skip to Main Content

ফিচার I ফোক-পপের যুগলবন্দি

ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত লোকশিল্প নাগরিক অনুষঙ্গে পপুলার আর্টের চেহারা নেয়। সেই ফোক আর্ট ও পপুলার আর্টের দুনিয়ায় নানা এক্সপেরিমেন্ট করে চলেছে বাংলার ‘যথাশিল্প’। লিখেছেন অনার্য তাপস

লোকশিল্প নিয়ে নাগরিক পরিসরে একধরনের নস্টালজিয়া কাজ করে। সেই নস্টালজিয়া কেমন, সেটা পরিষ্কার না হলেও একটি বিষয় পরিষ্কার যে মানুষ লোকশিল্প নিয়ে ভাবে, অন্তত ‘শিকড়ের জিনিস’ মনে করেও একবার ফিরে তাকায়। এই ফিরে তাকানোর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
মানুষ, নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ভাবধারা- সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের একটি স্বতন্ত্র ইমেজ রয়েছে পৃথিবীর বুকে। শিল্পরীতি বা শিল্পচর্চার ক্ষেত্রেও তার বৈচিত্র্য দেখা যায়। জামদানিসহ বিভিন্ন বস্ত্রের বয়ন, সূচিকর্ম, বাঁশ-বেত-কাঠ ইত্যাদি শিল্পের আলাদা গল্প আছে। শিল্প, শিল্পী, উপভোক্তা- এই তিন স্তরের মিথস্ক্রিয়ারও আলাদা গল্প রয়েছে। লোকশিল্পের ক্ষেত্রে এই গল্পটা তৈরি হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলকে কেন্দ্র করে, ভূমিরূপ আর প্রাকৃতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে। আর নাগরিক পরিসরে সেই গল্পটা তৈরি হয় ‘আইডেনটিটি’র কথা মাথায় রেখে। সে কারণেই মানুষ হয়তো লোকসংস্কৃতি বা লোকশিল্পকে ‘শিকড়ে’র জিনিস বলে মনে করে। নাগরিক পরিসরে লোকশিল্প অবশ্য নানা সময় ‘পপুলার আর্ট’-এর আকার পায়। রিকশাচিত্র ও সিনেমার ব্যানার চিত্র ইত্যাদির মতো নগরকেন্দ্রিক লোকশিল্প, যেগুলো মূলত আমাদের লোকশিল্পের নাগরিক অভিযোজন- যা লোকশিল্প ও গণশিল্পের স্তর অতিক্রম করে পপুলার আটের স্তরে পৌঁছায়।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অর্থনীতির অবাধ গতিপ্রবাহ, হাতের মুঠোয় আরও বৈচিত্র্যময় ব্যবহারিক অনুষঙ্গ, লোকশিল্পের প্রাত্যহিক ব্যবহার উপযোগিতা হ্রাস ইত্যাদি নানামুখী কারণে আমাদের লোকশিল্পের স্বাভাবিক প্রবাহ এখন প্রায় রুদ্ধ। অথবা অনেক ক্ষেত্রে মৃতপ্রায়। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, এ রকম এক সময়ে আমরা নতুন কিছু উদ্যোগ দেখতে পাই আমাদের শহরে, যে উদ্যোগ কিছুটা হলেও আমাদের মনে আশার আলো তৈরি করে। অন্তত আমরা এটা ভাবতে পারি যে লোকশিল্প, যাকে আমরা শিকড়লগ্ন বলে মনে করি, সেটি বিলুপ্ত হবে না কখনো। অন্তত ভিন্ন ধারায় হলেও তার একটা স্রোত থেকে যাবে আমাদের গর্ব করার বিষয় হিসেবে।
আমাদের এই শহরে লোকশিল্প ও তার পরম্পরায় তৈরি হওয়া নগরকেন্দ্রিক পপুলার আর্টের নতুন ধারার চর্চা অব্যাহত। এই চর্চায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে ‘যথাশিল্প’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। শিল্পী ও গবেষক শাওন আকন্দের নেতৃত্বে। লোকশিল্পের মোটিফ কিংবা ডিজাইন নিয়ে কাজ করার ইতিহাস আমাদের দেশে বা আমাদের শহরে নতুন কোনো বিষয় নয়। তাহলে ‘যথাশিল্প’র গুরুত্বের জায়গা কোনটি? এককথায় বলতে গেলে, এক্সক্লুসিভিটি।
একটু পেছনের গল্প বলা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে লোকশিল্পের বিভিন্ন মাধ্যম, সেগুলোর বর্তমান অবস্থা, শিল্পীদের অবস্থা, বিপণনব্যবস্থার নতুন পন্থা ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করে চলেছেন শিল্পী শাওন আকন্দ। এসব বিষয়ের ওপর ইতিমধ্যে তার কিছু বইপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন শিল্পমাধ্যম এবং শহরকেন্দ্রিক লোকশিল্প (যেমন সিনেমার ব্যানার ও রিকশাচিত্র) নিয়ে মাঠপর্যায়ের গবেষণা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সেই সব মাধ্যমের নতুন অভিযোজনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন শাওন। নতুন অভিযোজনের মধ্য দিয়ে মৃতপ্রায় শিল্পমাধ্যমগুলোকে নতুন রূপে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব বলে একসময় বিশ্বাস করতে শুরু করেন তিনি। সেই বিশ্বাস থেকে শুরু করেন পরীক্ষা-নিরীক্ষা। জামদানি অঞ্চলে কাজ করেছেন দীর্ঘদিন। নিরীক্ষা শুরু হয় সেখান থেকেই। জামদানি বস্ত্রকে শাড়িতে সীমাবদ্ধ না রেখে তিনি তৈরি করেন স্কার্ফ। কিন্তু প্রথম দিকে সেটা করতে গিয়ে দেখা যায়, জামদানি স্কার্ফ ব্যবহারের জন্য ঠিক জুতসই হচ্ছে না। শুরু হয় নতুন কাজ। কয়েকবারের চেষ্টায় মূল জামদানিকে অক্ষুণ্ন রেখে, নকশার আভিজাত্য ধরে রেখে তা দিয়ে ব্যবহার উপযোগী স্কার্ফ তৈরি করতে সফল হন তিনি। এরপর তিনি শুরু করেন সিনেমার ব্যানার পেইন্টিংকে ভিন্নতর মাধ্যমে অভিযোজনের কাজ। একের পর এক নিরীক্ষা শুরু হয়। ঢাকা শহরের গুরুস্থানীয় সিনেমার ব্যানার পেইন্টারদের নিয়ে শুরু হয় একের পর এক কর্মশালা। রঙের দীর্ঘস্থায়িত্ব নির্ধারণ, সিনেমার ব্যানারের মূল মেজাজকে অক্ষুণ্ন রাখা, কোন মাধ্যমে সিনেমার ব্যানারের স্টাইলকে ঠিক রেখে নতুন করে কাজ করা যাবে- দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে বিষয়গুলোর সুরাহা হয়। তারপর পরীক্ষামূলকভাবে তৈরি হয় বিভিন্ন জিনিস। সেগুলোর ফলাফল দেখে শুরু হয় তার বাণিজ্যিক উৎপাদন।
ঠিক একইভাবে পাটসহ বিভিন্ন উপাদান নিয়ে চলে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা। এর মধ্যে দেশে ও দেশের বাইরেও চলে নিরন্তর অনুসন্ধান। কুষ্টিয়া-রাজশাহীর নকশিকাঁথা, আফ্রিকার স্টোন আর্ট থেকে শুরু করে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা-মারমা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন শিল্পকর্ম দেখা, উপাদান-উপকরণের খোঁজখবর করা, উপাদানগত কৌশলের বিষয়ে জানাবোঝা চলতে থাকে। সমান তালে চলতে থাকে সিরাজগঞ্জ-পাবনা-টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন অঞ্চলের বস্ত্রবয়ন, ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীসহ ইউরোপের বিভিন্ন মিউজিয়াম ও জনগোষ্ঠীর শিল্পকর্ম দেখা। এই ব্যাপক অনুসন্ধান থেকে সংগ্রহ করা অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো শুরু হয় ‘যথাশিল্প’র জিনিসপত্র তৈরিতে। তবে শাওন ও তার দল যে বিষয়টিতে ব্যাপক মনোযোগ দেন, সেটি হলো শিল্পের অবিকৃতি। জামদানি নকশিকাঁথা, সিনেমার ব্যানার, রিকশাচিত্র, সরাচিত্র ইত্যাদি লোকশিল্পের যে মাধ্যমই হোক না কেন, নকশার মোটিফগুলো যেন অবিকল থাকে, দর্শনে কিংবা স্পর্শে যেন প্রকৃত শিল্পের অনুভব হারিয়ে যান্ত্রিক না হয়ে যায়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয় যথাশিল্পের তৈরি বিভিন্ন পণ্যে।
লাইফস্টাইল ও ফ্যাশন- এই দুই ক্ষেত্রেই সমান তালে পণ্য তৈরি করছে ‘যথাশিল্প’। দুই মাধ্যমের পণ্যেই তারা এনেছে নতুন ধারা, নতুন চমক। সাধারণ এবং বিভিন্ন দিবসকেন্দ্রিক উপহারসামগ্রীর জায়গায় তাদের নতুন ধরনের পণ্য মনোযোগ আকর্ষণ করেছে ক্রেতাদের। নকশিকাঁথার নোটবুকের ক্ষেত্রে যথাশিল্প তৈরি করেছে নিজস্ব ট্রেন্ড।
ইতিমধ্যে ঢাকা ও কলকাতার বিভিন্ন মেলায় তাদের জামদানি স্কার্ফ, নকশিকাঁথার নোটবুক, সাঁওতালচিত্রের পেন ও টিস্যু হোল্ডার, সিনেমার ব্যানার চিত্রের টুল, গয়নাসহ বিভিন্ন পণ্য প্রশংসা কুড়িয়েছে দর্শক-ক্রেতা-ডিজাইনারদের কাছে। এই ঈদে আসছে তাদের আরও নতুন প্রডাক্ট। ধানমন্ডির বেঙ্গল বই ও শৈলী, গুলশানের ইউনিমার্টের আউটলেটে ‘যথাশিল্প’ কর্নারে এবং মোহাম্মদপুরের আদাবর ১০-এ তাদের নিজস্ব আউটলেটে পাওয়া যাচ্ছে ‘যথাশিল্প’র জিনিসপত্র।

ছবি: যথা শিল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top