skip to Main Content

ফিচার I রাগরূপ

শাস্ত্রীয় সংগীতের মর্মে রয়েছে রং ও রূপে পৌঁছানোর সাধনা। সময়ের সঙ্গে তা পাল্টে যায়। লিখেছেন মনীষা উজ্জয়িনী

স্বর শোনার সঙ্গে রং দেখার অনুভূতির যোগ বিশ্বব্যাপী সর্বজনীন। বহু আগে থেকেই। এটা বিজ্ঞানী ও সংগীতচিন্তকদের লেখায় দেখা গেছে। তবে স্বরের বর্ণবৈচিত্র্য থেকে রাগ-রাগিণীর রঙে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি আজও। কিন্তু এর অন্তর্নিহিত যোগসূত্র নিয়ে প্রাচীনকাল থেকেই ভেবেছেন তারা। শুধু স্বর নয়, সুরের সঙ্গে বর্ণ ও বর্ণের প্রক্ষেপে সৃষ্টি হয়েছে রাগরূপ। বিশেষ করে ষোড়শ ও সপ্তদশ শতাব্দীতে রচিত বহু শ্লোকে রাগ-রাগিণীর এই রূপবর্ণনা পাওয়া যায়।
সংগীতের রাগ-রাগিণীর সঙ্গে রং ও রূপের সম্ভবত সবচেয়ে সার্থক প্রকাশ ঘটেছিল কাংড়া ও দক্ষিণি চিত্রমালায়। সেখানে এর দৃশ্য প্রতিরূপ ফোটানোর শৈল্পিক প্রয়াস দেখা যায়।
রাগ-রাগিণীর কল্পনার যেসব রূপ-চিত্র পাওয়া যায়, সেগুলোর প্রায় সবই মোগল আমলের আঁকা। এতে স্বভাবতই তখনকার পরিবেশ ও রুচিবৈচিত্র্যের ভেতর থেকে মোগল ও রাজপুত চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। এই রূপ সৃষ্টিতে ভারতীয় সংস্কৃতির ছাপ স্পষ্ট। অন্যদিকে, মুসলমানরা এতে ধর্মকে সযত্নে এড়িয়ে গেছে। অপরপক্ষে হিন্দুরা বিভিন্ন দেব-দেবীতে বিশ্বাসী। তাই সেসবের ছাপ কোনো কোনো রাগ-রাগিণীর রূপবর্ণনায় স্থান পেয়েছে।
সংগীত-শাস্ত্রকারদের মতে ছয়টি মূল রাগ। প্রতিটির আবার পাঁচটি, কারও মতে ছয়টি রাগিণী রয়েছে। এগুলো এক একটি বর্ণানুভূতি ও রূপ সৃষ্টি করে। ‘রাগিণী চিত্রমালা’য় এসব ছবির সঙ্গের রাগের চিত্র-প্রতিরূপ পাওয়া যায়।
ভৈরব: এই রাগে একটা রুদ্রমূর্তি কল্পনা করা হয়েছে, যার পুরো দেহ সর্পহার সজ্জিত। চুলের গোছা থেকে গঙ্গাধারা প্রবাহিত। কপালে অর্ধচন্দ্রশোভিত এবং চোখ ঢলঢল। এর মধুমাধবী রাগিণীতে আছে হলুদাভ পোশাক ও দৃষ্টির চঞ্চলতা। নাকে তিল ফুলের উপর শিশিরকণার মতো মুক্তার অলংকার। ভৈরবী রাগিণী প্রস্ফুটিত পদ্মফুল নিয়ে ভৈরবের অর্চনা করে। তার হাতে বীণা, হলুদাভ পোশাকে আয়ত ও উন্মুক্ত চোখ। ভৈরব ভোরের রাগ।
মালবকৌশিক: মোহন রূপ, যুবক- শান্ত ও গম্ভীর। গলায় মুক্তার মালা, পরিধানে ফিরোজা রঙের বসন। যুবতীদের সঙ্গে রসক্রীড়ায় রত। এর তোড়ী রাগিণী অপূর্ব রূপযৌবনা। তার পরিধানে সাদা বস্ত্র, কাঁচুলি, বিচিত্র অলংকার শোভিত, কর্পূর মিশ্রিত ও সুবাসিত তৈলসিক্ত কেশরাশি, বাগানে একা বসে বীণা বাজাচ্ছেন। খম্বাবতী রাগিণী রূপে অতিশয় লাবণ্যবতী, যুবতী। পরিধানে লাল রঙের পোশাক, একটি ছবির দিকে তিনি চেয়ে আছেন। গৌরী রাগিণী শ্যামবর্ণা ও তরুণী। অর্ধফোটা ফুল তার কানে শোভা পায়। গণকেলী রাগিণী যুবতী নারী। কদমগাছের নিচে একা বসে তিনি কাঁদেন। মালবকৌশিক রাগের কুকুভাকে কুকুভ নামে উল্লেখ করা হয়েছে। বিলাবল ঠাটের অন্তর্গত এই রাগের আধুনিক নাম কুকুভ বিলাবল। এটি আসলে বিলাবলেরই একটি প্রকার হিসেবে স্বীকৃত। অপূর্ব কারুকার্যখচিত একটি প্রাসাদের দরজার সামনে খোলা বারান্দায় পালঙ্কে বসে আছেন রূপসী এক বিরহিনী। তার মুখের সামনে আয়না ধরে দাঁড়িয়ে আরেকজন নারী। দূরে দিগন্তবিস্তৃত টিলা ও মাঝে মাঝে গাছের সারি। বিলাবল রাগের ছবিটি এ রকম।
হিন্দোল: অভিনব যুবক, মনোমুগ্ধকর পোশাক, সুন্দরী যুবতীরা তাকে ঘিরে থাকে। তরুণীদের সঙ্গে হাসি-পরিহাস করেন। এই রাগের বিলাবলী রাগিণী নায়কের অভিসার দর্শনের জন্য ব্যাকুল। খোলা কালো চুল, কপালে চন্দনের ফোঁটা। হিন্দোলের পটমঞ্জরি রাগিণীর রূপকল্পনায় রয়েছে অতিশয় রূপসীর আবির্ভাব। সোনার চেয়েও তিনি উজ্জ্বলবর্ণা, পরম সৌন্দর্য এবং লাবণ্যময়ী। বেণি করা চুলে নায়কের আসার অপেক্ষায় চঞ্চল। তিনি ঘরে অর্ধশায়িত অবস্থায় প্রতীক্ষা করছেন।
দীপক: নবীন যুবক। পরিধানে লাল পোশাক, গলায় গজমুক্তার মালা। তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে সব সময় রঙ্গরসিকতায় মেতে থাকেন। তিনি গান করেন এবং সেই সুর-প্রবাহে আগুন জ্বলে ওঠে। এই রাগের কেদারী রাগিণী হলো যুবতী। তার এলো চুল, কপালে চন্দ্রকলা। পরিধানে গেরুয়া পোশাক। দীপকের কানাড়া রাগিণীর বীরবেশ। শরীরের রং সোনার মতো উজ্জ্বল। নট বা নটি (পন্ডিত ভাতখন্ডে নট ও নটি একই রূপের ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন) রক্তবর্ণ, নবযৌবনসম্পন্ন। গলায় মুক্তার মালা, হাতে শঙ্খ ও সোনার অলংকার, বাহুতে বাজুবন্ধ।
শ্রীরাগ: গলায় পদ্মরাগ মণি ও স্ফটিকের মালা। তিনি সিংহাসনে উপবিষ্ট। তার রূপকল্পনায় দেখা যায় সাদা পোশাক, হাতে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল। যুবতীরা তার চারদিকে নানান রঙের পোশাকে নাচগান করেছে। এর মালবী রাগিণীর রূপে রয়েছে উন্নত স্তনযুগল। মালশ্রী রাগিণী হলো হলুদাভ বসনা। তিনি রক্ত, শ্বেত, নীল, হলুদ ইত্যাদি রঙের মণিমুক্তার অলংকারে আবৃত।
মেঘ: নিবিড় বর্ণ। তার মাথায় উত্তরীয়, রূপে মনোহর। এর মল্লার রাগিণী যুবতী, রূপলাবণ্যবতী। চাঁপা ফুলের মতো গায়ের রঙ, চুলে এই ফুলের মালা, কানে একই ফুলের দুল, কোমরবন্ধনী ও হাতের অলংকারও চাঁপা ফুলের তৈরি। পরিধানে হলুদাভ বস্ত্র।
প্রশ্ন উঠতে পারে, রাগের এই রূপকল্পনা কতটা বাস্তবসম্মত। সেটি বলার সুযোগ নেই। তবে কোনো শিল্পই মানবিক অনুভবের বাইরে নয়। এমনকি দেশকালের মধ্যেই তার নির্মাণ। যেকোনো শিল্পই ব্যক্তির আবেগ, অনুভূতি ও সৃষ্টিশীল চিন্তাকে উদ্দীপ্ত করে। রাগের রূপকল্পনা অস্বীকার করলে তার অন্তর্নিহিত ভাব ও সৌন্দর্যও ম্লান হয়ে পড়ে।

মডেল: অর্পিতা, এফা, সিম্মি ও নিহাফ
মেকওভার: পারসোনা
ওয়্যারড্রোব: আলমিরা বাই শাহরুখ আমিন (নিহাফ)
ছবি: ফারাবী তমাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top