skip to Main Content

ফিচার I শতবর্ষী প্যারামাউন্ট

বাঙালির আতিথেয়তায় পানীয় হিসেবে শরবত বিকল্পহীন। এর বিচিত্র স্বাদের প্রতি অনুরাগবশত গড়ে উঠেছে শরবত বিপণি। কলেজ স্ট্রিটের ‘প্যারামাউন্ট’ তেমনই একটি। বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির স্মারক শতবর্ষী এই তীর্থ গমনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন অতনু সিংহ

বাঙালির শরবতচর্চার আলাপে প্রথমেই আসবে ইসলামের প্রসঙ্গ। বাংলায় এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের সুবাদে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির অন্দরে প্রবেশ করে জীবনযাপনের সঙ্গে মিশে গেছে ইসলামিক দুনিয়ার অনুষঙ্গ। বাংলা ভাষার সঙ্গে যেমন আরবি-ফার্সির নানা শব্দ একাকার হয়েছে, তেমনই খাদ্যে, পানীয়ে, সৌন্দর্যবোধে ইসলাম প্রভাব বিস্তার করেছে বাংলায়। মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ার ফল ও ফুলের পাপড়ি সমৃদ্ধ পানীয়কে বলা হয় শরবত। আরবিতে বলা হয় শর্বা, তুর্কিতে সরবেত। শরবত শব্দটা ফার্সি। সুরা ও শরবত কাছাকাছি জিনিস। যদিও সুরা নেশার দ্রব্য। শরবত আমোদের পানীয়। ইরান থেকেই বাংলায় এর আগমন বলে মনে করা হয়। ধর্মবর্ণনির্বিশেষে সব বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে শরবতের গুরুত্ব প্রশ্নাতীত।
বাঙালির এই শরবতিচর্চার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হলো কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের শতাব্দীপ্রাচীন প্যারামাউন্ট শরবত। এটি শুধু বহুবিধ শরবতের দোকান নয়, বাংলার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত স্থানও বটে। সে বিষয় নিয়ে কিছু বলার আগে জানা যাক কী কী ধরনের শরবত পাওয়া যায় এই ‘প্যারামাউন্ট শরবত’-এ।
কোকো মালাই, ম্যাঙ্গো ম্যানিয়া, পাইনঅ্যাপল মালাই, ডাব শরবত, ক্রিমরোজ, লিচুর শরবত, খাস সিরাপ, লেমন সিরাপ, গ্রিন ম্যাঙ্গো, আঙুর শরবতের উজ্জ্বল উপস্থিতি এই পানীয় বিপণিতে। এ ছাড়া রাবড়ি দিয়ে তৈরি ‘প্যাশন ফ্রুটস’ কিংবা সিরাপের মধ্যে ‘ট্যামারিন্ড সিরাপ’ও উল্লেখযোগ্য। স্বাদভেদে এখানকার শরবতের দাম ভারতীয় রুপিতে ৪০ থেকে ২০০। এই সম্ভারের স্বাদ পেতে শুধু কলকাতা কিংবা পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার মানুষ এখানে ছুটে আসেন, তা নয়। বাংলাদেশ থেকেও নানা সময় পর্যটকের আনাগোনা দেখা যায় কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের ১/১/১ডি বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিটের ঠিকানায়।
একশ বছর আগে, ১৯১৮ সালে খোলা হয় এই দোকান। প্রথমে ঠিকানা ছিল ১/এ বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট। নাম ছিল ‘প্যারাডাইস’। বরিশাল থেকে কলকাতায় এসে এই দোকান শুরু করেছিলেন নীহাররঞ্জন মজুমদার। তিনি ছিলেন বরিশাল অনুশীলন সমিতির সদস্য। বলা যায় বিপ্লবী থেকে তিনি হয়ে ওঠেন শরবত বিক্রেতা। আর দেখতে দেখতে নীহারবাবুর এই উদ্যোগ সগৌরবে পার করে ফেলেছে শতবর্ষের মাইলফলক।
বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায় এই দোকানের জন্য ডাবের শরবতের ফমুর্লা তৈরি করে দিয়েছিলেন। যার মূল উপাদান ডাবের জল আর শাঁস। বাঙালি ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সফল হয়ে নিজেদের পুঁজি তৈরি করতে সক্ষম হোক, স্বনির্ভরতা অর্জন করুক—এই ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের লক্ষ্য। এ জন্য নিজে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বেঙ্গল কেমিক্যাল। পাশাপাশি অন্যদের প্রেরণা দিয়েছেন ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সফল হয়ে ব্রিটিশদের সমান্তরালে বাঙালির অর্থনৈতিক ভিত মজবুত করতে। তার উৎসাহেই প্রতিষ্ঠিত হয় প্যারামাউন্ট।
এসব কথা আমাদের জানিয়েছেন এই দোকানের বর্তমান কর্ণধার পার্থপ্রতিম মজুমদার। নীহাররঞ্জন মজুমদারের পরে এই দোকান চালিয়েছেন তার দুই পুত্র পরিমল মজুমদার ও দিলীপ মজুমদার। পরিমল মজুমদারের পুত্র পার্থপ্রতিম মজুমদার এখন দোকানের দায়িত্বে।
পার্থপ্রতিম মজুমদার জানাচ্ছেন, প্রথমে যখন এই দোকানের নাম ছিল ‘প্যারাডাইস’, তখন এটি ছিল ব্রিটিশবিরোধী বাঙালি বিপ্লবীদের আড্ডা ও গোপন মিটিংয়ের জায়গা। এই বিপ্লবীদের মধ্যে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, সত্যেন সেন, পুলিনবিহারী দাস প্রমুখ। তাদের সঙ্গে মিটিং করতেন প্রফুল্ল—এই খবর ব্রিটিশ সরকারের কানে যায়। শাসকদের রোষানল থেকে বাঁচতে কিছুদিন দোকানটি বন্ধ করে দেন নীহাররঞ্জন মজুমদার। পরে ব্রিটিশের চোখে ধুলো দিয়ে দোকানটির নাম বদলে পাশের আরেকটি ঠিকানায় ‘প্যারামাউন্ট’ নামের এই দোকান আবার চালু করেন।
এখানে কলকাতা তথা বাংলার শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতির জগতের বহু নক্ষত্র আনাগোনা করেছেন। সুভাষচন্দ্রের মতো বিপ্লবী থেকে শুরু করে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ, চলচ্চিত্র তারকা উত্তমকুমার, সুচিত্রা সেন, পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন, লেখিকা তসলিমা নাসরিন, অরুন্ধতী রায়সহ বহু বিশিষ্টজন এই শরবতের দোকানে এসেছেন। কেউ কেউ এসেছেন নিয়মিত, আড্ডায়ও মজেছেন।
যেহেতু এই শরবতের দোকানের কর্ণধার নীহাররঞ্জন মজুমদারের শিকড় বরিশাল। তাই তার উত্তরপুরুষেরা চান বাংলাদেশের ঢাকায় ও বরিশালে এই দোকানের শাখা খুলতে। তারা চান বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই দোকানের শরবতের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় ঘটুক।

ছবি: মাসুদুর রহিম রুবাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top