skip to Main Content

ফিচার I যুগলের রসনাভ্রমণ

ভ্রমণের সঙ্গে উপাদেয় খাবার। দর্শনীয় স্থানগুলোতে বেড়ানোর পাশাপাশি সেসবের আশপাশে থাকা প্রসিদ্ধ ভোজনালয়ের বিচিত্র পদ উপভোগের আনন্দ। খোদ রাজধানীতেই। লিখেছেন শিবলী আহমেদ

যাপিত জীবনের বাঁকবদল ঘটে বিয়ের মাধ্যমে। দাম্পত্য শুরুর কিছুদিন খোশমেজাজে থাকেন বর-কনে। একের আনন্দ অন্যের মনে সঞ্চারিত হয়। ভ্রমণে তা মধুর হয়ে ওঠে। কিন্তু দম্পতির এই আনন্দ যাপনে চাই মুখরোচক খাবার। ঢাকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে ঘুরে ঐতিহ্যবাহী পদ চেখে দেখলে সময়টুকু স্মৃতির রসদ হয়ে উঠতে পারে যৌথ জীবনে। নিজেদের গাড়ি থাকলে তো ভালোই, না থাকলে উবার বা পাঠাও সার্ভিস আছে। তবে রিকশায় চড়ে সঙ্গীসমেত এগলি-ওগলি ঘোরার মধ্যে আনন্দ পান যুগলদের অনেকেই।
ঢাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় হতে পারে সকাল, দুপুর ও রাতের ভোজ। মাঝখানে হালকা খাবার ও পানীয়। ঘুরে দেখা যেতে পারে সুন্দর জায়গাগুলো। ভ্রমণের ব্যাগটা ভরা চাই সেদিকে খেয়াল রেখে। ক্যামেরা থাকলে নেওয়া যায়। অথবা পাওয়ার ব্যাংকসহ মোবাইল ফোন। সঙ্গে দুই বোতল খাওয়ার পানি ও ছাতা থাকলে ভালো। যেসব জায়গায় ধুলার আধিক্য, সেখানে ব্যবহার করা যেতে পারে মাস্ক।
সকালের নাশতার সুনাম আছে এমন রেস্তোরাঁর বেশির ভাগই রয়েছে পুরান ঢাকায়। ব্রেকফাস্টের জন্য সেসব স্থানই উপযুক্ত। জনসন রোডের মানিক সুইটমিটের দই-চিড়ার খ্যাতি আছে। এই পদের সঙ্গে মেশানো হয় খাঁটি দুধের ঘোল, নারকেল, কলা ও রসগোল্লার শিরা। দই হয় বেশ ঘন। চিড়া লাল। এসবের মিশ্রণে খাবারটি বেশ সুস্বাদু। দই-চিড়ায় অরুচি থাকলে শাঁখারীবাজারের অমূল্য মিষ্টান্ন ভান্ডারের হালুয়া ও পরাটা দিয়ে দিন শুরু করা যাবে। লক্ষ্মীবাজারের পাতলাখান লেনের লুচি-ভাজি, নারিন্দার রাসেল হোটেল অথবা নবাবপুরের মরণচাঁদ মিষ্টির দোকানের ভাজি পরাটা, নাজিরাবাজারের ডাল-রুটি কিংবা কলতাবাজারের নাসির হোটেলের গরুর মাংস ও পরাটা দিয়েও নাশতা করা যাবে। এসব রেস্তোরাঁই নামকরা এবং খাবারগুলো জনপ্রিয়। যাদের বাসা থেকে ভাটারা কাছে, তারা কোকাকোলা মোড়ের জননী হোটেলের পরাটা-জিলাপি খেতে পারেন সকালে। এসবের বাইরে নাশতা হিসেবে আছে বাকরখানি। পাওয়া যায় পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোডে। খাওয়ার পর ঘোরাঘুরির জন্য সেখানে আছে হোসেনি দালান। স্থাপনাটি সাড়ে ৩০০ বছরের পুরোনো। মোগল আমলের। এর দক্ষিণাংশে বর্গাকৃতির পুকুর আছে। বাকরখানি পাওয়া যাবে মগবাজারের পেয়ারাবাগেও। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর ও মিরপুরের কিছু স্থানে।
নাশতার পরই চাই চা। পুরো ঢাকাতেই এই পানীয়ের দোকানের ছড়াছড়ি। বিশেষ চা পান করতে চাইলে গুলশান ১-এর পোস্ট অফিসের পাশে নাসিরের দোকানে যাওয়া যেতে পারে। এই চা তৈরির উপাদান গোপন। তা এত সুস্বাদু যে সকালবেলা অফিস কর্মীদের ঢল নামে দোকানের সামনে। দুই কাপ পান করে গুদারাঘাটে গিয়ে ওয়াটার বোটে ঘোরা যেতে পারে ঘণ্টাখানেক। হাতিরঝিলের লেকের ওপর ভেসে রামপুরা ও এফডিসি- এই দুই রুটে ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলে। অনেকেই তাতে ঘুরে বেড়ান। ঢাকার ভেতরে নৌভ্রমণের জন্য স্থানটি উপযোগী।
গুলশান ছাড়াও সুস্বাদু চা আছে। খিলগাঁওয়ের বাগিচা মসজিদের পাশে কাজীর দোকান। জলপাই রঙা চা মেলে সেখানে। টক ও মিষ্টির মিশেলে। এখানকার পুদিনা পাতা ও লেবুর চা প্রসিদ্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় টিএসসি ও পলাশীতে প্রায় ৪০ রকমের চা পাওয়া যায়। উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মরিচ চা, পনির চা, কাঁচা আমের ঝাল চা, মালাই চা ও দুধ চা। এসব ছাড়াও ধানমন্ডি রবীন্দ্রসরোবরের ডায়নামিকের চা, উত্তরা বিইউএসটির সামনে এনামের চা, খিলখেতের হোটেল রিজেন্সির পেছনের মাল্টার স্পেশাল চা, ভিক্টোরিয়া পার্কের সুলতানের চা এবং নিমতলীর বাদশাহ মিয়ার চায়ের সুনাম আছে। নিমতলীতে চা পানের পর ঘোরা যেতে পারে সেখানকার কুঠিতে। এটি মোগল আমলের প্রাসাদ। লাঞ্চের আগপর্যন্ত সময়টা আনন্দেই কাটবে।
সকালের চা পান যদি টিএসসিতে হয়, তাহলে ঘোরা যেতে পারে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ধানমন্ডিতে হলে ৩২ নম্বর লেকে। এসব জায়গায় অনায়াসে কেটে যাবে দু-তিন ঘণ্টা। লাঞ্চের সময় চলে আসবে। ঢাকাই রেস্তোরাঁগুলোর মেনুতে সবচেয়ে বেশি বৈচিত্র্য মেলে দুপুরের খাবারে। বিখ্যাত, সুস্বাদু ও ঐতিহ্যবাহী পদপ্রাপ্তির স্থান অনেক। যেমন জিগাতলার সুনামী রেস্তোরাঁর কাচ্চি বিরিয়ানি, পুরান ঢাকার হোটেল আল রাজ্জাকের কাচ্চি, মতিঝিলের হীরাঝিলের ভুনা খিচুড়ি, লালমাটিয়ার স্বাদ রেস্তোরাঁর তেহারি, বনানীর তেহারি অন হুইলসের তেহারি, নবাবপুর রোডের হোটেল স্টারের খাসির লেকুশ, নয়াপল্টনের ভিক্টোরি হোটেলের ৭০ আইটেমের বুফে, খিলগাঁওয়ের ভোলা ভাই বিরিয়ানি, নাজিরাবাজারের হাজির বিরিয়ানি, ধানমন্ডির দাওয়াত-ই-মেজবানের মেজবানি মাংস, কড়াই গোশত রেস্তোরাঁর ইলিশ সস, চানখাঁরপুলের নীরব হোটেলের গরুর মাংস ভুনা ও ভর্তা ভাত, গুলশান ২-এর খাজানার মাটন দম বিরিয়ানি এবং হায়দরাবাদি বিরিয়ানি, কাঁটাবনের অষ্টব্যঞ্জনের বিফ খিচুড়ি, শাহজাদপুরের মোহাম্মদী হোটেলের উটের মাংস ইত্যাদি। কম তেলে দুপুরের খাবার খেতে চাইলেও উপায় আছে। মতিঝিলের দেশি রেস্তোরাঁয় এ ধরনের পদ রান্না করা হয়। পুরান ঢাকায় মধ্যাহ্নভোজ সারলে ঘুরতে যাওয়া যেতে পারে আর্মেনিয়া চার্চ, ঢাকেশ্বরী মন্দির, রূপলাল হাউস, গোপীবাগের রোজ গার্ডেন কিংবা বলধা গার্ডেনে। লাঞ্চ কাঁটাবনে হলে ‘কাঁটাবন ফিশ অ্যান্ড পেট অ্যানিমেল’ বাজারটি ঘুরে দেখা যেতে পারে। নতুন সঙ্গীকে তার পছন্দের কোনো প্রাণী কিনে উপহার দিলে ভ্রমণের আনন্দে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে।

খাঁচা কিংবা অ্যাকুরিয়াম পাওয়া যাবে সেখানেই। অনেক দম্পতি হয়তো দুপুরে খাবারের পর ঘুরতে বেরোবার আগে পানীয় পান করতে চাইবেন। সে ক্ষেত্রে ঢাকার কিছু স্থানে লাচ্ছি, লাবাং, মাঠা, শরবত কিংবা বোরহানি মিলবে। নারিন্দার সৌরভের মাঠা, রায়সাহেব বাজারের বিউটি লাচ্ছি, ঠাটারীবাজারের স্টারের ফালুদা এবং তারা মসজিদের সামনের শরবত ও লাচ্ছি কিংবা চকবাজারের নুরানী শরবত তৃষ্ণাহরা। পান করার জন্য চকবাজারে গেলে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পাওয়া যাবে মোগল নিদর্শন বড় কাটরা, শায়েস্তা খাঁর আমলে তৈরি ছোট কাটরা এবং ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি জিনজিরা প্রাসাদ। এসব স্থানে ঘুরতে ঘুরতে বিকেল নামবে। এ বেলায় চাই হালকা খাবার। এই মেনুতে আছে নিকুঞ্জ ২-এর ব্যাচেলর হোটেলের সবজি পুরি, ঢাকা শর্মা হাউসের বিফ পাস্তা, মিরপুর পানির ট্যাংকের সামনের ঝাল ফুচকা, ৩০০ ফুটের কোয়েলের চাপ, সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলের সামনের আলুর দম, নাজিরাবাজারের বিসমিল্লাহ হোটেলের বটি কাবাব, মিরপুর ১০-এর শওকতের কাবাব, লালবাগের ভাটের মসজিদের পাশের কাবাব বন, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের মাঞ্জারের পুরি, হাতিরপুল মোড়ের হেরিটেজের শর্মা কিংবা গুলশানের কস্তুরির শর্মা। খাবারের স্বাদে বিভোর হয়ে আলাপচারিতা করতে করতে নেমে আসবে সন্ধ্যা।

দিনের আলো ফুরালে ঢাকায় ঘোরাঘুরির জন্য আকর্ষণীয় স্থানের সংখ্যা কম। হাতিরঝিলে যাওয়া যায়। অথবা কিছুক্ষণ সময় কাটানো যায় চন্দ্রিমা উদ্যানে। সিনেমা দেখারও ব্যবস্থা আছে। হলগুলোর মধ্যে বসুন্ধরা স্টার সিনেপ্লেক্স, শ্যামলী স্কয়ারের সিনেমা হল এবং যমুনা ফিউচার পার্কের ব্লকবাস্টার সিনেমাসের নাম আগে চলে আসে। যেখানে যেতে সুবিধা, সঙ্গী নিয়ে সেখানেই শো দেখা যেতে পারে। পপকর্ন ও কোমল পানীয় যোগে কেটে যাবে আরও দুই ঘণ্টা। এরপর ডিনার। দুপুরের খাবারের জন্য যে রেস্তোরাঁগুলোর নামডাক আছে, সেগুলোর রাতের খাবারের মেনুও নন্দিত। অনেকগুলোই মধ্যরাত পর্যন্ত খোলা থাকে। ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের কিছু রেস্তোরাঁ, বনানী ১১ নম্বর, মিরপুর ২ নম্বর স্টেডিয়ামের আশপাশের রেস্তোরাঁগুলো গভীর রাত পর্যন্ত খোলা থাকে। মিরপুর ডিওএইচএস, কালশী ও ভাটারাতেও কিছু রেস্তোরাঁ আছে। সেগুলোও খোলা থাকে।
তবে নবদম্পতির এই অ্যাডভেঞ্চারে বেরোবার জন্য ছুটির দিনই ভালো। নইলে এক জ্যামেই ভেস্তে যেতে পারে পরিকল্পনা। আনন্দের পরিবর্তে বিরক্তিও পেয়ে বসতে পারে।

ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top