skip to Main Content

ফিচার I সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম

বাঙালির সাবেকিয়ানা রসনায় ধরে রেখেছে সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম। বদলে যাওয়া কলকাতায়

বাংলাদেশ থেকে যাঁরা কলকাতায় বেড়াতে যান, তাঁরা সাধারণ ছকে বাঁধা নিয়মে শহরটি ঘুরে দেখেন। মার্কিউজ স্ট্রিট, সদর স্ট্রিটসহ নিউমার্কেট এলাকার হোটেলে দিনযাপন আর ওই চত্বরেই হাতে গোনা কিছু রেস্তোরাঁয় আহারাদি সম্পন্ন করেন তাঁরা। কিন্তু চেনা ছকে কলকাতাকে দেখলে ব্রিটিশদের বানানো ওই শহরের অনেক কিছুই বুঝতে পারা যাবে না, চেনা যাবে না সেখানকার বাঙালিদের নিজস্ব যাপনের অন্দর। শুধু কলকাতা নয়, যেকোনো শহরকে জানতে গেলে তার নিজস্ব বিষয়গুলো খুঁজে বের করতে হয়। সে জন্য সন্ধান করতে হয় সেখানকার পরিচয়বাহী ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক জায়গাগুলোকে। আর যেকোনো জায়গার সাংস্কৃতিক পরিচয় বহন করে তার নিজস্ব রসনাজগৎ।
বাংলাদেশে যেমন জেলা অনুযায়ী রান্নার নানা তারতম্য রয়েছে, তেমনই পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার খাবারের স্বাদও বিভিন্ন ধরনের। কলকাতার বাঙালিদের খাবারের নিজস্ব স্বাদ রয়েছে, তা বুঝতে পারা যাবে শহরের যেকোনো করপোরেট ফুড চেইনে অথবা নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা কেতাদুরস্ত হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোয়। কলকাতার বাঙালি খাবারের সাবেকিয়ানা খুঁজতে গিয়ে ‘ক্যানভাস’ খুঁজে পেয়েছিল সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম। ট্র্যাডিশনাল এই হোটেল কলকাতার তথা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নানা খাবারে পরিপূর্ণ। নগরীটির বিভিন্ন অলিগলি ঘুরে বেড়ালে যেমন ইতিহাস কথা বলে ওঠে, তেমনই প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন এই সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমে খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালির সাবেকিয়ানার সঙ্গে সম্পৃক্ত নানা খাবার, বিশেষত কলকাতা তথা পশ্চিম বাংলার রসনাজগতের নানা পদ।
সিদ্ধেশ্বরী আশ্রমটি বাঙালি হিন্দুদের দেবী সিদ্ধেশ্বরী কালীর নামে, হোটেলটি তৈরি হয়েছিল অনেকটা আশ্রমের কায়দায়। আগে খাওয়ার পাশাপাশি থাকার অর্থাৎ মেসের ব্যবস্থা ছিল, এখন নেই। কিন্তু হোটেলের কর্মচারীরাই এখন মেসের জায়গায় বসবাস করেন। সিদ্ধেশ্বরী কালীর নামে হলেও এই হোটেলকে কেবল হিন্দু হোটেল বলে না কর্তৃপক্ষ। বরং এই হোটেল হিন্দু-মুসলিমসহ সব মানুষের জন্যই উন্মুক্ত।
এই হোটেল তৈরি হয়েছিল ১৯৩৮ সালে, যদিও হোটেলের দায়িত্ব বর্তমানে যাদের হাতে তারা জানাচ্ছেন, বোর্ডে ১৯৩৮ লেখা থাকলেও এটি আসলে স্থাপিত হয় আরও ১০ বছর আগে, ১৯২৮ সালে। কোনো রকম চায়নিজ, মোগলাই, থাই, ইতালিয়ান খাবার পাওয়া যায় না এখানে। কেবল বাঙালির ট্র্যাডিশনাল মেনু। দুপুরের মেনুতে রয়েছে সরু চালের ভাত, মোটা চালের ভাত, সোনা মুগের ডাল, মসুরের পাতলা ডাল, বিভিন্ন শাকের চচ্চড়ি, মুড়িঘন্ট, শুক্ত, আলুপোস্ত, এঁচোড়ের সবজি, ফুলকপির তরকারি, ঝুরো আলুভাজা, আলুভাতে বা আলুর ভর্তা ইত্যাদি। সঙ্গে রয়েছে ১০-১২ রকমের মাছ আর খাসি ও মুরগির মাংস এবং আম অথবা টমেটোর চাটনি। মাছের মধ্যে রুই পোস্ত, রুই কালিয়া, রুই কষা, রুই মাছের পাতলা ঝোল, কাতলার কষা, ভাপা ইলিশ, সরিষা ইলিশ, ট্যাংরা মাছের ঝোল, পাবদার ঝোল, চিতল মাছের পেটি, ভোলা মাছের ঝাল, ভেটকি মাছের পাতুরি, বাগদা চিংড়ি, গলদা চিংড়ি, কই, সিঙ্গি, মাগুর ও মৌরালা মাছের ঝোল ইত্যাদি। আর রাতের বেলা রুটি, ভাত, ভেজিটেবল তড়কা, চিকেন তড়কা, ডিম তড়কা, ডিমের ঝোল আর চিকেন কষা। অবশ্য কেউ চাইলে রাতেও খাসির ঝোল বা পছন্দমতো মাছ খেতে পারেন।
এই হোটেলের পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন দেবযানী সেন ও রীতা সেন। দেবযানী জানাচ্ছেন, সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম তৈরি করেছিলেন ক্ষুদিরাম সরকার। আজকে যাঁরা এই হোটেলের দায়িত্বে আছেন, তাঁদের থেকে প্রায় চার প্রজন্ম আগে তিনি এটি তৈরি করেছিলেন। সেই পরম্পরা বহন করে চলছে। দেবযানী আরও জানাচ্ছেন, ১৯২৮ সাল থেকে এই হোটেল চলছে। কলকাতার জমিদার রানী রাসমণির জায়গা ভাড়া নিয়ে এই হোটেল গড়ে উঠেছিল। বেশ কিছুদিন হোটেলটি দেখভাল করতেন প্রয়াত সুজিত সেন। তাঁর প্রয়াণের পর ২০১৫ সাল থেকে এই হোটেল দেখভাল করছেন দেবযানী সেন ও রীতা সেন। এই দুজনের পরিচয় হলো, তাঁরা প্রয়াত সুজিত সেনের স্ত্রী ও বোন। দেবযানী পেশায় শিক্ষিকা আর রীতা সরকারি চাকরিজীবী। চাকরি সামলে দুজনেই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই হোটেল। এর কয়েকটি বাড়ির পরেই রয়েছে রানী রাসমণিদের বাড়ি। নিউমার্কেটের পেছন দিকে মার্কিউজ স্ট্রিট থেকে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় রোড যেতে রানী রাসমণি রোড আর এস এন ব্যানার্জি রোডের সংযোগস্থলের একটু আগে ডান দিকে রয়েছে এই হোটেল। এর একতলায় অনেক আগে মেস ছিল। গ্রাম-বাংলা ও মফস্বল থেকে কলকাতায় চাকরি করতে আসা মানুষেরা ওই মেসে থাকতেন। তাঁরা দুবেলা খেতেন এবং তাঁদের পাশাপাশি বাইরের লোকজনও এখানে নিয়ম করে দুবেলা খেতেন। তখন খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল মাটিতে আসন পেতে, কাঁসার থালা, বাটি ও গ্লাসে। এখন মেস নেই। কিন্তু দুবেলা হোটেল রয়েছে আজও জমজমাট। কাঁসার থালা-বাটি কিংবা মাটিতে আসনের ব্যবস্থা নেই, বরং চেয়ার-টেবিলেই খাওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে, তা-ও অনেক দিন হলো। চাকরিজীবী, অফিসপাড়ার লোকজন, পর্যটকসহ নানা ধরনের মানুষ এখানে দুবেলা পেট ভরে খান।
ঐতিহ্যের সঙ্গে যন্ত্রের মেলবন্ধনও করা হচ্ছে এই হোটেলে। এত দিন গোটা রেস্তোরাঁ ছিল নন-এসি। এখন আলাদা করে এসি কেবিন তৈরি করা হয়েছে। স্টিলের থালার উপরে কলাপাতা বিছিয়ে তাতে কাঁচা লঙ্কা, লেবু, পেঁয়াজের টুকরোসহ খাবার পরিবেশন করা হয়। স্টিলের গ্লাসে পানি ছাড়াও চাহিদামতো মাটির ভাঁড়ে করেও ক্রেতাদের কাছে খাবারের সঙ্গে পানি পরিবেশন করা হয়। হোটেলে বসে খাওয়ার পাশাপাশি পার্সেল নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। ভবিষ্যতে অ্যাপ বেইসড ফুড চেইনের সঙ্গেও এই হোটেলের খাবার মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে এই হোটেলের।
মাংসের থেকেও এ হোটেলে মাছের পদের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়। তবে চিংড়ি, পাবদা, ইলিশ, ভোলা, ভেটকি, ট্যাংরা ইত্যাদি মাছের পদের ক্ষেত্রে দাম নির্দিষ্ট নয়। বাজারে মাছের দাম যেদিন যেমন তার ওপর নির্ভর করে দৈনন্দিন এসব মাছের পদগুলোর দাম ঠিক করা হয়। খাওয়া শুরু হয় প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে। চলে বেলা তিনটে অবধি। আবার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা থেকে রাতের খাবারের জন্য মানুষ ভিড় জমান এই হোটেলে। প্রতিদিন অফিস করেন যাঁরা এমন মানুষের জন্য ভাত, ডাল, তরকারি, চারাপোনা আর রুই মাছের পাতলা ঝোল ও চাটনির ব্যবস্থা থাকে। যাঁরা শখ করে খেতে আসেন তাঁদের এবং পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন মাছ ও মাংসের নানা ধরনের মুখরোচক পদের ব্যবস্থা থাকে, আবার অসুস্থ মানুষদের কথা মাথায় রেখেও বিশেষ পদের ব্যবস্থা থাকে এখানে। প্রতিবছর পয়লা বৈশাখে এখানে যত মানুষ খান, তাঁদের পাতে খাবারের শেষে হোটেলের তরফ থেকে দই ও রসগোল্লা সৌজন্যবশত দেওয়া হয়, ওইদিন এগুলোর জন্য কোনো দাম নেওয়া হয় না।

দেবযানী সেন

এই হোটেলে দেখার মতো একটি বিষয় রয়েছে। তা হলো, কোন টেবিলে খাবারের বিল কত, সেটা বিশেষ ঢঙে অতিদ্রুত ক্যাশ কাউন্টারে ওয়েটাররা বলে যান। এটা শুনতে অনেক সময় কোনো লোকগান অথবা মন্ত্রোচ্চারণের মতোও শোনায়। দেবযানী দেবী জানাচ্ছেন, এই হোটেলের কর্মচারীরা মিলে একটা পরিবারের মতো হয়েছে, তাঁদের কাউকেই বাইরের মানুষ মনে করা হয় না। হোটেলের শ্রীবৃদ্ধি হচ্ছে কর্মচারীদের জন্যই।
যেহেতু নামের সঙ্গে ‘আশ্রম’ শব্দটা যুক্ত রয়েছে, তাই বাণিজ্যের থেকেও বড় করে সেবার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয় এখানে। এই হোটেল দীর্ঘদিন চলেছিল সুজিত সেনের হাত ধরে। সুজিতবাবু বাংলার বাউল-ফকিরদের আপনজন ছিলেন, নানা সময়েই পড়ে থাকতেন বিভিন্ন আশ্রমে, আখড়ায়, সাধুসেবায়। তিনি এই হোটেলের মধ্যে সহজ একটা ভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। দেবযানী সেন ও রীতা সেনও চান সেই সহজ ভাবটা নিয়ে হোটেলকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তবে বিদেশি ও বিজাতীয় খাবারের সঙ্গে বাঙালির ট্র্যাডিশনাল খাবার যাতে প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যায় এবং বাঙালিও যাতে তার খাবারকে বাংলার বাইরে আরও বেশি করে জনপ্রিয় করে তুলতে পারে, সেই ব্যাপারটাও দেবযানী সেনেদের ভাবনায় রয়েছে। মুক্তবাণিজ্যের যুগে কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ তথা সমগ্র বঙ্গের বাঙালির সাবেকিয়ানার রসনাসম্ভারকে বহুদূর ব্যাপ্ত করার ক্ষেত্রে সিদ্ধেশ্বরী আশ্রম আগামীতে বড় কোনো ভূমিকা পালন করতেই পারে- এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে হোটেল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে।

 অতনু সিংহ
ছবি: সৈকত মল্লিক ও অতনু সিংহ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top