skip to Main Content

ফিচার I বাংলার সুরযন্ত্র

বাঙালির নিজস্ব বাদ্য কম নয়। এই ঐতিহ্য হাজার বছরের বেশি আগের। লিখেছেন দীপান্বিতা ইতি
বাজনা গানের সহযোগী। তবে গান ছাড়াও বাজনা বাজে, যাকে বলা হয় যন্ত্রসংগীত। অন্যদিকে, শোভাযাত্রা, শবযাত্রা, যুদ্ধযাত্রা ইত্যাদিতে প্রাচীনকাল থেকেই বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার লক্ষণীয়। কিন্তু যেখানেই বা যে উদ্দেশ্যেই বাজুক, বাজনায় বাদ্যযন্ত্র লাগে।
খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দে রচিত ভরতের নাট্যশাস্ত্রে বাদ্যযন্ত্রকে চার শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছিল: ঘন বাদ্য, আনদ্ধ বাদ্য, শুষির বাদ্য ও তত বাদ্য। ঘন বাদ্য ধাতু দিয়ে তৈরি। কাঁসর, ঘণ্টা, করতাল, মন্দিরা ইত্যাদি বাদ্যের উদাহরণ। আনদ্ধ বলতে বোঝায় চামড়া দিয়ে ঢাকা বাজনা। সোজা কথায় পারকাশন ইনস্ট্রুমেন্ট। ঢাকঢোল, তবলা, মৃদঙ্গ- প্রভৃতি এই ভাগে পড়ে। শুষির বাদ্য বাজাতে হয় বাতাসের সাহায্যে। সাধারণত যন্ত্রের গায়ের একটা ফুটোতে ফুঁ দিয়ে বাজানো হয়। বাঁশি, সানাই, শাঁখ- এগুলো সব শুষির বাদ্য। আর তারের বাদ্যযন্ত্রকে বলে তত বাদ্য। যেমন সেতার, তানপুরা, সরোদ।
বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক উৎস থেকে বাংলায় বাদ্যযন্ত্রের বিভিন্নতা ও ব্যবহারের ব্যাপ্তির প্রমাণ পাওয়া যায়। নওগাঁর পাহাড়পুর (খ্রি. ৮-১২ শতক), কুমিল্লার ময়নামতিতে (খ্রি. ৭-১২ শতক) পাওয়া পোড়ামাটির ফলক ও পাথরের ভাস্কর্যে উৎকীর্ণ নানা মানব বা দেব-দেবীর মূর্তির সঙ্গে বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, যেমন কাঁসর, করতাল, ঢাক, বীণা, বাঁশি, মৃদঙ্গ ও মৃৎভান্ড ইত্যাদির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। দশম শতাব্দীতে রচিত বাংলা ভাষার প্রথম নিদর্শন চর্যাপদে গীত-নৃত্য-বাদ্যের বর্ণনা রয়েছে। চর্যার তিনটি পদে মোট সাতটি বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ আছে: বীণা, পটহ, মাদল, করন্ড, কসালা, দুন্দুভি ও ডমরু। ত্রয়োদশ শতকে রচিত ‘শূন্যপুরাণে’ পূজা উপলক্ষে ঢাক, ঢোল, কাড়া, মৃদঙ্গ, মন্দিরা, ডমরু, দুন্দুভি, বরঙ্গ, ভোর, ধীরকালি, শঙ্খ, শিঙ্গা, জয়ঢাক, দামামা, খমক প্রভৃতিসহ বিয়াল্লিশ ধরনের বাদ্যযন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে।
মধ্যযুগে উপমহাদেশে মুসলমান শাসকদের আগমনের ফলে প্রচলিত ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে। বাদ্যযন্ত্র এর বাইরে ছিল না। সানাই ও নহবতজাতীয় যন্ত্র মুসলমানদের অবদান। পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসনামলে এ দেশের সংগীতে পাশ্চাত্য প্রভাব দেখা যায়। বর্তমানে বহুল ব্যবহৃত হারমোনিয়াম, বেহালা, গিটার, বিউগল ইত্যাদি সেই সাক্ষ্য বহন করে।
বিশেষ কায়দায় দীর্ঘ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে আয়ত্তে আনতে হয় যে বাদ্যযন্ত্র, তা স্বয়ংসিদ্ধ বাদ্য। আর যে বাদ্যচর্চা জীবনাচরণ ও লোকাচারের অংশ, তা অনুগতসিদ্ধ বাদ্য। সব স্বয়ংসিদ্ধ বাদ্য যেমন শাস্ত্রীয় নয়, আবার সব অনুগতসিদ্ধই লোকবাদ্য নয়। তাল-লয়-সুর প্রকাশে শাস্ত্রীয় বাদ্য অনেকটা স্বাধীন এবং তা লোকসংগীতেও ব্যবহৃত হতে পারে। কিন্তু লোকবাদ্য শাস্ত্রীয় সংগীতে সংগত করা ততটা বৈশিষ্ট্যধারী হয়ে ওঠেনি। বলা যায়, শাস্ত্রীয় বাদ্যকে পদ্ধতিগত অনুশীলনের মধ্য দিয়ে বশে আনতে হয়। লোকবাদ্যে এর প্রয়োজন হয় না। আর এই অনুগতসিদ্ধ বাদ্য অর্থাৎ লোকবাদ্য যন্ত্রের ধরন ও ব্যবহারের বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ বাংলা ও বাঙালি।
বাংলার লোকবাদ্য বাজানো হয় কবিগান, পালাগান, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদি, মারফতি, মাইজভান্ডারি, সাঁওতালি, বাউল, ঝুমুর, ভাদু, টুসু ইত্যাদি গানে। আবার দুর্গাপূজা, রাস উৎসব, লীলাকীর্তন, দোতরা গান, গম্ভীরা, কুষাণ, যাত্রাগান, বিচারগান, লাঠিখেলা, নৌকাবাইচ, মেয়েলি গীত, বিবাহযাত্রা, শোভাযাত্রা, নাটগীত, মনসার ভাসান ইত্যাদি অনুষ্ঠানেও বাজানো হয়। এ দেশে কত ধরনের বাদ্য ছিল, তা হিসাব করে বলা যাবে না। অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখনো যা আছে, তা-ও দুই শর কম হবে না। বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদে যেসব বাদ্যযন্ত্রের নাম জানা যায়, তা হলো পটহ, একতারা, ঢোল, হেরুক বীণা, ডমরু, বাঁশি, মাদল, নেউর বা নূপুর, করন্ড, কশালা, দুন্দুভি, ডমরুলি ইত্যাদি। মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যে সবচেয়ে বেশি লোকবাদ্যের নাম জানা যায়। দামামা, দগড়, রগড়, ঢাক, ঢোল, খোল, ডম্ফ, বীণা, কাঁশি, বাঁশি, ডুগডুগি, করতাল, ঘণ্টা, মৃদঙ্গ, ভেউরি, ঝাঁঝরি, কাড়া, জয়ঢাক, শঙ্খ, তাসা, ঢেমচা, খেমচা, পাখোয়াজ, মাদল, রামসিঙ্গা, জগঝম্প, শানাই, মুহরি, রাক্ষসী ঢাক, দুন্দুভি, খঞ্জনি, খমক, তবল, তুরি, ভেরি, রণসিঙ্গা, টিকারা, টঙ্কার, মোচঙ্গ, কাহাল, পটহ, বরগা, মন্দিরা, মুহরি, মুরলি বা বংশী, নূপুর, ভেউর, করনাল, পিনাক, সাহিনী, স্বরমন্ডল, দোতারা, সেতারা, কাংশ্য, সানি, দড়মসা, ভেউর, বিষাণ, মরুজ, পাঢ়া, করড়া, টিকারা, ধাঙসা, কাকল, সারিন্দা, খটক, কিঙ্কিণি-কঙ্কণ, ভরঙ্গ, চুড়ি, তম্বুরা, কপিনাশ, ঘুঙুর, নৌবত, সিংহা, বিপঞ্চা, ঝাম, বর্গেল প্রভৃতি।
শুধু লোকসংগীতই নয়, পূজা-পার্বণ, ক্রীড়া-উৎসব, ব্যবসা, শিক্ষা, যোগাযোগ, প্রজ্ঞাপন- সর্বক্ষেত্রেই লোকবাদ্যের অপরিহার্যতা লক্ষ করা যায়। কিছু পেশায় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। যেমন সাপুড়েরা তুবডি বাজিয়ে সাপের খেলা এবং বাজিকরেরা ডুগডুগি বাজিয়ে বানর-ভালুকের খেলা দেখায়। ফেরিওয়ালা ও সার্কাসের জোকাররা পায়ে ঘুঙুর বেঁধে যথাক্রমে পণ্য ফেরি করে ও তামাশা দেখায়; জুড়ি ও খঞ্জনি বাজিয়ে বৈষ্ণব-বৈরাগী ও ভিখারিরা ভিক্ষা করে। বাদ্যযন্ত্রকে কেন্দ্র করে বাংলার লোকসমাজে নানা আচার-সংস্কারও প্রচলিত আছে। শঙ্খ ও সানাই কল্যাণকর বাদ্যযন্ত্র হিসেবে গণ্য হয়; আবার রাতে বাঁশি বাজানো অমঙ্গলজনক বলে একটি সংস্কারও প্রচলিত আছে। এভাবে লোকজীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে লোকবাদ্যের পরিবেশনানির্ভর সম্পর্ক সভ্যতার সূচনা থেকেই।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এত বিচিত্র বাদ্যযন্ত্র পাওয়ার কারণ বাঁশ, কাঠ, লোহা, তামা, চামড়া, মাটি, বেত ইত্যাদির সহজলভ্যতা ও প্রাচুর্য। লোকবাদ্যযন্ত্রের উপকরণ নিতান্তই প্রাকৃতিক এবং এর গঠন-প্রণালিও সহজ-সরল। লাউয়ের খোল, বেল বা নারকেলের মালা, বাঁশ, কাঠ, নল, পাতা, মাটি, লোহা, পিতল, সুতা, তার, শিং, শঙ্খ প্রভৃতি উপাদান দিয়ে এসব বাদ্যযন্ত্র নির্মিত হয়। সুতা, ঘোড়ার লেজের লোম, তার দিয়ে একতারা, দোতারা, বেনাজাতীয় ততযন্ত্র; বাঁশ ও নল দিয়ে বাঁশি ও তুবডি জাতীয় শুষিরযন্ত্র; কাঁসা, পিতল প্রভৃতি ধাতব পদার্থ দিয়ে খঞ্জনি, ঘণ্টাজাতীয় ঘনযন্ত্র এবং গরু, ছাগল ও সাপের চামড়া দিয়ে ঢাক, ঢোল, মাদল জাতীয় আনদ্ধযন্ত্র নির্মিত হয়। কিছু বাদ্যযন্ত্রে প্রাকৃতিক উপাদান প্রায় অবিকৃত থাকে, যেমন শঙ্খ ও শিঙ্গা। তালপাতা দিয়ে পাতাবাঁশি তৈরি হয়। মাটির সাধারণ হাঁড়ি বা ছোট কলসিও তালবাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। কচি আমের আঁটি ঘষে ভেঁপু তৈরি করা হয়।
বাংলার লোকবাদ্যের বেশির ভাগই বিলুপ্ত। যেগুলো টিকে আছে, সেগুলো বিপন্ন দশায় আছে। জীবনধারা পরিবর্তন, বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব, বাদ্যযন্ত্রের ডিজিটালাইজেশন, প্রশিক্ষণ ও চর্চার অভাব, দুষ্প্রাপ্যতা- সবকিছু মিলিয়ে বাংলার এই সাংস্কৃতিক উপাদান আজ বিলুপ্তির পথে। পুরান ঢাকার যতীন অ্যান্ড কোং প্রতিষ্ঠানের নবকুমার সাহার মতে, লোকজ সংগীতচর্চায় সবার আগ্রহ দিন দিন কমছে। এই জায়গা দখল করেছে ইলেকট্রিক যন্ত্র। ব্যবসা এখনো চলছে, তবে তিনি শঙ্কায় আছেন কত দিন চালাতে পারবেন। শাঁখারীবাজারের আদি বুদ্ধ অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী উত্তম কুমার বলেন, ‘দেশীয় বাদ্যযন্ত্র বাজানোর শিক্ষা গুরুমুখী বিদ্যা। গুরুর অধীনে প্রশিক্ষণ ও চর্চার প্রয়োজন। আজকাল সাধনা করে কয়জন? সস্তা জনপ্রিয়তার পেছনেই ছুটছে প্রায় সবাই। এমনকি বাবা-মায়েরাও সন্তানের হাতে বাদ্যযন্ত্র না দিয়ে শুধু পড়াশোনা করিয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বানাতে ব্যস্ত। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নেই, বাদ্যযন্ত্র সংরক্ষণ, প্রদর্শনী ও প্রশিক্ষণে নেই কোনো উদ্যোগ। তাহলে কী করে বাঁচবে এ শিল্প?’
তবে বাদন পদ্ধতি ও নির্মাণ-কৌশল জানা থাকলে বেঁচে থাকবে বাংলার বাদ্যযন্ত্র- এমন কথা বিশ্বাস করেন জলের গানের গায়ক, নাট্যকর্মী, চিত্রশিল্পী ও যন্ত্রশিল্পী রাহুল আনন্দ। বিদেশি যন্ত্রের আগ্রাসন ও দেশজ বাদ্যের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের গোঁড়া সমর্থক আমি নই। সংগীতের কোনো সীমা নেই, সীমান্ত নেই। তবে নিজের সন্তানকে আদর করার সুখটা আর কিছুতে নেই। দেশীয় বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে মনের ভাবটা বোঝাতে পারলে আমি কেন গান কম্পোজিশনের জন্য সিনথেসাইজারের কৃত্রিম স্বর নিয়ে মাতামাতি করবো? তার জন্য আমাদের বাজনা থেকে শব্দ সংযোজন করার মানসিকতা থাকতে হবে। লোকবাদ্যের সঙ্গে লোকজীবনের ভাব-দর্শন ও সত্তার যুগ-যুগান্তরের যোগ। এত সহজে তো এসব বিলুপ্ত হবার নয়।’
একতারা, দোতারা, বাঁশি, তুবড়ি, বীণা, সানাই, সিঙ্গা, কাঁসর, মন্দিরা, করতাল, খঞ্জনি, ঢাক, ঢোল, খোল, মাদল, ডুগি, তবলা- এগুলো পূর্বসূরিদের নানা সুখ-দুঃখের সাক্ষী হয়ে এসে পৌঁছেছে আমাদের হাতে। কেবল তা-ই নয়, এগুলো বাঙালির সাংস্কৃতিক সত্তার তাৎপর্যপূর্ণ অংশ। বাংলার ঐতিহ্য এতেই ধ্বনিত হয়।

ছবি: লেখক ও সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top