skip to Main Content

ফিচার I বান্ধগলা

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সমন্বয়ে এর বিকাশ। হাল ফ্যাশনে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। ফিউশনের নানা ধাপ পেরিয়ে। লিখেছেন ফাহমিদা শিকদার

উৎসবে ছেলেদের পোশাকের ক্ষেত্রে প্রথমে মাথায় আসে পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, ফরমাল স্যুটের কথা। এসবের ভিড়ে নতুন করে ট্রেন্ডে এসেছে বান্ধগলা। যেকোনো উৎসবে পরার উপযোগী এ পোশাকের বিশেষত্ব এর নেকলাইন। একে আলট্রা ফিউশন আউটফিট বলা যেতে পারে। ঐতিহ্যবাহী পোশাকের বিবর্তনের ফল বান্ধগলা। এখনো এর ধারা বিকাশমান।
বিবর্তনের ফ্যাশন
প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে পুরুষদের পোশাক ছিল আংরাখা। এ থেকে আসে আচকান এবং শেরওয়ানি। ব্রিটিশ ভারতে বিভিন্ন অঞ্চল যেমন রাজস্থান, পাঞ্জাব, দিল্লি, জম্মু, উত্তর প্রদেশ, হায়দরাবাদে রাজবংশ এবং সমাজের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিবর্গের পরিধেয় হিসেবে ছিল এ দুটি পোশাক। ইতিহাসবিদদের মতে আংরাখা, আচকান এবং শেরওয়ানি- তিনটিই ফ্যাশন ফিউশনের ফল। গোল্ডস্মিথ, ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের নৃতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক এমা টারলো ‘ক্লোদিং ম্যাটারস: ড্রেস অ্যান্ড আইডেনটিটি অব ইন্ডিয়া’ বইতে এ সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, পার্সিয়ান বালাবা কিংবা চ্যাপকান বা চ্যাপানোর বিকশিত রূপ ভারতীয় আংরাখা। ব্রিটিশরা ভারতে এলে তাদের প্রভাবে এটি সামনে বোতাম দেওয়া শেরওয়ানিতে পরিণত হয়। ভারতীয় অভিজাতবংশীয় মুসলমানরা বেশি পরত। অন্যদিকে আচকান, যেটি শেরওয়ানি থেকে একটু খাটো, তা উচ্চবংশের হিন্দুদের পরিধান করতে দেখা যেত। আংরাখা বিবর্তনের পর এ দুটি পোশাকেই ব্যবহার করা হয় ম্যান্ডারিন কলার।
এরপরই আবির্ভাব ঘটে বান্ধগলা বা যোধপুরি স্যুটের। ব্রিটিশ শাসনামলে যোধপুর রাজ্যে এর উৎপত্তি। ডিজাইনার স্বয়ং যোধপুরের মহারাজা শ্রী সরদার সিং। এটিকে ধরা হয় এ উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন ইন্দো-ওয়েস্টার্ন ফিউশন পোশাক হিসেবে। ভারতীয় ও পশ্চিমা পোশাকের নিখুঁত সংমিশ্রণ। একে ‘ইস্টার্ন টাক্সেডো’ও বলা হয়। এটি আচকানের খাটো সংস্করণ। পরা হতো যোধপুরি প্যান্টের সঙ্গে। এই প্যান্ট ঊরুর কাছে ঢোলা এবং হাঁটু থেকে গোড়ালি পর্যন্ত চাপা। বান্ধগলা নাম হওয়ার কারণ এ স্যুটের গলা বন্ধ থাকে। এখানেও দেখা যায় ম্যান্ডারিন কলার।
এই গলা বা কলার মিং রাজবংশের সময় প্রথম দেখা যায়। ১২ শতকের কথা। চিং রাজবংশের সময় এর নানা রকম বিকাশ ঘটে। খাড়া, গোল এবং সামনের দিকে অল্প উন্মুক্ত এই গলা এখন সারা বিশ্বে ম্যান্ডারিন কলার নামেই পরিচিত। যোধপুরি স্যুটের মাধ্যমেই এটি বিখ্যাত হয়। ১৯ ও ২০ শতকে পাশ্চাত্যে এই পোশাক বেশ জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষত গত শতাব্দীর ষাটের দশকে। তত দিনে এর নতুন নাম হয়েছে। নেহরু জ্যাকেট। ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহরুকে লম্বা ফ্লেয়ার আচকানে বেশি দেখা গেলেও দেশের বাইরে তিনি সব সময় পরতেন বান্ধগালা স্যুট।
বিখ্যাত ব্রিটিশ বয় রক ব্যান্ড দ্য বিটলস ষাটের দশকে ব্রিটেনে ট্যুরে বান্ধগলা স্যুটের কাছাকাছি ধরনের পোশাক পরেন। তাদের সেই ধূসর রঙের সিম্পল টেইলরড স্যুট খুব তাড়াতাড়ি তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পায়। হয়ে ওঠে তখনকার মড কালচারের ক্ল্যাসিক ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। ১৯৬৫ সালে নিউইয়র্কের শিয়া স্টেডিয়ামের কনসার্টেও দ্য বিটলসকে আবার দেখা যায় একই পোশাকে।
অন্যদিকে, হলিউডে প্রথম ইস্টার্ন ফ্যাশনের আবির্ভাব হয় বান্ধগলা স্যুটের মাধ্যমে। জেমস বন্ড ফ্র্যাঞ্চাইজির প্রথম মুভি ড. নো-তে শন কনারি পরেন পাঁচ বোতামের বাদামি সিল্কের নেহরু জ্যাকেট। একই ছবিতে জোসেফ ওয়াইজম্যানকে দেখা যায় বোতাম ঢাকা চাপা সাদা রঙের টু পিস বান্ধগলা স্যুটে। এমন একটা মুভির প্রধান দুটি চরিত্রের কস্টিউম হওয়ার জন্যই পুরো দুনিয়ায় স্টাইলটি লুফে নেয়। এরপর অস্টিন পাওয়ারস, স্টার ওয়ারস, গেম অব থ্রোনস, ব্ল্যাক প্যানথার- এসব হলিউডি মুভি ও টিভি সিরিজে বান্ধগলা স্যুটের সরব উপস্থিতি দেখা যায়। অনেক বিখ্যাত সেলিব্রিটি যেমন ভিন ডিজেল, চ্যাডউইক বোসম্যান, হ্যারি স্টাইল, নিক জোনাস বিভিন্ন রেড কার্পেট শোতে ক্যামেরাবন্দি হয়েছেন এই পোশাক পরে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অফিশিয়াল ড্রেস ছিল টু পিস বান্ধগলা। এ দেশের ইতিহাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টে তাঁকে দেখা গেছে এই পোশাকে। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসার সময় তাঁর পরনে ছিল এই স্যুট। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ২৯তম সাধারণ অধিবেশনে তিনি ভাষণ দেওয়ার দিন পরেছিলেন কালো বান্ধগলা স্যুট। নেহরুর মতো দেশের বাইরে গেলে তাঁকে এ পোশাকেই বেশি দেখা যেত।
চলতি ট্রেন্ড
কয়েক দশকে ফ্যাশনে বান্ধগলার অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ম্যান্ডারিন কলার আর এর গঠন ঠিক রেখে অন্য বেশ কিছু দিক বদল ঘটিয়ে এসেছে নতুন ধরনের পোশাক। আবার ট্র্যাডিশনাল বান্ধগলা স্যুটে নতুন ফ্যাব্রিক, প্যাটার্ন যোগ করে আপগ্রেডও করা হয়েছে।
নিও-ক্ল্যাসিক
যোধপুরি স্যুট বা প্রিন্স কোট নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে বেশি দেখা যায় বরের পোশাক হিসেবে। এ ছাড়া অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠান ও উৎসবে অনেকেই পরে এই স্যুট। বিয়েতে বরের সাজে রাজকীয় ভাব আনতে চাইলে বেছে নেওয়া যায় ভেলভেট, সিল্ক বা জ্যাকার্ড ফ্যাব্রিকের ওপর এমব্রয়ডারি বান্ধগলা স্যুট। আমাদের দেশের অনেক ডিজাইনার খাদি, সুতি, ডুপিয়ান সিল্কের বান্ধগলা স্যুট বানাচ্ছেন। এখন আবার এর আচকান স্টাইল অর্থাৎ সাইড বাটন কোট এবং ডাবল ব্রেস্টেড কোট পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া অ্যাসিমেট্রিক হেমলাইনের বান্ধগলা স্যুটও বেশ চলছে। বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। এগুলোকে অ্যাকসেসরিজ করা যায় বোতাম, চেইন আর পকেট স্কয়ারের মাধ্যমে। পাঞ্জাবি এবং শার্ট- দুয়ের ওপরই পরা যায়। পাঞ্জাবির নিচে তো চুড়িদার বা পাজামা থাকেই। শার্টের ক্ষেত্রে পরা যেতে পারে কনট্রাস্ট প্যান্ট। নতুনত্ব আনতে সঙ্গত হতে পারে যোধপুরি প্যান্টে। ভালো মানাবে নেভি ব্লু, মেরুন, ভায়োলেট, কালো এমনকি প্যাস্টেল শেড। এখন আবার নানা রকম ছাপা, বিশেষ করে ফ্লোরাল প্রিন্টের বান্ধগলাও পাওয়া যাচ্ছে। উৎসবে পোশাক হিসেবে বেশ মানাবে এগুলো। চাইলে বিজনেস কনফারেন্সের মতো ফরমাল ইভেন্টে প্লেইন সিল্কের কালো, ধূসর, নেভি ব্লু বান্ধগলা পরা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বটম হিসেবে এক রঙের প্যান্ট পরা যায়।
ওয়েস্ট কোট
ষাটের দশকের পর থেকে বান্ধগলা জনপ্রিয়তা পায় ওয়েস্ট কোট হিসেবেই। শুরু করেছিলেন নেহরু। আমাদের দেশে বঙ্গবন্ধুর সিগনেচার ওয়্যার হয়েছে মুজিব কোটের মাধ্যমে। ম্যান্ডারিন কলারের ছয় বোতামের কোমর পর্যন্ত লম্বা কালো স্লিভলেস বান্ধগলা এই কোট। কিন্তু একই ফিচারের অন্য রঙের পোশাক আবার ওয়েস্ট কোট। ক্ল্যাসিক বান্ধগলা স্যুটের মতো এরও আছে আংরাখা ও অ্যাসিমেট্রিক সংস্করণ। পাঞ্জাবির সঙ্গে এর টুইনিং। এক রং, প্রিন্ট, এমব্রয়ডারি- সব রকমের পাওয়া যায়। পরা যেতে পারে বিয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে ঈদ, পূজা ইত্যাদি উৎসবে। টুইনিংয়ের সময় কনট্রাস্টের কথা মাথায় রাখতে হবে। হালকা ডিজাইনের সাধারণ পাঞ্জাবির সঙ্গে ভারী ফ্যাব্রিক বা এমব্রয়ডারি এবং গাঢ় রঙের ওয়েস্ট কোট বেছে নেওয়া যায়। আবার এর উল্টোটাও হতে পারে। অর্থাৎ হালকা প্লেইন ওয়েস্ট কোট ভারী পাঞ্জাবির সঙ্গে।
শার্ট
এখন অনেক তরুণেরই পছন্দ। ম্যান্ডারিন কলারের স্লিম ভার্সন ব্যান্ড কলার দিয়ে লং স্লিভ বান্ধগলা শার্ট বানানো হয়। ক্যাজুয়াল এবং সেমি-ফরমাল পোশাক হিসেবে এই শার্ট পরা যায়। বটম হিসেবে জিনস, চিনো, সাধারণ ফরমাল প্যান্ট- সবই মানায়। বন্ধুদের আড্ডা বা ছোটখাটো পার্টিতে যেমন পরা যায়, তেমনি বড় কোনো ইভেন্টে ফরমাল স্যুটের নিচেও বেশ ভালো দেখাবে।
মডেল: হাসিন
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: এ জেড
ছবি: ফারাবী তমাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top