skip to Main Content

ফিচার I শারদীয় উৎসবের আঁতুড়ঘর

দেবী দুর্গার ইতিহাস কী? তাঁর পূজাই-বা প্রথম কোথায় শুরু হয়েছিল? হদিস দিয়েছেন উদয় শংকর বিশ্বাস

মা দুর্গা অম্বিকা, রুদ্রাণী, উমা, ভবানী, কন্যাকুমারী, কাত্যায়নী, জয়দুর্গা- কত না রূপে পূজিত। রূপের পার্থক্য অবশ্য যতই থাকুক, তিনি বাঙালির একান্ত আপনজন, ঘরের মেয়ে উমা। সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালির কাছে দুর্গা বিপত্তারিণী দেবী হিসেবেই পরিচিত। বাংলায় এমন কোনো জনপদ নেই, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গতিনাশিনী মা দুর্গা পূজিত হন না।
কিন্তু দেবী দুর্গার ইতিহাস কী? ঐতরেয় আরণ্যকের একটি মন্ত্রে (১০/১/৬৫) ‘দুর্গাদেবী’ নামের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। শাস্ত্র পন্ডিতেরা মনে করেন, সূর্য থেকে দুর্গার রূপের কল্পনা করা হয়েছে, তাই দুর্গাপূজার অর্থ যজ্ঞাগ্নির অকাল পূজা। দুর্গাপূজার প্রচলন কত প্রাচীন, তা নিয়ে মতভেদ আছে। তবে বিভিন্ন লেখকের রচনায় মা দুর্গার উল্লেখ থেকে মনে করা যেতে পারে, দেবী দুর্গা খুব অপরিচিত ছিলেন না। বাংলার প্রাচীনতম স্মৃতি নিবন্ধকার, ধর্মশাস্ত্রবেত্তা ভবদেব ভট্ট তাঁর দশকর্মা দীপিকা, কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি, ব্যবহার তিলকÑ এসব গ্রন্থে দুর্গার পূজার্চনা পদ্ধতির কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। তিনি ছিলেন ১১ শতকের বর্মন রাজা হরিবর্মাদেবের প্রধানমন্ত্রী। খ্রিস্টীয় ১২-১৩ শতকে রাঢ় নিবাসী মহামহোপাধ্যায় জীমূতবাহন রচিত দুর্গোৎসব নির্ণয় গ্রন্থে মৃৎপ্রতিমায় দুর্গার পূজার্চনার উল্লেখ আছে। একই রকম প্রখ্যাত শাস্ত্রবিদ শূলপাণি (খ্রি. ১৩৭৫-১৪৬০) প্রণীত দুর্গোৎসব বিবেক, বাসন্তী বিবেক এবং দুর্গোৎসব প্রয়োগ প্রভৃতি গ্রন্থে দুর্গাপূজাবিষয়ক আলোচনা ও নির্দেশিকা রয়েছে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক শ্রীচৈতন্যদেবের সমসাময়িক সুবিখ্যাত স্মৃতিকার রঘুনন্দন প্রণীত তিথিতত্ত্ব গ্রন্থে দুর্গোৎসবতত্ত্ব নামীয় প্রকরণে দুর্গাপূজাবিধি আলোচনা করেছেন। মিথিলারাজ সভাকবি, শাস্ত্রবিদ পন্ডিত ও বৈষ্ণব পদাবলীর রচয়িতা বিদ্যাপতি (খ্রি. ১৩৬৫-১৪৫০) তাঁর দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী গ্রন্থে মৃন্ময়ী দুর্গাপ্রতিমার পূজার উল্লেখ করেছেন। বিদ্যাপতির এই গ্রন্থ বাংলায় সুপরিচিত। কালিকাপুরাণ, দেবীপুরাণ, মৎস্যপুরাণ, কালীবিলাস, বৃহন্নন্দিকেশর পুরাণসমূহে দুর্গার উল্লেখ দেখা যায়। বলা বাহুল্য নয়, এ ধরনের কয়েক শতাব্দীপ্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থাদি অনুসরণ করলে জানা যায়, বাংলার মহাদেবী দুর্গার মৃৎপ্রতিমায় পূজার্চনা ঐতিহ্য কমপক্ষে আট শ-নয় শ বছরের প্রাচীন। তবে, কে কবে কোথায় প্রথম মৃৎপ্রতিমায় দুর্গার আরাধনা করেছিলেন, সেই ইতিহাস কিছুটা অস্পষ্ট।
মোগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫)-এর রাজত্বকালে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ ৮৮৭ বঙ্গাব্দে অর্থাৎ ১৫৮০ সালে বাংলায় প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন বলে ইতিহাসে প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়। রাজা কংস নারায়ণ ছিলেন মোগলদের নির্বাচিত বাংলার দেওয়ান ও সুবেদার। বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ-সমাজের মধ্যে তাহেরপুর রাজবংশ জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি ও দেশহিতৈষণা গুণে ছিল বিশেষ সম্মানিত। বারনই নদের (পূর্ববর্তী নাম বরাহী নদ) পূর্ব তীরে রামরামায় ছিল তাহিরপুর (বর্তমানে লোকমুখে তাহেরপুর) রাজবংশের আদি নিবাস। নদীভাঙনের কারণে রামরামা থেকে সরিয়ে এনে নদীর পশ্চিম তীরে গড়ে তোলা হয় বর্তমান রাজবাড়িটি। এই রাজবাড়ি প্রাঙ্গণে কংস নারায়ণদের প্রতিষ্ঠিত দুর্গামন্দির, শিবমন্দির, গোবিন্দমন্দিরসহ অন্যান্য স্থাপনা এখনো দেখতে পাওয়া যায়। ইতিহাসখ্যাত এই রাজবংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন সংস্কৃত বেণীসংহার-এর রচয়িতা ভট্টনারায়ণ বা নারায়ণভট্ট। তিনি ছিলেন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ। মনুসংহিতা গ্রন্থের টীকাকার কুল্লুক ভট্টের পুত্র রাজা কংস নারায়ণ তাহেরপুর রাজবংশের প্রভাব-প্রতিপত্তি বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন। রাজপুরোহিত রমেশ শাস্ত্রীর পরামর্শ অনুসারে প্রায় নয় লাখ টাকা ব্যয়ে তিনি শাস্ত্রসম্মতভাবে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেন। দুর্গাপূজার পদ্ধতি নামে রমেশ শাস্ত্রী একটি গ্রন্থ লিখেছিলেন। মাসব্যাপী প্রজাসাধারণের ভোজসহ বিনোদনের বিপুল আয়োজন করা হয়েছিল। অপরদিকে রাজা কংস নারায়ণের প্রবর্তিত শারদ দুর্গোৎসবকে ম্লান করার জন্য রাজশাহীরই ভাদুরিয়ার রাজা জগৎনারায়ণ প্রচলন করেছিলেন বাসন্তী দুর্গোৎসবের। বসন্তকালে এ পূজায় তিনিও ব্যয় করেছিলেন নয় লাখের বেশি টাকা।

এসব আয়োজনের কিছুকাল পরে নদীয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার ১৬০৬ সালে নদীয়ার কৃষ্ণনগরে আয়োজন করেন শারদীয় দুর্গাপূজার। প্রায় একই সময় কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার নিজ বাড়িতে ১৬১০ সালে এ পূজার সূত্রপাত করেন। তবে, প্রথম সর্বজনীন দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয় হুগলির গুপ্তিপাড়ায়। এরপর বাংলার বড়-ছোট নানা ধরনের জমিদারেরা এমনকি অর্থশালী গৃহস্থরা আয়োজন করতে থাকেন দুর্গাপূজার। সমগ্র বাংলায় দুর্গাপূজা ছড়িয়ে পড়ে, হয়ে ওঠে বাঙালির প্রাণের উৎসব। যদিও গ্রহপূজা, স্তূপপূজা, পশুপক্ষীপূজা, মূর্তিপূজা- সব অর্চনাতেই বাংলায় দুর্গাপূজার অস্তিত্ব ছিল। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না। কথিত আছে, খ্রিস্টীয় ১৪ শতকে রাজা জগদ্রাম (জগৎরাম রায়) বাংলায় আধুনিক প্রথা অনুসারী দুর্গোৎসব চালু করেছিলেন। ইনি ছিলেন জগদ্রামী রামায়ণ প্রণেতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার মেজিয়া থানার ভুলুই গ্রামের বাসিন্দা। অন্য মতে, মালদহের অধিপতি জগদ্রাম ভাদুড়ী মহাদেবের মাটির মূর্তি গড়ে বাংলায় প্রথম ‘নবরাত্রি ব্রত’ উৎসব (দুর্গাপূজা) পালন করেছিলেন। এসব পূজা সবই রাজা কংস নারায়ণের দেখানো পথে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সে কারণে তাহেরপুরকে বাংলার দুর্গাপূজার আঁতুড়ঘর হিসেবে অভিহিত করা হয়। বর্তমানে এখানে নতুন রূপে অষ্টধাতুর মা দুর্গা প্রতিস্থাপিত। যেখানে মহা ধুমধামে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। অষ্টধাতুর মাকে দেখবার জন্য দূরদূরান্ত থেকে প্রতিদিন ভক্ত ও সাধারণ দর্শনার্থীরা আসেন এ মন্দিরে। দুর্গামন্দিরের একটি প্রবেশ তোরণ আছে। এখানে অবশ্য দুর্গামন্দির ছাড়াও গোবিন্দ মন্দিরের কথা বলা আছে। তোরণ পেরিয়ে প্রবেশ করলে প্রথমে দেখা মিলবে প্রাচীন শিবমন্দিরের। যেখানে ছোট একটি শিবলিঙ্গ আছে। মূল শিবলিঙ্গটি অনেক আগেই খোয়া গেছে। এরপর আছে গোবিন্দমন্দির। এটি বহু পুরোনো, এর সামনে আছে একটি আটচালা। প্রতিবছর এখানে নামযজ্ঞ হয়। দেশের সেরা কীর্তনিয়ারা আসেন এখানে এবং কীর্তনের সুরে মুখরিত হয়ে ওঠে গোটা মন্দির প্রাঙ্গণ। নাটমন্ডপের এক পাশে রয়েছে বিশাল ইদারা বা কূপ। বর্তমানে কূপটি অব্যবহৃত। তারপর এগিয়ে গেলে কালী মায়ের মন্দির এবং সবার পরে দেখা মিলবে দুর্গামন্দিরের। বর্তমান দুর্গামন্দিরটি সংস্কার করা হয়েছে। ধামরাইয়ের বিখ্যাত কাঁসা-পিতল শিল্পীদের তৈরি করা অষ্টধাতুর মা দুর্গা এখানে লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিকসহ সপরিবারে রয়েছেন। এখানকার মায়ের নিত্যপূজা হয়। দিবভোগ দেওয়া হয় মাকে। যেকোনো ভক্ত মায়ের পূজা দিয়ে ভোগ গ্রহণ করতে পারেন। নিরিবিলি কিছুটা সময় কাটানোর জন্য তাহেরপুর দুর্গামন্দির আদর্শ জায়গা। শারদীয় দুর্গাপূজায় সহজেই ঘুরে আসতে পারেন বাংলার শারদীয় দুর্গাপূজার আঁতুড়ঘরে।

লেখক: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক এবং গবেষক
ছবি: লেখক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top