skip to Main Content

ফিচার I মেধস মুনির আশ্রম

এও বলা হয়ে থাকে, দুর্গাপূজার শুরু মেধস মুনির আশ্রম থেকে। রামায়ণে বর্ণিত কাহিনিরও আগে। কিন্তু কোথায় এই আশ্রম? জানাচ্ছেন কমল দাশ

শারদীয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে রামায়ণের কাহিনি। লঙ্কেশ্বর রাবণকে বধ করার জন্য সমুদ্রতটে দেবীর উপাসনা শুরু করেন রামচন্দ্র। তাঁর উপাসনায় ১০৮টি নীল পদ্মের মধ্যে একটি পদ্ম কম পড়লে নিজের চোখের নীলবর্ণ মণিকে দেবীর পায়ে সমর্পণ করতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দেখা যায়, দেবী নিজেই নীল পদ্ম লুকিয়ে রেখে ভক্তির পরীক্ষা নিচ্ছিলেন। রামচন্দ্রের তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে দেবী তাঁকে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ের বর দান করেন। শরৎকালে তিনি দুর্গাপূজা করেছিলেন, সেটা ছিল অকালে। কারণ দুর্গাপূজার নিয়ম ছিল বসন্তে। দুর্গার নাম তাই বাসন্তী। অকালে দুর্গাপূজা থেকেই এর নাম হয় অকালবোধন। তবে একে ঘিরে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মিথ, সত্যযুগের মেধস মুনির দুর্গাপূজাকে ঘিরেও প্রচলিত। বলা হয় রামচন্দ্রের বহু আগেই মেধস মুনির আশ্রমে দুর্গা পূজিতা হয়েছিলেন। শত্রুদের চক্রান্তে নিজের ক্ষমতা ও রাজ্য হারিয়ে ধার্মিক রাজা সুরথ উদ্‌ভ্রান্তের মতো ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হন মেধস মুনির আশ্রমে। তাঁর দুর্দশা দেখে হারানো রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য তাঁকে দুর্গাপূজার উপদেশ দেন মেধস মুনি। তা মেনে সুরথ রাজা আড়ম্বরপূর্ণ দুর্গাপূজার প্রচলন করেন। এর ফলে দেবী দুর্গার আশীর্বাদে শত্রুদের পরাস্ত করে তিনি আপন রাজ্য উদ্ধারে সক্ষম হন।
কিন্তু দুর্গাপূজার উৎপত্তিস্থল সেই মেধস মুনির আশ্রম কোথায়? ঐতিহাসিক কোনো তথ্য এই আশ্রম প্রসঙ্গে নেই। আসলে ইতিহাস ও মিথ্যের গতিপ্রকৃতি একটু ভিন্ন। ইতিহাসপূর্ব ঘটনার প্রতীকী উপস্থাপনা হলো মিথ, কিন্তু আধুনিক সময়েও মিথ তৈরি হয় নানাভাবে। যেমন ১৩৩ বছর আগে বেদানন্দ স্বামী দৈবক্ষমতা দিয়ে জেনেছিলেন, সেই মেধস মুনির আশ্রম চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর করলডেঙ্গার পাহাড়ে। বেদানন্দ স্বামীর উদ্যোগেই গড়ে ওঠে এই আশ্রম। চন্ডী, শিব, তারা, কালীসহ বিভিন্ন দেবদেবীর মোট ১০টি মন্দির রয়েছে এই আশ্রমে। আশ্রম প্রাঙ্গণেই রয়েছে সীতাপুকুর।
কিন্তু ওই বেদানন্দ স্বামী কে? বরিশালের গৈলা অঞ্চলের পন্ডিত জগবন্ধু চক্রবর্তীর বাড়িতে ১২৬৬ বঙ্গাব্দের ২৫ অগ্রহায়ণে চন্দ্রশেখর নামে এক পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। জন্মের দুই বছর পর জগবন্ধু মারা যান। মায়ের অনুরোধে চন্দ্রশেখর ১৪ বছর বয়সে বিয়ে করেন মাদারীপুরের রামনারায়ণ পাঠকের কন্যা বিধুমুখীকে। ছয় মাস পর মারা যান স্ত্রী। এর কিছুদিন পর মাও মারা যান। সংসারে আপন বলতে আর কেউ রইল না। নিঃসঙ্গ চন্দ্রশেখর নানা বেদ শাস্ত্র পাঠ করে হয়ে ওঠেন পরিচিত পন্ডিত। তখন নাম হলো শীতলচন্দ্র। তিনি মাদারীপুরে প্রতিষ্ঠা করেন সংস্কৃত কলেজসহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পরবর্তীকালে যোগীপুরুষ স্বামী সত্যানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের পর চন্দ্রশেখরের মনে চন্দ্রনাথ দর্শনের আগ্রহ জন্মে। তিনি চলে আসেন চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে। সেখানে তার জীবনে বৈরাগ্য আসে। তত দিনে চন্দ্রশেখর হয়ে ওঠেন বেদানন্দ স্বামী। জনশ্রুতি রয়েছে, যোগবলে বেদানন্দ স্বামী দর্শন লাভ করেন চন্দ্রনাথের (শিব)। মানুষের বিশ্বাস, চন্দ্রনাথ সেই দর্শনে বেদানন্দকে পাহাড়ের অগ্নিকোণে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার আদেশ দিয়ে বলেন, ‘দেবীর আবির্ভাব স্থান মেধস আশ্রম পৌরাণিক শত সহস্র বছরের পবিত্র তীর্থভূমি। কালের আবর্তে সেই পীঠস্থান অবলুপ্ত হয়ে পড়েছে। তুমি স্বীয় সাধনবলে দেবীতীর্থ পুনঃআবিষ্কার করে তার উন্নয়নে মনোনিবেশ করো। দেবী দশভুজা দুর্গা তোমার ইচ্ছা পূরণ করবে।’ জনশ্রুতি, দৈববলে প্রভু চন্দ্রনাথের আদেশে বেদানন্দ স্বামী পাহাড়-পর্বত পরিভ্রমণ করে পবিত্র এ তীর্থভূমি মেধাশ্রম আবিষ্কার করেন। বোয়ালখালী উপজেলা সদর থেকে আট কিলোমিটার দূরে মধ্যম করলডেঙ্গা গ্রামের করলডেঙ্গা পাহাড়ের চূড়ায় এই আশ্রমের অবস্থান। আশ্রমের প্রধান ফটক দিয়ে প্রায় আধা কিলোমিটার গেলে উপরে ওঠার সিঁড়ি। প্রায় ১৪০টি সিঁড়ি ভেঙে উঠলে মেধস মুনির মন্দির চোখে পড়বে। এই মন্দিরের পরই দেবী চন্ডীর মূল মন্দির। এর এক পাশে সীতার পুকুর, পেছনে রয়েছে ঝরনা। মন্দিরের পেছনে সাধু সন্ন্যাসী ও পুণ্যার্থীদের থাকার জন্য রয়েছে দোতলা ভবন।
প্রায় ৬৮ একর জায়গাজুড়ে স্থাপিত এই মন্দিরে প্রতিবছর মহালয়ার মাধ্যমে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে আহক্ষান জানাতে প্রতিবারের মতো এবারও চলছে প্রস্তুতি। সেদিন শত শত পুণ্যার্থীর পদচারণে মুখরিত হয়ে ওঠে এই আশ্রম।
আশ্রমের পুরোহিত বুলবুলানন্দ মহারাজ জানান, প্রতিবছর মহালয়ার মধ্য দিয়ে দেবীপক্ষের সূচনা হয়। ভোর থেকে চন্ডীর আরাধনার মাধ্যমে দেবী দুর্গাকে আহক্ষান করা হয়।

ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top