skip to Main Content

ফিচার I ভাড়ায় আমি ভাড়ায় তুমি

দায়বদ্ধ যৌথ যাপনের তাগিদ থেকে গড়ে উঠেছে বিয়ে নামের প্রতিষ্ঠান। ভাড়ায় বা বিনিময়মূলক চুক্তিতে দুই নরনারীর বসবাস কি এর বিকল্প হতে পারে? লিখেছেন অতনু সিংহ

বাঙালি হিন্দুদের একটি জনপ্রিয় লোকাচার জামাইষষ্ঠীকে কেন্দ্র করে একপ্রকার ঠাট্টার প্রচলন আছে। সেটা হলো, জামাইষষ্ঠীতে জামাই যদি ব্যস্ততার কারণে বউয়ের বাড়ি গিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ির আপ্যায়ন গ্রহণ করতে না পারেন, তাহলে জামাই ভাড়া করতে হবে। এটা নিছকই ঠাট্টা। জামাইষষ্ঠীতে জামাই ভাড়া করতে হয় না। মেয়ে তার জামাইকে বগলদাবা করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে এক দিনের জন্য হলেও আতিথেয়তার আড়ালে বাপের বাড়ির আদব-কায়দার সঙ্গে অভ্যস্ত করায়। কিন্তু ভাড়া করা জামাই ব্যাপারটির একটা ট্র্যাডিশনাল রূপক এখান থেকে অনুসন্ধেয়। যে রূপককে পরিবর্ধন করে ভাড়ায় বিবাহব্যবস্থার দিকে যাওয়া যেতে পারে। বিয়েকে যদি একটি সামাজিক চুক্তি হিসেবে দেখা যায়, তাহলে এর আবশ্যিক পরিণতি চুক্তিভিত্তিক বিয়ে। এটাই হলো সাময়িক বিয়ে। বিয়ে যেহেতু ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার একটি প্রতিষ্ঠান, তাই একে ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক নানা সুযোগ-সুবিধা আদায়ের লক্ষ্যে সাময়িক চুক্তির মধ্য দিয়ে সাময়িক বিয়ের বিষয়টিতে অনেকেই অংশ নিচ্ছে আজকের এই জটিল আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক ভূব্যবস্থায়। ভাড়া করা বিয়ের ব্যাপারে আলাপ করার আগে অবশ্যই ‘বিবাহ’ প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে কিঞ্চিৎ বক্তব্য প্রয়োজন।
যূথযাপনের চুক্তি
সভ্যতার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ, পরিবার-ব্যক্তিমালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তিবিষয়ক আলোচনা, যৌনতা সম্পৃক্ত মানব ইতিহাস, ট্যাবুর নির্মাণ ইত্যাদি বিষয় থেকে বহু আগেই এই সত্য আমরা জেনে গেছি যে বিবাহ আসলেই একটি সামাজিক চুক্তি। যৌনতাকে কেন্দ্র করে সামাজিক গঠনতন্ত্রে বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। কেননা, মাতৃতন্ত্র ও প্রাচীন যৌথযাপনের ব্যবস্থা ভেঙে গিয়ে ব্যক্তিমালিকানা ও সম্পত্তির কনসেপ্ট যখন সামনে এসেছে, তখন থেকেই যৌনতার ব্যক্তিগন্ডি নির্মিত হয়েছে, তৈরি হয়েছে সামাজিক অনুশাসনের ছলাকলা। তারপরেও যৌনতা ঘিরে যে মায়াভাব চুইয়ে চুইয়ে আমাদের হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়ে, সেই মায়ানির্ভরতাকে আমরা প্রেম বলে চিহ্নিত করি, আর প্রেমের যৌনতা ও যৌনতাকেন্দ্রিক সামাজিক দ্বন্দ্বের ভেতরেই এগিয়ে যায় প্রেম। ট্যাবুনির্মিত সমাজ নারীকে শিশ্নছিন্ন করেছে বলে ফ্রয়েডের অভিযোগ, আবার যে ট্যাবুনির্মিত সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে বিবাহের প্রতিষ্ঠা, সেই প্রতিষ্ঠানে স্বয়ং ফ্রয়েড মশাইও যাপন করেছেন বহুদিন। আবার বিবাহ প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করেও জর্জ বার্নার্ড শ নিজেও বিয়েটিয়ে করেছিলেন।
বিবাহের সমান্তরালে
উপমহাদেশে বৌদ্ধতন্ত্র, ফকিরি কিংবা সহজিয়া পন্থায় বিবাহব্যবস্থার সমান্তরালে মনের মানুষ বা নিরঞ্জন সাঁইকে খোঁজার লক্ষ্যে সাধনসঙ্গীর সঙ্গে যাপনের ট্র্যাডিশন রয়েছে। তাতেও একধরনের চুক্তির বিষয় আছে, তা হলো ভাবের ঐক্য বা ভাব বিনিময়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব থেকে ঐক্যে পৌঁছানো- সেখানকার স্পিরিচুয়াল যাপনের অন্দরে তা একধরনের অব্যক্ত চুক্তিই বটে। কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুসারী ট্যাবুকেন্দ্রিক ক্ষমতায়ন ও তার নিয়ন্ত্রণ তাতে নেই। যদিও সেখানে যৌথযাপনের ব্যাপারে একধরনের কমিটমেন্ট থাকে। আধুনিকতার মধ্য থেকে অন্তর্ভাগে এসে যখন রাষ্ট্র অথবা আইনস্বীকৃত বিবাহের বদলে লিভ-টুগেদারকে বেছে নিয়েছেন অনেকেই। আর্থিক দায়দায়িত্বের ব্যাপারে সমান অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে দুটি মানুষের মানসিক ও যৌনযাপনের নাম লিভ-টুগেদার। তবে সম্পর্কের এই উন্মুক্ত প্রতিষ্ঠানে যৌথ যাপনের দীর্ঘসূত্রতার ব্যাপারে কোনো প্রতিশ্রুতি থাকে না। থাকে না কোনো আইনি বাধ্যবাধকতা। তাই, ভাড়ার বিয়ের ব্যাপারটি বোঝার আগে সোশ্যাল ও সেক্সুয়াল ‘কন্ট্র্যাক্ট’-এর পোস্টস্ট্রাকচারাল প্রতিষ্ঠান লিভিং টুগেদারের ব্যাপারেও ভাবনার অবকাশ থেকে যায়।
নাগরিকত্ব ও ভাড়া বিয়ে
বিয়ের মডেল রাষ্ট্রীয় ও আইনি বিষয়গুলোর মধ্যে ব্যক্তিনৈকট্যপূর্ণ একটি কাঠামো। কিন্তু যখন পুঁজির দৃশ্যমান চেহারা ক্রমে গায়েবি হয়ে গিয়ে রাষ্ট্রকেন্দ্রিক যেকোনো সক্রিয়তা থেকে বর্ডার ব্যাপারটি অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, তখন ফের মানুষের যাযাবর হয়ে ওঠার লগ্ন হাজির। এখন শহর ক্রমশ ঘিরে ফেলছে গ্রামকে, আর গ্রামীণ থেকে শহুরে হয়ে ওঠা মানুষের জন্য বরাদ্দ প্রাকৃতিক ও জৈবিক উপাদানগুলোও হয়ে পড়ছে সীমিত। তাই জীবন-জীবিকার খোঁজে এক কাঁটাতার অতিক্রম করে আরেক কাঁটাতারের নগরজীবনে ক্ষতবিক্ষত মানুষকে চলে যেতে হচ্ছে, হতে হচ্ছে দেশান্তরি। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সীমানা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেও অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখার জন্য ক্ষমতাশীল কিংবা অপেক্ষাকৃত কম ক্ষমতার রাষ্ট্রও তার সীমানাকে কার্যকর রাখছে প্রবলভাবেই। তাই দেশান্তরে কাজের সন্ধানে সবার যাওয়ার সুযোগ থাকছে না। এই অবস্থায় বিবাহ প্রতিষ্ঠানটি অনেকের কাছেই হয়ে উঠেছে এক রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন রাষ্ট্রে বাসস্থান তৈরির একটি মাধ্যম। ভিন্ন রাষ্ট্রের কোনো নাগরিককে কেউ বিয়ে করলে তিনিও ওই রাষ্ট্রে বসবাস ও জীবিকার সুযোগ পেয়ে যান। তাই, রাষ্ট্রের চোখে ধুলো দিতে বিয়ের আশ্রয় নিচ্ছেন অনেকে। টাকাপয়সার বিনিময়ে আইনি বিয়ের জন্য অনেকেই চুক্তিবদ্ধ হচ্ছেন, রাষ্ট্রীয় বা আইনিভাবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছেন। কিন্তু বিয়ের বাকি বিষয়গুলো, অর্থাৎ ঘরসংসার, যৌনতা, কমিটমেন্ট ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত থেকে যাচ্ছে এই ভাড়াবিয়ের ক্ষেত্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গ্রিনকার্ড হাসিল করার লক্ষ্যে এমন অনেক ঘটনার সংবাদই আজকাল আমরা পেয়ে থাকি। যুক্তরাজ্যেও এমনটা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ধরা পড়লে কড়া শাস্তির বিধান অবশ্য আছে, কিন্তু কটা ঘটনাই-বা রাষ্ট্রের নজরে আসে? এমন ভাড়া বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক সময়েই অনেকে কিছুদিন ঘরও বাঁধছেন লিভ-টুগেদার ফর্মে। কিন্তু সম্পর্কের পরিণতি এসব ক্ষেত্রে শূন্য বললেই চলে। তবু জীবনের রণরক্ত যাপনে বিবাহ প্রতিষ্ঠানের এমন বিনির্মাণ ঘটানো ছাড়া অনেকেই নিরুপায়। এই অসহায়তার কারণ মানুষের মৌলিক অধিকারের অনিশ্চয়তা।
ভাড়া করা পিতৃত্ব
পিতৃত্ব বা বীর্য ভাড়া করে অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কাজেও লোক দেখানো বিয়ে করছেন অনেকে। সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর সেই বিয়ে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। যেমন ভিয়েতনামের হ্যানয় শহর। কুমারী কোনো মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হলে রক্ষণশীল সমাজ মেয়েটিকে নীচু নজরে দেখবে। এ কথা মাথায় রেখে নকল বিয়ে বা ভাড়া বিয়ের আয়োজন রোজই বেড়ে চলেছে ভিয়েতনামের এই শহরটিতে। গত কয়েক বছরে ভাড়া করা বিয়ের সংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে বেড়ে গেছে বলে সংবাদমাধ্যমে উঠে আসছে। রীতিমতো প্যাকেজ করে অনুষ্ঠিত হচ্ছে এমন বিবাহ। ‘ভাইনামোস্ট’ নামে একটি সংস্থা এমন বিয়ের আয়োজন এবং তা সম্পন্ন করার কাজ করে থাকে।
দাম্পত্য এড়াতে
ম্যারেজ ইজ আ লিগ্যাল প্রস্টিটিউশন। এই উক্তিকে ভাড়া বিয়ের মাধ্যমে শাব্দিক অর্থে সত্য করে তুলেছে মনুবাদী মধ্যপ্রদেশের পুরুষেরা। ভারতের মধ্যপ্রদেশের শিবপুরি জেলার একটি এলাকায় পুরুষেরা মনে করে, বিয়ে করতে বেশ ঝামেলা-ঝক্কি। তাই বিয়ে না করে বউ ভাড়া করে দাম্পত্য জীবন কাটান ওই এলাকার পুরুষেরা।
তবে এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পোষা স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্য নিয়েই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখায় এসব পুরুষ। বউ ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি আইনগতভাবে বৈধ করতে স্ট্যাম্প পেপারে চুক্তিও করে নেয় তারা।
ওই এলাকার পুরুষেরা মধ্যযুগীয় কায়দায় নারী কেনাবেচার মতোই নারীকে বা নারী শরীরকে ভাড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে সাময়িক সংসার যাপন তথা যৌন যাপন করে। মধ্যপ্রদেশের শিবপুরি জেলার গোয়ালিয়র ডিভিশনে প্রশাসনের কোনো কর্তাব্যক্তির এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। এই এলাকায় ভাড়াবিয়ের প্রচলনকে ‘ধাদিচা’ প্রথা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়।
সর্বশেষ উদাহরণ থেকে স্পষ্ট, ভাড়াবিয়ের মাধ্যমে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষতন্ত্রের যৌনক্ষমতায়নের জায়গাটি ধাক্কা খেলেও পুরুষতন্ত্রও নিজের কূটকৌশলে ভাড়াবিয়ের মধ্যেও পিতৃতন্ত্র আরোপ করেছে কোথাও কোথাও। এ কথা ঠিক, বিবাহ বলতে যদি অর্থনৈতিক ও সামাজিক দায়দায়িত্ব সমানভাবে ভাগ করে নিয়ে দুটি মানুষের শরীর ও মনের সহাবস্থান হয়, তাহলে ভাড়াবিয়ে কোনোভাবেই বিয়ের বিকল্প নয়। বিবাহহীন একসঙ্গে যৌথযাপনের বিকল্প হিসেবেও ভাড়াবিয়েকে চিহ্নিত করা যায় না।

মডেল: টুটুল, আয়শা
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: মানসা
ছবি: ক্যানভাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top