skip to Main Content

ফিচার I বিয়ের ফুড রিচুয়ল

বিচিত্র খাবার। বর-কনের জন্য। তাদের যৌথ জীবনকে সুখকর করে তুলতে। পৃথিবীর প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে রয়েছে এ-সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রথা

বিয়ে নিয়ে জানা-অজানা বিচিত্র রীতি ছড়িয়ে আছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। রসনায়ও রয়েছে বৈচিত্র্য। বিয়ের খাবারের সঙ্গে যেমন রয়েছে লোকাচারের সম্পর্ক, তেমনি বিভিন্ন প্রথা ও বিশ্বাস এতে জড়িয়ে আছে। প্রাচীনকাল থেকেই। বর্তমানেও সেসবের রেশ রয়ে গেছে। কেউ নিছক আনন্দের জন্য এসব রীতি মানেন, কেউবা আবার বংশপরম্পরায় পালন করছেন। যেমন দক্ষিণ নাইজেরিয়ার ইগবো উপজাতির একটি খাবার কোলানাট। এটি ঔষধি। ক্যাফেইনে ভরপুর। এটি তারা খায় ক্ষুধা নিবারণ ও শক্তি সংগ্রহের জন্য। বিয়েতে কনেপক্ষ বরপক্ষকে উপহার হিসেবে কোলানাট দেয়। খাবারটিকে নবদম্পতির পারস্পরিক বিভেদ ঘোচানোর প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রথা অনুযায়ী, বর-কনে তাদের বাবা-মায়েদের সঙ্গে একটি কোলানাট ভাগ করে না খাওয়া পর্যন্ত বিয়ে সম্পন্ন হয় না।
গোলাকার ভাতের বল। মিষ্টি। সৌভাগ্য পেতে চাইলে নবদম্পতিকে তা গিলে খেতে হবে। চিবানো যাবে না। এটি চীনাদের বিয়েতে প্রচলিত এক বিশ্বাস। মিষ্টি ভাতের বলকে ‘ট্যাঙ ইউয়ান’ বলে। সুন্দর ও বিপত্তিহীন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে বিয়ের দিন কিংবা তার আগের রাতে এটি খায় বর-কনে। এ ছাড়া চীনে নবদম্পতিকে বুনো রাজহাঁসের মাংস রেঁধে খাওয়ানো হয়। যাতে তারা আজীবন পরস্পরের সঙ্গী হয়ে থাকতে পারে।
বুলগেরিয়ার বিয়েতে রুটি বেশ গুরুত্ব পায়। অনুষ্ঠানের আগের রাতে কনের মা খুব যতেœর সঙ্গে ‘পিটকা’ তৈরি করেন। ভাজার সময় এর ফুলে-ফেঁপে ওঠার ওপর নির্ভর করে নবদম্পতির সুখ। এমন বিশ্বাস প্রচলিত আছে দেশটিতে। এ ছাড়া দম্পতির মাথার উপর বিশাল একটি রুটি মেলে ধরা হয়। বর ও কনে সেটির দুই প্রান্ত ধরে টানেন। ছিঁড়ে যাওয়ার পর যার ভাগে বেশি যায়, দাম্পত্যে তার প্রাধান্য ও আধিপত্য নিশ্চিত হয়।
দক্ষিণ কোরিয়ায় সহজলভ্য দুটি ফল জুজুবে ও চেস্টনাট। বিয়ের পর ‘পাইবায়েক’ নামের অনুষ্ঠানে এগুলোর প্রয়োজন হয়। নববধূ তার শ্বশুরবাড়ির সবাইকে ফলগুলো পরিবেশন করেন। কিন্তু বয়োজ্যেষ্ঠরা তা না খেয়ে নতুন বউয়ের দিকে ছুড়ে মারেন। বধূ সেগুলো নিজের জামায় লুফে নিতে চেষ্টা করেন। যত বেশি নেওয়া যাবে, তত বেশি সন্তানের মা হওয়া যাবে বলে বিশ্বাস করা হয়। এ ছাড়া নবদম্পতির দীর্ঘায়ু কামনা করে ‘কুক সু’ নামের নুডলস খায় দক্ষিণ কোরিয়ানরা।
গ্রিসে বিয়ের অনুষ্ঠানে ক্যান্ডির প্রলেপযুক্ত আমন্ড খাওয়ার চল আছে। এর মিষ্টি ও তেতো স্বাদ দাম্পত্য জীবনের মসৃণ-বন্ধুর পথচলার প্রতীক হিসেবে বিবেচ্য। সেগুলো ছোট ছোট থলে কিংবা রুপার পাত্রে পরিবেশন করা হয়। অতিথিদের হাতে বিজোড় সংখ্যায় তুলে দেওয়া হয় ক্যান্ডি। গ্রিকরা বিশ্বাস করে, বিজোড় সংখ্যাকে পূর্ণসংখ্যায় ভাগ করা যায় না বলে নবদম্পতির সম্পর্কও কখনো ভাগ হবে না। এ ছাড়া সে দেশে নববধূরা নিজের দস্তানায় সব সময় কিছু চিনি লাগিয়ে রাখেন, যাতে দাম্পত্য সুখের হয়।
বিয়ের কেককে সম্পদ, উন্নতি, বিশুদ্ধতা ও সমৃদ্ধির প্রতীক ভাবে বারমুডার মানুষ। এ উদ্দেশ্যে বর সোনালি কাগজে মোড়া কেক বয়ে আনেন। কনে তা নিয়ে আসেন রুপালি কাগজে মুড়ে। পাত্রীর কেকটি এক প্রকার স্থানীয় মদে ভেজানো থাকে।
বিয়েতে একধরনের বিশেষ খাবার খায় ব্রাজিলিয়ানরা। সেটিকে নবদম্পতির মধুর সম্মিলনের প্রতীক ভাবা হয়। খাবারটি দেখতে স্যান্ডউইচের মতো। দুটি ছোট কুকির ভেতরে থাকে মিষ্টি স্বাদের পুর। তা চিনির উপর গড়িয়ে সুন্দর মোড়কে বাঁধা হয়। খাবারটির স্থানীয় নাম ‘বেম ক্যাসাডোস’। যার বাংলা অর্থ ‘ভালোভাবে বিয়ে’। এটি পরিবেশনের আগে অতিথিদের নিজ নিজ ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার অনুরোধ করা হয়।
‘বো টাই’ নামের একটি খাবার বিয়েতে শুভবার্তা বয়ে আনে। এমনটাই বিশ্বাস করেন ইতালীয়দের কেউ কেউ। আটা বা ময়দার খামির তেলে ভেজে চিনির মধ্যে গড়িয়ে খাবারটি বানানো হয়। এ ছাড়া ক্যান্ডি করা আমন্ডে ভরা বাক্স উপহার দেওয়া হয় অতিথিদের। ইতালীয়দের ধারণা, ক্যান্ডিগুলো ভালো-মন্দ মিশেলে যাপিত জীবনের দর্শনকে তুলে ধরে।
মধ্যযুগে ইংল্যান্ডে একটি প্রথার সূচনা হয়েছিল, যা আজও সেখানে রয়ে গেছে। বিয়ের সময় অতিথিরা ছোট ছোট কেক নিয়ে আসেন। সেগুলো চিনি, মধু ও আমন্ডের তেল দিয়ে তৈরি। নবদম্পতি কেকগুলোর উপর চুমু এঁকে দেন। এরপর সেগুলোর উপরিভাগ সংরক্ষণ করা হয়। দম্পতির প্রথম সন্তানকে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার সময় তা কাজে লাগে। এই কেকগুলোকে উর্বরতা ও সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ভাবা হয়। স্থানীয়ভাবে সেগুলো ‘ক্রিশ্চেনিং কেক’ নামে পরিচিত।
হেরিং মাছের ডিম জাপানিদের কাছে পারিবারিক উন্নতির প্রতীক। এ ছাড়া তারা ৯ সংখ্যাকে শুভ মনে করে। এর প্রভাব পড়েছে বিয়ের খাবারেও। জাপানের বিয়েতে একটি বিখ্যাত রীতি হচ্ছে ‘সান-সান-কুদো’। এতে তিনটি ভিন্ন আকৃতির কাপ একটির উপর আরেকটি বসানো থাকে। সেগুলো এক প্রকার মদ জাতীয় পানীয়ে পূর্ণ, যা স্থানীয় ভাষায় ‘সাকে’ নামে পরিচিত। বর-কনে, বরের পিতা-মাতা এবং কনের পিতা-মাতা- এই তিন দম্পতি কাপগুলো থেকে তিন চুমুক করে মদ পান করেন। ফলে ৯ চুমুক পানীয় কমে যায়। অনুষ্ঠানের এ অংশকে দাম্পত্য জীবনের শুভসূচনা বলে গণ্য করা হয়।
আইরিশ বিয়েতে পানীয়র তালিকায় মধুযুক্ত মদ থাকে। একে ‘মিড’ বলে। এটি পৌরুষ ও প্রজননক্ষমতা বর্ধক হিসেবে কাজ করে বলে ভাবা হয়। ইউক্রেনে বিয়ের ঐতিহ্যবাহী খাবার হচ্ছে ‘কোরোভাই’। এটি একধরনের মিষ্টি রুটি। বর ও কনে উভয় বাড়ির মানুষেরা একত্রে রুটিটি খেয়ে জানিয়ে দেন যে তারা একীভূত হয়েছেন। এ ধরনের একটি লোকাচার আছে মেক্সিকোতেও। তারা বিয়েতে যে ‘পোলভোরোন’ খায়, তা একধরনের শর্টব্রেড কুকি। দাম্পত্য জীবন মধুর করে তোলার আশায় ‘সুমান’ ও ‘লেচে ফ্ল্যান’ নামের কিছু মিষ্টি খাবার খায় ফিলিপাইনের বাসিন্দারা। ‘বানহ জুজে’ নামের এক প্রকার মিষ্টি পদ খাওয়া হয় ভিয়েতনামে। দাম্পত্যের বৈবাহিক সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে দেখা হয় এটিকে।
এসব ছাড়াও বিশ্বের নানা দেশের বিয়েতে বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার আছে। যেমন ফরাসি বিয়েতে এক প্রকার কেক থাকে, যেটি আকারে আইফেল টাওয়ারের মতো। ভারতে বিয়ের শুভসূচনা হয় ‘মধুপাক’ নামের প্রসাদ দিয়ে। নরওয়ের ‘ক্রান্সকেক’, মরক্কোর ‘ট্যাজিন’, জার্মানিতে ছোট ছোট মিটবলের সঙ্গে স্যুপ, সুইডেনের ‘প্রিন্সেসটার্টা’- সবই বিয়ের ঐতিহ্যবাহী খাবার। যেগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা ধরনের প্রথা ও বিশ্বাস।

 শিবলী আহমেদ
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top