skip to Main Content

ফিচার I ২০১৮ ফ্যাশন রাউন্ডআপ

চমকে ভরপুর ছিল গত হয়ে যাওয়া ২০১৮ সালের ফ্যাশন জগৎ। নতুন ট্রেন্ড, ভিন্ন আঙ্গিকের উপস্থাপনা, ডিজাইনারদের বৈচিত্র্যময় কালেকশন, সেলিব্রিটি এনডোর্সমেন্ট- সব মিলিয়ে বছরটি ছিল পুরোপুরি সরগরম। বিগত বর্ষের সবচেয়ে আলোচিত ফ্যাশন ট্রেন্ড ও চমকগুলো নিয়ে এই আয়োজনে

প্রতিবছরের ফ্যাশন ট্রেন্ড ও নতুন আকর্ষণগুলোর সূত্রপাত হয় ফ্যাশন উইকগুলোর মাধ্যমে। সবচেয়ে বড় চারটি ফ্যাশন ক্যাপিটাল নিউইয়র্ক, লন্ডন, মিলান ও প্যারিসে বিশ্বের সব স্বনামধন্য ফ্যাশন ডিজাইনাররা রানওয়েতে উপস্থাপন করেন নতুন সব ড্রেস ও অ্যাকসেসরিজ। পরবর্তী সময়ে সেগুলো পৌঁছে যায় গ্রাহকের দোরগোড়ায়। বিগত বছরেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বছর শুরুর ট্রেন্ড হিসেবে আগের বছরের স্প্রিং-সামার ফ্যাশন উইকগুলোতে দেখা যায় সহজ ও আরামদায়ক পোশাকের আধিপত্য। গুচি, ব্যালেন্সিয়াগা, ভারসাচি, শ্যানেলের মতো ব্র্যান্ডগুলো তুলে ধরে ইজি ফ্যাশন ও কোমল রঙের সমন্বয়ে অভিনব কিছু ডিজাইন। এর রেশ ধরে গত বছরের শুরুতে ফ্যাশন ট্রেন্ডে বিশ্বব্যাপী আধিপত্য ছিল স্ট্রিট ওয়্যার এবং সরবেট ও জেলাটো রঙের। ব্লাশ পিঙ্ক, পাউডার ব্লু, সফট পিচ ইত্যাদি রঙের আধিক্য ছিল ব্যাপক। এই প্যাস্টেল কালারের সূচনা হয় শ্যানেল, প্রিন, ভিক্টোরিয়া বেকহামের মতো বিশ্বখ্যাত ডিজাইনার ব্র্যান্ডগুলোর হাত ধরে। স্ট্রিট ওয়্যারের ক্ষেত্রে লক্ষ্যযোগ্য ছিল ওভারসাইজড শার্ট, ফেডেড ডেনিম জিনস, স্টেটমেন্ট লোগো ডিজাইন ইত্যাদি।

এ ছাড়া এখনকার ব্যাপক প্রচলিত দুটি শব্দ ‘স্পোর্টস ওয়্যার’ ও ‘অ্যাথলেইজার’-এর প্রভাব দেখা যায় বছরজুড়ে, যা শুরু হয় স্প্রিং-সামার কালেকশনের মধ্য দিয়েই। বিখ্যাত স্পোর্টস ওয়্যার ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গে ডিজাইনার ব্র্যান্ডগুলোর কোলাবোরেশনের মাধ্যমে উঠে আসে কটন ট্রাউজার, উইন্ডব্রেকার, স্লিপ ড্রেসের মতো ব্যতিক্রমধর্মী সব পোশাক। এ ছাড়া সামার কালেকশনে আরও আলোচনায় ছিল গ্লসি এবং স্মোকি পার্টি আউটফিট, ট্রান্সপারেন্ট ড্রেস, ওভারসাইজড হ্যান্ডব্যাগ ইত্যাদি।
বছরের মাঝামাঝি অনুষ্ঠিত হয় অটাম-উইন্টার বা ফল ফ্যাশন উইক। শীতকালীন আবহাওয়া সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আয়োজিত এই ফ্যাশন উইকের এবারের আসর ছিল চমকপ্রদ। পুরোনো রীতি অনুযায়ী প্রথম অনুষ্ঠিত নিউইয়র্ক ফ্যাশন উইকে নিজের ভিন্নধর্মী চিন্তার মাধ্যমে সবার নজর কেড়েছেন গুচির ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর আলেক্সান্ডার ওয়াং। এ আসরে তিনি হাজির হন করপোরেট অ্যাটায়ার নিয়ে। যা তার বরাবরের গ্ল্যামারাস আউটফিট কালেকশন থেকে পুরোপুরি ভিন্ন। আরও আলোচিত ছিল প্লাস সাইজ মডেলদের আবির্ভাব ও আশির দশকের ফ্যাশনের নতুন সংস্করণ। অন্যদিকে লন্ডনের ফল ফ্যাশন উইকে উল্লেখযোগ্য ছিল বারবেরির রেইনবো পাফার জ্যাকেট, যা সমকামীদের প্রতি সমর্থনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং বেশ প্রশংসিতও হয়েছে। আর ছিল সিকুইন, সাইকেডেলিক ডিজাইন ইত্যাদি। মিলানে নজর কেড়েছে আলবার্তা ফেরেটির ফ্লোরাল আউটফিট, হাই ওয়েস্টেড ট্রাউজার, কাউবয় হ্যাট, দোনাতেল্লা ভারসাচির ডিজাইন করা ক্রিস্টাল বিডেড ফ্রিঞ্জ ড্রেস, পার্টি ড্রেস ইত্যাদি। ফ্যাশন উইকের ফল আসরের পর বছর শেষে শীতের আগমনী বার্তায় নতুন করে চল দেখা যায় ওভারসাইজড স্টেটমেন্ট জ্যাকেট, ভেলভেট ব্লেজার, হাই ওয়েস্টেড ডেনিম ও ড্যাড স্নিকারের।
গত মৌসুমে বিশ্বের বড় বড় ফ্যাশন ক্যাপিটালের সঙ্গে পাল্লা দিয়েছে এশিয়া মহাদেশের দুটি দেশ ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া। নতুন ধাঁচ, বাহারি রং, নতুন বিভিন্ন স্টাইল ও ফিউশন ড্রেস, তারুণ্যের বৈচিত্র্য, ভবিষ্যৎ পোশাক- এসব মিলিয়ে ইন্ডিয়া ফ্যাশন উইক স্প্রিং-সামার ২০১৯ ও সিউল ফ্যাশন উইক স্প্রিং-সামার ২০১৯ ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
দিল্লির জওহরলাল নেহরু স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়া ফ্যাশন উইকের মূল উদ্দেশ্য ছিল ফ্যাশনের মাধ্যমটির সাহায্য নিয়ে আন্তর্জাতিক দেশগুলোর মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলা। আয়োজনজুড়ে ছিল ভারতীয় সভ্যতার বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী পোশাক, অ্যাবস্ট্রাক্ট প্যাটার্ন ও মেটালিক কালারের আভিজাত্য। মেয়েদের পোশাকে যেমন ছিল মেটালিক কালারের ম্যাক্সি, পাগড়ি, স্কার্ট, মিনি ড্রেস, তেমনি ছিল ব্লু গাউন, প্রিন্ট ড্রেস, শার্ট ইত্যাদিও। জাঁকজমকপূর্ণ এ আসরে অধিকাংশ ডিজাইনারের শো স্টপার হিসেবে দেখা যায় বলিউড ডিভাদেরকে। তবে সবার আকর্ষণের মূলে ছিল সুস্মিতা সেনের লিমনসেলো ডিজাইনার জুটি ‘ভূমিকা অ্যান্ড জ্যোতি’ এর ডিজাইন করেন ডায়ানা পেন্টির ভিধি ওয়াদওয়ানি এন্সেম্বেল ইত্যাদি। আসরের শেষ দিনের অনুষ্ঠানে অভিনেত্রী টাবুকে দেখা যায় সঞ্জুক্তা দত্তের ডিজাইন করা মেখলা চাদরে। আর প্রাচী দেশাই উপস্থিত হন ডিজাইনার আর্চিতা নারায়ানম-এর নতুন কালেকশন থালাসাতে। তবে গত আসরের এই ফ্যাশন উইকে মেনস ওয়্যারের চমক ও নতুনত্ব ওমেনস কালেকশনকেও সম্ভবত হার মানিয়ে গেছে। স্ট্রিট স্টাইল এবং ফ্লোরাল ও নান্দনিক ঢঙের পোশাকের মধ্যে এস্কিউ লংলাইন কুর্তার সঙ্গে ঢিলেঢালা প্যান্ট ও স্টেটমেন্ট স্নিকার, ভিন্ন ধাঁচের পরিবর্তিত গোলাপি স্ট্রাইপড প্যান্টের সঙ্গে সাদা শার্ট ও সাদা স্নিকার, রঙিন প্যাটার্ন শার্ট ইত্যাদি ছিল আসরের আকর্ষণ।
স্ট্রিট স্টাইল এবং মেনজ ওয়্যারের মূল থিম ছিল সিউল ফ্যাশন উইকেও। বৈশ্বিক সম্প্রীতি ও নির্মল পরিবেশের বার্তা নিয়ে হাজির হওয়া গত বছরের এই ফ্যাশন উৎসবে ছিল এক্সপেরিমেন্টাল আউটফিট ও বোল্ড ফ্যাক্টরের বহর। এসবের মধ্যে ডিজাইনার উ ইয়ং মির বম্বার জ্যাকেট, চেক ব্লেজার, ইউটিলিটি ভেস্ট, ডিজাইনার আর শেমিস্তের টারটেল নেক পিস স্টেটমেন্ট টি-শার্ট, ডজো ইন্টারন্যাশনাল এ ইউনিসেক্স আউটফিট ব্যাপক আলোচনায় ছিল। মূলত তরুণ ডিজাইনারদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এই আসর তাদের নতুন আইডিয়া পরিবেশনের মাধ্যমে সিউলের ফ্যাশন জগৎকে বিশ্বদরবারে প্রশংসনীয় করে তুলেছে।
২০১৮-এর ফ্যাশন ট্রেন্ডের সঙ্গে ওতপ্রোত ছিল ওয়েডিং অ্যাটায়ার। ডাচেস অব সাসেক্স মেগান মার্কেলের জন্য ডিজাইনার স্টেলা ম্যাককার্টনির ডিজাইন করা অপটিক হোয়াইট হল্টার নেক গাউন, দীপিকা পাড়ুকোন ও রণবীর সিংয়ের বিয়ের উৎসবে সব্যসাচী মুখার্জির ডিজাইন করা চোখধাঁধানো আউটফিট, প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার রালফ লরেন গাউন ও ফালগুনী শেন পিককের ডিজাইন করা সিলভার ব্লাশ বিড লেহেঙ্গা- এ সবকিছুই ছিল ফ্যাশন বিশ্বে আলোচনার শীর্ষে। যা বছরের বিভিন্ন সময়ে ফ্যাশন জগৎকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।
ফ্যাশন ও ট্রেন্ডের সঙ্গে আরেকটি ব্যাপার অনেকাংশে জড়িত। তা হলো সেলিব্রিটি স্টাইলিং। সেলিব্রিটিদের কিছু স্টাইল ও ফ্যাশন সেন্স প্রতিবছরই ‘ট্রেন্ডসেটার’ হয়ে দাঁড়ায়। গত বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। স্টাইল সেন্স, ব্র্যান্ড এনডোর্সমেন্ট, ইনস্টাগ্রাম ফলোয়ার এসব পরিমাপকের ভিত্তিতে গেল বছরের আলোচিত ফ্যাশন ইনফ্লুয়েন্সারের তালিকায় প্রথম স্থান দখল করেন কার্শিয়ান পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আমেরিকান সেলিব্রিটি মডেল ও ফ্যাশন আইকন কাইলি জেনার। অ্যাডিডাস ট্র্যাক স্যুট, ডিওর সানগ্লাস, ভিক্টোরিয়াস সিক্রেটের আন্ডার গার্মেন্টস, অ্যালেক্সান্ডার ওয়াংয়ের মিনি ড্রেস এবং নিজের জন্মদিনে পরা পিঙ্ক ড্রেস- এ সবকিছু মিলিয়ে গেল বছর আলোচনার শীর্ষে ছিলেন এই মডেল। তালিকায় যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে ছিলেন কার্দাশিয়ান পরিবারের আরেক সদস্য কিম কার্দাশিয়ান এবং ডাচেস অব সাসেক্স মেগান মার্কেল।
সব ট্রেন্ড, কালেকশন ও ডিজাইনের ভিড়েও ২০১৮-এর ফ্যাশন জগতের সবচেয়ে মুখ্য বিষয় ছিল ফ্যাশন ও নৈতিকতার বন্ধুত্ব। ২০১৮-এর বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনুষ্ঠিত ফ্যাশন উইক ও র‌্যাম্প শোগুলোতে জাতি, বর্ণ, গড়ননির্বিশেষে বৈচিত্র্য ছিল সর্বকালের সবচেয়ে বেশি। শ্যামলা ও কালো বর্ণ এবং ট্রান্সজেন্ডার ও প্লাস সাইজ মডেলদের রানওয়েতে উপস্থিতি ছিল ব্যাপক। যা ২০১৫-এর প্রায় ২৫ গুণের কাছাকাছি। যদিও ফ্যাশনবোদ্ধাদের মতে এই পরিবর্তন প্রশংসনীয় হলেও শুধু যারা র‌্যাম্পে উপস্থিত হচ্ছেন তাদের বৈচিত্র্যায়ণ নয়। প্রয়োজন দর্শকের মানসিক পরিবর্তন।
নৈতিকতার ছাপ ছিল বিশ্বখ্যাত ফ্যাশন ও বিউটি ব্র্যান্ডগুলোর প্রডাক্টেও। বিশ্বব্যাপী ডিজাইনার ব্র্যান্ডগুলো গ্রাহকের কাছে নিজেদের পণ্যগুলোকে আরও স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে বর্জন করেছেন বিলুপ্ত পশুর চামড়া, কেমিক্যাল, প্লাস্টিক ইত্যাদির ব্যবহার। ক্রুয়েলটি ফ্রি এথিক্যাল প্রডাক্টের এই তালিকায় সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে প্রিমার্ক, মার্ক অ্যান্ড স্পেন্সার, ডাভ ও গুচির মতো বিখ্যাত কোম্পানি।
সব সমীকরণ, নতুন ভাবনা, ডিজাইনারদের স্বতন্ত্র চিন্তাধারা ইত্যাদি মিলিয়ে এই ছিল ২০১৮-এর ফ্যাশন বিশ্ব।

 সাকিব শাহমাত
ছবি: ইন্টারনেট

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

Back To Top