skip to Main Content

ফিচার I সুরমাপারের স্বাদ!

দেশের উত্তর-পূর্ব কোণের ভূখ-টি প্রকৃতিতে যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনি খাবারেও। লিখেছেন সামীউর রহমান

বাংলা সাহিত্যে স্বাদু গদ্য লিখিয়েদের মধ্যে সৈয়দ মুজতবা আলীর তুলনীয় লেখক খুব কম। উপভোগ্য তার লেখনী। ঠিক যেন পছন্দসই কোনো খাবার! তিনি যে ভোজনরসিক ছিলেন, তার লেখনীতেই প্রমাণিত। কাবুলিওয়ালার সঙ্গে দস্তরখানে, নীল নদের পারের ক্যাফের আড্ডা থেকে প্যারিসের অভিজাত রেস্তোরাঁ- সর্বত্রই তার সাবলীল বিচরণ। তিনি জন্মেছিলেন বরাক উপত্যকায়। র‌্যাডক্লিফ লাইন তার জন্মস্থান করিমগঞ্জকে বাংলাদেশের বাইরে ঠেলে দিলেও সিলেটের মানুষ করিমগঞ্জকে শ্রীহট্টের অংশ বলেই মনে করেন। সীমানারেখা পাঞ্জাবকে ভাগ করলেও যেমন পাঞ্জাবি রসনাকে আলাদা করতে পারেনি, ব্রিটিশদের এঁকে দেয়া সীমারেখাও সিলেটকে ভাঙতে ব্যর্থ। আর কী আশ্চর্য, খোদ ইংল্যান্ডের বুকে এখন সিলেটি রসনার জয়জয়কার!
দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশে যারা বেড়াতে আসেন, ফেরার পথে তাদের সঙ্গী হয় নিকোবিনা কোম্পানির সাতকড়ার আচারের একটি বয়াম। সিলেটি রান্নার আইকন হয়ে গেছে সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংসের পদটি। কাঁচা সাতকড়া বেছে কেনা, পরিবহন ও প্রক্রিয়াজাত করার ঝামেলা এড়াতেই পর্যটকরা কিনে নেন সাতকড়ার আচার। হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর মাজারের আশপাশে বেশির ভাগ দোকানেই এই আচার সুলভ বলে কিনতেও ভুল হয় না! একটু ঝাল করে রান্নার শেষ দিকে সাতকড়ার আচার মিশিয়ে দিলে বেশ একটা ঘ্রাণ হয়, ঝোলে যোগ হয় একটা মৃদু তেতো ভাব, যা মাংস ভুনার স্বাদ বাড়িয়ে তোলে। তবে সিলেটের পাকা গৃহিণীরা ভুলেও ওপথ মাড়ান না! বয়ামবন্দি আচারের চেয়ে টাটকা সাতকড়া দিয়েই তারা তৈরি করেন মাংসের এই পদ।
বাতাবিলেবু আকৃতির একটি লেবুজাতীয় ফল সাতকড়া, যা সিলেট, মেঘালয় ও আসাম অঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলেই জš§ায়। সেই সাতকড়া কেনায়ও বাড়ির কর্তাকে দিতে হবে মুনশিয়ানার পরিচয়। বেছে বেছে কম তেতো ও সুন্দর ঘ্রাণযুক্ত সাতকড়া না কিনলে যে সবটাই মাটি! তবে গৃহিণীর অভিজ্ঞতা কম মূল্যবান নয়। সাতকড়া কাটার পর চেখে বুঝতে হয় কতটা তেতো। শুধু তা-ই নয়, রান্নায় মেশাতেও হয় সময়মতো। বেশিক্ষণ জ্বালে রাখলে পুরো রান্নাটাই হয়ে যাবে তেতো, আবার খুব কম সময়ের জন্য রান্না হলে ঘ্রাণটা ঠিকমতো বেরোবে না। এই জটিল হিসাব কষেই মাংস কষিয়ে রাঁধতে হবে সাতকড়া দিয়ে।
এভাবে মাংস রান্নাটা বহুল পরিচিত হলেও সিলেটি রসনায় মাছের সঙ্গে সাতকড়া খাওয়াটা স্থানীয়ভাবে বেশি প্রচলিত। ছোট মাছ, কিংবা বড় মাছের কাটাকুটো বা মাথার অংশ দিয়ে সাতকড়ার টক ঝোল দুপুরের খাবারে শেষ পদ হিসেবে সিলেটিদের কাছে খুব উপাদেয়। স্থানীয় ভাষায় যা পরিচিত ‘ট্যাঙ্গা’ বা ‘খাট্টা’ নামে। বাংলাদেশে বেশির ভাগ জায়গাতেই ভাত তরকারির পর শেষ পর্বে ডাল খাওয়া হলেও সিলেটে ডালের বদলে মাছের এই টক ঝোল যথেষ্ট সমাদৃত। ট্যাঙ্গা বা খাট্টা রান্নায় সাতকড়া ছাড়াও ব্যবহৃত হয় আদালেবু ও থৈকর। এই দুটোই আসাম অঞ্চলের নিজস্ব টকজাতীয় ফল, যার উৎপাদন হয় সিলেটের পাহাড়ি টিলায়। আদালেবু ও থৈকর সাধারণত সাতকড়ার চেয়ে আকারে খানিকটা ছোট হয়। নানান ঔষধি ও ভেষজ গুণসম্পন্ন এসব লেবুজাতীয় ফল মাছ রান্নায় বেশি ব্যবহৃত হয়। ছোট করে কেটে মলা-ঢেলাজাতীয় মাছের মাখা ঝোল কিংবা টক ঝোল রান্নায় আদালেবু ও থৈকর যোগ করে বাড়তি স্বাদ। বিশেষ করে গরমের দিনে তেল মসলাযুক্ত খাবারের বদলে মাছের টক শরীরে আনে প্রশান্তি।
আখনির বর্ণনা বাদ দিয়ে সিলেটি রসনার গল্প বলা আর বিরিয়ানি থেকে মাংস বাদ দেয়া একই কথা। অনেক জায়গায় ইফতারি মানে ছোলা-মুড়ি মাখা! তবে সিলেটে মুড়ি নৈবচ নৈবচ! ইফতার মানে আখনি থাকতেই হবে। আপাতদৃষ্টিতে সিলেটের আখনির সঙ্গে ঢাকাই তেহারির কোনো অমিল খুঁজে পাওয়া না গেলেও স্বাদে ও রন্ধনশৈলীতে এই দুটো পদ অনেকটাই আলাদা। আখনি রান্না করা হয় তেজপাতা, দারুচিনি, লবঙ্গ ও নানান মসলায় সুবাসিত পানিতে। ফুটে ওঠা পানিতে রেশমি কাপড়ের ভেতর নানান মসলার পুঁটলি বানিয়ে ছেড়ে দেয়া হয়। পানি কমে এলে কিংবা মসলার নির্যাস পানিতে মিশে গেলে সেই পুঁটলি তুলে নেয়া হয় কিংবা পানি ছেঁকে নেয়া হয়। তারপর সেই পানি দিয়েই হয় আখনি। গরু, খাসি বা মুরগির মাংস ছোট ছোট টুকরো করে পোলাওর চাল (চিনিগুঁড়া বা কালিজিরা) দিয়ে রান্না হয় আখনি। তাতে মেশানো হয় মটর, গাজর ও আলু। ইফতারে আখনি তো রীতিমতো অপরিহার্য। ছোলা ভাজা বা স্থানীয়ভাবে ‘চানা ভুনা’র সঙ্গে আখনি ও পেঁয়াজু না হলে তো সিলেটিদের ইফতারই জমবে না! রোজার দিনগুলো ছাড়াও অতিথি আপ্যায়নে, বিশেষ ধর্মীয় দিন বা মৃত্যুবার্ষিকীতে (আঞ্চলিক ভাষায় শিন্নি) তবারক হিসেবেও আখনি খাওয়ানো হয়।
ইয়েমেন থেকে এসেছিলেন হজরত শাহজালাল (রহ.), তার সঙ্গে এসেছিলেন আরও ৩৬০ আউলিয়া। যারা থেকে গিয়েছিলেন সিলেটেই। ধারণা করা হয়, তাদের সঙ্গেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে এই রন্ধনপ্রণালি আসে সিলেট অঞ্চলে। এ রকম আরেকটি খাবার ময়দার হালুয়া, যা ‘তুশা শিন্নি’ নামেও আঞ্চলিকভাবে পরিচিত। বাংলাদেশের বেশির ভাগ জায়গায় বুটের ডালের হালুয়া, বেসনের হালুয়া, সুজির হালুয়া তৈরি করা হয়। মূলত শবেবরাতে হালুয়া তৈরির প্রচলন। তবে ময়দার হালুয়া বা তুশা শিন্নি সিলেটের বাইরে খুব কম প্রচলিত। ‘হালুয়া’র ধারণাটি এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। নানান অঞ্চলে ও ভাষার বিবর্তনে হেলভা, হালভা, আলুভা নামের যে খাদ্য প্রস্তুতপ্রণালি, সেটাই হালুয়া। মূল প্রক্রিয়া হচ্ছে শস্যদানার গুঁড়া বা ফলের নরম অংশকে ঘি বা তেলে ভেজে চিনির প্রলেপ দিয়ে সংরক্ষণ। সিলেট অঞ্চলে শবেবরাতে মসজিদে মসজিদে শিন্নি বিতরণ বা আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠানো রুটি-হালুয়ার তশতরিতে তুশা শিনি থাকবেই। গরম পানিতে তেজপাতা, দারুচিনি, এলাচি দিয়ে ফুটিয়ে তাতে চিনি ঢেলে তৈরি করতে হবে সুগন্ধি ‘সিরা’। তারপর ময়দা ঘিয়ে ভেজে চিনির সিরা ঢেলে নেড়ে নেড়ে তৈরি করা হয় তুশা শিন্নি। তাতে মেশানো হয় কিশমিশ, বাদাম ইত্যাদি। সিলেটের মাজার রোডে, দরগাহর ঠিক বাইরে দুপাশে তাকালেই দেখতে পাবেন, অনেক দোকানেই টিলার মতো স্তূপ করে ডিশে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তুশা শিন্নি। তবে ওসব না চেখে কোনো সিলেটি বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন আদায় করুন, তাহলে ‘আসলি সোয়াদ’ টের পাবেন।
বিরুইন চালের ‘চুঙ্গা পিঠা’র গল্প না বললে তো অসম্পূর্ণই থেকে যাবে সিলেটি রান্নার উপাখ্যান। ধারণা করা হয়, স্থানীয় পাহাড়ি আদিবাসীরা হাঁড়ি-পাতিলের বদলে বাঁশের ভেতরে চাল ভরে তারপর বাঁশ পুড়িয়ে ভেতরের চাল সেদ্ধ করে ভাত খেত। ধীরে ধীরে সেটা স্থানান্তরিত হয় সমতলের বাসিন্দাদের জীবনধারায়। চুঙ্গা পিঠা খেতে লাগবে ঢলু বাঁশ আর বিরুইন চাল। বিরুইন চাল একধরনের চাল, যার ভাত আঠালো। থাই রসনার ‘স্টিকি রাইস’ যার অনেকটা কাছাকাছি। বাঁশের ভেতর ভেজানো চাল ভরে বাঁশের মুখটা কলাপাতা দিয়ে বন্ধ করে হালকা আঁচে বাঁশ পোড়ানো হয়। কিছু সময় পর বাঁশ ফেড়ে ভেতর থেকে বের করে আনা হয় আঠালো লম্বাটে ভাতের দলা, যার সঙ্গে মিশে আছে ঢলু বাঁশের ঘ্রাণ। এই চুঙ্গা পিঠা খাওয়া হয় মাছ বিরান অর্থাৎ মাছভাজা অথবা দুধ, গুড় ও নারকেলের মিশ্রণে বানানো খিরসা দিয়ে। শহুরে জীবনে অবশ্য এত আয়োজনের উপায় নেই। তাই বলে কি খাওয়া থেমে থাকবে? অনেক শহুরে বাড়িতে ছুটির দিনের সকালের নাশতাটা থাকে বিরুইন চালের ভাতের সঙ্গে দুধ, কলা, নারকেল। পোলাও রান্নাও করা যায় বিরুইন চাল দিয়ে, এই আঠালো ভাতের পোলাওর সঙ্গে বোয়াল মাছ ভাজা, বড় কৈ মাছ ভাজা, সরপুঁটি মাছ ভাজা খুব উপাদেয়। মোদ্দা কথা ‘বিরুইন ভাত আর মাছ বিরান’ যেন রাজ্জাক-শাবানা জুটি!
এসব ছাড়াও বলতে হয় রাই শর্ষের শাক বা লাইশাকের কথা। মণিপুরিরা বলে লেহু, তাদের সবচেয়ে প্রিয় শাক। এটাই ভারতের সেভেন সিস্টার্স অঞ্চলে আর নেপালে পরিচিত গুন্দ্রুক নামে। গাছ আর ফুল দেখতে সরিষাগাছের মতো, পার্থক্য হলো বড় হলে পাতাগুলো অনেক প্রশস্ত হয়ে যায়। স্বাদও কিছুটা সরিষা শাকের মতো, তবে ঝাঁজ সরিষা থেকে অনেক গুণ বেশি। কাঁচা লাইশাক মুখে দিলে ঝাল লাগে। লাইশাক ভেজে খাওয়া যায়। ভর্তা করেও। আলু, বেগুন বা অন্য সবজির সঙ্গে মিলিয়ে লাবড়া বানিয়ে খাওয়া যায়। মণিপুরিরা খাবারের সঙ্গে কাঁচা লাইশাকের কচি ডগা কামড়ে খেতে পছন্দ করে। লেহুর কচি ডগার সঙ্গে সেদ্ধ আলু আর শুঁটকি মিশিয়ে তৈরি হয় মণিপুরি স্যালাড সেঞ্চু। মাছের সঙ্গে, বিশেষ করে আইড় বা বোয়াল মাছ দিয়ে লাইশাকের রান্না তুলনাহীন। এতে টাকি বা শোল মাছ মিশিয়ে বানানো ভর্তার তো তুলনা নেই! লাইশাকের কথা এলে কান টানলে মাথা আসার মতোই আসে সিলেটি নাগা মরিচের কথা। বিশ্বের সবচেয়ে ঝাল মরিচ ভূত জলোকিয়ার নিকটাত্মীয় এই নাগা মরিচ। সিলেটিরা লাইশাকের ভর্তার সঙ্গে কিংবা সিদল শুঁটকির সঙ্গে পাতে নাগা মরিচ পেলে যে ফোয়া গ্রা, ক্যাভিয়েরও দূরে ঠেলে দেবেন, সে কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়!
সিলেট থেকে জাহাজে চড়ে বিলেত যাওয়া খালাসিরাই ব্রিটেনে কারি বিপ্লবের জনক! স্যাঁতসেঁতে মেঘলা আবহাওয়ায় টক ঝাল স্বাদের ‘কারি’ই ব্রিটিশদের স্বাদকোরকে জুগিয়েছিল এমন টংকার, যা তারা পায়নি হ্যাম, বেকন আর সসেজে। তাদের হাত ধরেই তো চিকেন টিক্কা মাসালা, বালতি চিকেনের মতো উদ্ভাবনী সব ডিশ তুষ্ট করছে ব্রিটিশ রসনা।
আখনি থেকে আদালেবু, সাতকড়া মাংস থেকে সাত রঙের চা, সিলেটের খাবারের বৈচিত্র্য এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির মতোই। দেশের উত্তর-পূর্ব কোণের এই ভূখন্ড প্রকৃতি যেন সাজিয়েছে নিজ হাতে। আছে টিলাময় ছোট ছোট পাহাড়ে চা গাছের সারি, স্বচ্ছ জলের পাহাড়ি নদী, ঝরনা, জলাবন আর চিরহরিৎ বন; তেমনি এই অঞ্চলের খাবারও বৈচিত্র্যে ভরপুর। আর সে কারণেই বোধ হয় দেশের অন্যান্য জায়গার চেয়ে সুরমাপারের স্বাদ খানিকটা আলাদাই!

লেখক: সাংবাদিক, কালের কণ্ঠ
ছবি: সুমন্ত গুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top