববর্ষ। (১৪ এপ্রিল বাংলাদেশের পয়লা বৈশাখ বা নববর্ষ) অর্থাৎ বেঙ্গলি নিউ ইয়ার। সেদিন থেকে আমরা গুনতে শুরু করি নতুন বছরের পুজো-পার্বণ, বিয়ে ইত্যাদির তারিখ ও মাস।
-তাহলে মা, দু-দুটো নিউ ইয়ার ইন ওয়ান ইয়ার।
-না, বিট্টু, একেক জাতি একেকভাবে তাদের নববর্ষ উদ্‌যাপন করে। তারিখ এবং দিনও আলাদা। সেটা হতে পারে তাদের ব্যবসায়িক সুবিধার্থে কিংবা রীতি অথবা নতুন ফসলের সূত্রে। যেমন- তেলেগুতে নববর্ষকে বলা হয় ‘উগারি’, মহারাষ্ট্রে ‘গুড়িপাওয়া’, পাঞ্জাবে ‘বৈশাখী’, তামিলনাড়ুতে ‘পুতাণ্ড’, আসামে ‘বহাগ বিহু’, গুজরাটে ‘বেসতু বরষ’ ইত্যাদি।
তোকে অনেক বছর আগেকার কথা বলছি। পয়লা বৈশাখকে তখন ঋতুধর্মী উৎসব হিসেবে গণ্য করা হতো। কৃষি ফলনের ওপর নির্ভর করে উৎসবটি উদ্‌যাপন করা হতো। ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হিজরি পঞ্জিকা অনুযায়ী কৃষিকাজ সম্পর্কীয় যাবতীয় হিসাব, খাজনা আদায় করা হতো। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষিকাজের সঙ্গে মিলতো না। ফলে কৃষকদের অসময়ে খাজনা মেটাতে বাধ্য করা হতো। বিষয়টি শৃঙ্খলাবদ্ধ করতে এবং খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরবর্তীকালে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ নামে পরিচিতি লাভ করে। আবার অন্যমতে, বঙ্গাব্দের আগের নাম ছিল শশাকাব্দ। অর্থাৎ রাজা শশাঙ্কের অভিষেক-উৎসবের দিনটি বঙ্গাব্দের প্রথম নববর্ষ। মত যাই-ই হোক না কেন, উৎসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল খাজনা আদায় শেষে প্রজাদের একটি নির্দিষ্ট দিনে খাওন-দাওন পর্ব ও মনোরঞ্জন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে জমিদার বাড়িতেও উদ্‌যাপিত হতো নববর্ষ। সারা বছরের মানসিক ও শারীরিক শোষণকে ভুলিয়ে দিতে এই একটি দিনের জন্য রাজা, শাসক কিংবা জমিদার হয়ে উঠতেন উদার মনের মানুষ।
বিট্টু হাঁ করে তাকিয়ে রয়েছে মায়ের মুখের দিকে। গোগ্রাসে গল্প গিলছে। মা আরেক দিন শোনাবে কৃষকদের নানা কথা? বিট্টু বাবার মুখে শোনে তাদের জীবনের সংগ্রাম, মরে যাবার গল্প, আত্মহত্যার কাহিনি। নাহ্, বিট্টু আজ থেকে থালায় ভাত ফেলে আর উঠবে না।
-কী হলো বিট্টু, কী ভাবছ?
-মা, এবার পয়লা বৈশাখে চাষিদের জন্য তুমি কিছু রান্না করবে। আমরা সেই সব খাবার নিয়ে যাব ওদের গ্রামে।
-বিট্টু, এক দিনের খাবারে ওদের গোটা বছর কি পেট ভরবে? ভালো করে পড়াশোনা করো। তারপর তাদের জন্য কী ভালো কাজ করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবো। আমি তোমার পাশে তো রয়েইছি। একটু সিরিয়াস হয়ে গেলাম বোধ হয় না রে? জানিস তো, হুতোম প্যাঁচার নকশায় কালিপ্রসন্ন সিংহ লিখেছিলেন, ‘ইংরেজরা নিউ ইয়ারের বড় আমোদ করেন। আগামীকে দাড়াগুয়া পান দিয়ে বরণ করে ন্যান- নেসার খোঁয়ারির সঙ্গে পুরানকে বিদায় দেন। বাঙালিরা বছরটি ভালো রকমেই যাক আর খারাবেই শেষ হোক, সজনে খাড়া চিবিয়ে ঢাকের বাদ্দি আর রাস্তার ধুলো দিয়ে পুরানকে বিদায় দ্যান। কেবল কলসী উচ্ছুগ-কর্তারা আর নতুন খাতা ওয়ালারাই নতুন বৎসরের মান রাখেন।’
তবে এরপর দৃশ্যপট বদলেছে। বাঙালিরা সার্বিকভাবে তুমুল আনন্দে উদ্‌যাপন করে নববর্ষ। পয়লা বৈশাখের সকালে আমার মা নিম ও হলুদ বেটে তেলের সঙ্গে মাখিয়ে রাখতো। সেদিন সকাল বেলায় স্নান না করলে কোনো খাবারেই দাঁতে কাটতে দিত না মা। ফলত হলুদ মেখে স্নান করে নতুন জামা পরে তারপর বড়দের প্রণাম সারতাম। পেটে তখন ইঁদুরদৌড়। সঙ্গে জিভে জল গড়াতে শুরু করেছে। রান্নাঘরে ভোর থেকে মা, ঠাকুমা, কাকিমারা ষোড়শপচার জোগাড়ের ব্যবস্থায় তুমুল কাণ্ড বাধিয়েছে। বাঙালিরা এখনো চেষ্টা করে নবর্ষকে একেবারে খাঁটি বাঙালিয়ানায় উপভোগ করতে। সেটা বেশভূষাই হোক কিংবা খাবার। বাঙালি রেস্তোরাঁয় তাই উপচে পড়ে মানুষ।
কর্মরত মহিলাদের জন্য এটা একদিকে সুবিধে। বাঙালি রেস্তোরাঁগুলোয় আজকাল অনেক পুরোনো দিনের রান্না পাওয়া যায়। যার ফলে ঘর-বাইর সামলে যারা সেই সব রান্না করে উঠতে পারেন না, তারা চলে যান এ ধরনের বাঙালি রেস্তোরাঁয়। তবে দুঃখ একটাই বিট্টু। বর্তমানে বাঙালির কাছে ভাষার কোনো কদর নেই, নেই এই ভাষাকে রপ্ত করার ইচ্ছে। আজকাল এক বাঙালি আরেক বাঙালির সঙ্গে কথা বলে ইংরেজিতে। আমরা পরপর সাজিয়ে বাংলার বারোটা মাস বলতে পারি না। এমনকি যে মুহূর্তে আমরা নববর্ষ উদ্‌যাপন করছি, অনেককেই জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারবে না কোন সনে পড়লো। একটানা বৃষ্টি হলে অনুমান করি, এ মাস হয়তো বা আষাঢ় কিংবা শ্রাবণ; গরম পড়লে চৈত্র-বৈশাখ…আশ্বিনে পুজো। পরবর্তী প্রজন্ম সেটাও কতটুকু বলতে পারবে আমার আশঙ্কা। বাংলা ভাষা ছিল একটা মিষ্টি জলের স্রোতসি^নী নদীর মতো, যা বর্তমানে শীর্ণকায়।
তার উত্তর? জীবিকার জন্য যে নেই দরকার বাংলা ভাষার। তাই যেখানে পেট কা সওয়াল, সেখানেই ইজ্জত কা সওয়াল।
ক’দিন আগে বাংলাদেশ ঘুরে এলাম। তাদের ভাষার প্রতি এখনো যে কত টান রয়েছে, সেটা বুঝলাম প্লেন থেকে নেমে। চারপাশে লেখা রয়েছে বাংলা হরফ। তাঁরা যে প্রাণের বিনিময়ে ভাষাকে রক্ষা করতে পেরেছে। নাহ্, বিট্টু, আজ তোর মা বড্ড বেশি বকছে। চল লিস্ট, থুুড়ি, তালিকা বানাই। নববর্ষে রান্না করতে হবে না বুঝি!
-মা, কাগজ-কলম নিয়ে আসি?
-লেখ, প্রথমে শসার শুক্তো, তারপর বেগুনি, চালকুমড়োর পুর, ভেটকির পাতুরি, মাছের কালিয়া, কষা মাংস, চাটনি আর শেষ পাতে মিষ্টি দই ও সন্দেশ। এবারে কাগজটা দেখি। ওমা, খালি পেজ, কিচ্ছু লিখিস নি যে!
-মা, আমি যে বাংলা লিখতে পারি না। দু’চোখ ভরে জল গড়াচ্ছে। দায়ী কারা? দায়িত্ব কাদের? ছোটদের জীবনের প্রথম শিক্ষাটাই যে বাড়ি থেকে। আঁচলে চোখ মুছে ধরা গলায় বিট্টুকে হাত ধরে বললাম- কথা দিলাম, আগামীকাল থেকে আমি তোমায় শেখাবো বাংলা।
শসার শুক্তো: ঝিরিঝিরি করে শসা কেটে নুন মাখিয়ে নিন। কড়াইতে তেল ও ঘি গরম করুন। তাতে সর্ষে ফোড়ন দিন। এবারে শসা ছাড়ুন, ঢেকে দিয়ে রান্না করুন। যখন শসা সেদ্ধ হয়ে যাবে, আধ চা-চামচ ময়দা জলে গুলে ছড়িয়ে দিন। চিনি দিয়ে ভালো করে নাড়িয়ে নিন। নামানোর আগে সব ভালো করে ফেটিয়ে ছড়িয়ে নাড়াচাড়া করে নামিয়ে ফেলুন।
চালকুমড়োর পুর: চালকুমড়ো অর্ধচন্দ্রাকার করে স্লাইস করুন। এপিঠ-ওপিঠ বঁটিদা দিয়ে কয়েকবার চিরে নিন। চালকুমড়োর মাঝখানে অর্ধেকটা কেটে পকেট করুন। তাতে কাঁচালঙ্কা, নারকেল বাটা, নুন মাখিয়ে একসঙ্গে পুর ভরুন। ময়দা গুলে তাতে কালিজিরা, নুন ও শুকনো লঙ্কাগুঁড়া মেলান। গরম তেলে লাল করে ভেজে নিন।
ভেটকির পাতুরি: ভেটকির ফিলে ধুয়ে লেবুর রস, নুন, হলুদ, নারকেল, সর্ষে ও কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মাখিয়ে কলাপাতায় পুরে বেঁধে নিন সুতা দিয়ে। তেল গরম করে এপিঠ-ওপিঠ খুব ভালো করে ভাজুন। কলাপাতা কালো হয়ে এলে বুঝবেন যে পাতুরি হয়ে এসেছে।

ছবি: লেখকের সৌজন্যে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top