skip to Main Content

ফিচার I ভাষা সংগ্রামের উপমহাদেশ

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও তার ক্রমপরিণতিতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। বাংলা ও বাঙালির ভাষা ও জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের মতোই গোটা বিশ্বে বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতি ভাষার অধিকারের লড়াই চালিয়েছে। সেই লড়াই আজও অব্যাহত উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তা ভাষার লড়াই যেমন, তেমনি বাঁচার লড়াইও বটে। লিখেছেন অতনু সিংহ

বাংলা ভাষার অধিকার অর্জনের লড়াইকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের আকার দেওয়ার পরিণতিতেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্ম। এটা বিশ্বের ভাষা ও জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক লড়াইয়ের ইতিহাসের মধ্যে সবচেয়ে সফল ও উজ্জ্বল। গোটা বিশ্বের বিভিন্ন জাতিসত্তা তাদের বাঁচার লড়াইয়ের অভিমুখ নির্ধারণ করেছে ভাষা ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করেই। কেননা এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে অর্থনীতি ও জীবনের মৌলিক অধিকার। মাতৃভাষা থেকে গণমানুষকে বিযুক্ত করা হলে জীবনের মৌলিক অধিকারগুলো থেকেই বঞ্চনা করা হয়। এ কারণেই অধিকার অর্জনের লড়াই তথা বাঁচার লড়াইয়ের অভিমুখ অনেকাংশেই ভাষাকেন্দ্রিক। আর তাই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও তার ক্রমপরিণতিতে পুবের বাঙালির জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রামের মতোই গোটা বিশ্বে বিভিন্ন জাতিসত্তা তাদের মাতৃভাষা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম চালাচ্ছে।
প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদী যুগের অবসানের পরে নয়া-উপনিবেশবাদ ও তার রাজনৈতিক পরম্পরায় লিঙ্গুয়িস্টিক ও কালচারাল হেজিমনি শোষণের উপায় হিসেবে প্রকটভাবে হাজির হয়। এ মুহূর্তেও গোটা বিশ্বের বিভিন্ন মডার্ন ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো কনফেডারেশন তথা বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের শর্তকে ধুলায় মিশিয়ে গায়েবি লগ্নিপুঁজির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তার ভাষা ও আঙ্গিককে ঔপনিবেশিক করে তুলছে। ততই তার প্রতিরোধে অস্ত্র হয়ে উঠছে নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ইত্যাদি। কাতালোনিয়ার উত্তাল মুক্তিসংগ্রামের কথা আমরা এ প্রসঙ্গে হাজির করতে পারি। এ মুহূর্তে উপমহাদেশে তামিল, কন্নড়, মিজো, পাঞ্জাবি, সিন্ধি, বেলুচ, মারাঠা, নাগা, কাশ্মীরি জাতিসত্তার ভাষা, গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই জারি রয়েছে। এই লড়াইগুলোর ইতিহাসও রয়েছে। একই সঙ্গে স্কটিশ, আইরিশ, কাতালান ইত্যাদি জাতিসত্তাগুলোর ভাষা সংগ্রাম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের লড়াইয়ের ইতিহাস ও বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল।
উপমহাদেশে বাংলা ভাষার অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে দুটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের সাক্ষী রয়েছি আমরা। প্রথমটা তো পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষার অধিকার অর্জনের আন্দোলন। দ্বিতীয়টি বরাক উপত্যকায়, আসামে। ১৯৬১ সালে। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য আসামে, ১৯৬১ সালে রাজ্য সরকার ঘোষণা করে আসামের একমাত্র সরকারি ভাষা অহমীয়া। এই ঘোষণায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে সেখানকার বাঙালিরা। ঐতিহাসিকভাবে আসাম ছিল বাংলারই অংশ। ব্রিটিশরা আসামকে বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে পৃথক রাজ্যে রূপান্তর করে। পাশাপাশি অহমীয়া মূলত বাংলা ভাষার একটি উপভাষা। তা ছাড়া আসামের শিলচর এলাকায় বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। গোটা আসামে বাঙালিরা বিরাটসংখ্যক জাতিসত্তাগোষ্ঠী। তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষার হককে পদদলিত করে অহমীয়া ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়। সরকারি এই পদক্ষেপের প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল সেখানকার বাঙালিরা। প্রতিবাদস্বরূপ তারা সংগঠিতভাবে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করে দেয়। ১৯৬১ সালের ১৯ মে, শিলচরে সত্যাগ্রহীদের ওপর পুলিশ গুলি চালায়। শহীদ হন ১১ জন ভাষাসংগ্রামী, সত্যাগ্রহী। ১৯৫২ সালের পর ফের ১৯৬১ সালে ভাষার জন্য শহীদ হয়েছিলেন বাঙালিরা। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে দুটি গণ-আন্দোলনে যেভাবে রক্ত ঝরেছে, ভাষার জন্য শহীদ হয়েছেন আন্দোলনকারীরা, ঠিক তেমনটাই ঘটেছে বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষা আন্দোলনে। মণিপুরের ভাষাগুলোর মধ্যে মৈতৈ ও বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষা সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। ১৮১৯-১৮২৫ কালপর্বে বার্মা-মণিপুর যুদ্ধের সময় ব্যাপকসংখ্যক মণিপুরি ছড়িয়ে পড়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও তৎকালীন পূর্ববঙ্গে। ১৯৫০ সাল থেকে আসাম ও ত্রিপুরায় বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। ১৯৫৫ সালে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালু করার দাবিতে গঠিত হয় নিখিল ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি মহাসভা’। এর ঠিক আগে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ত্রিপুরার জনগণনায় বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যাকে এক দশক আগের জনগণনার তুলনায় বহু শতাংশ কম করে দেখানো হয়। ১৯৬১ সালে আসামে এ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। এর ফলে ভাষা বিদ্রোহে বাধ্য হয় সেখানকার যুবসমাজ। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ত্রিপুরা ও আসামে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন ও ভাষা বিদ্রোহ চরম আকার নেয়। ১৯৯২ সালে তৈরি হয় নিখিল ‘বিষ্ণুপুরী-মণিপুরি গণসংগ্রাম পরিষদ’। এই বিদ্রোহ চলে নব্বই দশকের শেষ অবধি। ১৯৯৫ সালে ত্রিপুরা সরকার বিষ্ণুপুরী-মণিপুরি ভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা প্রচলন করে। কিন্তু আসাম সরকার তখনো অনমনীয়। শেষমেশ ২০০১ সালের বরাক উপত্যকার ১৫২টি স্কুলে বিষ্ণুপুরি-মণিপুরি ভাষার ‘কনাকপাঠ’ সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়। ২০০৬ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ে এই ভাষা সাংবিধানিক মর্যাদা পায়। এদিকে ঢাকা তথা পূর্ববঙ্গ কিংবা শিলচর তথা বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা সংগ্রামের উত্তরাধিকার বহন করে কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গে নতুন করে লড়াই শুরু হয়েছে। হিন্দি আগ্রাসন ও হিন্দুত্ববাদের প্রতিরোধ এর লক্ষ্য। বাংলা ভাষার সাংবিধানিক অধিকার ও বাঙালি জাতিসত্তার যুক্তরাষ্ট্রীয় অধিকার অর্জনের প্রশ্নে ফের পশ্চিমবঙ্গের যুবসমাজ সংগঠিত হয়েছে। কেননা পশ্চিমবঙ্গের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা হলো বাংলা ভাষা। এই প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গে ‘বাংলা পক্ষ’সহ কয়েকটি সংগঠন লড়াইয়ের ময়দানে হাজির হয়েছে।
উপমহাদেশের ভাষা সংগ্রামের আলাপে অতি অবশ্যই তামিল ভাষা ও দ্রাবিড়-তামিল জনতার জাতিসত্তার লড়াই উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর সময় থেকেই সমান্তরালে হিন্দি আধিপত্যবাদ ও হিন্দি আগ্রাসনবাদের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই তারা চালিয়েছে। তা আজও জারি রয়েছে। বহু ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, বিশ্বাস, মত ও পথের ভারতবর্ষকে উত্তর ভারত, পশ্চিম ও মধ্য ভারতের একাংশের নেতারা হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান ন্যারেটিভের একমাত্রিক কাঠামোর আকার দিতে চেয়ে ব্রিটিশদের সহায়তায় যে কল্পিত ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চেহারা দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে ভাষা ও সংস্কৃতির লড়াই চালিয়ে আসছে তামিল ভাষাভাষী মানুষ। সেই লড়াইয়ের সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদবিরোধী, বর্ণবাদবিরোধী সামাজিক সমানাধিকার ও সমতার লড়াই। ব্রিটিশ ভারতে ১৯৩৭ সালে সি রাজাগোপালাচারীর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির আঞ্চলিক কংগ্রেস সরকার প্রতিটা স্কুলে হিন্দি ভাষাশিক্ষা বাধ্যতামূলক করলে তার প্রতিবাদে দ্রাবিড় বলয়ের তামিল নেতা ই ভি রামস্বামীর নেতৃত্বে শুরু হয় আন্দোলন। হিন্দি আগ্রাসন বরাবরই ব্যর্থ হয়েছে দ্রাবিড় বলয়ে। তা সে ব্রিটিশ ভারতের পূর্বতন মাদ্রাজ হোক অথবা আজকের তামিলনাড়ু কিংবা কর্ণাটক, কেরল, অন্ধ্রর মতো রাজ্যগুলোতে। আন্নাদুরাই, করুণানিধি প্রমুখ তামিল নেতা তাঁদের ভাষা ও জাতিসত্তার লড়াইয়ে বানোয়াট ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ‘মিথ’ ও জাতিবাদী দম্ভকে ভেঙে চুরমার করেছিলেন। তাঁরা জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে একসময় ভারত থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন তামিলনাড়ু তৈরি করতেও চেয়েছেন। এবং তাঁদের সেই দাবি আজও তামিলনাড়ুর মেইনস্ট্রিম রাজনীতির অন্দরের চোরাস্রোতে প্রবহমান। ভারতের তামিলনাড়ুর তামিল জাতির ভাষা ও জাতিসত্তার অধিকারের সংগ্রামের প্রেরণায় শ্রীলঙ্কার তামিল জাতিসত্তার মানুষেরা আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়েছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে সেই সংগ্রামকে ছত্রভঙ্গ করে দিতে সক্ষম হয়েছিল শ্রীলঙ্কা সরকার। কিন্তু নির্মূল করতে পারেনি। ব্যাপকতা কমলেও শ্রীলঙ্কার অন্দরে তামিল জনতার লড়াই অব্যাহত।
তামিল ভাষা আন্দোলন কেবল তামিলনাড়ুর দ্রাবিড় জনতার কাছে নয়, বরং গোটা দ্রাবিড় বলয়ের দ্রাবিড় পরিচিতিসত্তার মানুষের কাছেই প্রেরণার। ফলে আমরা দেখলাম, বছর দেড়েক আগে কর্ণাটকে কন্নড় ভাষাভাষী মানুষের হিন্দি আগ্রাসনবিরোধী ব্যাপক গণ-আন্দোলন। এর নেতৃত্ব দিয়েছিল ‘কেভিআর’ নামের একটি সংগঠন। সাংবিধানিকভাবে ভারত একটি ইউনিয়ন রাষ্ট্র, যা আসলে বহু ভাষা, সংস্কৃতি ও জাতিসত্তাভিত্তিক অনেকগুলো দেশের সমাহার- এই যুক্তিতে তারা কর্ণাটক রাজ্যের পৃথক জাতীয় সংগীত ও রাজ্য পতাকা প্রচলনের দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছিল। একই সঙ্গে কর্ণাটকে অবস্থিত ভারত সরকারের সমস্ত অফিস কাছারি থেকে হিন্দিতে লেখা সাইনবোর্ড প্রতিস্থাপিত করেছিল কন্নড় ভাষায় লেখা সাইনবোর্ড দিয়ে। এই আন্দোলন বৈপ্লবিক আকার নেয়। পরে কর্ণাটকের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়া এই আন্দোলনকে সমর্থন জানান। তাঁর উদ্যোগেই কর্ণাটকে বাধ্যতামূলকভাবে সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে কন্নড় ভাষাকে রাজ্যের যোগাযোগের প্রধান ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার পাশাপাশি চালু হয় লাল-হলুদ রঙের রাজ্য পতাকা। কর্ণাটকের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে ওই পতাকাই ব্যবহার করা হচ্ছে। তামিলনাড়ুতেও বহুদিন ধরে রয়েছে তামিল ভাষার জন্য নির্দিষ্ট পতাকা। গোটা দ্রাবিড় বলয়জুড়েই হিন্দি আধিপত্যের প্রতিরোধে এবং নিজ মাতৃভাষার সর্বাধিক অধিকার অর্জনের জন্য সংগঠিত গণ-আন্দোলন গোটা উপমহাদেশের নিপীড়িত জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ের বিশেষ প্রেরণা।
উপমহাদেশে নিপীড়িত জাতিসত্তার আন্দোলনগুলোর ক্ষেত্রে আরেকটি প্রেরণা নাগা নেতা অঙ্গামি জাপু ফিজো। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সমাহার নাগা জাতির জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে তাঁর সংগ্রাম উপমহাদেশের ভাষিক ও জাতিসত্তার রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নাগাদের আন্দোলনে তাঁদের মধ্যকার কুকি-চিন-নাগা ভাষার স্বীকৃতি ও সরকারি কাজে তার ব্যবহারের দাবিগুলোও গুরুত্বপূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত ছিল। নাগাল্যান্ডের মতো মিজোরামেও দীর্ঘ সময় ধরে ভাষা ও জাতিসত্তার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন আজও জারি আছে। ঠিক একইভাবে কাশ্মীরি জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই বা মুক্তিসংগ্রামের মধ্যেও রয়েছে ভাষার প্রশ্নটি। কাশ্মীরি জাতিসত্তার জন্য ভারত-পাক দুই রাষ্ট্রের সমান্তরালে সার্বভৌম কাশ্মীর গড়ে তোলার লক্ষ্যে সুদীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাসের ক্ষেত্রে কশুর ভাষা ও কাশ্মীরি সংস্কৃতি মূল বিষয়। অনেক পরে ধর্মীয় অনুষঙ্গ এই লড়াইয়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। যদিও ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে কাশ্মীরি জাতিসত্তার আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব কাশ্মীরির জাতীয় মুক্তির লড়াই হিসেবে। ভারতের অন্দরে ভাষা সংগ্রামগুলোর মধ্যে কোঙ্কানি, মারাঠি ও পাঞ্জাবি ভাষার অধিকার রক্ষার আন্দোলনগুলোও যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। খালিস্তান আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একসঙ্গে ধর্মীয় পাঞ্জাবি শিখ জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছিল। সেই আন্দোলনকে দমন করে ইন্দিরা গান্ধী সরকার। এরই সূত্রে স্বর্ণমন্দিরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান এবং যার পরিণতিতে শিখ দেহরক্ষীর হাতে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর মতো ঘটনার সাক্ষী থেকেছে উপমহাদেশের মানুষ। সশস্ত্র খালিস্তান আন্দোলনের যুগ শেষ হলেও পাঞ্জাবি শিখ জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক লড়াই আজও অব্যাহত। যদিও কানাডায় বসে সেই রাজনীতির কর্মকা- চালায় খালিস্তানিরা। কিন্তু ধর্মীয় সূত্রে খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনের বিষয়টির সমান্তরালে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব পাঞ্জাবির ভাষা ও জাতিসত্তার অধিকারের প্রশ্নে পাঞ্জাবে নতুন করে অসাম্প্রদায়িক সংগ্রাম শুরু হয়েছে।
উপমহাদেশের ভাষা সংগ্রাম ও জাতিসত্তার লড়াইয়ের ক্ষেত্রে ভারতের অন্দরে সাঁওতাল ও মুন্ডাদের লড়াইও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সাঁওতাল, কোল-ভিল, মুন্ডারা ঐতিহাসিকভাবেই সংগ্রামী। তাদের ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদী ও বর্ণবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে তারা তাদের অধিকার অর্জনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। পন্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর হাত দিয়ে অলচিকি লিপির উদ্ভাবন ভারতের পূর্বাঞ্চলে সাঁওতাল পরিচিতিসত্তার লড়াইয়ে সাংবিধানিক সাফল্যের পেছনে একটি বড় অবদান। ১৯৯২ সালে মণিপুরি, কোঙ্কনী ও নেপালি- এই তিনটি ভাষাকে ভারতের সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করার পরে সাঁওতালি ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবিতে ব্যাপক গণ-আন্দোলন শুরু হয়। যার সাফল্য আসে ২০০৩ সালে। ওই বছরের ২২ ডিসেম্বর সাঁওতালি ভাষাকে ভারতের সংবিধানের অষ্টম তফসিলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ভারতের বিহার রাজ্য ভেঙে ঝাড়খন্ড তৈরি হওয়ার ঘটনাও সাঁওতাল-মুন্ডাদের রাজনৈতিক সাফল্য। সাঁওতালি ভাষার সংগ্রাম ভারতের লিঙ্গুয়িস্টিক পলিটিকসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানের অন্দরেও ভাষা ও জাতিসত্তার রাজনীতি অব্যাহত। যেভাবে উর্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা, ঠিক একইভাবে পাকিস্তানের অন্তর্গত সিন্ধু প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের মানুষ তাদের সিন্ধি, বেলুচ ও পশতু ভাষার অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য সংগ্রাম চালাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরেই। এটি জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম তথা স্বাধীনতার লড়াইয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ও নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীগুলোর ভাষা সংগ্রামের ইতিহাসও প্রায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সমবয়সী। চাকমা ও মারমাদের সংগ্রামের ব্যাপারে সবাই অবগত।
একটা কথা মনে রাখা দরকার, ধর্ম-বর্ণের সমানাধিকার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তাগুলোর সমানাধিকারের ভিত্তিতে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের শর্ত পূরণ করে বহুজাতিক ও গণতান্ত্রিক কনফেডারেশন বা ফেডারেল রাষ্ট্র সামাজিক সাম্যের ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু তা না হয়ে জাতিবাদী রাষ্ট্রপ্রকল্প যদি আধিপত্যের নিদর্শন তৈরি করে, সে ক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও সামাজিক সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিসত্তার লড়াই অপরিহার্য হয়ে পড়ে।

ছবি: সংগ্রহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top